ওল্ড ব্যান্ড রিইউনিয়ন

 

দিনগুলি এইরকম যে, ফিরা ফিরা আসে। আজকে সন্ধ্যাবেলায় যেমন আসছি ওল্ড স্কুল ব্যান্ডের রিইউনিয়নে। পুরান কলোনি’তে যেইখানে থাকতাম আমরা, কলেজে পড়ার সময়ে। লিড সিঙ্গারের পায়ে নীল জুতা। তারও প্রেমিকা আসছে, তার কাছে অনেক দিন পরে। সে কনফিউজড, সে কি আরো গান গাইবো নাকি প্রেমিকার সাথে ব্যাক স্টেইজে চইলা যাবে। ব্যাক স্টেইজ বলতে অর্ধেক পর্দা দেয়া ছোট একটা রুম। সে তার কাছে গেলো, জড়াইয়া ধরলো। বেস গিটারিস্ট সামনে চইলা আসলো। সে গান গাইবে কিনা শিওর না। লিড গিটারিস্ট এবং ভোকাল যে সে প্রেমিকারে কি কি জানি বলতেছে; তাদের পুরান প্রেম নতুন হয়া উঠতেছে। শে তারে বলতেছে যে, আমি তো তোমার গান শুনতে আসছি! তোমার গানই আমার প্রেম। তুমি গান গাও। তারা তাদের ঠোঁটে চুমা খাইলো। বেস গিটারিস্ট তাদের দিকেই তাকাইয়া ছিল। লিড সিঙ্গার যখন স্টেইজের মূল জায়গাটাতে আসতে শুরু করতে করলো, তখন সে হাসলো; সরে আসলো তার জায়গায়।

তারা উড়িয়া হিপের জুলাই মনিং’টা গাইতেছিল। রাতের বেলায়। বাংলায় শুনতেছিলাম আমি।

আমি ছিলাম এইখানে জুলাইয়ের সকালে
প্রেম খুঁজতেছিলাম
একটা নতুন ভোরের
আর সুন্দর সূর্যের
শক্তি নিয়া

প্রথম পাখির গানের
শব্দে
আমি ঘরের জন্য বাইর হইছিলাম
ঝড় নিয়া
আর রাতটা আমার পিছনে
আর আমার নিজের একটা পথে

দিনের সাথে আসছিল সিদ্ধান্তটা যে
আমি তোমারেই খুঁজবো
লা লা লা

আমি প্রেম খুঁজতেছিলাম
অদ্ভূত সব জায়গায়
একটা পাথরও ছিল না
যা আমি উল্টাইয়া দেখি নাই

এক হাজার চেহারার চাইতে
বেশিই চেষ্টা করছিলাম
কিন্তু কেউই জানতো না তখন
যে আগুণটা পুড়তেছে

আমার হৃদয়ে, আমার মনে, আমার আত্মায়
লা লা লা লা

আমি ছিলাম এইখানে জুলাইয়ের সকালে
প্রেম খুঁজতেছিলাম
একটা নতুন ভোরের
আর সুন্দর সূর্যের
শক্তি নিয়া

প্রথম পাখির গানের
শব্দে
আমি ঘরের জন্য বাইর হইছিলাম
ঝড় নিয়া
আর রাতটা আমার পিছনে
হ্যাঁ, আর আমার নিজের একটা পথে

 

গানটা শেষ হওয়ার পরে ওরা দশ-পনের মিনিটের একটা ব্রেক চাইলো। আমরা ফ্লোরে বইসা শুনতেছিলাম। ওইখান থিকা উঠলাম। ভোকালটা তার প্রেমিকার কাছে ফিরা গেলো। ওরা ওদের ঠোঁটে চুমা খাইলো। গাঢ় হয়া উঠতেছে ওদের চোখ।

ঘটনাটা দেড় তলার মতো একটা জায়গায়। একতলার ছাদের উপ্রে একটা ঘর। ক্লাব-টাব ছিল হয়তো আগে। এখন ভাঙা-চোরা কিছু জিনিসে ভরা। পাঁচ-ছয়টা সিঁড়ি ভাইঙা আমরা একতলার ছাদে নামলাম। কিছুদূর হাঁইটা গেলে সিঁড়ি আছে নিচে নামার। স্লোপি জায়গাও আছে। চাইলে সাইকেল নিয়াও আসা যায়।

আমরা সিগ্রেট খাইতে খাইতে জায়গাটা দেখতেছিলাম। বিল্ডিংটার পাশেই একটা পুকুর। কচুরিপণার ফাঁকে ফাঁকে একটু পানি দেখা যায়। তার পাশে একটা বটগাছ। বটগাছের ছয়টা গুড়ি। দেখার মতো একটা জিনিস। ভাবতেছি ছবি তুইলা ফেইসবুকে চেক-ইন দিবো কিনা। ছাদের উপর থিকা বটগাছটা দেখা যায়। কিন্তু ছবি তুলতে গেলে পুরাটা আসবে না, সামনে আরেকটা গাছের ডাল আছে। চোখ ত ফাঁকি দিতে পারে, কল্পনা করতে পারে। ক্যামেরা সেইটা পারবে না। পারে হয়তো, টেকটিসটা আমার এখনো জানা নাই। বা আমি ত দেখলামই। ছবি তুইলা আর কি হবে! এইরকম ভাবলাম। বটগাছের পরে একটা রাস্তা। একটা রিকশা গেলো। একটা রিকশা আসলো। একটা দুই টনি পিক-আপও যায়। এই নির্জন রাস্তায়।

সবাই মিইলা চা খাইতে নিচে যাই। টিনের একটা ঘর। আমরা বাইরে দাঁড়াইয়াই খাই। তখন দোকানের মালিক আসেন। দাড়ি আছে উনার। জামাত-টাইপ ট্রিম করা দাড়ি না, অগোছালো। হয়তো গতবারই হজ্জ কইরা আসছেন। মাথায় গোল টুপি। পান খান। তিনি তখন বলতেছিলেন যে, উনার আরো দুইটা হোটেল আছে। একটার নাম আল্লার দান, এইটারও একই নাম। আরেকটা হোটেলের নাম, কাতার হোটেল। কইলেন যে, রিক্সাওলাদের লাইগা হোটেলের ভিতরটা (মানে ইন্টেরিয়র) সাজানো এক কঠিন কাজ। কারণ যদি টাইলস থাকে, ওইরকম হোটেলে ওরা ঢুকবো না। ফ্লোরটা অবশ্যই মাটির রাখা লাগবো। ঘরটা টিনের হইলে ভালো হয়। দেয়াল থাকলেও এটলিস্ট ওপরটা টিন দিলে ভালো। কিন্তু মুশকিল হইলো ভদ্রলোকের এলাকায় টিনের ঘর উনারা রাখতে দিতে চান না। সুন্দর কইরা ফেলতে চান। এখন সুন্দর হইলে ত আর রিক্সাওলারা ঢুকবো না! তবে এই গরিব-মার্কা’র আরেকটা সুবিধা আছে। ভদ্রলোকের পোলাপানরা চা খাইতে আসে। তারা ভাবতে পারে, গরিব মানেই সৎ; অন্যরকম একটা সুন্দর, যা আমাদের সৌন্দর্য্য-বোধ মিস কইরা যায়।

তারপর তিনি আমার দিকে তাকাইয়া কইলেন, আপনেরে ত আমি চিনি! আপনি ধানমন্ডিতে থাকেন না! আপনের আব্বার গাড়িটা কাতার হোটেলের পাশ দিয়াই ত যায়! উনি কথা কইতেই থাকলেন। উনার ভুল আমি ভাঙাইলাম না। এমনিতে আমার চেহারাটা বেশ কমন। দেখলে অনেকেরই চেনা চেনা লাগে। একবার এক ট্যাক্সিওলারে নিয়া সারাদিন আনোয়ারা’র ভিতর ভিতর ঘুইরা বদ্দারহাটে নামার পরে সে কইলো, আপনি ত গতকালকেও সারাদিন আমারে নিয়া ঘুরছেন; আপনারে দেইখাই আমি চিনছি! আমি ত শুইনা থ। কয় কি! আমি ত’রে ভাই, জীবনে প্রথম আনোয়ারা’য় গেলাম। তার ভুল ভাঙাইতে গিয়াই দেখলাম যে, এইটা সম্ভব না। তারপর থিকা এই ভুল আমি আর কখনোই করি নাই। চা খাইতে খাইতে তার জীবন-বাস্তবতার গল্প শুইনা উপরে চইলা আসতে থাকলাম।

উপরে আইসা আবার সিগ্রেট ধরাইলাম। দুই একজনের সাথে কথা কইলাম। একজনরে ত আমারও পরিচিত মনে হইলো। পরে ভাবলাম, পরিচিত না হইলে কি আমরা আর একসাথে এইখানে আসতাম! এই ভাবনায় ক্লান্ত লাগলো খুব। অ-পরিচিত থাকা বেশ কঠিন ব্যাপার। ছোট্ট একটা গ্রহের ভিতর কেমনে আর না-দেইখা-শুইনা থাকতে পারি আমরা। চিৎ হয়া শুইয়া পড়লাম একটা সময়। বা যেহেতু কনসার্টে আসছি আমরা, আবার গ্রাস খাইছিলাম হয়তো একটু। শুইয়া থাকতেই ভালো লাগতেছিল। শুয়া শুয়া দেখতেছিলাম একটু দূরে দুইটা ব্যাগ আমার – একটা ল্যাপটপের, আরেকটা ছোট, হয়তো অফিসের কাগজপত্র। এইগুলা নিয়া আমি কেমনে যাবো!

ভিতরে গান শুরু হইছে আবার। ওরা ওয়ারফেইজের যত দূরেই যাবে গান’টা গাইতেছে। গানটা অনেক দূরে আর দূরে চইলা যাইতেছে…

 

আমি ভোকালের প্রেমিকার কথা ভাবতেছিলাম। শে অনেক ইয়াং। এমন একটা বয়স যখন মানুষ প্রেমে পড়ে। আর প্রেমের প্রেমে কে না পড়ে! কোক-স্টুডিও’র কার্শ খেল্-এর ফিউশন গায় ওরা তখন।

আমার লজ্জারে রাইখো তুমি
ধ্যান করি, তোমার পায়ে ধরি
দুখীর ত তুমিই এক ভরসা

প্রিয়া রে তর কারণে
কাপড় বদলাইলাম আমি

আসে যায়
যুগ আসে যায়
জানে কেমনে
রূপ ধরে আসে

প্রিয়া তর কারণে রে
কাপড় বদলাইলাম
রে প্রিয়া

বাতি নিভাইও না
ভোরের ধ্বনি আসতেছে
শরীরে কাপড় রাখছিলাম আমি সারাদিন

গোপনে গোপনে সে সব চুরি করে
গোপনে গোপনে সে মনে ঢুকে

প্রিয়া রে তর কারণে
কাপড় বদলাইলাম আমি

গোপনে গোপনে সে সব চুরি করে
গোপনে গোপনে সে মনে ঢুকে


ভোকাল আর তার প্রেমিকা একসাথে গান গাইতেছে এখন। হিন্দি আর ইংরেজিতে গান গায় ওরা। আমি বাংলা কইরা শুনতে থাকি।

সবাই কোরাস কইরা গাইতেছে। আমি ভীড়ের ভিত্রে চুপ কইরা শুনতেছি। পুরানা সব গান। ওল্ড ব্যান্ড ওরা, নতুন গান নিয়া আসছে। পুরান গানও গায় সাথে। রিইউনিয়নে। কিছুটা দ্বিধা যে, নতুন গান কি পুরানাগুলার মতো ভালো হইতেছে কিনা।

কেকে’র পল দিয়া এন্ডিং শুরু করে ওরা।

আমি
কালকে থাকি কি না-থাকি
আগামীকাল, এই সময়ের কথা মনে থাকবে
সময়, এইটা প্রেমের সময়

আসো, আমার সাথে আসো
আসো, কি ভাবো তুমি
ছোট এই জীবন

আগামীকাল যদি মিলে যায়
তাইলে ত সৌভাগ্যই

আমি
কালকে থাকি কি না-থাকি
এই সময়ের কথা মনে থাকবে

আমি কালকে থাকি কি না-থাকি
আগামীকাল, এই সময় মনে আসবে

সময়, এইটা প্রেমের সময়
আসো, আমার সাথে আসো
আসো, কি ভাবো তুমি
ছোট এই জীবন

আগামীকাল যদি মিলে যায়
তাইলে ত সৌভাগ্যই

আমি
কালকে থাকি কি না-থাকি
এই সময়ের কথা মনে থাকবে

সন্ধ্যার আঁচল
ওড়াইয়া নিয়া আসতেছে
দেখো সুন্দর এই রাত
আসো আমরা দুইজনে মিইলা
নিজেদের প্রেমকাহিনি লিখি

আমি
কালকে থাকি কি না-থাকি
এই সময়ের কথা মনে থাকবে
আসতে থাকা সকাল জানে
কি দিওয়ানি রঙ নিয়া আসবে
আমার চাহাতরে তুমি রাইখা দাও না
যেন কোন একটা নিশানা সে

আমি
কালকে থাকি কি না-থাকি
এই সময়ের কথা মনে থাকবে

আমি
কালকে থাকি কি না-থাকি

আগামীকাল, এই সময়ের কথা মনে থাকবে
সময়, এইটা প্রেমের সময়

আসো, আমার সাথে আসো
আসো, কি ভাবো তুমি
ছোট এই জীবন

আগামীকাল যদি মিলে যায়
তাইলে ত সৌভাগ্যই

আমি
কালকে থাকি কি না-থাকি
এই সময়ের কথা মনে থাকবে

কি যে নিরবতা। সময়ের ভিতর। কনসার্ট শেষ হওয়ার পরে ছবির হাটে আসছি আমরা। হাঁটতেছি এখন। কুয়াশার মতো বৃষ্টি পড়তেছে।

রেখা গাইতেছে গান ফারুক শেখের লাইগা! মন কি জিনিসরে জান, আপনি আমার প্রাণটারেই নেন!

গল্প ত এট্টুকই।

 

আষাঢ়, ১৪২১।

 

ফেইসবুক নোটের লিংক http://on.fb.me/1NKpdGo

 

Leave a Reply