ব্লগ ও সাহিত্য: ক্ষুদ্রত্বের আকাংখা এবং আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা

কমিউনিটি ব্লগে ত লিখছি কিছুদিন; সম্ভবত ২০০৬/৭ থিকা ২০১০ এর মাঝামাঝি সময়টাতে; সচলায়তন-এ নিয়মিতই, প্রায় ৮/১০মাস; আমার ব্লগ-এ ২/৩মাস, আর এর ফাঁকে সামহোয়ারইন ব্লগ-এ কিছুদিন ছাড়াছাড়া-ভাবে; এরমধ্যে গুগল-এও একটা নিজের ব্লগ অ্যাকাউন্ট করছিলাম, একধরণের আর্কাইভিং এর জন্য। কোনকিছুই কনটিনিউ করা হয় নাই, শেষপর্যন্ত।

কেন যে হয় নাই, এই বিষয়টা নিয়া মোটামুটি একটা ধারণা আমার হইছে।

একটা কারণ যে আমি ‘সাহিত্য’ লিখতে চাই, ‘ব্লগ’ লিখতে চাই না। সাহিত্য এবং অন্যান্য লিখিত ফর্ম (সংবাদ প্রতিবেদন, এনজিও গবেষণা-পত্র…) এর মধ্যে নানান পার্থক্য আছে, প্রধান পার্থক্যটা মনেহয় উদ্দেশ্যের দিক থিকা। উদ্দেশ্য বলতে খুব ডেফিনিট কিছু না যে, আপনি আসলে কি করতে চাইতেছেন, কেন, কার জন্য ইত্যাদি… এইসব প্রশ্নের সমাধান কইরা ত আর লেখালেখি হয় না, কিন্তু একটা ধারণা আসলে থাকেই বা লিখতে লিখতেই তৈরি হইতে থাকে। ‘কেন’ জিনিসটা রিফ্লেক্টেট হয় মোস্টলি ‘কিভাবে’-এর ভিতর দিয়াই; আলাদা কইরা ‘কেন’ মনেহয় হয় না।

বর্তমান বাংলা ব্লগ-এর কম্যুনিটিগুলা সাহিত্য-চর্চার জন্য প্রাথমিকভাবে নেগেটিভ একটা জায়গা বইলাই মনে হইছে; কারণ এইসব ব্লগ-এর মূল উদ্দেশ্য সাহিত্য করা না, বরং একটা কম্যুনিটি তৈরি করা আর কম্যুনিটি দিয়া সাহিত্য হয় না। সাহিত্য-রচনার প্রেক্ষাপটটা খুবই ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার।

তাই কেউ যদি সাহিত্য-চর্চার মূল জায়গা হিসাবে ব্লগরে বাইছা নেন সেইটা ব্লগ-এর জন্য যেমন বাজে, সাহিত্য’র জন্য ত আরো বেশি, কারণ সেইখানে সাহিত্য-চর্চার ভিতর দিয়া আমি একটা সরব পাঠক-গোষ্ঠীরে বাইছা নেই; যেহেতু তারা সরব থাকেন, তারা তাদের এই পর্যন্ত পড়াশোনার ভিতর দিয়া গইড়া উঠা রুচি চাপাইতে থাকেন লেখক এর উপর; যারা সাহিত্য বিষয়ে নিজের কিছু জায়গা তৈরি করতে পারছেন, এইটা তাদের জন্য কোন সমস্যা না, কিন্তু নতুন লেখকরে যখন পাঠকের এই চাপটারে নিতে হয়, তখন সেইটা তার লেখারে অনেকবেশি বিপদে ফেলতে পারে। বেশ কয়েকজন ব্লগারের ক্ষেত্রে এইটা দেখছি। যা-ই হোক, এইটা হয়তো লেখক হিসাবেই উনাদের পছন্দ যে উনারা ব্লগার-ই হইতে চান, একটা কম্যুনিটিরে রিপ্রেজেন্ট করতে চান।

ব্লগ-এ সাহিত্য ছাপানো যাইতেই পারে, কিন্তু ব্লগ-সাহিত্য বইলা আলাদা কোনকিছু দাঁড়াইছে বইলা মনে হয় নাই, বাইরের দিক দিয়া যা আছে, সেইটা একটা ক্ষুদ্রত্বের আকাংখা; মানে অনেককিছুর ভিতর আমি সাহিত্যও করতে চাই; লেখক এমনিতেই একটা মাইনর কারেক্টার সমাজের ভিতর, কিন্তু এই লেখক-চরিত্রেরও বিবর্তন দরকার, তাই তারে বর্তমান সমাজের ভিতর অ্যাকোমোডেড করার জন্য হয়তো আরো ক্ষুদ্র কোন সংস্করণের দরকার হইতে পারে, যেমন, ব্লগার-লেখক।

আবার ডাইরি লেখার বিকল্প আসলে ব্লগ হইতে পারে নাই। কারণ অনেক ব্যাপারেই এইটারে আমি পারসোনাল রাখতে চাই, সবকিছু এখনই পাবলিকলি বলতে চাই না হয়তো; ঈর্ষা, লোভ, হতাশা – সবকিছুই ত আর বর্তমানের ভিতর বলাও যায় না, অনেকসময়।

যেইটা করা যায়, কিছু ব্যক্তিগত ঘটনা হয়তো লেখা যাইতো, লিখছিও এইরকম কিছু; কিন্তু এরও একটা প্যার্টান দাঁড়ায়া যায়, যেইটা হয়তো একভাবে সাহিত্য হয়া উঠতে পারে, কিন্তু এই চেষ্টাটা অনেকভাবেই ব্যাপারটারে আরো বেশি সংকুচিত করার সম্ভাবনা রাখে।

তাই ব্লগে লেখা আর হয় না, শেষ পর্যন্ত ব্লগে সাহিত্যের সিগনিফিকেন্স বইলা যা আছে সেইটা আরেকটা ছাপানোর একটা জায়গাই, দৈনিক পত্রিকার মতোই; পার্থক্য যেইটা, সংবাদপত্র যেইখানে অনেকটাই মূক ও বধির, তার তুলনায় এইখানে কথা বললে মাঝে মাঝে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। সব লেখাই ত প্রকাশ-বিহ্বল, কিন্তু প্রকাশ-প্রচার এমনই একটা বাধা, যেইটা লেখক হিসাবে আর উতরানোই যায় না, কারণ হয়তো যে, লেখক তার লেখার আধ্যাত্মিক-মূল্য নিয়াই বেশি চিন্তিত, বাণিজ্যিকতা নিয়া লেখক হিসাবে তার করার তেমন কিছু্ই নাই, এইরকম একটা জায়গাতেই থাকেন। এইটাও খুববেশি সুবিধার অবস্থান না আসলে।

আর এইসব কিছু কইরা কি হবে, লেখা ত হোক আগে, তাইলে সব-ই হবে!

…………………………………………………………..

কমেন্টস 

Local Talk, আপনি বিষয়গুলা বলাতে আরেকটু স্পষ্ট করার সুযোগ পাইলাম; আপনার পয়েণ্টগুলা ধইরাই বলি:

১. যে কোন জায়গারেই মোল্ড করা সম্ভব, ‘মূল’ ব্যাপারটা ত স্থির কোনকিছু না… আর অন্যদিক দিয়া দেখতে গেলে, সাহিত্য’র মূল জায়গাটা আসলে কই? দৈনিকের চিপায়, লিটল-ম্যাগ-এর বারান্দায়? সাহিত্যের নিজেরই ত কোন ঘর-বাড়ি নাই! তাই হয়তো সাহিত্য যে কোন জায়গাতেই করা যায়! ব্লগ-এ সাহিত্য-প্রচার নেগেটিভ বইলা মনে করি না, বরং সাহিত্য-চর্চার জায়গা এইটা না, আমার উপলদ্ধিটা এইরকমের; কারণ যে ধরণের চেষ্টা দেখছি ব্লগ-এ, তার ‘মূল’ লক্ষ্য একটা কম্যুনিটি তৈরি করা আর সেইখানে সাহিত্যচর্চার ব্যাপারটা খুব বেশি দূর আগাইতে পারে না, এই কম্যুনিটি সেন্স-এর কারণেই…

২. এইখানে আপনি মনে হয় ‘৬০এর দশকের লেখকদের কথা বলতেছেন! সাহিত্যের একটা যোগাযোগ-আকাংখা আছে, পাঠকের সাথে ইন্টার-অ্যাকশন থাকাটা যে কোন লেখকের জন্যই জরুরি এবং বিভিন্নভাবেই লেখকরা এইটা করেন বইলা আমার ধারণা… আমি যেইসব উদাহারণ দেখছি তাতে মনে হইছে, এতগুলি ‘ভুল-বোঝা’রে এন্টারটেইন করার দরকার লেখক-এর নাই… তবে ‘অস্বস্ত্বি’র চাইতে ‘অভ্যাস’ এর ব্যাপারটা হয়তো ভালোই আছে ‘ষাট-এর দশকের লেখকদের’; উদাহারণ হিসাবে বিডিনিউজ-এর ‘অপিনিয়ন’ এর পাতার কথা মনে আসছে, এইরকম ‘লেখক এর মৃত্যু’ রলাঁ বার্থও মনে হয় কল্পনা করতে পারেন নাই!

৩. সাহিত্যের একটা কাজ হইলো নতুন চিন্তারে সমাজের ভিতর নিয়া আসা, তাই সমাজের বিদ্যমান কম্যুনিটিগুলাতে সাহিত্য যে বেশিরভাগ সময়ই প্রান্তিক একটা ব্যাপার হয়া থাকবো, এই প্রস্তুতি মনে হয় লেখকের থাকে; তবে আমার ধারণা ব্লগে সেই ধরণের সাহিত্যচর্চাই অব্যাহত থাকবো যা কম্যুনিটির রুচিরে সার্ভ করতে পারবো এবং হয়তো সেই ধরণের সাহিত্যের প্রতি আপনারও অনুগ্রহ থাকবো, কিন্তু সেইটা কিরকমের সাহিত্য, সেই সন্দেহটা আমার থাকলো…

…………

লেখক ত আসলে ডিসকানেক্টেড একটা সেল্ফ, লেখালেখির মাধ্যমে মাঝে মধ্যে সবার সাথে কানেক্ট করার চেষ্টা করেন… এইটা সইরা গেলেই মনে হয় ব্লগের লেখা আসে 🙂

 

Leave a Reply