“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…”

কথা: আবদুল গাফফার চৌধুরী।
সুর: আলতাফ মাহমুদ।

——————————————————

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি।
আমি কি ভুলিতে পারি।

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না না  খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

সেদিনো এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিলো হেসে।
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেনো,
এমন সময় ঝড় এলো, ঝড় এলো খ্যাপাবুনো।

সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণের দেশের দাবীকে রুখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।

সূত্র: জাগরণের গান, পৃষ্টা ৭৯।

____________________________________

একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে গানটা শোনা হইলো কয়েকবার এবং পড়লামও। লিরিকস হিসাবে এর কাব্যিকতা ওই সময়ের বাংলা-কবিতার যে প্যাটার্ন তার বাইরের কিছু না। উপমা হিসাবে দেখেন; কাল নাগিনী, কালবোশেখী,  তারপর তৃতীয় প্যারাটা – পুরাটাই কাব্যিক একটা ব্যাপার, আঁধার, পশু, ঘৃণ্য পদাঘাত… এইগুলা উপমা হিসাবে নতুন কিছু না। কিন্তু গান হিসাবে এইটা একভাবে ‘অমরত্ব’ পাইছে। মানে, ৬০ বছর পরেও এইটা একটা বড় অডিয়েন্সের কাছে রিলিভেন্ট। এর কারণ অবশ্যই এর কাব্যিক উৎকর্ষতা না।

বরং ঘটনা হিসাবে একুশে ফেব্রয়ারি বিস্তৃত হওয়ার ভিতর দিয়া এই গানও ছড়াইয়া গেছে এবং যাবে। এই গান একটা ইন্সিপিরেশন হিসাবে কাজ কইরা থাকতে পারে এখনকার কবি ও সং-রাইটারদের যে কোন আন্দোলন নিয়া কবিতা বা গান লেখার ক্ষেত্রে। কারণ কবিতা বা গান যা-ই হোক, রাজনৈতিক ঘটনাটা যদি সাকসেসফুল হয়, তাইলে একটা একটা সিগনেচার গান ও কবিতার দরকার পড়তে পারে, তখন এর কাব্যিকতা যা-ই হোক, ‘অমরত্ব’ ঘটতে পারে!

সবসময় যে একই রকমের ঘটনা ঘটে, তা না। একটা ব্যান্ডের গানের কথা মনে পড়তেছে, ১৯৯০ এর দিকে হবে গানটা। চিটাগাংয়ে একটা জনসভায় ১৯৮৮ এর দিকে শেখ হাসিনার উপর গুলি চালানো হইছিলো, সেইটা নিয়া গান গাইছিলো। সেই ঘটনাটা যেহেতু খুব বড় একটা কিছু হয়া উঠতে পারে নাই, গানটাও অপ্রাসঙ্গিক হয়া গেছে।

তবে অবশ্যই যারা আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়া গান লিখেন, তারা ‘অমরত্ব’ পাইবার জন্য লিখেন – এইরকম একটা নির্দিষ্ট ভাবনার ভিতর আটকাইয়া ফেলতে চাই না। অনেক লেখা হয় আন্দোলনকারীদের মনোবল বাড়ানোর জন্য। নিজস্ব আবেগের তাড়না থিকা। এমন বিভিন্নরকমও আছে, থাকে।

অনেক সময় আন্দোলনের বাইরে গিয়াও গানগুলা নতুন অর্থ নিয়া প্রাসঙ্গিক থাকতে পারে, যেমন, উই শ্যাল ওভারকাম, হোয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস গন… এইরকম উদাহারণও আছে। অনেক সময় ত পুরান গানও রিলিভেন্ট হয়া উঠে নতুন আন্দোলনে, যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার সোনার বাংলা… যদিও এর অন্য রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো, কিন্তু নতুন অর্থেই সেইটা প্রাসঙ্গিক এখন।

মোটকথা, একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো হিসাবে কবিতা ও গান এর উপযোগিতা আছে। এরা শুধুমাত্র আন্দোলনের আবেগটারেই ধারণ করে না, একটা পর্যায়ে আইসা সম্ভবত আন্দোলনরে ডিফাইন করতে শুরু করে। একুশে ফেব্রুয়ারি’র এই যে বিষাদ এইটা আন্দোলনের স্মৃতি থিকা আসেন না, বরং এই গানই ছড়াইয়া দেয়।

 

Leave a Reply