ভাষা’র জেলখানা

।। কারাগারের রোজনামচা ।। শেখ মুজিবর রহমান ।। বাংলা একাডেমি ।। মার্চ, ২০১৭ ।।

বইটা কিনার পরে পড়া হয় নাই। এরপরে কয়েক পেইজ পড়ছিলাম। পড়ার ইচ্ছা হয় নাই আর। কিন্তু কয়েকটা পেইজ পড়ার সময় কিছু জিনিস চোখে পড়ছিলো, দাগ দিয়া রাখছিলাম। তো, আরেকবার পড়া শুরু করার আগে ভাবলাম জিনিসগুলি বইলা রাখি।

—————–

“জেলখানায় পাগলা গারদ আছে তার কাছেরই সেলে তাঁকে বন্দি রাখা হয়েছিল।” (শেখ হাসিনা, পেইজ – ১৪)

পাগলদেরকে যে পছন্দ করতেন উনার বাপ সেইটা নিয়াই ভূমিকাতে বলতেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এইটার পলিটিক্যাল জায়গাটা নিয়া কনশাস হন নাই যে, কেন তারে পাগলদের কাছের সেলে রাখা হইলো? এইটা একটা থ্রেট তো অবশ্যই। ফুকো’র কারণে সোসাইটির পাওয়ার স্ট্রাকচারের লেবেলিংয়ের মধ্যে ক্রিমিনাল আর পাগল’রা যে কাছাকাছি রকমের জিনিস – এইটা তো আমরা জানি-ই এখন। তখনো, থিওরি জানার আগেই, এইটা প্রাকটিসের ভিতর আছিলো। যে, পাগল বানায়া জেলখানায় রাইখা দিতে পারে উনারে। বা পাগলদের সাথে রাখতে রাখতে পাগল বানায়া দেয়া যাইতে পারে। এইরকম কাছাকাছি রকমের পসিবিলিটিগুলিরে পলিটিক্যালি যে ট্রাই করা হয় নাই – তা তো না! one bird flew over the cuckoo’s nest সিনেমাটা তো আছেই। মানে, ক্রিমিনালিটি আর পাগলামি – খুবই কাছাকাছি রকমের জিনিস। এইটারে পলিটক্যালি মার্ক না করলে মুশকিল।… তো, এর বাইরে জেলখানায় গিয়া পাগল হইছেন তো অনেকে। আবার অনেকে ‘পাগল’ হওয়ার কারণে জেলখানা থিকা ছাড়াও পাইছেন। লুইস আলথুসারেরই এইরকম হইছে।

“সাবজেল দুইতিন মাসের সাজাপ্রাপ্ত লোক ছাড়া রাখে না। ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় তিন বছরের উপর জেল হলে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাইয়া দেয়।” (পেইজ ২৭)

খুবই নিরীহ বাক্য। কিন্তু ‘পাঠিয়ে’ আর ‘পাঠাইয়া’ শব্দ দুইটা খেয়াল করেন, আরেকবার পইড়া। এডিটরদের ‘ভুল’ এইরকম মনেহয় না আমার। মানে, হইলে হইতেই পারে, কিন্তু যদি দুইবার ‘পাঠিয়ে’ বা দুইবারই ‘পাঠাইয়া’ হইতো তাইলে কথাটা হইতো না ওইরকম। এইরকম ‘ভুল’ যে কতো দরকারি জিনিস! এইরকম ভালো একটা ‘প্রমাণ’ পাইয়া ভাল্লাগছে অনেক। মানে, আপনি ‘পাঠিয়ে’ লিখলে সারাজীবন একই কাজ কইরা যাইতে হবে – এইটা খুবই ভুল জিনিস আসলে।

“এক সেলে কোনোদিন দুইজনকে রাখা হয় না। কারণ, দুইজন থাকলে ব্যভিচার করতে পারে, আর করেও থাকে।” (পেইজ – ২৮)

৩০/৪০ জনরে রাখা হবে, ৪/৫ জনরে বা ১ জনরে; কিন্তু ২ জনরে কখনোই না। তুমি আর আমি – খুবই ডেঞ্জারাস একটা ইউনিটি। দুইটা মানুষ কেন থাকবে একসাথে, সোশ্যালিও! একটা ফ্রেন্ড সার্কেল থাকতে পারে, একটা ফ্যামিলি। কিন্তু দুইটা মানুষ একলগে থাকলে আকাম-কুকাম করতে পারে, করতেছে, না করলেও ভাবতেছে, ভাবাটাও তো করা-ই একরকমের। ‘ব্যভিচার’ হইতেছে কি হইতেছে না – এইটা মোটেই আমার কনসার্ন না, কনসার্নটা হইতেছে ইউনিট হিসাবে, প্যাটার্ন হিসাবে কোনটা বেশি কন্ট্রোলের বাইরে, পাওয়ারের। ইভেন ইন জেলখানা, দুইজন মানুষের একসাথে থাকাটা ঝামেলার।

“জেলে কতগুলি কথা ব্যবহার হয় যা বাইরের লোক সহজে বুঝতে পারবে না। আমি যখন প্রথম জেলে আসি তার পরদিন সকালে একজন কয়েদি ‘পাহারা’ এসে আমার ও আমার সাথী কয়েকজনকে বলল আপনাদেরকে ‘কেসটাকেোলে’ যেতে হবে। আমরা তো ভেবেই অস্থির। বাবা ‘কেসটাকোল’ কি জিনিস?… কেস টেবিল থেকে ‘কেসটাকোল’ নতুন একটা ইংরেজি শব্দ কয়েদিরা জন্ম দিয়েছে। এররকম অনেক শব্দ ও নাম জেলখানায় আছে।” (পেইজ ৩০ – ৩১)

এইটা আরেকটা ফেভারিট জায়গা আমার। একটা শব্দ একটা ল্যাঙ্গুয়েজ থিকা আরেকটা ল্যাঙ্গুয়েজে কেমনে ট্রাভেল করে… চিন্তার একটা ব্যাপার তো আছেই, ভোকাবুলারি বা রিদমের আর সাইন বা হরফেরও। যেইরকম ম্যাক্সমূলার হইছিলেন মোক্ষমূলার, আলকেমি হইছে কেমেস্ট্রি। এইরকম ট্রাভেলিংগুলিরে লোকেট করতে পারা যায় শব্দের ভিতর দিয়া। এক একটা জায়গায় গিয়া, ভাষাতে গিয়া একটু অন্যরকম হইতেছে। কোন না কোনভাবে কোন না কোনকিছু থাইকাই যাইতেছে হয়তো। যেই দুনিয়াতে আমরা থাকি, সেইটা এইরকম ভাষার জেলখানাই মনেহয়।

Leave a Reply