ছোট শহরের গল্প

ছোট শহর মানে একজন কবি থাকেন সেইখানে। জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী, ইন্ডিয়া রাষ্ট্রের পশ্চিমবাংলা প্রদেশের, কবি রণজিত দাশ এই কথা কইছেন; ইন ফ্যাক্ট উনি কবিতাই লিখছেন এইরকম; এমন পাওয়ারফুল! কিন্তু উনি মনে হয় বড় শহরেই থাকেন, মুম্বাই অথবা দিল্লী। এই কথা সত্যি না হইলেও সমস্যা নাই; এইটা ত গল্প-ই। গবেষণা না। সুতরাং না-জানা দিয়াও গল্প লেখা যাইতে পারে, ধারণা কইরা। আসলে যা যা আমরা জানি খালি তা নিয়াই গল্প লেখার মতো বাজে জিনিস তো আর কিছু হইতে পারে না। উনি ঢাকা শহরেও মনে হয় আইছেন কয়েকবার। কবিদের লিস্ট বানাইছেন এবং কবিরে প্রাবন্ধিক ও অনুবাদকরে কবি হিসাবে চিনছেন, এইরকম। সার্টিফিকেটও নাকি দিছেন, মৌখিক; আর যেইটা লিখিত, তারে কইছেন, সিলেকশন, পরিবর্তনযোগ্য। যদিও পরে কইছেন যে, উনার না-জানা আছে, ধারণা কইরাই দিছেন। এই অর্থে, উনার কবি বাছাইয়ের ঘটনা উনার শারীরিকভাবে বড় শহরে থাকা, না-থাকার মতোই প্রায়।

যা-ই হোক, সেইটা বিষয় না। বিষয় হইলো, ছোট শহর। সেইখানে একজন কবি থাকেন বা না-থাকেন, বেশ কিছু গল্প এবং গল্পকার অবশ্যই আছেন।

সেই কথা মনে হইলো, যখন ছোট শহরের একটা গল্প আমারে একজন (যিনি শব্দের ভিতরেই প্রকাশ্য থাকতে চান, এইরকম) শুনাইছেন; যে, ছোট শহরে একটা কিশোরী মেয়ে থাকে, শে বাঘের বাচ্চা পালে; একসময় বাঘের বাচ্চাটা বড় হয়া যায়, ছোট শহরে আর আঁটে না, সে তখন কী করে! বড় শহর’রে জঙ্গল মনে কইরা সেইখানে গিয়া রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা পড়ে! আহারে যদি সে ছোট শহরে থাকতো, তাইলে বড়জোর রিকশার তলে পড়তো, হাত-পা মচকাইতো, ব্যান্ডেজ-বাঁধা শরীর দেইখা আমাদের মনে জাগতো কামনা – বাঘের বাচ্চা এবং কিশোরী মেয়ে’র প্রেম এই জাতীয় গল্পও লেখা যাইতো হয়তো; আর এই কারণেই ছোট শহর অনেক রোমাণ্টিক ব্যাপার, তাই না?

আমি কই, হায় হায় আমার জীবন দেখি গল্প হয়া যাইতেছে। দ্রুত গল্প লিখার সিদ্ধান্ত নেই আমি। অথেনটিক ছোট শহরের একটা গল্প, যেইটা আবার গল্প-লেখা নিয়া।

সময় বিকালবেলা। সন ইংরেজী ১৯৮৯। গরমের দিন। বাতাস বহিতেছে।

স্থান অবকাশ হোটেল। অবস্থান লঞ্চঘাটের কিনারায়।

একজন মদখোর ও একজন দার্শনিকের আলাপ এবং পরে একজন কবি ও রাজনৈতিক নেতাও যোগ দিবেন। একজন স্কুলশিক্ষকও আসার কথা, তবে নাও আসতে পারেন। শেষ পর্যন্ত, সাংবাদিক আইসা পুরা গল্পটার কন্ট্রোল নিবেন।

টেবিলে চা আসার পরে মদখোর শুরু করেন,‘কিঅ, আমার বাপে নাইলে মদই খা; ইলিগ্গা হে এইডা নিয়া গল্প লিখবো! লেখচছ বালা কতা, এইডারে ছাপাইয়া আবার লুকজনের মইধ্যে বিলিও করছ! তোমরা’র আস্কারা পাইয়া পাইয়া এই বাদাইম্মা পোলাপাইনগুলা এই কাম করার সাহস পা, নাইলে টেঙ্গি-টুঙ্গি ভাইঙ্গা ড্রেইনো ফালাইয়া রাখতাম। হে আমার বাপরে লইয়া লেখে, ইলা বলে মদ খাইয়া ড্রেইনো পইরা রইছে! আরে ইলা ত অহনও বাইচ্চা রইছে, তুই হেরে লইয়া কেমনে গল্প লেহছ! হে জীবিত মানুষরে গল্প বানাইয়া লাইছে, আর তোমরাও কিচ্ছু কও না!’

‘তোমারে বাল্টার বেনিয়ামিন এর একটা গল্প কই; ভুলেও কইলাম ওয়াল্টার বেঞ্জামিন কইয়ো না, রংফর্সাকারী গল্পলেখকের লাহান।’

‘হ, তোমার ত খালি পুটকিপুড়া আলাপ!’

‘বাল, ইলিগ্গাই তোমার এই দশা…’ দার্শনিক তার মহাজাগতিক আবরণ ছিঁড়া লোকাল ইমেজে প্রায় পড়ি পড়ি অবস্থা, কোনরকম সামলাইয়া নিয়া কন, ‘হুনো আগে… এই বাল্টার বেনিয়ামিন বা সংক্ষেপে বব গেছেন বেকেটের বাসাত; গিয়া দেহেন তার পড়ার রুমের দেয়ালে বড় কইরা লেখা ‘সত্য হইলো পাত্থর’ আর জানালার শিকের মইধ্যে একটা কাঠের গাধার খেলনা; বেকেট সেই খেলনা গাধার গলার মধ্যে একটা কাগজ ঝুলাইয়া রাখছে, লেখা “আমারও এইটা মাস্ট বুঝা লাগবো।” হি হি হি… কিরম সেয়ানা দেহ, হারামজাদা…’

‘এইডা ত আরেকটা গল্প-ই হইলো! তর লগে মদ থইয়া চা খাইতে বইছি কি তর বাতাপুরামির আলাপ হুনবার লাইগা!’

‘না হুইনা আর কি করবি, বিপদে যখন পড়চছ। সবতে আউগ আগে, আইলে পরে এইটা নিয়া ইম্পলিমেন্টেবল সলিউশনের দিকে যাওয়া যাইবো।’

‘কারে কারে কইচছ আইবার লাইগা?’

‘আইলেই দেখবি।’

তালের বড়া ভাজা হইছে। মিষ্টি খাজা আর রসগোল্লার পাশে রাখা আছে। কাঁচের আলমিরাটাতে। টিনের বড় বোলে। খাইবো কি খাইবো না, আবার পেট খারাপ করে কিনা, এই কথা ভাবতেছে দার্শনিক। যখন দুইজনই নিরব, তখন তৃতীয় একজনের দরকার পড়ে; তিনি কবি।

সবুজ স্পঞ্জের স্যান্ডেল পইরা চটাস চটাস শব্দ কইরা তিনি আসেন। চেকের শার্ট। একহাতা গুটানো। আরেকহাতা’র বোতাম লাগানো। ইন ছাড়া। খাকি প্যাণ্টের ওপর ঝুলতেছে। যেন তিনি দেখেন নাই; তারপরও কোন এক দৈব যোগাযোগের ফলে ওই টেবিলেই আইসা বসেন।

জগতের প্রতি ব্যাপক অনীহার পাশাপাশি অসম্মতিপ্রকাশপূর্বক তিনি শুরু করেন ‘তোমরা এহানো কেন বইছো? আনন্দের চাইতে কি অবকাশ ভালো?’ যেন নিজেরেই জিগান। উত্তরের প্রত্যাশা নাই, এই অভিমানের। দার্শনিক পাল্টা উদাস হন। মদখোরের পোলা, যিনি মদখোর, দাঁত কিড়মিড়ান।

কবি বলতে থাকেন,

আমার মইরা যাইতে ইচ্ছা করে
তাই আমি খালি চা আর সিগারেট খাই
ফলে ঘুম আসে না, আবার
কফিও খাইতে ইচ্ছা করে;
এইটারে যে অস্তিত্ববাদ কয়
তুমরা কি তার বালের জানো কিছু!

এই বাল কিন্তু হিন্দি, সূচাগ্র পরিমাণ জ্ঞান হইতে তোমরা তিরোহিত। অস্তিত্ববাদ নিয়া কিছুর জায়গায় লিচুও জানে না, অথচ এই সময়ে গল্প লিখছে। তবু তিনি ত সাহিত্যই করছেন; কিও, আমরা কি তারে এর জন্য মাফ করতে পারি না।’

মদখোর আর ধৈর্য্য ধইরা রাখতে পারেন না; তিনিও বলেন ‘এমনেই যায় না আবার, ত্যানা প্যাঁচায়! তর বাপরে লইয়া লেখলে পরে কইচ এই কথা। তহন আমি কবিতা চুদাইমু নে!’

‘অশ্লীল কথা বলাটা কি ঠিক? কিঅ, তুমি কিছু কও না!’

দার্শনিক তখন নিরবতা দিয়াই আরেকটা কিছু বলার চেষ্টা করেন। এতে দুই পক্ষই বিরক্ত হন। মদখোর এবং কবি। তখন এফেক্টিভ তৃতীয় পক্ষের দরকার পড়ে; যিনি বিকল্প শক্তি গড়ে তুলবেন। বিশেষ কইরা প্রতি পাঁচ বছর পর পর, নির্বাচনের আগে আগে। তিনি রাজনীতিবিদ, সোশ্যাল ওর্য়াকারও; এনজিওতে অথবা ব্যাংকে চাকরি করেন। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সাফল্য, কলেজে একবার জিএস ইলেকশন কইরা ফেইল করা।

পায়ে বেইল্টওলা চামড়ার স্যান্ডেল। আফজাল সুজ এর। ধূসর কালারের শার্ট, ইন করা; কালো রংয়ের প্যাণ্টের ভিতর। একলা আসতে চান নাই বইলা লগে দু্ইজনরে জোর কইরা আনছেন। একই বাড়ির লোক ওরা। ওরাও জিএস ইলেকশন করতে চায়! না পারলে অ্যাটলিস্ট সমাজ-কল্যাণ সম্পাদক। সদস্য পদে, কোনমতেই না।

উনি সরাসরি প্রসঙ্গে ঢুকেন। ‘প্রথম কথা, এইটা আম্লীগ বিনপি’র ব্যাপার না। ডাক্তার সাব’রে লাগবো; উনিই ত টাকাটা দিছেন স্মরণিকা ছাপাইবার লাইগা। অ্যাজ অ্যা ফাইনান্সার ওনার রেসপনসিবিলিটি সবার আগে। খালি টাকা দিয়া দায়িত্ব শেষ করলেই ত হইবো না। কী না কী ছাপাইতাছে এইটা দেখবো না! এহন স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় আছে বইলা আম্লীগের একজন প্রবীণ নেতা সর্ম্পকে লেখছে। পরেরবার আম্লীগ ক্ষমতায় আইলে বিনপি’র বাচ্চু চাচারে লইয়া লিখবো। আরে সমাজ বইলা ত একটা ব্যাপার আছে নাকি! সাহিত্য ত রাজনীতির উর্ধ্বে না। রাজনীতি করার পরিস্থিতি যদি না থাকে, সাহিত্য কই থিকা আইবো। তারপরে তার ফ্যামিলির অবস্থাটা দেখেন। বাপ ত ভালো মানুষ। কারো’র সাতে-পাচে নাই। ছোটভাইটা ত ভালোই গান গা…’

মানে, ছোট শহরেও রাজনৈতিক নেতা থাকেন। যিনি পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, কি করিতে হইবে? লেনিনও পড়ছেন।

সবাই মিইলা ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া হয়। রাজনৈতিক কর্মী দুইজনের একজনরে দায়িত্ব দেয়া হয় শিক্ষকরে নিয়া আসার এবং আরেকজনরে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রেসক্লাব থিকা সাংবাদিক সাব’রে নিয়া আসার।

চেম্বারে গিয়া দেখা যায়, উনি রোগী দেখতেছেন। রাত আটটা পর্যন্ত দেখবেন। ততক্ষণ উপরের রুমে বসতে রিকোয়েস্ট করা হয়। চা এবং পুরি পাঠানো হইতেছে। যে কোন অপেক্ষাই অনর্থক নয়। এইরকমের অনুসিদ্ধান্তসহ।

উপরে উইঠা দেখা গেলো, কৃষক সমিতির মাসিক মিটিং হইতেছে। মোজাইক করা ফ্লোরে, পাটিতে বইসা। থানা কমিটির সভাপতি, যিনি এমনিতে টেইলার্সের দোকান চালান, বলতেছেন, ‘বধূনগরের থিকা তিনজন কৃষক আসার কথা ছিল; হেরা কি আসছিলো? মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতার কথা না শু্ইনা আমাদের কর্মসূচী ঠিক করলে সেইটা সফল হবে না।…’ কিছুটা হয়তো বলার ছিল এবং কিছুটা হয়তো শোনানোর জন্যও আছিলো।

সবাইরে ঢুকতে দেইখা কইলেন, ‘বস, বস;… তোমরা বস। আমাদের মিটিং শেষের পর্যায়েই; সিদ্ধান্তগুলা লিইখা আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি করবো।’

চা পুরি খাইতে খাইতে কথা হইতে থাকলো। ‘যেটা হইছে, সেইটা অবশ্যই বাজে এবং পলিটিক্যালি এইটা ত কারো জন্যই ভালো না। ছেলেটা ভালো, কিন্তু কেন যে এই আকামটা করলো। নিজেরে বড় মনে করলে ত হবে না। বরং পার্টির জন্য ক্ষতি। ওরা ত একসময় পার্টিতেই আসবো। আর কই যাইবো।…’ কৃষক সমিতির সভাপতি বলতেছিলেন। শাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরা।

একটু সময় পরে একজন রাজনৈতিক কর্মী আইসা জানাইলেন, শিক্ষক আসতে পারবেন না; সামনে মেট্ট্রিক পরীক্ষা, সন্ধ্যার পরে আরেকটা একস্ট্রা বেইচ পড়ানো লাগতেছে। তবে সবাই যেইটা বলবে, তার সাথে উনার কোন দ্বিমত নাই। উনি সমাজের সমষ্টির পক্ষে; ব্যক্তির চাইতে সমাজই বড়। সমাজের স্বার্থ দেখতে হবে। এইরকম। যদিও অনেকেই বুঝতে পারলো, তিনিও যেহেতু একজন গল্পলেখক, ব্যাপারটারে তিনি এড়াইছেন। পরবর্তীতে, ঐতিহাসিকভাবে উনার সংশ্লিষ্টতা যেন প্রমাণযোগ্যভাবে না থাকতে পারে। এইটুকু জায়গা সমাজ ত ইগনোর করতেই পারে! করেও; নরমালি ছোটগল্প এইটুকু ফাঁকের মধ্যেই অপারেট করে, সমাজে।

সমাজের স্বার্থটা যে কী, সবাই তখন তা ভাবতে শুরু করেন। খুববেশি দূর পর্যন্ত ভাবা লাগে না কারণ সমষ্টি হিসাবে নিজেদের আস্থাটা নিয়াই সবাই খুশি হইতে থাকেন। ভাবনার আর দরকার পড়ে না। এইরকম অদরকরি টাইমে তখন ডাক্তার সাহেব আসেন। উনি সর্বদা হাসিসুখ, হাসিমুখ। স্লিম ফিগার উনার। যদিও রাস্তায় কমই হাঁটেন। কেউ উনারে রিকশা ছাড়া কখনো হাঁইটা বাইরে রোগী দেখতে দেখে নাই। মানে, এইটুক প্রেস্ট্রিজ উনার আছে।

আরেকজন রাজনৈতিক কর্মী আসেন; বলেন যে, সাংবাদিক সাব আসছেন। পরের রিকশাতেই। একটু পরেই হয়তো ঢুকবেন।

সাংবাদিক সাব প্রতিষ্ঠিত বাড়ির ছেলে। বিবিসির জন্য আতাউস সামাদ যেইরকম, ছোট শহরে তিনিও এইরকম বাহ্যিক, ছোট শহরে থাইকাই রাজধানী’রে রিপ্রেজেন্ট করেন এবং এর সাপেক্ষে ছোট শহররে দেখার মতো একটা স্পেসে নিয়া আসেন যে, এইটা ত আসলেই ছোট শহর, যদিও ইর্ম্পটেন্ট। স্বভাবতই উনি গম্ভীর, ইর্ম্পটেন্ট হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হিসাবে। প্রাথমিক আলাপের পরে বলেন যে, ‘এর ত একটা বিহিত করাই লাগবে। আমি আজকে সিরাইজ্যা পাগলার দরবারে যাইতেছি। আগামীকাল সকাল এগারোটার সময় প্রেসক্লাবে একটা মিটিং ডাকেন। এর সাথে জড়িত সবতেরে কইবেন; মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি’র ঢাকায় যাওয়ার কথা আগামীকাল, সেক্রেটারি যাতে মাস্ট থাকে। দক্ষিণ পাড়ার ঘটনা হইলেও উত্তর পাড়া’র বইশ্যা রাজাকারের গুষ্ঠির লোকও রাখতে হবে। লিল মিয়ার বাড়ির কাউরেও রাইখেন। নাইলে পরে হেরা ঝামেলা করবো।… গল্পলেখকরে মুরব্বী’র পাও ধইরা মাফ চাওন লাগবো।’ রায় উনি তখনই দিয়া দেন অবশ্য।

এইরকম একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিতর জমায়েতের শেষ হয়।

নিউমার্কেটের পাশেই প্রেসক্লাবের গলি। হর্কাস মার্কেটের পাশে। কাচারির বাইরের ঘরটা, এমনিতে। চারদিকে দেয়াল দেয়া, উপ্রে টিন।

তিনটা বসার টেবিল তিন কোণায়। তাস খেলার জন্যই বসে লোকজন, সন্ধ্যায়। এক কোণায় একটি টিভি। তার সামনে চারটা চেয়ার।

এখন জনা বিশেক লোক। হাতল ছাড়া ছোট কাঠের চেয়ারে গোল হয়া বসছেন, ঘরের মধ্যে। ইনটেন্স একটা অবস্থা। রায় ঘোষণার পর।

রায়ের সামারী মোটামুটি এইরকম –

স্মরণিকার সমস্ত কপি বাজার থিকা প্রত্যাহার কইরা নষ্ট কইরা ফেলতে হবে। কোনরূপ অনুলিপিও রাখা যাবে না। বলাকা ফটোষ্ট্যাটরে এইটা বইলা দিতে হবে। 

এরপরে এইরকম কোন স্মরণিকা করতে হইলে প্রেসক্লাবে সভাপতিরে সবগুলা লেখা দেখাইয়া নিতে হবে, ছাপানোর আগে। সভাপতি নূন্যতম দুই সপ্তাহের মধ্যে উনার মতামত জানাইবেন। 

বিজ্ঞপনদাতা এবং আর্থিক অনুদানপ্রদানকারীদেরও এই বিষয়ে সচেতন হইতে হবে। 

এই গল্পকার ভবিষ্যতে সমাজে এইরকম অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করবেন না এই মর্মে মুচলেকা দিতে হবে এবং একজন প্রবীণ নাগরিকের সম্মানহানির অপরাধে উনার কাছে মাফ চাইতে হবে

‘মাঙ্গির পুত, তুই আমার বাপের পাও ধইরা একঘণ্টা বইয়া থাকবি! শুয়োরের বাচ্চা…’ কানতে কানতে মদখোরের ছেলে, যে নিজেও মদখোর, ন্যায়বিচার পাইয়া উদ্বেলিত, সাধারণত বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে অস্থিরতায় যা ঘটে, গল্প-লেখকরে মারতে যায়। উপস্থিত জাগ্রত জনতা আইসা তারে বাঁধা দিক, এইটাও সে চায়; এই কারণে বলার পরেই সে মুভমেন্টটা শুরু করে; যেন বলা ও করা একইসাথে সম্ভব না। আশ্চর্যজনকভাবে (দার্শনিক ভাবে) জমায়েতও তার কর্তব্য বুঝতে পারে, তিন-চাইরজন উইঠা গিয়া তারে জড়াইয়া ধরে।

মদখোর বাবা পুত্রের এইরকম আবেগে একটু লজ্জাই পান। বলেন, ‘আরে হেরে ধরছ না তরা!’ আর অপেক্ষা করতে থাকেন কখোন গল্পকার আইসা তার পায়ে ধরবো। জীবনে মেম্বারি ইলেকশনটাও তিনি জিততে পারেন নাই, এই মদ খাওয়ার কারণেই হয়তো। ভাবতেছিলেন, যে কোন বিজয়ই অস্বস্তিকর, কারণ বিজয়ীর মতো আচরণ করতে হয়। আর তিনি তা পারতেছেন না। যতক্ষণ না পায়ে ধরতেছে, বিজয় ত ভিসিবল হইতেছে না। ‘মাফ কইরা দিছি’ বলা যাইতেছে না।

একটা সময় অপেক্ষার পরে গল্পকার হয়তো আইসা মাফ চায়া ফেলেন, তা না হইলে ঘটনাটা শেষ হওয়ার কথা না। কিন্ত যেহেতু উনি পরে আর কখনোই গল্প লেখেন নাই, ঘটনাটা কেউ আর মনেও রাখে নাই।

এরপর থিকা ছোট শহরে গল্প লিখা বন্ধ থাকে, অনেকদিন। সম্ভবত এই সময়টাতেই রণজিত দাশ কোন ছোট শহর ভিজিট কইরা থাকতে পারেন। হালকা রোমাণ্টিক গল্প লেখার ভিতর দিয়া এই গুমোট অবস্থাটা কাটে একটা সময়। যখন জীবনানন্দের কবিতার পরে উনার গল্প-উপন্যাস আবিষ্কার হয়, ব্যাপকভাবে। শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সিকদার আমিনুল হক, রবীন্দ্র গোপ’রা ভাবেন; বাপরে, তাইলে আবার দুই চাইরটা গল্পও লিখা লাগবে, কবি হইতে হইলে! রণজিত দাশও একটা উপন্যাস লিখেন। এইরকম।

বাঘের বাচ্চাটা বড় শহরে বইয়া ছোট শহরের লাইগা কান্দে। কিশোরী মেয়েটা ইন্ডিয়া চইলা যায়। ওরা পরস্পরকে চিঠি লিখে – আমরা আবার ছোট শহরে একদিন ঘুরতে যাবো!

সেই ঘুরতে যাওয়া আর হয় না কোনদিন; বরং স্মার্ট মোবাইল ফোনের পর্দায় এই গল্পটা পড়তে পড়তে এক ধরণের বিস্বাদ ধরণের বিষাদ আসে মনে; কেউ কেউ কবি, কিন্তু সকলেই গল্পকার তাইলে!

ছোট শহরের কেউ কেউ তখন লেখকের পারসোনাল ব্লগে  ছাপানোর পরেও এই গল্পটা পড়ে।

 

আশ্বিন-কার্তিক, ১৪২০।

 

Leave a Reply