কবিতার ইশতেহার নিয়া

১.

“ইশতেহার লিখে কখনো কবিতা হয় না।” – সাজ্জাদ শরিফ।

“আসলে কবিতার ইশতেহার কেবল একটি ইশতেহারই, ইশতেহার ছাড়া অন্য কিছু নয়।” – শান্তনু চৌধুরী।

‘কবিতার অর্থ, কবিতার অনর্থ’ নামে সাজ্জাদ শরিফ একটা লেখা লিখছেন, ছাপা হইছিল দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী’তে নভেম্বর ১৮, ২০১১ সনে। উনার এই লেখার বিষয় নিয়া উনি আগে বলছিলেন একটা বক্তৃতায়, সেই কথাগুলা শোনার সৌভাগ্য আমার হইছিল। তাই লেখা পড়াটা অনেকটা আবার শোনার মতো ঘটনা। কথার যদি গুরুত্ব থাকে, তাইলে সেইকথা বারবার বলতে এবং শুনতে কোন দোষ নাই। তার উপরে উনার কথার কোন ‘অন্যমত’ বা ‘বিরোধিতা’ও চোখে পড়ে নাই।

কিন্তু আমার কনসার্ন যতোটা না তার কবিতার ‘বাঁকা-তত্ত্ব’ বা ‘শব্দের প্রতিসরণ’ বিষয়ে, তার চাইতে অনেকবেশি ‘কবিতার ইশতেহার’ বিষয়ে। সাজ্জাদ শরিফ এই ‘ইশতেহার’ নিয়া বলার পরে শান্তনু চৌধুরীও এইটা নিয়া কথা বলছেন, দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য-সাময়িকী’র পাতাতেই।

ত, ‘কবিতার ইশতেহার’ নিয়া উনারা কি বলছেন, সেইটা উদ্ধৃতি আকারে প্রথমে দিছি। উনাদের কথা যদি ‘সত্যি’ হিসাবে ধরি, তাইলে প্রশ্ন আসে, উনারা ‘কবিতার ইশতেহার’ কেন লিখছিলেন বা এইটা নিয়া কথা-বার্তা কেন বলতেছেন? মানে, ‘ইশতেহার’ লিইখা যদি ‘কবিতা’ লিখা না যায় বা এইটার যদি ‘ইশতেহার’ ছাড়া অন্য কোন মানে না থাকে, তাইলে কেন এই ‘কষ্ট’ তারা করছিলেন?

আমার ধারণা, এইটার ‘অর্থ’ তারা জানেন এবং সেইটা তারা ‘গোপন’ করতেছেন; কারণ একটা ‘কবিতার ইশতেহার’ আর কিছু করুক বা না-করুক কবিতার একটা অথরিটি তৈরি করে। আর এইটা উনাদের পরবর্তী কথাগুলাতেও আর ‘গোপন’ থাকে নাই।

 

২.

“… কিন্তু কবিসুলভ সংবেদনশীলতা যে তাঁদের সঠিক সংকেত দিয়েছিল গত দুই-আড়াই দশক ধরে বাংলা কবিতার ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া ভাষা দেখে আজ তা-ই মনে হয়।” – সাজ্জাদ শরিফ।

“গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের কবিতায় এই ইশতেহারটি একটি মাপকাঠি হিসেবে কাজ করেছে বা কবিতার গতিপথ বাতলে দিয়েছে, তাহলে এই দাবি কি খুব অসংগত মনে হবে?” – শান্তনু চৌধুরী।

মানে, ‘কবিতার ইশতেহার’-এর ত ‘একটা’ ভূমিকা আছে তাইলে! এইটা খালি ‘কবিতা হয় না’ বা ‘ইশতেহার ছাড়া অন্য কিছু নয়’ এর বাইরেও ‘একটা কিছু’ যা ‘দুই-আড়াই দশক ধরে বাংলা কবিতার ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া ভাষা’ এবং ‘একটি মাপকাঠি’ বা ‘কবিতার গতিপথ বাতলে’ দেয়ার মতো ঘটনা।

কেন তারা প্রথমে কইলেন, ‘কবিতার ইশতেহার’-এর কোন ভ্যালু নাই এবং তারপর এর উপর ‘সুপার-ভ্যালু’ চাপাইলেন? এর উত্তর নিশ্চিতভাবে উনারাই জানেন এবং যদি উনারা প্রশ্নটা ফিল করেন, তাইলে হয়তো এর একটা উত্তর করবেন। আমি আমার একটা অনুমানের কথাই বলি।

 

৩.

অনুমানটা একটু আগে বলছি, কবিতার ইশতেহারের একটা কাজ হইলো কবিতার অথরিটি তৈরি করা। কবিতার এই ইশতেহারের ভিতর দিয়া উনারা নিজেদেরকে কবিতার অথরিটি হিসাবে এস্টাবলিশ করতে চাইছিলেন বা চাইতেছেন। সাহিত্যের ইতিহাস দেখলে এইটার অনেক উদাহারণ পাওয়া যাবে; যথা, বাংলা-সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসু। উনি বাংলা-কবিতার অথরিটি ছিলেন একটা সময় এবং এই অথরিটি ‘ভালো’ কোন জিনিস না; কারণ ‘কবিতা’র ধারণারে ‘নতুন’ করতে গিয়া কবিতারে নানানভাবে সংকীর্ণ-ই করে।

যেমনটা করছেন সাজ্জাদ শরিফ (কিছুটা কম) এবং শান্তনু চৌধুরী (কিছুটা বেশি)।

কেমনে সংকীর্ণ করলেন তারা? বাংলা-কবিতার এইটিইস সর্ম্পকে যারা থিসিস লিখবেন, এইটা তারা হয়তো আরো ভালো বলতে পারবেন।  কিন্তু সাজ্জাদ শরিফ এবং শান্তনু চৌধুরী’র এই কবিতার ইশতেহারের ক্লেইমের বিপরীতে বলা যায়, বাংলা-কবিতার এই যে চেইঞ্জ (৮০-পূর্ব, মানে ’৬০-’৮০ এবং ’৮০-পরবর্তী) এইটা শুধুমাত্র একক ইশতেহারের কোন ঘটনা না, বরং সেই সময়ে অনেকগুলা ধারা-ই স্পষ্ট হয়া উঠতেছিল, যারা এই চেইঞ্জটারে ড্রাইভ করছেন, যাদেরকে এই ইশতেহারের বাইরে ‘আলাদা’ বইলা আইডেন্টিফাই করা সম্ভব।

ত যখন তারা ইশতেহাররে হাইলাইট করেন একটা সময়ের ঘটনা হিসাবে, অনান্য ঘটনাগুলারে ‘অনুল্লেখ’ রাইখা, তখন সেইটারে সংকীর্ণ ত বলা যাইতে পারে…

৪.

প্রিসাইজলি বলতে গেলে, এইটিইসের সমস্যাও এইটাই, গোষ্ঠী-ভাবনা’টা; এইটা পরবর্তী সময়ে আইসা আর খুব একটা প্রমিনেন্ট হয়া উঠতে পারে নাই। পারে নাই যে এইটা ভালো হইছেই।

৫.

তাইলে কি আমরা ‘কবিতার ইশতেহার’ লিখবো না? যে কোন ‘কবিতার ইশতেহার’-এর বিরোধিতা করবো? এইটাও মনে হয় না; যেইটা নিশ্চিতভাবেই মনে হয়, যখন কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ইশতেহার কবিতার অথরিটি হিসাবে নিজেরে ক্লেইম করতে চায়, তখন তারে তার নিজের জায়গাটা চিনাইয়া দিতে পারাটা দরকার; যেমন ধরেন এই ইশতেহারের ক্ষেত্রেই: পঙ্কস্রোত, চৈতন্যের ইট, শাণিত কৃপাণ, রসকুম্ভের আত্মা, বিন্দুবাদী প্রক্রিয়া – এইগুলা এইটিইসের একটা প্যার্টান ছাড়া আর কিছুই না।

 

সাজ্জাদ শরিফ-এর লেখার লিংক:

http://eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=1&date=2011-11-18#

 

শান্তনু চৌধুরী’র লেখার লিংক:

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-12-09/news/207326

 

Leave a Reply