লেখকের ব্যক্তিগত নৈতিক আচরণ দিয়া তার সাহিত্যের বিচার হইতে পারে না

[লেখকের ব্যক্তিগত নৈতিক আচরণ দিয়া তার সাহিত্যে বিচার হইতে পারে না এবং একইভাবে, নৈতিকতার নতুন প্যারামিটার আবিষ্কার করাটাই সাহিত্যের উদ্দেশ্য হইতে পারে না। ]

এইটা একটা অ-সাহিত্যিক ঘটনা। এই যে, নৈতিকতা দিয়া সাহিত্যরে বিচার করা। এইটা প্রায় সময়ই ঘটে। গবেষণাকর্মীরা সম্ভবত সাহিত্যরে এইভাবেই দেখতে চায় যে, সাহিত্য নৈতিকতার নতুন কোন ফর্দ আবিষ্কার করতে পারলো কিনা এবং এইভাবে তারা সাহিত্যরে নৈতিকতার ভিতর সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা চালায়। খুব সাম্প্রতিক সময়ে যেইটা ঘটছে, সেইটা নিয়াই বলি।

বিডিআর্টস রবীন্দ্রনাথের কিছু ‘জোচ্চুরি’ নিয়া একটা গবেষণাপত্র প্রচার করছে, সেইখানে মানুষ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ কি কি ‘বাজে’ কাজ করছেন এবং সাহিত্য নিয়াও কি কি ‘দুর্নীতি’ তার ছিল, সেইরকম কিছু ঘটনার কথা বলা হইছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য নিয়া কোনরকম বিচার সেইখানে নাই, সেইটা ওই গবেষণা কর্মের উদ্দেশ্যও না।

গবেষণার উদ্দেশ্য সম্ভবত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররে ‘দেবতা’ থিকা ‘মানুষ’ এ পরিবর্তিত করার। কিন্তু যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররে ‘দেবতা’ হিসাবে আমি দেখি নাই, তারে ‘মানুষ’ হিসাবে দেখার বাসনাও জাগে নাই। বরং একজন সাহিত্যিকরে যখন ‘দেবত’ বা ‘মানুষ’ ক্যাটাগরিতে দেখা হয়, তখন মনে হয় তার সাহিত্য-কর্মরেই বাতিল করা হয়। একটা সময়ের ‘প্রতিষ্ঠিত’ সাহিত্য আরেকটা সময়ে অ-গুরুত্বপূর্ণ হয়া উঠতে পারে; কিন্তু একজন সাহিত্যিকের বিবেচনাতে যখন তার সাহিত্য-বিচাররে বাদ দেয়া হয়, সেইটা কোন সাহিত্যিক আলাপ হইতে পারে না।

গবেষণাপত্রের ডিটেইলসে আমি যাইতে চাই না, বরং এর পদ্ধতি এবং প্রবণতাগুলা নিয়া কথা বললেই মনে হয় এনাফ। দুইটা আরগুমেন্ট এস্টাবলিশ করার চেষ্টা করা হইছে, সেইখানে। এক, মানুষ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ‘বাজে’ লোক ছিলেন, প্রজা-নির্যাতন করছেন, খাজনা আদায় করছেন, ইত্যাদি। দুই, সাহিত্যিক দিক দিয়াও উনি ‘বাজে সাহিত্যিক’ ছিলেন, কারণ অন্যের চিন্তা এবং সুর নিজের লেখা এবং সুর বইলা চালাইয়া দিছেন।

আমার নিন্দার প্রস্তাব এক নাম্বার জায়গাতে। যেমন ধরেন, মীর মোশারফ হোসেন ‘জোচ্চুরি’ করার জন্য জেলও খাটছেন, তাই বইলা তার লেখা ‘বিষাদ-সিন্ধু’রে আমার বাদ দিয়া দিবো! তাইলে ত জঁ জেনে’রে মতো ‘চোর’রে সাহিত্যিকই বলতে পারবো না। সাহিত্যের বাইরে অনান্য ক্ষেত্রের কথা বললে, নিউটন সাহেবও (সেলিম রেজা নিউটন না, আইজ্যাক নিউটন) যদ্দুর শুনছি মানুষ হিসাবে খুব একটা ‘ভালো’ লোক ছিলেন না, তাই বইলা উনার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কাররে আমরা ‘খুব একটা ভালো’ বইলা মনে করবো না! এইগুলা থুবই আজাইরা ধরণের প্রস্তাব। এই ধারণাগুলা যারা ইম্পোজ করেন, প্রচার করেন এবং নিরব থাকার মাধ্যমে সার্পোট করেন, তারা আসলে সাহিত্যরে অসাহিত্যিকভাবে মোকাবিলার রাস্তা তৈরি কইরা দেন। সেই প্রচেষ্টারে এইখানে নিন্দা জানাইলাম।

একটা কবিতা/গল্প/উপন্যাস, কবিতা/গল্প/উপন্যাস হইতে পারলো কিনা সেইটা তার ভিত্তিতে করাটাই যৌক্তিক। মানুষ ভালো না বইলা তার সাহিত্য খারাপ – এই ধরণের যুক্তি সাহিত্য বিষয়ে প্রাসঙ্গিক মনে হয় না।

সাহিত্যের আলোচনার বাইরেও, ‘জমিদার’ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রফেশনাল দায়িত্বই হইলো খাজনা আদায় করা, রেভিনিউ বাড়ানো; ত, তিনি কেন তার প্রফেশনাল দায়িত্বরে অস্বীকার করবেন! যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি জমিদার, তিনি ত বাউল-এর আচরণ করতে পারেন না। সমাজ সাহিত্যিকরে তার সাহিত্য-কর্মের মতো ‘পবিত্র’ জ্ঞান করতে চায়। এই চাওয়াটা সমাজের আকাংখা, সাহিত্যিকের ব্যক্তিত্বের উপর না-চাপানোটাই ভালো।

 

২.

এইবার দুই নাম্বারের জায়গাটাতে আসি। এইটা ঠিক নিন্দা প্রস্তাবের অংশ না। কিন্তু বিবেচনা করা যাইতে পারে। আমি ইন-জেনারেল বলার চেষ্টা করি।

সাহিত্য-রচনার বাইরেও সাহিত্যিক হওয়াটা একটা সামাজিক অ্যাক্টিভিটি। যেহেতু সামাজিক অ্যাক্টিভিটি, অনান্য অ্যাক্টিভিটির মতোই ভিতর এইখানে একটা ‘রাজনীতি’ আছে। এইটার কথা এই অ্যাক্টিভিটির সাথে যারা জড়িত তারা খুব একটা বলতে চান না। মারা যাওয়ার পর, সাহিত্যিকদের ডায়রির ভিত্রে এইরকম বিষয় ‘ব্যক্তিগত বেদনা’ হিসাবে আবিষ্কার করা যায়। আল মাহমুদের একটা বইয়ের রিভিউ করতে গিয়া এইটা নিয়া বলছিলাম কিছুটা।

সাহিত্য তা-ই না যা লেখা হয়, বরং সাহিত্যরে ‘তৈরি করার’ বা ‘বানানো’র একটা ব্যাপার থাকে, সমাজের ভিতর। এই ‘বানানো’র কাজে সাহিত্যের অথরিটি হিসাবে নানান প্রতিষ্ঠান কাজ করে, সমাজে। যেমন, বাংলা একাডেমি, সাহিত্য সাময়িকী, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, বইয়ের দোকান, এরা বিভিন্ন পর্যায়ে নানান বাছাইয়ের ভিতর দিয়া সাহিত্য-রুচি’রে ‘তৈরি করে’ বা ‘বানায়’। এই অথরিটি’র জায়গাগুলাতে যারা থাকেন, তারা তাদের রুচি বলেন আর ক্ষমতা-ই বলেন, নানান কারনেই সমাজের ভিতর সাহিত্যিক অ্যাক্টিভিটিরে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেন। এই ‘নিয়ন্ত্রণ’গুলা ঠিক ‘এক্সপ্লেইন’ করা না গেলেও, একভাবে ‘বলা’ যায়।

এই ‘বলা’টারে যারা ‘নিরবতা’র ভিতর সীমাবদ্ধ করতে চান, তাদের এই কাজরেও  নিন্দা করতে চাই আমি। কিন্তু এর সাথে যেইটা এড করা দরকার, কারো সাহিত্যরে যখন শুধুমাত্র তার ‘নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা’ বা তার ‘নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতার ইচ্ছা’ দিয়াই ডিফাইন করা হয়, তখন সেইটাও একটা অ-সাহিত্যিক কাজ হয়াই দাঁড়ায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে প্রমথনাথ এবং গগন হরকরা’র যে উদাহারণ গবেষণাপত্রটাতে দেয়া হইছে, সেইটা র.ঠা.-এর ‘নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা’র দুইটা উদাহারণ হিসাবেই আমি দেখি। এইক্ষেত্রে, প্রমথনাথ এবং গগন হরকরা’র ‘বলা’টারে আমি অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং র.ঠা.’র দিক দিয়া এই ‘নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা’ তার অনান্য সাহিত্য-কর্মরে দুর্বল কইরা তোলে, এইরকম কোন বিবেচনা আমার মধ্যে আসে না।

সবশেষে, মানুষ হিসাবে ‘খারাপ’ বইলা এবং অন্যের সুর এবং চিন্তা ‘চুরি’ করছেন বইলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাজে সাহিত্যিক’ হয়া যান না। অনান্য অনেক সাহিত্যিক কারণেই তার সাহিত্যের সমালোচনা করা যাইতে পারে। বরং ওইগুলি না কইরা এইরকম পাতলা টাইপের ক্রিটিক রবীন্দ্রনাথরে আরো হাইলাইট করার-ই ঘটনা, একদিক দিয়া, এই এক্সপেক্টশনটা যে, উনি তো উনার টাইমের মানুষের চাইতে বেটার কিছু আছিলেন না! যেন মানুষ হিসাবে বেটার হইতে পারলেই হইলো, যত ট্রাশ-ই লিখেন না কেন, সেইটা মেইন ঘটনা না!

 

 

 

Leave a Reply