লেখকের পেশা, জীবন-যাপন, ভণ্ডামি…

একজন কবি’র পেশা আসলে কী হওয়া উচিত, বাংলাদেশে, এই টাইমে? মানে, ভ্যাগাবন্ড বা বিপ্লবী হওয়া ছাড়া উনারে যদি কোন সামাজিক পেশায় কাজ করা লাগে কামাই করার লাইগা? স্টুডেন্ট লাইফেই এই প্রশ্নটা নিয়া একটা সময় আমি খুব টেনশনে থাকতাম। পরে চাকরি করতে গিয়া তো আরো বিপদে পড়ছিলাম, কোন প্রাইভেট কোম্পানিতে সেলস-এ চাকরি কইরা কবিতা-লেখা কেমনে সম্ভব? আপনার লাইফ-স্টাইল, সোশ্যাল অ্যাপিয়েরেন্স, কাজকাম যেইটা কিনা পুঁজি’র গোলামিতে নিয়োজিত, সেইরকম একটা সামাজিক পজিশনে থাইকা, আপনি কি কবিতা লেখার সাহস করতে পারেন? বা করাটা কি উচিত? বিশেষ কইরা, যখন এক ধরনের আবশ্যিক শর্ত সোসাইটিতে এগজিস্ট করতেছে যে, কবিতা মানেই এক ধরনের প্রতিবাদ- বিদ্যমান ক্ষমতা-কাঠামো’র, খুব স্থুল বা সূক্ষ্ম, যে কোন অর্থেই; সেইটা খালি কবিতা লিইখা করলেই হবে না, লাইফ-স্টাইল দিয়া প্রমাণও করা লাগবে! এইসব জিনিস তো ফেইস করা লাগছে আসলে পারসোনাল লাইফে, একটা টাইমে, বেশ সিরিয়াসলি।[pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

বাংলাদেশের সোশিও কালচারাল কনটেক্সটে কবি হইতে পারেন আসলে – কলেজ বা ইউনির্ভাসিটির টিচার (প্রাইমারি বা হাইস্কুল হইলে হবে না; তবে পিএইচডি স্টুডেন্ট হইলে আরো বেশি হওয়া যাবে…), সাংবাদিক (এই এরিয়াটা এখন ব্যাপক, বলা ভালো, মিডিয়া-কর্মী), এনজিও-কর্মী বা রিসার্চার, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হইলেও চলে বা অ্যাডফার্মের কপি রাইটার থিকা শুরু কইরা ক্রিয়েটিভ ডাইরেক্টর’রেও মেবি মাইনা নেয়া যায়। এইরকম কিছু সিলেক্টিভ লিস্ট আছে, যারা কম-বেশি এলাউড। পাবলিকরে কনভিন্স করা যাইতে পারে ‘কবি’ হিসাবে । সরকারি-আমলারাও আছেন হয়তো, কিছু ডাক্তার বা কর্পোরেটের বড় অফিসার। কিন্তু এই সেকেন্ড ক্যাটাগরিটার হিসাব আবার ভিন্ন; কবি/লেখক হিসাবে পরিচিত হওয়া এবং কবিতা লেখা। প্রকৃত লেখক/কবি বইলা যে সামাজিক-চরিত্র, উনি সবসময় টিচার, জার্নালিস্ট, এনজিও-কর্মী… এই ক্যাটাগরিটা। উনারা ডেডিকেটেড লেখক/কবি; বাকিরা পাওয়ার প্রাকটিসের জায়গা থিকাই লিখেন [টাকা-পয়সা বেশি হইলে যেইরকম মসজিদ-মাদ্রাসা বানায়, দান-খয়রাত করে এইরকম…], ব্যাপারটা মিথ্যা না, কিন্তু আমার কনসার্নটা এইরকম লিনিয়ার ট্রুথের জায়গাটা নিয়া।

লেখালেখি’র ব্যাপারটার সাথে এক ধরনের জ্ঞান-চর্চা, মোরালিটি, কমুনিকেট করা বা সোশ্যাল রিফর্মের বিষয়গুলা জড়িত, যার কারণে হয়তো খুব সহজেই এই জায়গাগুলা থিকা তারে এসোসিয়েট করা যায়, আর এইসব পেশাগুলাতে থাকার কারণে বেশ ইজিও লাগে। কিন্তু যেই কাম আমি লেইখা করবো, সেই একই কামকাজ নিয়াই কেন থাকা লাগবো, সোশ্যাল-লাইফেও! মানে, জ্ঞান-চর্চা এবং শিল্প-চর্চা তো একই বিষয় না বা একইভাবে জিনিসগুলা তো লেখালেখি’র ঘটনাটারে বিপদেও ফেলতে পারে। একটু ভাইবা না দেখলে ব্যাপারটা খুবই ইল্যুশনারি হওয়ার কথা।

একটা তো হইলো, কমন সোশাল আইডেন্টিটির ভিতরেই অপারেট করা আর আরেকটা হইলো লেখা আর লাইফ লিড করা দুইটারে একই লিনিয়ার ফর্মে দেখা – এই দুইটা জটিলতার কারণেই লেখালেখির সাথে খাপ খায় এইরকম কোন পেশা বাইছা নেয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে কখনোই স্বস্তিদায়ক মনে হয় নাই। আমার পেশা আমার সামাজিক বিবেচনার ফল। আর লেখালেখি করার লাইগা লাইফের সাথে, সোসাইটির সাথে, প্রফেশনের সাথে কোন না কোন ধরনের নেগোশিয়েশনে আসতে হয়, কোন না কোনভাবে লেখালেখিটারে লাইফের ভিতর বা লাইফটারে লেখালেখির ভিতর অ্যাকোমোডেড করা লাগে; মানে, এইরকম বাইনারি কইরা যদি দেখতেই হয়।

তো একরকম গোঁয়ারের মতোই আমি ভাবতে পারতেছি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি চিন্তা করতে পারতেছি, ফিল করতে পারতেছি, মনে করতেছি যে, একটা কিছু আমি লিখতে পারি, ততক্ষণ কেন চুপ কইরা থাকবো? যে কোন সামাজিক-পেশার মানুষের পক্ষেই লেখালেখি করা পসিবল; কিন্তু অনেকেই শরম পান, এরপরেও; একটা সোশ্যাল অবস্ট্রেকল ইম্পোজ করা হয়। এই পেশা ব্যাপারটা যে ইর্ম্পটেন্ট বানানো হয়, আমার ধারণা, এই জায়গাটাতে জীবন-যাপনের একটা ঘটনা আছে।

একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, জীবন-যাপন এবং লেখালেখি পরিপূরক একটা ব্যাপার। একজন যেইভাবে লেখেন সেইভাবে জীবন-যাপন করতে চান বা যেইভাবে জীবন-যাপন করেন, তারে লেখালেখির ভিতর নিয়া আসতে চান। এইটা ঘটে, এক ধরনের এক্সচেইঞ্জ তো চলতেই থাকে, তাই বইলা এরা পরিপূরক কোনকিছু না, বরং উল্টাটা ঘটে; মানুষ তার পেশা দিয়াই নিজের ইন্টেলেক’রে লিমিট করতে চান বেশি নিজের পেশা’রে নিজের ইন্টেলেকের মধ্যে ইনসার্ট করার চাইতে। এইটা একটা সোশ্যাল ট্যাবু’র ঘটনা।

গত কয়েকবছর আগে কবির চৌধুরীর অনুবাদ করা প্রাচীন একজন ফরাসি দার্শনিকের একটা বই কিনছিলাম, জীবন-যাপনের শিল্পকলা নামে, একটু পড়তে গিয়াই মনে হইলো যে, ওইখানে আসলে শিল্পকলার কিছু নাই, জীবন-যাপন যেই জিনিস, শিল্পকলা সেই একই জিনিস না। মনে হইলো যে, আসলে দুইটা ভিন্ন ঘটনা; এক্সপ্লোরেশনটাই ডিফরেন্ট।

একটা জীবন-যাপন কোন শিল্পকলার কোন ধার না ধাইরা পার হয়া যাইতে পারে, একইভাবে শিল্পকলারও জীবন-যাপনের কোন নির্দিষ্ট নিয়ম মাইনা চলতে হয় না। আমি চাকরি না কইরা ব্যবসা করলে, লেখালেখির ক্ষেত্রে দেখার জায়গাটা খুব বেশি অন্যরকম হইতো বইলা মনে হয় না, কারণ যেইটা দৃশ্যমান বা চিন্তার ব্যাপার সেইটা লেখকের সামাজিক অবস্থানের বিষয়-ই খালি না বরং লেখালেখির ক্ষেত্রে তার নিজস্ব ডিসিশানের কন্ট্রিবিউশনটা অনেক বেশি। একইরকম সামাজিক অবস্থানের যেইরকম সিমিলারিটি থাকে, একইভাবে একই সোশ্যাল পজিশনে থাইকাও ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা খুবই পসিবল।

আসলে যেইটা হয় যে, এক ধরনের মিথ তৈরি করা হয়, লেখালেখির সাথে জীবনের মিল খোঁজার জায়গাটাতে জোরটা দেয়া হয়। কিন্তু জীবন-যাপনের ঘটনারে খালি প্রফেশনের সাথে, লেখালেখির সাথে আটকাইয়া রাখাটা খুবই ন্যারো একটা ঘটনা। আমাদের জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতাগুলা খালি আর্টে আসে না, আর্টে যেই লাইফরে আমরা ইমাজিন করি সেইটার মকারি লাইফে আরো বেশি হয়।

প্রচলিত ধারণা আছে যে, কবিরে তাঁর কবিতার মতোই হইতে হবে, আর সেইটা না হইলে এইটারেই ভণ্ডামি বলতে চায় লোকে। আপনি একবার কইলেন যে, কৃষ্ণচূড়া সুন্দর, তারপর আপনি আর কৃষ্ণচূড়ার উপর ডেইলি লাইফে কোনদিন বিলা হইতে পারবেন না – এইরকমের স্থিরতা আর সামগ্রিকতা হয়তো আমিও চাই, কিন্তু এইটা কখনোই ঘটনাটা না!

এই তথাকথিত ভণ্ডামিটা আর্ট-কালচারের ভিতরই আছে, এই যে আমার লাইফ আমার আর্টের মতোন হইতে পারতেছে না – এইরকমের একটা ভ্যাকুয়াম। যার যার যন্ত্রণা এবং আনন্দের নিজস্ব ইকুয়েশন আছে। কেউ যদি নিজের ইচ্ছা-মতো জীবন-যাপন করতে পারেন, তার মতো লাকি মানুষ তো আসলে আর হয় না। ইভেন এই লাক-এর জায়গাটারেও একজন রাইটার কেমনে ডিল করবেন, সেইটা তার জন্য ক্রুশিয়াল একটা ডিসিশান।

আপনি কি লিখবেন, কেমনে লিখবেন এইটা যেমন রাইটারের একটা ডিসিশান, আপনি কোন লাইফ-স্টাইলটারে চুজ করবেন – এইটাও আরেকটা চুজিংয়েরই ব্যাপার, বেশিরভাগ সময়। সোসাইটির দেয়া মুখোশের অপশনগুলির ভিতর আমি মাথা ঢুকাইতে চাই নাই। কেউ চাইলেও সেইটারে আমি দোষের মনে করি না। সোশ্যাল লাইফটা তো আছে এইখানে; অনেকে হয়তো বেটার ডিল করতে পারেন, অনেকে পারেন না, কিন্তু এইটা নাই – এইটা বলার কোন উপায় নাই। কিন্তু লেখকের প্রফেশনটাই লেখক না। এইটা জাস্ট গ্রসলি লেখকের টেক্সটরে ইগনোর করার একটা তরিকাই।

 

 

Leave a Reply