ইন্টারভিয়্যু ফর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

 

তানিম কবির : কবিতা কেন লিখেন— একজন কবি এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে বাধ্য কি না? যদি বাধ্য নন— তো কেন? আর হোন যদি— আপনার প্রতিও একই প্রশ্ন; কেন লিখেন কবিতা?

ইমরুল হাসান: একজন কবি কবিতা কেন লিখেন সেইটার উত্তর দিতে বাধ্য না। কারণ এই জিজ্ঞাসা আইনের আওতায় পড়ে না। তবে কে প্রশ্ন করতেছেন সেইটার উপরেও নির্ভর করে। যেমন, পুলিশ বা উকিল, থানাতে বা আদালতে জিজ্ঞাসা করলে কবি আইনত বাধ্য মনে হয় (কনফিউশন অর্থে)। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতে হয়। এইখানে সেইরকম একটা কিছু অনুমান কইরা উত্তর করতে গেলে বলা যায়: কবিতা লেখাটা একটা বয়সের পরে অভ্যাসই মনে হয় (নিশ্চিতি অর্থে), মাঝে মাঝে অনিচ্ছাতেও হয়তো লেখা যায়।

 

তা. ক. : ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’— এই ‘কেউ কেউ’ বা ‘কারও কারও’ কবি হয়ে ওঠায় ঐশীপ্রাপ্তির কোনও ঘটনা থাকে কি? নাকি পুরো ব্যাপারটাই রেওয়াজ নির্ভর? আপনার কী মনে হয়?

ই. হা.: শিউর না। রেওয়াজেরও ত দরকার আছে। যেমন গজল-গায়ক মেহেদি হাসান একটা ইন্টারভিউতে বলতেছিলেন ব্যায়ামের কথা, যা খুবই দরকারি ‘দম’ বাড়ানোর জন্য। কবিদের ক্ষেত্রে একটা সময় যে ড্রাগসের ব্যাপার ছিল সেইটাও মিথ্যা না। মানে, নানান রকমের রীতি ও রেওয়াজ থাকতে পারে।

অন্যদিকে বাঁইচা যে আছি এবং এখনো যে মরি নাই এইটাও একটা ঐশী ঘটনা, তাইলে কবিতা লেখার ঘটনা বাদ থাকে কেমনে! মানে, ব্যাপারটা পারস্পেকটিভের, যিনি দেখতেছেন তার ব্যাপার; যিনি লিখতেছেন উনার দিক থিকা ব্যাপারটা (ঐশীতা এবং রেওয়াজ-নির্ভরতা) খুব বেশি সিগনিফিকেন্ট কিছু না।

 

তা. ক. : এখনকার কবিদের ছন্দবিমুখতার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার? কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু? কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তারে ছন্দ আপনার কাছে সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধক?

ই. হা.: যদি আমি নিজেরে ‘এখনকার কবিদের’ অর্ন্তভুক্ত করি তাইলে আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি পরিশ্রমের অভাব। অথবা এইটা যে খুব দরকারি একটা জিনিস এইটা ফিল না করতে পারাটাও একটা কারণ হইতে পারে।

কবিতায় ত ‘ছন্দ’ এর দরকার আছে। মানে, প্রচলিত ছন্দের (অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত…) কথাও যদি ধরেন।

আমি প্রচলিত ছন্দে ঠিক ইউজড টু না। কিন্তু কেউ হইতে পারলে ভালো।

 

তা. ক. : দশকওয়ারী কবিতা মূল্যায়নের প্রবণতাটিকে কিভাবে দেখেন? আপনার দশকের অন্যান্য কবিদের কবিতা থেকে নিজের কবিতাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার উপাদানসমূহ কী বলে মনে হয় আপনার?

ই. হা.: ‘দশকওয়ারী কবিতা মূল্যায়নের প্রবণতাটিকে’ কিছুটা আজাইরা হিসাবেই দেখি। কারণ প্রতি ১০ বছরের ব্যবধানে কবিতা আবশ্যিকভাবে চেইঞ্জ হয় না, যেমন প্রতি ৫ বছরে গর্ভমেন্ট আবশ্যিকভাবে চেইঞ্জ হওয়ার কথা (তাও ত ঠিকমতো হয় না)।

আমার বয়সের যারা যারা কবিতা লিখেন ‘নিজের কবিতা’ তাদের চাইতে ‘আলাদাভাবে চিহ্নিত’ করা সম্ভব কিনা সেই ব্যাপারে আমি তেমন কিছু ভাবি নাই। আলাদা হইছে কি হয় নাই সেইটা যিনি লিখেন তার চিন্তা করারও দরকার নাই।

 

তা. ক. : তিরিশের দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত— প্রত্যেকটি দশক থেকে যদি তিনজনের নাম করতে বলা হয় আপনাকে— কারা আসবেন? উল্লিখিত কালখণ্ডে কোন দশকটিকে আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?

ই. হা.: নাম বলতে আমার আপত্তি নাই; কিন্তু আমার দশক-জ্ঞান খুব একটা ভালো না, প্যাঁচ লাগাইয়া ফেলবো। তারপরও দুইভাগে ভাগ কইরা কিছু নাম বলার চেষ্টা করা যাইতে পারে –

যাদের কবিতা আমি দিয়া ইনফ্লুয়েন্সড হইছি বইলা মনে করি : জীবনানন্দ দাশ, ফররুখ আহমেদ, আল মাহমুদ, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, কাজল শাহনেওয়াজ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সুমন রহমান। (অন্যভাষার কবিদের নাম নিলাম না।)

যাদের কবিতা পইড়া আমি কিছুটা চমকাইছি: মঈন উদ্দিন, রেজাউল করিম, আন্দলীব আমিন, মৃদুল শাওন, সাইদ জুবেরী, নাসিফ আমিন, নওশাদ জামিল, তারিক টুকু, লুনা রুশদী (আরো কয়েকজন আছেন, মানে উনারা ত আসিতেছেন…)। যাদের নাম কইলাম উনারাও লিখতেছেন। দেখা যাক, উনাদের কবিতা আমার কবিতারে বাতিল কইরা দেয় নাকি আরো রিলিভেন্ট কইরা তোলে!

সাম্প্রতিক কবিতাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কবিতা বর্তমান কালেরই বিষয়। কবিতা লিখার জন্য অতীত বা ভবিষ্যত সবসময়ই অগুরুত্বপূর্ণ।

 

তা. ক. : দেশভাগোত্তর দুই বাংলার কবিতায় মৌলিক কোনও পার্থক্য রচিত হয়েছে কি? এ-বাংলায় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন। ওপার বাংলায়ও নকশালবাড়ি আন্দোলনসহ উল্লেখযোগ্য কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন— এসমস্ত কিছুর আলাদা আলাদা প্রভাব কবিতায় কতোটা পড়েছে বলে মনে করেন?

ই. হা.: পার্থক্য ত আছে; দেশভাগের আগেও হয়তো ছিল। কিন্তু কেন্দ্র যেহেতু ‘কলকাতা’ ছিল, একই মনে হইতো। এখন ‘ঢাকা’ এবং ‘কলকাতা’ দুইটা কেন্দ্র তৈরি হইছে। এখন ধরেন, সিলেটের কবিতা আলাদা কিনা সেই প্রশ্ন তৈরি হয় না। সিলেট আসামের সাথে থাকলে এই প্রশ্ন তৈরি হইতে পারতো হয়তো। কবিতার কোন জিনিসটারে আমরা ‘মৌলিক’ বলবো? আমি যেহেতু ‘সার্বজনীন কবিতা’র ধারণায় বিশ্বাস করি, একটা কবিতা কবিতা হয়া উঠলে আর তেমন কোন পাথর্ক্যরে ‘মৌলিক’ বইলা মনে হয় না।

কবিতা আবশ্যিকভাবেই রাজনৈতিক অবস্থার একটা ফলাফল, কারণও হইতে পারে মাঝে-মধ্যে; মানে সর্ম্পক একটা আছে। যদিও ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন নিয়া তেমন কোন ‘ভালো’ কবিতার কথা মনে করতে পারতেছি না এখন।

 

তা. ক. : কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলুন। কবির কি পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিৎ? বর্তমানে বাংলা কবিতার পাঠক কারা?

ই. হা.: যদি অভিযোগ থাকেই, সেইটা আমলে নিয়া কবিদের নতুন কইরা জনসম্পৃত্ত ও বোধগম্য কবিতা লেখার দায়িত্ব নেয়ার দরকার নাই। কবিতা মার্কেটিং করার ব্যাপারটা অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু কবিতারে জরুরি কইরা তোলারই বা কী দরকার!

কবির যা মনে চায় তা-ই লেখা উচিৎ।

পাঠক বইলা ত কিছু নাই। পাঠক আসলে ছদ্মবেশী কবি।

 

Leave a Reply