বুক রিভিউ: দ্যা নর্থ এন্ড

ভার্সিটিতে পড়ার সময় রিফাত ভাইয়ের (কবি রিফাত চৌধুরী) লগে কয়েকদিন নীলক্ষেতের বাবুপাড়া বস্তিতে উনার ঘরে আড্ডা হওয়ার পরে, উনি আরেকজনের সাহিত্যিক’রে আমার পরিচয় দিলেন, ও হচ্ছে ইমরুল, অনেক বিদেশি সাহিত্য পড়েছে, অনেক ক্ল্যাসিক পড়া ছেলে… (রিফাত ভাই খুব শুদ্ধ-ভাষায় কথা বলতেন) আমি মোটামুটি পাজলড উনি কি আমার প্রশংসা করলেন নাকি বাঁশ দিলেন? (কারণ তখন আমি ইংলিশই পড়তে পারি না ঠিকমতো, বিদেশি লেখকের নাম-টাম বলতে পারি, এইরকম… ) এই অভ্যাস উনার ছিল, বলতেন যে, রাস্তায় কম-পরিচিত কেউ জিগাইলে বলবো যে, বেকারিতেই আছি! মানে লোকটা তো জানে না, ভাববে, কোন বেকারিতে কাজ করতাম, সেইটাই করতেছি, বেকার হয়তো ভাববে না, কি বলেন! বইলা নিজেই হাসতেন, শব্দের (নাকি নিজের) ডুয়ালিটি নিয়া…

তো, বর্ণালী সাহার বই নিয়া লিখতে গিয়া এই ‘ধান ভানতে শীবের গীতের’ কথা মনে হইলো, কারণ আমি খেয়াল কইরা দেখছি, এখনকার বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাস আমি খুব কমই পড়ছি, আর খুব ইনটেনশনালিই; মেবি দুইটা কারণে। এক হইলো, যে কোন কিছু পড়লেই তো আমার হাত চুলকায়, জিব নড়তে থাকে কিছু কওয়ার লাইগা, আর বলাটা যতোই ট্রাই করি ‘হয়তো’ ‘মনেহয়’ দিয়া কইতে, খুব রুড জিনিসই হয়। মানে, ব্যাপারটা এইরকম না যে, আমি খুব ‘সত্যি’ কথা বলি, বরং আমি খুব গোড়া থিকা বাতিল কইরা দেয়ার জায়গা থিকা মেবি বলি 🙁 যার ফলে, একটা মিস-কমিউনিকেশন তৈরি হইতে পারে বেশিরভাগ সময়, অনেকে পড়ার পরে বলবেন, বইটা তো এইরকম না! উনি বই পইড়া এইরকম কথা কইলেন কেনো!… আরেকটা হইলো, অবভিয়াসলি, কি দরকার পড়ার! খুববেশি ইম্পর্টেন্ট হইলে তো পড়া-ই লাগবে কোন না কোন সময়…

এখনকার বাংলাদেশি গল্প-উপন্যাসের কথা আসতেছে কারণ উনার বইটা বাংলা-ভাষায় লেখা একটা সাহিত্যের বই, ফলে একটা এবসুলেট সাহিত্য-ধারণা থিকা দেখার বাইরেও একটা কম্পারেটিভ অবস্থার বেসিস দেখার একটা ঘটনা তো থাকা দরকার। তো, সেইটা এক রকমের এবসেন্টই থাকবে আসলে।…
দ্যা নর্থ এন্ড পড়তে গিয়া ওরহান পামুকের একটা কথা মনে হইতেছিল, কোন একটা লেখা বা ইন্টারভিউতে উনি বলতেছিলেন, একটা গ্লোবাল এফ্লুয়েন্ট মিডল-ক্লাস এমার্জ করতেছে সারা দুনিয়াতে, চীন, হংকং, ইন্ডিয়া, ব্রাজিল, তুরস্ক, ঘানা, সাউথ-আফ্রিকা সব জায়গার মিডল-ক্লাসের কিছু মিলের জায়গা বা কমন গ্লোবাল কালচার তৈরি হয়া উঠতেছে। আমার ধারণা, এই নভেলটা অই ক্লাসের মেজাজটারে আপহোল্ড করে। বাংলা-ভাষায় লেখা একটা ইন্টারন্যাশনাল নভেল হওয়ার মেজাজ নিয়া আছে।

এইটা মনে হওয়ার তো কিছু কারণ অবশ্যই আছে। ‘জোকার’ সিনেমা যেমন একটা রেফারেন্স। ডেনমার্কের কোন শহর, লন্ডন, ঢাকা, নিউ জার্সি’তে থাইকাও একলগে সবাই ‘জোকার’ সিনেমাটা দেখতেছে, আলাপ করতে পারতেছে, আর এইটা খুব দূরে দূরে ঘটতেছে – তা না, একই সাথে, একই দুনিয়ার ঘটনা এইগুলা, কানেক্টেডও, এই নভেলে।…

তাহমিমা আনামদের ইংলিশ নভেল যেইখানে ‘বাংলাদেশি উপন্যাস’ হইতে চায়, সেইটার রিভার্স একটা ঘটনার মতন। ‘বাংলাদেশি ইংলিশ নভেলে’ যেইখানে ‘প্রকৃত বাংলাদেশ’রে তুইলা ধইরার একটা ইনটেনশন কাজ করে বা ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেট’রে ইংরেজি ভাষায় হাজির রাখতে চায় (এইটার শুরু কি অমিতাভ ঘোষরে দিয়া নাকি?), সেইটার পারসপেক্টিভে এই বইটা বরং বাংলাদেশি একটা নভেল, যেইটা গ্লোবাল মিডল-ক্লাসের ক্রাইসিসগুলারে ডিল করতেছে। মানে, এইটা চাপানো কোন জিনিস না ‘বাংলা-সাহিত্যে’, বরং নতুন একটা ঘটনা হিসাবে দেখা যাইতে পারে।… এই জিনিসটার মেবি আরেকটু খেয়াল করা যাইতে পারে মিরা নায়ারের সিনেমার পারসপেক্টিভে; উনার সিনেমাতে ইন্ডিয়ান লোকজন বিদেশে থাকেন – এইরকম না খালি, বরং অলওয়েজ একটা কালচারাল ডিস-এনগেইজমেন্টের মধ্যে থাকেন, এইরকম। মানে, বাংলাদেশের সমাজ, বাংলাদেশের সাহিত্য বইলা যে ফিক্সড/টিপিক্যাল কিছু জিনিস আছে… এর বাইরেও মানুশ-জন আছে আর কি
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’রা যখন ১৯৬০’র দশকে বিদেশি-সাহিত্য লিখতেছিলেন বাংলা-ভাষায়, তখনো উনারা বাংলা-ভাষায় এইসব জায়গারে হাইলাইট কইরা বাংলা-সাহিত্যরে ‘দুষিত’ করার কথা মনেহয় ভাবতে পারেন নাই।…

২.
দ্য নর্থ এন্ড গোছানো একটা নভেল, স্ট্রাকচারটা ভালো। মানে, কবিতা যে ছন্দ লেখা হইলে ‘ভালো কবিতা’ বা ছন্দ-ছাড়া লিখলে ‘ভালো না’ – এইরকম যেমন না; মানে ‘ছন্দ’ যেমন ‘ভালো কবিতার’ কোন ক্রাইটেরিয়া না, একইরকম ভাবে, কাহিনি খুব গোছায়া লেখা বইলা ভালো – তা না, বরং গোছানো জিনিসটা ভালো হইছে, ফ্রি-রাইটিংয়ের নামে অগোছালো বা অযত্নের লেখার চাইতে। মনে হইছে, সুর-তাল-রয় ঠিকঠাক রাখার ব্যাপারে একটা নজর আছে; বেসুরা না হওয়ার দিকে নজর আছে। ফিনিশিং’টাতে একটু তাড়াহুড়া হইছে বইলা মনে হইতে পারে এই রিদমের কারণে, কিন্তু আন-রিয়েল লাগে নাই।

কয়দিন আগে পিটার হেনকেকের দ্য গ্রেট ফল পড়লাম, শেষের দিকে আইসা অইটার কথাও মনে হইলো ফরম্যাটের কারণে, কারণ অইটাও একটা দিনেরই কাহিনি। পিটার হেনকেকের দিনটা একটা ডিস-এনগেইজমেন্টের জায়গা থিকা কানেক্ট করতে চায় আর এক্সপান্ড করতে থাকে। বর্ণালী সাহার দিনটা কোন না কোন এনগেইজমেন্টরে ধইরা রাখতে চায়, আর গোল বা সার্কুলার হয়া উঠে; কিন্তু যেহেতু বৃত্তটারে এক্সপান্ড করতে পারে না, ঘুরতে ঘুরতে এর ভিতরেই আটকা পইড়া থাকে, এক রকম। দূরত্ব জিনিসটা যত কাছের মনে হইতেছিল, ধীরে ধীরে সেইটা সরতে থাকে আরো…

৩.
টনি মরিসনের মেবি কথাটা, একজন উনারে জিগাইতেছিল, এখনকার (তা-ও তো ১০/১৫ বছর হওয়ার কথা) নভেলে কোন জিনিসটা আপনার ভাল্লাগে না? উনি বলতেছিলেন, নভেল’রে লাইফের এক্সপেরিয়েন্সের ভিতরে আটকায়া রাখা হয় – এইটা ডিমিনিং একটা ব্যাপার মনেহয় উনার কাছে; যে, কেউ নার্সের চাকরি করে, তো, নার্সের জীবন নিয়াই তারে লিখতে হবে… বা কেউ ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকলে নিউইয়র্ক নিয়া যেন লিখতে পারবে না!

সাহিত্যরে যে একটা এথনোগ্রাফিক্যাল ডকুমেন্ট হয়া উঠতে হবে – এই ডিমান্ডটা দিন দিন বাড়তেছে। সাহিত্য’রে সাহিত্য হয়া উঠতে হবে – এইরকম স্নবিশ একটা জায়গার বিপরীতে।

বাড়তেছে দুইটা কারণে। এক হইলো, আমরা সাহিত্য’রে যাচাই করি রাইটারের বা আমাদের জীবন-অভিজ্ঞতার বেসিসে; যে উনি জীবনরে, সমাজরে ‘ফুটাইয়া তুলতে পারছেন’ কিনা; যেইটার বেসিসে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটা নদীর নাম’রে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র চাইতে (উপন্যাস হিসাবে বেটার কিনা, সেইটার বাইরেও) বেটার একটা এথনোগ্রাফি হিসাবে মানতে পারি।

দুসরা জিনিস হইলো, একটা ‘জীবনের ধারণা’ বা পলিটিক্যাল/কালচারাল থিওরি’র বেসিসে সাহিত্য’রে যখন যাচাই করতে যাই তখন প.ন.মা.’রে তি.এ.ন.না.’রে বেটার বইলা ভাবতে পারি। ক্লাস-স্ট্রাগলের ধারণাটা অনেকবেশি স্পষ্ট তো এইখানে।…

তো, এই দুইটা তরিকাই ঝামেলার বইলা আমি মনে করি। একটা নভেল বেটার এথনোগ্রাফি হইতে পারলো কিনা বা কোন পলিটক্যাল-থিওরি’রে এস্টাবলিশ করতে পারলো কিনা – দুইটার কোনটাই সাহিত্য-মাপার বাটখারা হইতে পারে না। আপনারে ‘কিছু ফিল’ করাইতে পারলো কিনা, ‘কিছু ভাবাইতে’ পারলো কিনা, ‘প্লেজার’ দিতে পারলো কিনা… এইসব নন-আর্গুমেন্টেটিভ পজিশনের চাইতে।

কিন্তু রিডার’রা যেমন এইগুলা বেসিসে পড়েন, রাইটারের পক্ষেও এইরকমের ধারণাগুলারে এভয়েড করাটা টাফই হয়। বাতিল করার ভিতর দিয়া হইলেও জায়গাগুলারে ডিল করতে হয়। এইভাবে একটা সময়ের ইন্টেলেকচুয়াল চিন্তা বা সাহিত্যের ক্রিটিক, পার্ট অফ সাহিত্য হয়া উঠে। কিন্তু দিনশেষে, সাহিত্য বা নভেল যদি একটা স্নবারির এগেনেস্ট একটা টুল-ই হয়া উঠে সামাজিকতার – সেইটাও মাইনা নেয়ার মতো কিছু না। এই জায়গা নিয়া বর্ণালী সাহা কনশাস আছেন – এইটা মনে হইছে। কনশাসনেসটারে ভালোভাবেই ডিল করছেন উনি।

ও, আর কোন সন্দেহ ছাড়াই ভাষা উনার স্ট্রং পার্ট; কিন্তু মনে রাখা ভালো যে ক্রিকেটে (রাহাতের বিশ্বাসঘাতকতার মতো 🙂 ) একজন ব্যাটসম্যানের যে স্ট্রেংথ, মানে, যেইখান দিয়া চার-ছক্কা মারে, আউট হওয়ার চান্সও অইখানেই বেশি থাকে।

 

Leave a Reply