‘সত্যি’ বলার অথরিটি

ছোটবেলায়, মানে এইটিইসের দিকে, এই গুজব’টা শুনছিলাম। যে, ইসরাইলি’রা কেমনে প্যালেস্টানিদেরকে তাদের বাসা-বাড়ি থিকা দেখায়া দিছিলো। তখন তো ইয়াসির আরাফাত, ইন্দিফাদা’র… ভিতর দিয়া প্যালেস্টাইনিরা একভাবে ঘুইরা দাঁড়াইতেছিল, তো, উনাদের ভার্সন অফ ট্রুথও পাওয়া যাইতো কিছু।pullquote] [/pullquote]

গুজব’টা এইরকম ছিল: কোন একদিন প্যালেস্টাইনি রেডিও থিকা ঘোষণা আসলো যে, কোন সামরিক মহড়া বা কিছু হবে, প্যালেস্টাইনিরা যাতে তাদের বাড়ি-ঘর থিকা দূরে একটা জায়গায় সইরা যায়, একদিনের জন্য; তো, এই রেডিও ঘোষণা’রে সত্যি মনে কইরা প্যালেস্টাইনিরা যখন সইরা গেছে, তখন নাকি আম্রিকান সেনাবাহিনি হুইদিদেরকে অই বাড়ি-ঘরগুলাতে ঢুকায়া দিছে। তো, মুসলমানদের লগে সবসময় চিট করা হইতেছে, ইহুদি’রাও এইরকম চিট কইরা প্যালেস্টাইনিদের জায়গা-জমি দখল করছে!

এইটা মেবি তখনকার কন্সপিরেসি থিওরি’রই একটা ভার্সন। কিন্তু আমি পরে কয়েকবার গুগুল-টুগলে সার্চ দিয়া দেখছি, ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ 🙂 এর মতন, এইটা সত্যি না মিথ্যা – এইরকম কোন আলাপও দুনিয়ার কোথাও নাই। এমনকি ইহুদি বসতি কেমনে শুরু হইলো ইসরাইলে এই নিয়া এনথ্রোপলিজিক্যাল কোন আলাপও পাই নাই। (কারো কোন রেফারেন্স জানা থাকলে দিয়েন প্লিজ। একটু দেখার ইচ্ছা হইতেছে।)

তো, সমস্যা’টা এইটা না যে, মিথ্যাগুলা, ভুলগুলা নাই হয়া যাইতেছে; বরং সত্যি জিনিসটা যেইভাবে অ্যাপিয়ারড হইতেছে, সত্যের যেই অথরিটি তৈরি হইতেছে, সেইটারে আমি ভয় পাইতেছি। গুগুলে তো এই নিয়া কিছু নাই – ও, তাইলে তো এইটা সত্যি না! বা উইকিপিডিয়া তো কিছু বলে নাই এইটা নিয়া – তাইলে তো এইটা মনেহয় সত্যি না! এইরকম সাবট্রাকশনগুলারে ডরাইতেছি আমি।

আরেকটা উদাহারণ দেই, বিষাদ-সিন্ধুর লেখক মীর মোশারফ হোসেন কোন এক হিন্দু জমিদারের এস্টেটে চাকরি করতেন, ফরিদপুর রাজবাড়ি’র দিকে।… তো, কোথাও একবার দেখছিলাম, উনি কয়েক বছর বা কয়েক মাস জেল খাটছিলেন, কলকাতায়। মেবি, জমিদারের খাজনা তুইলা তার যে মালিক, সেই জমিদারের বিধবা বউ’রে দেন নাই, এইরকম কিছুর জন্য… অথবা লেখালেখির কোন কারণেই। কিন্তু উনি জেলে গেছিলেন কিনা, কোন অপরাধের কারণে, সেইটাই উনার জীবনীর আলাপে পাই নাই। মানে, উনার সাহিত্য নিয়া আলাপে এইটা অবশ্যই জরুরি কোন জিনিস না (তবে লেখক চরিত্র’রে ‘পবিত্র’ দেখানোর যেই প্রজেক্ট, সেইটারই একটা পার্ট); কিন্তু উনার জীবনী নিয়া দুয়েকটা লেখা আমি দেখছি, উনার জন্ম বা মৃত্যু’র ডেইটে লোকজন যখন কথা বলেন, তখনো অইটা সত্যি কি মিথ্যা – এইরকম কোনকিছু দেখি নাই। মানে, এই ‘গুজব’টার কথাও যেহেতু কোথাও নাই, আমি-ই বানাইতেছি হয়তো। 🙂

শেষ আরেকটা উদাহারণ, কোন জিনিস সত্যি নাকি গুজব – এইটা কোন সোর্স বা রেফারেন্স দিয়া প্রমাণ করি আমরা? নিশ্চিতভাবেই, পত্রিকা, টিভি নিউজ হইতেছে আমাদের সময়ের ‘সত্যি’র মালিক। উনারা কিছু কইলে সত্যি, যদি না কন তাইলে মিথ্যা। এখন ধরেন, ৫০ বছর পরে কেউ যদি খোঁজ করতে চায়, গত পার্লামেন্ট ইলেকশনে বাংলাদেশে রাতের বেলা ভোট দেয়া হইছিল কিনা – এই সত্যি কি খুঁইজা পাবে কেউ কোন পত্রিকায়, কোন নিউজে?

মানে, দেখেন, আমাদের ‘সত্যি’ বলার অথরিটি আমরা যাদেরকে দিতেছি, যেইভাবে দিতেছি – সেইটারে অন্ধের মতন আমাদের বিশ্বাস করা’টা ঠিক কিনা? এই কথাটা আমি বলতে চাইতেছি।

আর ‘সত্যি’ জিনিসটারে আমরা যেন ‘অ্যাপিয়েরেন্সের’ লগে মিলায়া না ফেলি। ‘রেভিউলেশন উইল নট বি টেলিভিশনাইজড’ নামে একটা ডকুমেন্টারিতে মেবি দেখাইতেছিল, নিকারাগুয়ার একটা ঘটনা; যখন অপজিশন পার্টি মিলিটারির হেল্প নিয়া অইখানের কমিউনিস্ট পার্টিরে ক্ষমতা থিকা সরায়া দিছিল; তখন পাবলিক মিছিল নিয়া পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ের দিকে যাইতেছিল; টিভি’তে দেখাইতেছিল তখন, পাবলিক ‘অসহায় পুলিশের’ 🙂 দিকে ঢিল মারতেছে, তাদেরকে মাইরা ফেলতে চাইতেছে! অথচ তার পাশেই পুলিশ যে গুলি কইরা মানুশ মারতেছিল, সেইটাই দেখাইতেছিল না!

তো, এইরকম, যতটুক দেখা যায়, বা যেইভাবে দেখা যায়, সেইটার ‘সত্যি’ বইলা দাবি করতে থাকতে থাকাটা খালি একটা ইগনোর করার ব্যাপার না, না বাটপারি স্বভাবই না, বরং ইন্টেলেকচুয়াল একটা ক্রাইম।

Leave a Reply