ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা: সেলিব্রেটিং অ্যা ‘ট্রু’ পোয়েটস লাইফ

 

তুমি আমার ঘুম, ভাস্কর চক্রবর্তী, প্রতিভাস, ১৯৯৮। পৃষ্টা: ৬৪।

ভাস্কর চক্রবর্তী’র এই কবিতার বইটা আমি তখন পড়ি নাই; শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণাটা যখন পড়ছিলাম। অবশ্য তখনই পড়া যাইতো, কিন্তু উনার একটা বই পইড়াই সন্তুষ্ট ছিলাম যে, উনার কবিতা পড়া হইছে।

আমাদের সময়ে কবিতা লিখেন বইলা যাঁদের সাথে পরিচয় আছে, উনারা সবাই দেখি ভাস্কর চক্রবর্তীরে চিনেন। শীতকাল আসার আগে আগে উনার কবিতার বইটার নাম নেন, আমিও কইছিলাম একবার হেমন্তের বাতাসে শীতের গন্ধ পাইয়া যে, শীতকাল চইলা আসলো,সূপর্ণা! কিন্তু অ্যাজ সাচ উনার কবিতা নিয়া তেমন কিছু শুনি নাই, বাংলাদেশে।

বা হয়তো বলছেন লোকে; বলাবলি’র ভিতরই যে সবসময় সবকিছু থাকবো, তাও ত না। কতকছিুই ত পইড়া আছে। আমিও বলি না। কিন্তু এই বইটা পড়ার পরে ভাবলাম যে, কিছু বলা যায়; যা কিছু আমরা পড়ি, তা নিয়া কিছু ত বলার থাকে। হয়তো মাঝে-মধ্যে বলি; মাঝে-মধ্যে বলি না। এইক্ষেত্রে, বলা আর না-বলা খুব কাছাকাছি কিছু জিনিসই শেষ পর্যন্ত – এইরকম একটা স্বস্তিও থাকে আর কি!

এমনিতে, উনার সর্ম্পকে ট্যাগ লাইন ছিল আমার ‘মধ্যবিত্তের কবি’ ( শক্তি চট্টোপধ্যায় একটা এস্কেপ পয়েণ্ট পাইয়া গেলেন)। উনি মধ্যবিত্ত লাইফটারে খুব এনজয় করছেন উনার কবিতায় – এইরকম ভাসা ভাসা কিছু ব্যাপার ছিল মনে হয়। যা-ই হোক, সেইটারে খুব একটা আর মনে রাখি নাই। উনার কবিতা পড়তে ত ভালোই লাগে এবং আসলে শব্দের কিছু সূত্র ধরতে পারলে আমার ধারণা অন্য অনেকের কবিতাই পড়তে খারাপ লাগার কথা না। কিন্তু একটা সময় পরে, কবিতার শ্রুতিমধুরতাও ক্লান্তিকর হয়া উঠতে পারে, ১০ বার, ২০ বার বা ৫০ বার পড়ার পরে। রিপিটেটলি, এইটা যদি তার মিনিংরে রিডিফাইন না করতে পারে। এইটা ভাবতে গিয়াই সম্ভবত মনে হইলো যে, উনার কবিতা আসলে একটা কোর জায়গারে ডিফাইন করে, বারাবার। অন্য প্রায় সবার কবিতাই তো!

ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায় আমি আছে খুব। এই আমি হইতেছেন কবি। কলকাতার বরানগরে থাকেন। সিগারেট খান। এইরকম।

এখন এই যে কবি-চরিত্র তিনি খুব একটা ঘুরতে-টুরতে যান না (এমনিতেও এইটা রিসেন্ট ফেনোমেনা)। একটা ৮/১০ কিলোমিটারের ভিতরই লাইফ নিয়া আছেন। খালি যে আছেন, তা না; এই থাকাটারে তিনি কবি’র জীবন হিসাবে কবিতাতে প্রজেক্ট করছেন। যেই কারণে মনে হইতে পারে যে, কবি এইরকমই। এইটা একটা সাজেশন উনার কবিতার ভিতরে যে, কবি এইরকম এবং তাঁর কবিতাগুলা।

এইটা কবি’র আটকাইয়া থাকা খালি না; ‘কবি’ ধারণার প্রতি উনার কন্ট্রিবিউশন হিসাবেই এইটারে পড়া যায়। এই গ্লোরিফিকেশন, সাধারণ, প্রাত্যহিকতার প্রতি প্রেম – শম্পা, পারুল এঁরা খালি ‘সাধারণ’ এবং সাধারণ বইলাই কবিতা এখন। যা কিছু ‘অ-সাধারণ’, তারা আর কবিতা না – এইভাবে কবিতার প্রতি উনার অনীহা বা আরোপ আছে; তুমি বাল ভদ্রলোক, তুমি কেন লিখবা কবিতা? অবশ্য এইটা সত্যি যে, যে ভদ্রলোক তিনি কেন লিখবেন কবিতা!

কবিতা পড়তে পড়তে কয়েকটা লাইন দাগালাইম, যদিও কবিতা কি আর দাগানো যায় – এই অস্বস্তি ছিলো প্রথমে; এর কয়েকটা নিয়া বলি:

“আমি বাঁচি কোনো রূপকথা কোনো নাকীকান্নার জন্যে নয়

শুধু দু-একটা স্নেহ দু-একটা হাত

শুধু দু-একটা হাসির জন্যে*

এইরকম মিনতি/অহংকার আমাদের হুমায়ুন আহমেদেরও আছে। টু অ্যা গ্রেটার এক্সটেন্ড বঙ্গীয় শিক্ষিত সমাজেরও আছে মনে হয়। এইরকমটা কবিতা করার জন্য ভালো। কবি’রে সামাজিকভাবে পারসিভ করার লাইগাও ভালো

দাগাইয়া রাখা অন্যান্য লাইনগুলা:

“বিশ্বসুন্দরীর জন্যে আমার কোনো দুর্বলতা নেই

তোমার জীবনের ৮/১০ কিলোমিটারের মধ্যে আমি ঘুরছি”

(১৯৯৭, পৃষ্টা – ৬২)

কী যে ভালো! দুনিয়া বলতে বুঝি আমি তোমারি দুনিয়া। একটা গান লিখো আমার জন্যে; আর আমি ত শালা কবিতার পরে কবিতা লিইখা যাইতেছি; ঐশ্বরিয়া’র সামনে তোমারে ছোট হইতে দিবো না। যদি তুমি ছোট ফিল না-ও করো, করতে যে পারো, সেই সম্ভাবনার কথা ভাইবা যখন আমি লিখি, তখন তোমারে কি তা ভাবতে বাধ্য করে না, সুলেখা?

প্রতিটা বিপদ থেকে আমাকে মোহন সিং বাঁচায় নিমেষে

বলেঃ লেখো তুমি। – আমি লিখি। আমি

তোমাকে আমাকে লিখি পারুলের কথা লিখি

(এই রাত এই রাত্রি, পৃষ্টা ৫৯)

এই লেখা, ইন ফ্যাক্ট নিজেরেই বলা। লিখি। লিখি আর কী! বলতে ত পারি না, প্রায় প্রতিদিনই মাস্টারবেট করি।

একথাও তো সত্যি

আমি রাস্তার মধ্যে গান গেয়ে উঠছি ফিসফিসিয়ে

সরু একটা গলিতে দিব্যি লটকে আছি

(সরলরেখার খোঁজে, পৃষ্টা -৫৮)

এইখানে ‘সরু গলি’ হইতেছে কবিতা এবং ‘লটকে’ থাকার জন্য। বাংলা-কবিতা লটকাইছিলো একদা; এখন ত গলায় ফাঁস নিতেছে, বলবেন, যশোদা মাতা এবং মা আমিনা।

চুলোয় যাক গত পরশুর কবিতা

বিশাল বুকের সব মহিলারা তার থেকে ভালো

পাঁশকুড়া সর্ম্পকে কিছু ভাবতে-বসা ভালো

দুব্বোঘাস নিয়ে

সাদাসিধে ৪/৫ টা লাইন লিখে ফেলাও ভালো

(পাঁশকুড়া, পৃষ্টা ৫৪)

‘বিশাল বুকের সব মহিলা’  – শরীরের প্রতি কীরকম কিম্ভুত টাইপের ভালোবাসা; যেমন ধরেন, তোমার চোখের জন্য ভালোবাসা, কালো ঠোঁটের লাইগা, ইট ক্যান বি; হইতে পারে এই যৌন-ছদ্মবেশগুলার ফ্রাস্টেশন থিকা এই জায়গাটা আসছে; কিন্তু তারপরও ভাই, এইটা ত একটা শরীর-ই, না? যথন আমার চোখ ফুটে, ঠোঁট ফুলে, আমার বুক বিশাল হয়, একই ত রকম! শরীরের কল্পনা থিকা শরীর আলাদা হয়া যায়!

‘দুর্বাঘাস’, ‘সাদাসিধে ৪/৫ টা লাইন’ এইটাও যে কবিতা, এইটা ভাস্কর চক্রবর্তী আসলে।

বেহুঁশ জ্বরে জলপট্টি দেবো

তোমাকে দেবো ভাতের থালা

আলুপোস্ত দিয়ে

(স্তব্ধতামিশ্রিত, পৃষ্টা -৫৩)

আই ক্যান ফিল দ্য ইর্টানিটি। করলা ভাজির মতো। প্রাত্যহিকতা ও অনন্ত, একসাথে।

বাকিগুলা বর্ণনা ছাড়া, কয়েকটা লাইন, কবিতার (আর কতো ভালো লাগে, একঘেঁয়েমি না?):

এই জামা-গেঞ্জি কাচতে আর ভালো লাগে না

এক কাপ চায়ের জন্য ঘুরতে আর ভালো লাগে না

…..

বিরক্তিকরভাবে আমি ভদ্রলোক হয়ে যাচ্ছি

(পেরিয়ে যেতে যেতে, পৃষ্টা ৪৯)

তোমার পাছায় হাত রেখে আমি বুঝেছিলাম জিজি

জীবন ঠিক কী রকম

আর মৃত্যুই বা কেমনতর।

(জিজি -২, পৃষ্টা ৪৫)

হাতচিঠির দিন শেষ

যৌন-বন্ধুত্বের যুগ শুরু হলো?

কলমী শাকের মতো ভালবাসা, মিনসেগুলো

চিবিয়ে খেয়েছে –

এসো আমরা হাঁটি তবু – । তাহারা দৌড়াক।

(তরী, পৃষ্টা ৪২)

“…আমি ঝিমিয়ে পড়ছি

আর ঘুরে বেড়াচ্ছি বাজারের রাস্তায়

আর লিখে রাখছিঃ শম্পা আমার প্রেম…”

সরলরেখার খোঁজে (পৃষ্টা,৫৮)

শম্পা! নাকি, ‘… ক্ষতচিহ্নের রক্তপাত আঙুলে মুছে নিয়ে/আমি নগরীর দেয়ালে দেয়ালে, বৃক্ষের বাকলে লিখছি তোমার নাম/এই যে তোমার প্রেম; ওগো হৃদয় হরণ!’ (সুনীল সাইফুল্লাহ)

মানে কেমনে পড়বো আমি কবিতা, কোন রেফারেন্সটারে মুখ্য কইরা তোলবো? ব্যাপারটা অনির্ধারিত না; কিন্তু ডিসিশান নেয়া লাগে এবং নেয়া যায়ও। যেমন, ভাস্কর’রে কইলাম, তুমি ভায়া, প্রাত্যহিক-মধ্যবিত্ত-প্লেটোনিক-কবি।

 

* বইটা এখন আর নাই, কই জানি হারাইয়া ফেলছি। কবিতার নামটা লিখি নাই তখন, এই কারণে এখনো দিতে পারতেছি না। সরি! কিন্তু এইরকম লাইন বইটাতে আছে, আমি শিওর।

 

 

অগাস্ট: ১৭, ২০১৩।

রি-রাইট: মার্চ ১৯, ২০১৪।

Leave a Reply