সাহিত্যে ‘দলাদলি’ নিয়া

ব্যাপারটা যে খুব স্পষ্ট তা না, বরং বেশ ব্যক্তিগত, অস্পষ্ট একটা টেরিটরি, এইখানে যাঁরা জড়িত তাদেরও মুখ বন্ধ রাখাই নিয়ম। তারপরও ব্যাপারটা ত কথা বলার! কারণ, কবি বা লেখক নিজে নিজে লিখলেও তাঁর সাহিত্যের একটা আবশ্যিক কাজ হইলো সমাজের অন্যান্য মানুষজনের সাথে মিনিমাম একটা যোগাযোগরে সম্ভব করা। আর এইটা সম্ভব হয় যোগাযোগের বিভিন্নরকমের প্রতিষ্ঠিত কাঠামোগুলারে এক্সপ্লয়েট করার মাধ্যমেই।

চালু-থাকা যোগাযোগ-কাঠামোটার কোন না কোন বিপর্যয় না ঘটাইয়া শিল্প-সাহিত্য’রে কার্যকর করা সম্ভব হয় না। এই কারণে প্লেটো’র সরল একরৈখিক সমাজের ফাংশনের ভিতর কবি বা লেখকদেরকে অ্যাকোমডেড করাটা কঠিন ছিল; কিন্তু এখনকার বাস্তবতায় এই সাহিত্য-কর্ম সামাজিক জীবনের একটা আবশ্যিক অংশ। যেমন ধরেন, স্কুল-কলেজে সাহিত্য ত পাঠ্য, ইন ফ্যাক্ট সাহিত্য পড়ার ভিতর দিয়াই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু। দৈনিক পত্রিকাতে থাকে সাহিত্য-পাতা, অনলাইন নিউজসাইটেও; কলেজের ছাত্রসংসদ ইলেকশনে সাহিত্য-সম্পাদক পদ থাকে (এখন মনে হয় ইলেকশন হয় না আর), মানে বিভিন্নভাবে এইটা ভিজিবল একটা জিনিস।

বর্তমান সমাজে সাহিত্যের বিভিন্ন রকমের ব্যবহারযোগ্যতা আছে। এই কারণে সাহিত্যের দুশমন কখনোই সাহিত্য-বিরোধীরা না, কারণ উনারা সাহিত্য নিয়া সচেতনই থাকতে চান না, এইটা থাকলে আছে, না থাকলে নাই। কিন্তু সাহিত্যের সমস্যা সবসময় মাঝারি-মানের সাহিত্য। এই সাহিত্য হইলো সমাজের সবচে’ স্ট্রংগেস্ট এসথেটিকস, যেইটা শুধুমাত্র তার ব্যবহারযোগ্যতার ভিতর দিয়াই সমাজে কার্যকর থাকে বা থাকতে চায়।

অনেকে হয়তো এইরকম ব্যবহারযোগ্যতার অ্যাসথেটিক্যাল দলে বিলং করেন না, কিন্তু মনে হইতে পারে যেন একটা দলে আছেন। একটা সময়ে যারা লিখতেছেন, তাদের নিজেদের নিজেদরকে একটা দল বইলা ভাবা’র ব্যাপার আছে। এইক্ষেত্রে যেইটা হয় যে, দুই-চারজন একসাথে হইয়া আরেকজনরে বাদ দিয়া দিলাম; এবং এইটাই আসলে সাহিত্য-রাজনীতি বইলা একটা জিনিসের অপারেট করার জায়গা। কার কার নাম নিলাম সেইটা ইর্ম্পটেন্ট না, বরং কার নাম নিলাম না বা কট্টুক নিলাম এর ভিতর দিয়াই সমসাময়িক ‘দল’ বেশি ভিজিবল এবং পাওয়ারফুল রাখতে পারে নিজেদেরকে।

কিন্তু যারা খালি কবি-ই হইতে চান না, কবিতাও লিখতে চান, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আবিষ্কার করতে পারবেন যে, এই ‘দল’ জিনিসটা এটলিস্ট কোন সাহিত্যিক কারণে এগজিস্ট করে না। এইটা সবসময়ই সাহিত্যের বাইরের ব্যাপার। সাহিত্যে আপনি এই জিনিসটারে বাদ দিতে পারবেন না; মানে, একটা লেভেল পর্যন্ত এইটার যে মিনিং তারে অস্বীকার কইরা আপনি লিখতে পারার কথা না। কারণ বাজারি-সাহিত্যের বিপরীতে সাহিত্য শেষ পর্যন্ত কোন নবুয়ত-পাওয়ার ঘটনা না।

 

২. 

পেশা হিসাবে লেখালেখি আমাদের সমাজে এখনো প্রতিষ্ঠা পায় নাই। যেই সময় আপনি লেখায় দেন, সেইটা ঢাকা শহরে সব্জি বেচায় ইনভেষ্ট করলেও এরচে বেশি টাকা কামাই করতে পারবেন। কিন্তু তার মানে এই না যে, এইটার তেমন কোন গুরুত্ব নাই বাজারে। বরং বিভিন্ন ধরণের পেশায় এইটা ভ্যালু অ্যাড করে।

সমাজে কবি-সাহিত্যকদের এস্টাবলিশ যে ইমেজ আছে সেইটা হইলো, তিনি বেকার, সাংবাদিক, বিপ্লবী ইত্যাদি। কোন সামাজিক পেশার লোক না; হইলেও সেইটাতে তিনি খুবই অদক্ষ।

একজন কবি’র পেশা আসলে কী হওয়া উচিত, বর্তমান বাংলাদেশে? মানে, কোন প্রাইভেট কোম্পানিতে সেলসে চাকরি কইরা কি কবিতা-লেখা সম্ভব বা শেয়ারবাজারে ব্রোকারি কইরা? মানে, আপনার জীবন-যাপন, অবস্থান, পেশা, কাজকর্ম যেইটা কিনা পুঁজি’র গোলামিতে নিয়োজিত, সেইরকম একটা সামাজিক অবস্থানে থাইকা, আপনি কি কবিতা লেখার সাহস করতে পারেন? করাটা কি উচিত? বিশেষ কইরা, যখন এক ধরনের আবশ্যিক শর্ত আছে যে, কবিতা মানেই প্রতিবাদ – বিদ্যমান ক্ষমতা-কাঠামো’র, খুব স্থুল বা সূক্ষ  যে কোন অর্থেই। কিন্তু এইসব শর্ত আসলে নিজেরাই ফাঁদ তৈরি করতে থাকে। কারণ এইরকম সামাজিক ব্যবস্থার ভিতর বেশিরভাগ সময়েই বিপ্লব আসলে ভিন্ন একটা পেশা।

এর বিপরীতে একটা মানুষের পেশাই খালি ঐ মানুষ’টা না। আপনি কীভাবে জীবন-যাপন করবেন,  এইটা যেমন টু সাম এক্সটেন্ড একটা বাছাইয়ের ব্যাপার; আপনি কী লিখবেন, কীভাবে লিখবেন এইটাও একটা সিদ্ধান্তেরই ব্যাপার। জীবন এবং সাহিত্যের সত্যরে একইভাবে আবিষ্কার করতে যাওয়াটা কোন সমাধান হইতে পারে না।

এইখানে দলাদলি’র প্রশ্নটা এইভাবে আসতে পারে যে, পেশা’র ভিতর দিয়া ত এক ধরণের সামাজিক-সম্পর্কগুলা ডেভেলাপ করে, তখন কবি হইতে চাইলে শেয়ার মার্কেটের ব্রোকার হওয়াটা বেশ কঠিন কাজ; যেইখানে আপনি সাংবাদিক হইলে সাহিত্য না করাটাই একটা অপরাধ হইতে পারে! এই বেরিয়ারগুলা আছে।

কিন্তু এই যে কবি’র পোর্টেট’টা সমাজে তৈরি হইলো, সেইটা কি এমনে এমনেই হইছে? বা কারা করছে? কেমনে? এইটা ব্যাখার বাইরের কোন জিনিস না।

 

৩.

এক একটা যুগে এক একরকমের দাড়িপাল্লা থাকে, সাহিত্য-মাপার। যেমন ধরেন, আল মাহমুদ ত বলছেন, বুদ্ধদেব বসু’র কবিতা পত্রিকাতে উনার লেখা ছাপা হওয়ার পরে উনার কবি-স্বীকৃতি পাওয়াটা সহজ হয়। মানে, একটা সময় ছিল কয়েকটা সাহিত্য-পত্রিকা, যারা সার্টিফিকেট দিতো কবি-সাহিত্যিকদের; পরে আল মাহমুদও দিছেন অনেক সার্টিফিকেট, বেহুদা। বেহুদা কারণ, তখন লিটল ম্যাগাজিনের যুগ; লাস্ট ডিকেডের এইটিইজের ঢাকায়। কোন একটা লিটল ম্যাগাজিনে লেখা ছাপা হওয়া মানে আপনি খালি সাহিত্যিক-ই না, প্রতিষ্ঠান-বিরোধীও হইতে পারতেন একই সাথে। এক টিকিটে দুই সিনেমা!

একটা ঘটনার কথা মনে হইলো, কিন্তু এইটাই একমাত্র ঘটনা না। দুইহাজার নয় সালে বঙ্গের কবি রণজিৎ দাশ এবং বাংলা’র অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও কবি সাজ্জাদ শরিফ ‘বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামে বাংলাদেশের কবিতার একটা এনথোলজি সম্পাদনা করেন। ওইটাতে এইটিইজের কবিতা বলতে এক সময়ের গান্ডিব-গোষ্ঠী’র কবিতাই খালি থাকতে পারে ‘শ্রেষ্ঠ’বিচারে। এখন সম্পাদকের/দের নিজের বিচার থাকবোই, এইটারে আপনি প্রমাণ করতে পারেন না যে, ওই সময়ের অন্য কবি যারা আরো আছেন তাদের সাথে ব্যক্তিগত বা নান্দনিক সম্পর্ক না থাকার কারণে তাদেরকে উনারা ‘শ্রেষ্ঠ’ বলতে পারেন নাই।

এইখানে প্রমাণযোগ্য বইলা কোন জিনিস নাই। বা আপনি দাবিও করতে পারেন না যে, উনারা বাছাইয়ের কারণগুলা যেন ক্লিয়ার করেন। বড়জোর এইটা নিয়া সমালোচনা করতে পারেন, তাও অনির্দিষ্টরকমেরই। লিগ্যালি সাহিত্য-সম্পাদক এইরকম একটা ব্যাপার। এই যে প্রমাণ করার কিছু নাই, লিখিত কোনকিছু নাই এর অর্থ তৈরি হয় যে, এইখানে জানি কিছুই নাই! বেসিক্যালি, ঘটনা এইটাই। আপনি খুশি না হইলে নিজে সম্পাদনা কইরা আরেকটা অ্যানথোলজি করেন এবং সেইটারে চালু করার চেষ্টা করেন! দেখেন, পারেন কিনা! সাহিত্য-রাজনীতি এইটাই, আপনি যখন এই প্যাঁক-কাদার ভিতর যাইতে থাকবেন, ততই নিজেরে মাখাইতে থাকবেন, আরো।

 

৪.

তবে এই অপ্রকাশ্যের বিপরীত আছে। এই অবদমন ও এক্সপ্লোরেশনের নাম – ইস্তেহার (বা মেনিফেস্টো)!

এখন ত আপনি অরিয়েন্টালিজম পইড়া, তালাল আসাদের নাম শুইনা পাশ্চাত্য সাহিত্য-আন্দোলনরে গালিগালাজ করতে পারার  (মদিনা) সনদ অর্জন করছেন; কিন্তু আমার ছোট্ট আশা আছে যে এর এফেক্টগুলারে দলবাজি অর্থে হয়তো খারাপ  ভাবতে পারেন না! ধরেন, লোরকা’র দুয়েন্দে, আঁদ্রে বেতোঁ’র সুরিয়ালিজম ইত্যাদি; এইগুলা নতুন কিছু জিনিসরে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করে, যেইটা ঠিক খারাপ  জিনিস না।

কিন্তু একটা ইশতেহার যেইটা করে, তার বাই-প্রডাক্ট হিসাবে নতুন অথরিটি তৈরি করে। একটা সময়ের সাহিত্যের পীরেরাই আরেকটা সময় সাহিত্যের কসাই হইয়া ওঠেন। সাহিত্য-তত্ত্ব অবশ্যই দরকারি এবং তত্ত্ব-চিন্তাটা অনেককিছুরেই স্পষ্ট করতে পারে। এবং একইসাথে সাহিত্যের একটা কাজ হইলো তার প্রেজেন্সের ভিতর দিয়া তত্ত্বের এরিয়াটারে অ-পর্যাপ্ত প্রমাণ করা।

মানে, যা-ই হোক, সাহিত্য খালি সাহিত্য নিয়াই নাই, এর রিলিভেন্সগুলা সাহিত্যিক আলাপের বিষয় না হইলেও, লেখক হিসাবে আপনি ইগনোর করতে পারার কথা না, পুরাপুরি।

 

 

পৌষ ২৪ – ২৭, ১৪২০।

রি-রাইট: চৈত্র ১৬ – ১৭, ১৪২০।

 

 

Leave a Reply