নেলসন ম্যান্ডেলা: তাঁর সাম্প্রতিক জীবনী-গ্রন্থ

 

NELSON MANDELA Conversations with Myself. MACMILLAN. 2010.

 

গ্রন্থ এবং জীবনী-গ্রন্থ বিষয়ে

ম্যান্ডেলা যখন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখনকার সময়ে একটা জায়গাতে বলতেছেন যে, বই পড়ার ব্যাপারটা উনি খুব মিস করেন। বই-পড়া ব্যাপারটা যতোটা না ‘জ্ঞান’ এর সাথে জড়িত, তার চাইতে অনেকবেশি ‘আনন্দ’ বা এন্টারটেইনমইন্টের সাথেও সর্ম্পকিত। একটা নতুন বই-এর সাথে সময় কাটানোটা একজন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার মতোই ঘটনা। প্রতিদিন তো আর নতুন মানুষের সাথে, নতুন ধারণার সাথে যোগাযোগ হয় না। তাই বই পড়তে পারাটা ভালো!

অনেকদিন পর তাঁর এই বইটার সাথে একটা ভালো টাইম কাটলো।

বই এর ক্যাটাগরি করলে জীবন-গ্রন্থ আমার একটা পছন্দের ক্যাটাগরি। একজন মানুষ নিজের সর্ম্পকে কি প্রকাশ করতে চায়, কেমনে করতে চায় – এইটা খুবই ইন্টারেস্টিং ঘটনা। যেমন, আল মাহমুদ-এর বিচূর্ণ আয়নায় কবি’র মুখ -এ তিনি তাঁর জীবনের অনেক বিস্ফোরক ঘটনা এবং ‘মনে-হওয়া’র কথাগুলি বলছেন; আবার গোলাম রব্বানী সাহেব তাঁর ওকালতি ও জজয়তি জীবনের কাহিনি বলতে গিয়া, তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির কথা উল্লেখ করছেন, যেইটা তাঁর কাছে মনে হইছে, সিগনিফিকেন্ট কন্ট্রিবিউশন আছে, বাংলাদেশের আইন-ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে; অনেকটাই জীবন-বৃত্তান্ত এর ফরম্যাটে, কিন্তু এতোটাই কমপেক্ট যে, শ্রদ্ধা আসে, নিজের সর্ম্পকে এতো কম বইলা শেষ করার অভ্যাসটা, একটা রেয়ার ঘটনাও!

আবার কমন কিছু ফরম্যাটও আছে, ছোটদের জীবনী-গ্রন্থ সিরিজ পড়ছিলাম; ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর। ’৮০ এর দশকে বাইর হইছিল ২০/৩০ খন্ডে, প্রতিটাতে ৫/১০জন এর জীবনী। অথবা ইন্ডিয়া থিকা আসতো মহাত্মা গান্ধী, লেলিন, সুভাষচন্দ্র বোস এর জীবনী, চটি বইয়ের মতো।

বইটার একদম শেষে ম্যান্ডেলাও বলছেন অটোবায়োগ্রাফি সর্ম্পকে, “My general impression, after reading several autobiographies, is that an autobiography is not merely a catalogue of events and experiences in which a person has been involved, but that is also serves as some blueprint on which others may well model their own lives.” (Page: 409) একটা জীবন ত শুধুমাত্র ঘটনাগুলি না, বরং ঘটনাগুলির পারসেপশন, কিভাবে তিনি মোকাবিলা করলেন, দেখলেন, জীবনরে কি ভাবনা দিয়া উনি ইনভলভড করলেন ঘটনার সাথে।

 

বই বিষয়ে

ম্যান্ডেলার এই বইটা বরং একটা প্রজেক্ট আকারে করা। ম্যান্ডেলা ২০০৪ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তাঁর সব ডকুমেন্টস নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন এর নেলসন ম্যান্ডেলা সেন্টার অফ মেমরি অ্যান্ড ডায়ালগ এর ‘ম্যান্ডেলা আর্কাইভ’ এ দান করেন। ২০০৮ সালে এই প্রজেক্ট এর শুরু। উনার নানান ইন্টারভিউ, নোটবুক, একটা আত্মজীবনীর ড্রাফট থিকা এই বইটা বানানো। বেশ বড় একটা টিম কাজ করছে, এই প্রজেক্টটা কমপ্লিট করতে।

এক একটা জীবনী-গ্রন্থ পড়তে গেলে, এক একটা ফিলিংস হয়, লেখক বিষয়ে। যেমন ধরেন, হুমায়ুন আহমেদ এর ব্যক্তিগত কথা-বার্তাগুলিই, এক ধরণের হিউমার থাকেই, এইটা তাঁর নিজের জীবনরে দেখার একটা ভঙ্গি। যে কোন হিউমারের মধ্যে এক ধরণের সুপিয়রিটি/ইনফিউরিটি বা বুঝা/না-বুঝা’র একটা ব্যাপার থাকে, তা না হইলে আসলে ‘হিউমার’টা হইতেই পারে না। হিউমারে একটাকিছু না-বলা থাকতে হয়, যেইটা বুঝতে পারার ভিতর দিয়াই হিউমার’টা রিভিল হয়; এই রিভিল করার প্রসেসটা সবসময় কোনকিছুরে ‘ট্রু’ মিনিংয়ের ভিতর আন্ডারমাইন না কইরা ঘটতে পারে না। যা-ই হোক, ম্যান্ডেলার এই বই এর যে দুনিয়া, সেইটা বেশ কৌশলী মনে হয়, আর আসলে একজন রাজনৈতিক নেতার, পাবলিক-ফিগার এর জীবন-কাহিনি এইরকমটা তো হইতেই পারে। মনে হইছে, এই ‘কৌশল’ এর জায়গাটাতে তিনি তাঁর সৎ অভিব্যক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করছেন, কারণ এমনসব মানুষের সাথে তাঁর কথা-বার্তার অংশ রাখা হইছে, যাঁরা তারে খুব ভালোভাবেই চিনেন এবং তাঁর জীবনের অংশ তাঁরা, কোনকিছু লুকানো বা এড়াইয়া যাওয়াটা বেশ মুশকিল, এইসব ক্ষেত্রে।

কৌশল এর চাইতে বলা যায়, উনি বরং অনেকবেশি সর্তক। কারণ এমনসব বিষয় আছে, যা হয়তো ‘বিরোধ’ এর জায়গাটারে এক্সপ্লোর করবে, আবার এমনসব বিষয় আছে, যা হয়তো ‘ঐক্য’ এর জায়গাটারে দৃঢ় করবে; এইসব বিষয়গুলা উনি খুব সর্তকভাবে প্রকাশ করছেন। কথা-বলার সময় উনার অবস্থান এবং উদ্দেশ্য সর্ম্পকে দায়িত্বশীলতার কারণেই উনি খুব সচেতন ছিলেন।

 

পাবলিক এবং প্রাইভেট লাইফ

বইটা আসলে তাঁর প্রাইভেট লাইফ নিয়া, ব্যক্তিগত জীবন, ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি। ‘ব্যক্তিগত’ জায়গাটাতেও উনি প্রচন্ড রকমের নির্মোহ! উনার নিজের কাছে একটা বড় প্রশ্ন ছিল, এই যে রাজনীতিতে আইসা পরিবার এর ভরন-পোষণ, ছেলে-মেয়েদের বড় করার দায়িত্বটা নিতে পারেন নাই, এইটা কি ঠিক হইলো কিনা? – এই জায়গাটাতে খুবই অসহায় মনে হইছে তারে, আল্টিমেটলি এইটা ত একটা চয়েস এর ব্যাপার, একটা সিদ্ধান্ত ত নিতেই হইতো। আর এইক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের পক্ষেই দাঁড়াইছেন; তারপরও প্রায়ই উনি উদ্বিগ্ন, ছেলে-মেয়েরে সময় দিতে পারলেন না বা জেল থিকা যদি বাইরও হন, সংসার চালাইবেন কি কইরা।

আর ব্যক্তিগত সীমানাটাতে উনি খুবই কঠোর, যখন জিজ্ঞাসা করা হইলো, উইনি’র সাথে ডির্ভোস এর কথা, ম্যান্ডেলা ‘ব্যক্তিগত কারণ’ এর কথা-ই উল্লেখ করলেন।

আবার পাবলিক লাইফের প্রাইভেট বিষয় নিয়াও বলছেন, যেইখানে ট্রেসি চ্যাপমানের গান পুরাটা শুনতে পারলেন না বইলা খারাপ লাগতেছে কিংবা আর্থার মিলার এর সাথে সাক্ষাতকার এর জায়গাটা; যেইখানে ম্যান্ডেলা তারে একজন মহান-ব্যক্তি হিসাবেই উল্লেখ করছেন এবং কৃতজ্ঞতা জানাইয়া হাসছেন, সেই গ্রেটনেস এর ভিতর আর্থার মিলার ম্যান্ডেলারে গ্রহণ করছেন বইলা।

জেলখানার জীবনটারে উনি কিভাবে ফেইস করছেন – এই প্রশ্নটা খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই আসছে। আর এইটা ম্যান্ডেলা দেখছেন স্বাভাবিকতার নিয়ম হিসাবেই। আসলে একটা জীবন, সেইটা যেমনই হোক, একটা নির্দিষ্ট সময় পর তার সবকিছুই গা-সওয়া হয়া যায়, আপনি বুইঝা যাবেন, বাঁইচা থাকতে হইলে কি করতে হইবো আপনারে।

তবে ২/৩টা ঘটনা খুবই স্পর্শকাতর, মা’র মারা যাওয়া, সড়ক র্দুঘটনায় ছেলের মৃত্যু কিংবা উইনি’র উপর পুলিশি নির্যাতন… এইগুলির পরেও শত্রুতা ভুলে থাকা খুবই অসম্ভব!

 

জেল সর্ম্পকে

জেলখানা এমন একটা জায়গা, যেইখানে না গেলে রাষ্ট্রের রিয়েল পলিসিগুলা বোঝা সম্ভব না – এই উপলদ্ধি ম্যান্ডেলারও।

 

মিথ

একটা না, তাঁর বিষয়ে আসলে অনেক মিথ-ই তো আছে। এর মধ্যে অন্যতম  যে, ম্যান্ডেলা অহিংসবাদী। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করেই বলছেন যে, কোন ধরণের রাজনৈতিক আন্দোলন এর পদ্ধতি কি হবে, সেইটা সবসময়ই নির্ভর করে, পরিস্থিতির উপর (পৃষ্টা ৫২-৫৩ এ কিছু কথা-বার্তা আছে)। উনি নেগোশিয়েন এর উপর জোর দিছেন, কারণ এইভাবে সম্ভব ছিল তখনকার রাজনৈতিক জটিলতার সমাধানের।

যখনই সুযোগ পাইছেন, ম্যান্ডেলা তাঁর রাজনীতির জায়গাটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করছেন যে, তাঁর লড়াইটা সাদা মানুষদের বিরুদ্ধে না, বরং ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র বিরুদ্ধে; কেউ সাদা বইলাই বেটার না আর কালো বইলাই ইনফিরিয়র না। এই একটা ভুল ধারণার বিরুদ্ধেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় লড়াই করছেন।

তারপর উনি কিন্তু কমিউনিস্ট ছিলেন না; খুব স্পষ্টভাবেই বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার কালোমানুষেরা কখনোই ‘সম্পত্তি’র মালিক হয় নাই, তারা সেইটা হইতে চায়, তাই ক্যাপিটালিজমরেই উনি পাটির নীতি হিসাবে সার্পোট করেন আর এই কারণেই কি ওবামা এই বইয়ের ফরোয়ার্ড লিখছেন? কিন্তু মনে হইছে, নীতির একটা ব্যাপার ত আছেই, কিন্তু যিনি/যারা বাস্তবায়ন করবেন, এর উপরই সমস্তকিছু নির্ভর করে, প্রথমে।

তবে সবচে বড় যে মিথটা উনি অস্বীকার করেন, সেইটা উনার মুখ থিকা শোনা-ই ভালো, যেইটা তাঁর বইয়ের শেষ প্যারাগ্রাফ: “One issue that deeply worried me in prison was the false image that I unwittingly projected to the outside world; of being regarded as a saint. I never was one, even on the basis of an earthly definition of a saint as a sinner who keeps on trying (page: 410)”.

 

পটভূমি

কিছুদিন আগে ইনভিকটিয়াস সিনেমাটা দেখি, মর্গান ফ্রিমান ম্যান্ডেলার চরিত্রে ছিলেন, যেভাবে তারে দেখানো হইছে, সেইটা দেইখা আগ্রহ বাড়ছিলো। আর বইটার পাইরেট কপি তো গুলাশান এর মোড়ে হাতে নিয়া ঘোরে পুলাপাইনগুলা।  ছাপাটা একটু বাজে, কিন্তু এই রিসেন্ট বই এর অরিজিনাল কপি কি ঢাকার কোন দোকানে পাওয়া যায় – এই তথ্যও অজানা ছিল; তাই একদিন শনিবার দুপুরে কিনে ফেলছিলাম…যেহেতু পাইরেট কপি কিছু গন্ডগোল ত থাকবোই, ২পৃষ্টা বাদ গেছে (৩৬২-৩৬৩) ছাপানোর সময়।

আসলে বই জিনিসটা কমদামি বইলাই কেউ কিনে না, বরং একটা বই এর পাঠকের কাছে দরকারি/দামি হয়া উঠাটা জরুরি। যদিও পাইরেসিই এই বইগুলারে অনেকবেশি মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যে নিয়া আসছে, এই ঢাকা শহরে। মিনিমাম একটা পাঠক-শ্রেণীও তৈরি হইতেছে হয়তো।

 

জর্জ সেফেরিস

কি করে কুড়িয়ে এক করবে/একটা মানুষের হাজারটা টুকরো। জর্জ সেফেরিসের এইরকম একটা কবিতার লাইন পড়ছিলাম বহুদিন আগে; এই বইটা পড়তে গিয়া, এই লাইনটার কথা মনে হইতেছিল।

 

Leave a Reply