সাহিত্য ও রাজনীতি: আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত ‘ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র প্রেক্ষিতে

‘ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আমি প্রথম পড়ি ১৯৯৩ সালের দিকে। ফররুখ আহমদ মারা যান ১৯৭৪ সালের ১৯শে অক্টোবর। আর বইটা প্রকাশিত হইছিল ১৯৭৫ সালের জুন মাসে, ফররুখ স্মৃতি তহবিল এর পক্ষ থেকে। আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদনা করছিলেন। বইটা পড়ার মাধ্যমেই আমি কবি ফররুখ আহমদরে আবিষ্কার করি।

আবদুল মান্নান সৈয়দ

আবদুল মান্নান সৈয়দ

 

‘ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটা যখন প্রকাশিত হয়, আমি ওই সময়টায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার কথা ভাবি। স্বাধীনতার পর সেক্যুলার ধারণা তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রশ্নাতীত একটা ব্যাপার; এমনকি মনে হয়, তখনকার রাজনৈতিক এবং দার্শনিক যে চিন্তা, সেইটা মর্ডানিটির সাথে কোন মোকাবিলায় যাওয়ার সামর্থ্য রাখে নাই, বাংলাদেশে। সেই পরিস্থিতিতে, ‘ইসলামী চেতনার পুর্ণজাগরণের’ তকমা লাগানো কবি’র শ্রেষ্ঠ কবিতা সম্পাদনা করা এবং প্রকাশ করাটা অনেকবেশি সাহিত্যিক একটা ঘটনা, কিছুটা রাজনৈতিক রিস্কসহ  –  এইভাবেই আমি দেখি।

আসলে সাহিত্যের সাথে রাজনীতির সর্ম্পকটা কি রকম? যে কোন সাহিত্যই সরাসরি অথবা তার দূরবর্তী ধারণায় কোন না কোন রাজনীতিরে সমর্থন দেয়, আবার একইভাবে অনেক সাহিত্যরে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা সম্ভব আর সেইটা হয়ও। যেমন ’৬০ এর দশকে রবীন্দ্রনাথরে আশ্রয় করছিল বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ, কিংবা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে শামসুর রাহমানের কবিতা অথবা আল মাহমুদ এর জামাত-পন্থী হয়া উঠা, এছাড়াও কমিটেড কমিউনিস্ট লেখকরা তো ছিলেন বা আছেনও হয়তো। তার মানে, রাজনৈতিক মতাদর্শগুলি বা পরিস্থিতির সাথে সাহিত্যের একটা সর্ম্পক আছে। সাহিত্য যেমন রাজনীতিরে সার্পোট অথবা অপোজ করে, রাজনীতিও সাহিত্যরে ব্যবহার করে। কিন্তু এই ব্যবহার সর্ম্পকে লেখক নিজে কতোটা সচেতন –  এই প্রশ্নটা সম্ভবত আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়া উঠতেছে।[pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

ফররুখ আহমদ এর রাজনৈতিক সচেতনতা কি রকম ছিল? এইখানে বরং ফররুখ আহমদ এর কবিতার জায়গাটারে আবদুল মান্নান সৈয়দ কিভাবে দেখছেন সেইটা নিয়াই বলি। ১৯৮১ সালে তিনি চল্লিশের দশক এর বাংলা-কবিতার ধারায় ফররুখ আহমদরে ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে: “প্রায় পাশাপাশিই চলেছিল ফররুখের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিচেতন কবিতার ধারা। কিছুকাল আগেও আমি এ ধরণের কবিতা বলতে ‘ইসলামসচেতন’ শব্দ ব্যবহার করেছি। এখন ব্যবহার করছি ‘স্বতন্ত্র সংস্কৃতিচেতন’ কথাটি। আমার বিবেচনায়, এই শব্দগুচ্ছ প্রয়োগ করলে সত্যের নিকটতর হওয়া যায়। কেননা ফররুখ ব্যবহৃত ইসলামি ঐতিহ্য সর্বক্ষণই বাঙালি-মুসলামানের স্বাত্যন্ত্রিক ধর্ম-সাংস্কৃতিক পটে স্থাপিত।” (পৃষ্টা: ৫৯, ফররুখ আহমদ: জীবন ও সাহিত্য, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সূচীপত্র, ২০০৯)

ফররুখের কবিতার মূল প্রবণতা হিসাবে যেইটা প্রতিষ্ঠিত হইছে, সেইটা ‘ইসলামসচেতন’ থেকে ‘স্বতন্ত্র সংস্কৃতিচেতন’ হিসাবে বিবর্তিত হইছে সৈয়দ এর বিবেচনায়। দেখার ব্যাপারটা হইলো যে, ব্যাখ্যাটা বিবর্তিত হইতেছে, কবিতা কিন্তু না। মানে যেইভাবে আমরা কবিতারে দেখি, আমাদের সময়ের ভিতর দিয়া সেইটা পাল্টায়। আরো সংলগ্ন হইতে থাকে আমাদের সময়ের ভিতর।  একটা সময়ের ঠিক চিন্তাই আরেকটা সময়ে ভুল হইতে থাকে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতে যখন মুসলামনদের রাষ্ট্র গঠন হয়, তখন এই ‘ইসলামসচেতন’ তকমা শিরের তাজ; আবার যখন ভাষার জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন হয়, তখন ‘ইসলামসচেতন’ ভাবধারারে খুব সহজেই সন্দেহের চোখে দেখা যায়। সেই কারণে, সৈয়দ এর এই সরে আসাটা, অনেকবেশি প্রাসঙ্গিক হয়া উঠে। ফররুখ আহমদরে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সৈয়দরে এই কথাও বলতে হয় যে, “…ধর্ম যতখানি উদ্বুদ্ধ করেছিল, ততখানি প্রেরণা জুগিয়েছিল দেশ।” কথাট মিথ্যা না, কিন্তু বলা যে লাগে, এইটা একটা ঘটনা।

কবিরে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলতে হয়। কিন্তু ফররুখ আহমদ এর কবিতার যে রাজনীতিটা, সেইটার ব্যাখ্যায় ফররুখও হয়তো কখনো স্পষ্ট করার দরকার মনে করেন নাই এবং আবদুল মান্নান সৈয়দও তারে লোকেট করতে গিয়া, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ। ফররুখের ধর্ম-চেতনারে তিনি একদিকে যেমন ‘সেক্যুলার’ ধারণার ভিতর এ ঠিকমতো অ্যাকোমোডেড করতে পারেন না, আবার একটা এইটাও স্বীকার করতেছেন যে, ফররুখের কবিতার বিষয় যতোটা না ‘ইসলাম’, তার চাইতে অনেকবেশি ‘ইসলামি সংস্কৃতি’; এই ইসলামি সংস্কৃতি বাঙালি-মুসলামানের সমাজে যেইভাবে গৃহীত হইছে, তার একটা রূপ নিয়া আসার চেষ্টাটা ফররুখের কবিতার ভিতর সবসময়ই ছিল। হয়তো তার চেষ্টাটারে রাজনৈতিকভাবে ডিফাইন করাটা সম্ভব হয় নাই; কিন্তু এই যে চেষ্টাটা, আলাদা একটা রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে বাঙালি-মুসলামনরে আইডেন্টিফাই করাটা – এইটা ফররুখ আহমদ এর কবিতার একটা মূল্যবান রাজনৈতিক ব্যাপার। আবদুল মান্নান সৈয়দ ফররুখ আহমদ এর এই বিবেচনাটারে কিছুদূর পর্যন্ত ব্যাখ্যা করার একটা চেষ্টা করছেন বলে আমার ধারণা। একটা রাষ্ট্র, একটা জাতি এবং একটা ধর্ম – এই তিন পরিচয়ের ভিতর বাঙালি-মুসলমান তো এখনো খাবি খাইতেছে।

১৯৪০এর দিকেই বাঙালি-মুসলামন বলে একটা সত্তা আবিষ্কার হইতে থাকে বাংলা-সাহিত্যে আর সম্ভবত ফররুখ আহমদরেই শেষ পর্যন্ত এই রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রধান কবি হিসাবে দেখা যায় (একইসঙ্গে নজরুল ইসলাম আর জসীমউদ্দিনরেও পাওয়া যাইবো, আগে এবং পরে)।

কিন্তু রাজনীতি-সচেতনতা সবসময় পরের একটা ব্যাপার, আগে তো কবিতা হইতে হইবো, তারপর এর রাজনীতি নিয়া আলাপ। রাজনীতির কারণে কোন কবিতা টিকাইয়া রাখা মুশকিল, বরং রাজনীতি তার প্রয়োজনেই কবিতারে খুঁজে বাইর করে। ফররুখ আহমদ এর কবিতা নিয়া আগ্রহ আছে বইলাই তার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়া এই প্রসঙ্গে আসা। ৭০ বছর পরেও তাঁর ‘কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি’ এখনো তো পড়তে ভালো লাগে!

 

২.

এইবার আবদুল মান্নান সৈয়দ এর প্রসঙ্গটাতে ফেরত আসি। তিনি কিভাবে ফররুখের শ্রেষ্ঠ কবিতা সম্পাদনা করেন, সেই ঘটনাটা বলছেন, এইভাবে: “১৯৭৫এর মার্চ মাসের দিকে আমার অপরিচিত দুজন তরুণ, ফাওজুল কবির খান ও মাসুদ আলী, ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা সম্পাদনার প্রস্তাব নিয়ে আসেন – যার জন্যে আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। ওঁরা সরাসরি বলেন সম্পাদক হিশেবে আমাকে কোন অর্থ তাঁরা দিতে পারবেন না, কিন্তু তারা সর্বান্তঃকরণে চান যে বইটি আমিই সম্পাদনা করি। আমি খানিকটা হতচকিত হয়ে, কি বলব বুঝে উঠতে না-পেরে, ড্রয়িংরুম থেকে উঠে গিয়ে আমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করি। আমার আব্বা এমনই গম্ভীর ও রাশভারি ধরণের পুরুষ ছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমাদের – তাঁর সন্তানদের – দূরত্ব ঘোচেনি। আব্বা বললেন, ‘এ পর্যন্ত তুই যা সাহিত্যকাজ করেছিস, আমি মনে করি, এটাই তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো কাজ হবে।’ আমি মুর্হূতমাত্র দেরি না-করে, ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে, তরুণদ্বয়কে আমার অনুমোদন জানিয়ে দিলাম। পরবর্তী মাস তিনেক ধরে ফররুখের ইস্কাটনস্থ ফ্ল্যাটে আমরা কয়েকজন অনুক্ষণ কাজ করে বইটিকে প্রস্তুত করি। সে-সময় যে-তরুণটি সর্বাধিক সপ্রেম পরিশ্রম দিয়েছিল তার নাম ফজল মাহমুদ, কবিতা লিখত, পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং কোনো অজ্ঞাত কারণে আত্মহত্যা করে।” (পৃষ্টা: ১১-১২, ফররুখ আহমদ: জীবন ও সাহিত্য, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সূচীপত্র, ২০০৯)

যদ্দুর বোঝা যায়, সৈয়দ কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলেন; কিন্তু তাঁর এই বিভ্রান্তি কি রাজনৈতিক নাকি সাহিত্যিক, ঠিক বোঝা যায় না, এই বর্ণনায়। তবে শেষে যে বইটা বাইর হইছে, সেইটা আবদুল মান্নান সৈয়দ এর সেরা কাজ হইছে কিনা এইটা বলার সময় হয়তো আসে নাই, কিন্তু ফররুখরে চিনতে অনেকরেই সাহায্য করবে; অন্তঃত আমারে করছে। ফররুখের কবিতার তিনটা জিনিস আমার চোখে পড়ছিলো, তাঁর আধুনিকতা (জীবননান্দের খুবই সমসাময়িক), ইসলামি-সংস্কৃতির উপাদান (এই জায়গাটাতে উনার এক্সপেরিমেন্ট অনেক, এইখানে উনি হয়তো একটা চেষ্টা করছেন পুঁথি-সাহিত্যের অনেক বিষয়রে আধুনিক কবিতার বিষয় হিসাবে নিয়া আসতে) আর তাঁর স্যাটায়ারগুলা (খুবই দুঃখজনক যে, এইটার কথা কেউই বলেন না, বাংলা স্যাটায়ার কবিতার এনথোলজি করতে গেলে, ফররুখ ছাড়া কেমনে সম্ভব!); ফররুখের এই মেজর জায়গাগুলার চিহ্ন পাওয়া যায় শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনটাতে।

আবদুল মান্নান সৈয়দ তো প্রচুর গবেষণা করছেন, অনেকরে নিয়াই লিখছেন। রাজনৈতিক বিবেচনার চাইতে সাহিত্যিক প্রচেষ্টাগুলাই ছিল মুখ্য অথবা হয়তো এইভাবেই তিনি নিজেরে লুকানোর আয়োজন করছেন। তিনি বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলামনদের সমস্ত সাহিত্য-সামগ্রীগুলারেই তাঁর বিবেচনার ভিতর নিয়া আসছেন। নিজের রাজনৈতিক অস্থিরতাটারে তিনি বরং অনেকবেশি ছড়াইয়া দিছেন। কিন্তু তাঁর সাহিত্য-গবেষণা আমারে খুব একটা আকর্ষণ করে না, মূলত তাঁর মলিন ভাষা-ভঙ্গি’র কারণে। ভাষার ব্যাকরণরে তিনি বিরক্ত করতে চান নাই। এই কারণে হয়তো তাঁর চিন্তাও আটকাইয়া গেছে। অথবা তিনি হয়তো সচেতনভাবেই সাহিত্য ও রাজনীতির যে লাইনটা টানছেন, সেইটা অতিক্রম করতে চান নাই।

তারপরও আবদুল মান্নান সৈয়দ সবসময় তাঁর সাহিত্য-গবেষণায় বাঙালি মুসলামান সাহিত্যিকদের ভালোভাবেই ইনক্লুড করছেন, যেইটা হয়তো অন্যান্য অনেক সাহিত্যিকই করেন নাই। আর এই বিস্তৃত কাজের ভিতর দিয়া তিনি একটা স্পেস তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যেইখান থেকে বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদেরকে স্পষ্টভাবে দেখাটা অনেকবেশি সম্ভব হয়া উঠছে।

 

৩.

আসলে এই লেখাটার উদ্দেশ্য ছিল একটা ধারণার বিস্তৃতি ঘটানো, কিন্তু লিখতে গিয়াই মনে হইলো, যদি আরো তথ্য-উপাত্তের সাহায্য থাকতো তাইলে খুবই পূণাঙ্গ একটা লেখা হিসাবে তৈরি করা যাইতো।  আমি খুবই লজ্জিত যে, ফররুখ আহমদ এর মতো একজন পরিশ্রমী লেখক এবং আবদুল মান্নান সৈয়দ এর মতো একজন অধ্যবসায়ী গবেষক এর বিষয়ে লিখতে বসছি, কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই। ‘ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটা থাকলে ভালো হইতো, কিন্তু যোগাড় করতে পারি নাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি সাব্বির আজম এর কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে আবদুল মান্নান সৈয়দ এর “ফররুখ আহমদ: জীবন ও সাহিত্য” এবং  বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত “ফররুখ আহমেদ রচনাবলী ২য় খন্ড” বই দুইটা দেয়াতে।

শেষ পর্যন্ত হয়তো একটা ড্রাফট হিসাবেই লেখাটা রয়া গেলো, যার আরো বিস্তার ঘটানোর আগ্রহ থাকলো, ভবিষ্যতে।

 

ইমরুল হাসান

ঢাকা।

 

 

ফেসবুক নোটের লিংক: http://bit.ly/1Oj2vtS

 

Leave a Reply