দুর্গতিনাশিনী

ফটো: আনিকা শাহ
———————–

ব্যাপারটা স্ট্রাইক করলো এটিএম-এ টাকা তুলতে গিয়া; টাকা থাকার কথা ছিল, টাকা ত নাই; কিন্তু আগে থিকা কোনো আওয়াজ দেয় নাই; মেশিন ত কয় আগে, যে ভাই আপনের ত টাকা নাই, বাটন টিপেন কেন খালি, চাইলে হিসাবের কাগজ নিয়া যান। অথচ সে কিছু না কইয়া কাগজ বাইর কইরা দিলো। কাগজ পইড়াও কিছু বোঝা যায় না; কোনো হিসাব নাই, খালি একটা লাইন, তাও মিনিংলেস, কোনো অর্থ নাই। গাণিতিক কিছু একটা লেখা, নাম্বার সাইন ইত্যাদি দিয়া। তখনই মনে হইলো, কোনো একটা গণ্ডগোল আছে এইখানে; খালি এইখানেই না অন্যান্য জায়গাগুলাতেও; যার ভিতর দিয়া এইটা ইনিশিয়েটেড হইছে। এইটাই শেষ না, মাত্র শুরু হইলো দিন। তখনো সকাল। দশটা বাজে নাই। অফিস-টাইম শুরু হয় নাই। ওহ্, অফিসে ত যাইতে হবে তাইলে।

ফেইসবুকে যেইরকম একটা ইস্যু শেষ না হইতেই আরেকটা ইস্যু চইলা আসে; ছবির হাট বন্ধের লাইগা স্ট্যাটাস দিতে না দিতেই স্পেনের পাঁচ গোল খাওয়া, তারপরে কালশীতে বিহারী পুড়াইয়া মারা, ওগো মোর জাতীয়তাবাদ, ওরা কি মানুষ না! শেষ না হইতেই মানুষ সরদার ফজলুল করিম মরলেন, যিনি নিটশে’রে সুপার-হিউম্যান ধারণার লাইগা হিটলারের বাপ ভাবছিলেন; সেইটা পার হইতে না হইতেই ইন্ডিয়ার সেকেন্ড ক্লাস টিমের সাথে বাংলাদেশ ওয়ানডে ম্যাচ হারলো, সন্ধ্যা ও বৃষ্টি একসাথে এবং পহেলা আষাঢ়ের প্যান প্যান; আর্জেন্টিনা’র খেলা… এইরকম দুর্গতিগুলা আসতেই থাকবো একটার পরে একটা। এইরকম মনে হইলো, ঘটনাটা।

গুলশান দুই নাম্বার থিকা এক নাম্বারে যাইতে হবে। তারপর ওইখান থিকা অফিসে। মেইন রোডে ত রিকশা চলে না। মাঝে মাঝে চলতে পারে কিছু, উল্টা দিক থিকা একটা রিকশা আসতেছিল; মাঝখানের ডিভাইডারের ফাঁক দিয়া ডানপাশে চইলা যাইতেছে; বেশ একটু সামনে, অফিসের ড্রেস-পরা অবস্থায় রামপুরা বাজারে যাওয়ার সময়ের ডাক দিলাম; রিকশাওলাও চমকাইলো মনে হয়, গুলশানে তারে ত কেউ অমোন করে ডাকে না! কে এই বাদ্দাইম্মা! দেইখা সে ড্রেসের সাথে আওয়াজ মিলাইতে পারে না; কনফিউজড হয়; কিন্তু সে চলেই যেতে থাকে তার ঘোর-লাগা কাব্যিক বাস্তবতার আরো ভিত্রে; আমার একমাত্র সম্ভাবনা, আরো দূরে…

রিকশা ত পাওয়াই যাবে। গলিতে ঢুকতে হইবো আর কি, ওয়েস্টিনের। কিন্তু আমি কেন অফিসে যাবো? আসলে ত অফিস নাই, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাইতেছি। চাকরি খুঁজতে আর ইচ্ছা করে না। এইটাই টাইনা-টুইনা চালায়া যাই, বাল। কনফিডেন্স নিয়া বইসা থাকতে ভাল্লাগে না। এতসব ইল্যুশনরে ধামাচাপা দিয়া কদ্দূর যাবো আমি? আমি ত জানি না। আর জানা-বোঝা’র দুনিয়া খুবই আজাইরা লাগে এবং এইসব আজাইরা-আজাইরা ভাবা’র ভিতর দিয়া আমি যে কাব্য-ভাব’টা ধইরা রাখতে পারি, ঠাকুর বা ফকিরও সেইটা পারতো কিনা সন্দেহ। তাইলে কেন আমি কনফিডেন্ট হইবো, বাউন্ডারির বাইরে গিয়া এমন প্রশ্ন কেন জিগাইবো না যাতে এমন একটা জায়গা এচিভ করতে পারি যে, আমি জানি না; এইবার তোমরাই বলো। অথচ সেইটা আর হয় না। অথরিটি হয়া উঠার চাইতে অথরিটিরে ভাইঙা দিতেই ত যত আনন্দ এবং যে কোনো ইন্টারভিউ’র উত্তর আসলে প্রশ্নকারীরে সন্তুষ্ট করাই শেষ পর্যন্ত, প্রশ্নটা কী চাইতেছে সেইটারে গেইস করতে পারার পলিটিক্যাল ঘটনাই। সো, হাউ কুড আই আনসার দ্যাট? অথরিটিরে ত প্রশ্ন করা যায় না, বাতিল-ই করা যায়। আর সেইটা করতে গেলে বাস্তিলে স্যাড হয়া পইড়া থাকতে হবে, মরা’র আগ পর্যন্ত।

মরা’র ঘটনাটা আসলে ঘটে খুব ধীরে ধীরে। সেইরকম ধীর-প্রবণ অসুখ শুরু হইছে। ইন্টারভিউ দিতে না গিয়া সুমনের কাছে গেলাম। সুমন কয়, তর যে দাঁতে ব্যথা, ওইটা ত আর আগে কছ নাই! ওরে একটু চিন্তিত মনে হইলো। আমিও চিন্তায় পড়লাম। দাঁতে ব্যথা নিয়া আমি সুমনের কাছে কেন আসছি? ও ত মেডিসিনের ডাক্তার। আমার ত যাওয়ার কথা মাসুদের কাছে, ডেন্টিস্ট, ঝিগাতলায়। খালি ভাবি যে যামু; যাই না আর। সুমন কইলো, তুই ব, আমি একটু আইতাছি। দেখি, একটা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় বইসা ছিলাম আমরা। গ্লাসের দরজা দিয়া বাইরেটা দেখা যায়। আমি সুমন হয়া পাশের বিল্ডিংয়ে যাই আর সাথে সাথেই নাইমা আসি এক মঙ্গোলয়েড বুড়ার সাথে কথা কইতে কইতে। ওই ব্যাটা মনে হয় আরো বড় ডাক্তার, প্রফেসার অথবা কনফুসিয়াস। ওর সাথে আরো সঙ্গ-পাঙ্গ, লোকজন। এর মধ্যে কনফুসিয়াস সুমনের সাথেই কথা কয়। কিছুক্ষণ পরে, কনফুসিয়াস টয়োটার একটা সেডানে কইরা চইলা যায়। সুমন আবার ঢুকলে সুমন হয়া যায়। আমি কই, কি রে কী কইলো? সুমন কনফিডেন্ট থাকার চেষ্টা করে ওর কনফিউশনগুলা নিয়া। কয়, এই ঔষুধ খাইবি, ওইটা খাইবি না; এইরকম। কিন্তু মরা নিয়া কিছু কয় না। মরতে হইলে ত পিজি, সোহরাওয়ার্দী ইত্যাদিতে যাইতে হইবো, খালি ওর চেম্বারে গেলে হইবো নাকি, আমি ভাবি। আর টাকা থাকলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, এটলিস্ট ইন্ডিয়া। আমার সব চেত গিয়া পড়লো, সুমনের উপ্রে। সুমন হইলো অমনোযোগী ডাক্তার। ও রিসার্চ-টিসার্চ করলে ঠিক আছিলো। প্র্যাকটিসেও ঠিক আছে; কিন্তু বন্ধুদের কাছে আসলেই অমনোযোগী হয়া যাই; ডাক্তারি গাম্ভীর্য আর রাখতে পারি না। ডাক্তারি পেশাতে গাম্ভীর্য ইজ ভেরি মাচ রিকোয়ার্ড; যে যত বড় গাম্ভীর্য, সে তত বড় ডাক্তার। আমার আর ভাল্লাগে না।

আমি চাই অন্য কোথাও চইলা যাইতে। অন্য কোনো দুনিয়ায়। মাইগ্রেট করতে পারলেও ত হয়। কানাডায়। ওইখানে জীবন নাকি আরো কঠিন। বরফ এবং শীত। আমি ভাবি এস্কেইপের কথা; পরে আবার একটু এডিট করি, শীত না হয়তো, কোনো হেমন্তে। কিন্তু সেইখানে, দশকে দশকে কবিরা আকুল, তারা পাতা হয়া পাতা-ঝরাদের কবিতা লেখে:

 

ত্রিভুবনে কেউ আর নাই/সাময়িক হয়া ঝুলতেছে/গাছে গাছে সবাই

যে যে পাতা ঝরে যায়/তা তা দেইখা হাসে/যে যে পাতা ঝরে নাই

কিছু কিছু পাতা/এইরকমও ভাবে,/চুদাচুদি-ছাড়া পাতারা কেমনে জন্মাই?

 

কবিতাতেও বিরক্তি আসে। এখন হইলো কবিদের গদ্য লিখার টাইম, বুঝলা? কবিতা আর লিখতে না পাইরা আল মাহমুদ সাজেশন দেন। উনি কবিতার সাথে গল্পরে মিলাইতে না পাইরা, কবিদের গল্পকার বানাইতে চাইছেন। ওই ট্রাডিশ্যানরে ডিঙাইতে হইবো একটু একটু মাইনা না-মানার ভিতর দিয়া, নাইলে তুমি কিয়ের ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্ট! এই টান্ডলামি নিয়া সমাজবিজ্ঞানী সেরের উপ্রে সোয়া সের জোড়া দেন; জীবনে যেই যেই কাজকাম করেন, সেই সেই কাজকাম নিয়া গল্প-কবিতা-সাহিত্য লিখেন না কেন আপনারা? হাগা-মুতা বাদ দিয়া একটা দিন কি পার করছেন আপনে, অথচ আপনার কবিতায় বা গল্পে হাগা-মুতা’র স্থান কোথায়? উল্লেখই নাই! খাওয়া-খাদ্য রান্ধনের কথা না হয় বাদই রাখলাম। এটলিস্ট করলা ভাজি নিয়াও একটা গল্প কি লিখতে পারতেন না আপনারা! এইরকম রিয়ালিটি বাদ দিয়া সাহিত্য করলে কেমনে হবে, বলেন? একটা তক্ষক থাকতে থাকে তখন, আইবিএ’র গ্যারাজে। আপনে যেমনে ডাকবেন, সেও একইভাবে ডাকতে থাকবে, যতবার আপনি ডাকবেন; মইরা গেলেও সে তার ডাক থামাইতে পারবে না, যদি আপনি না থামেন। রিপিটেশন ইজ লাইফ। তুমি হেমন্তের কাছে গিয়া কী করবা, হেমন্তই বারবার আসতে থাকবো। তুমি খালি চোখ বন্ধ কইরা চায়া থাকো! আর তখনই দেখি একটা পরিষ্কার পাত্র তার পানি-জল খাইতে শুরু করছে আবার। অল্প-বয়সের কবি বেশি-বয়সের মহত্ব আবিষ্কার করতে থাকেন। বেশি বয়সের কবি তব্দা মাইরা বইসা থাকেন। তাই তো, তাইতো চিবাইতে থাকেন। প্রতিবছর হেমন্তে, পাবলিক লাইব্রেরিতে তিনি ঝরিয়া পড়েন, বইমেলা আসতে না আসতেই। উনাদের হাসি হাসি রাশি রাশি কথার ভিতর মধু জমতে থাকে, সুন্দরবনের।

অল্প-বয়সের ম্যাচুরিটি আর বেশি-বয়সের নাদানিতে ভাসতে ভাসতে আমি চইলা আসি আবার, ভেজাল-দুনিয়ায়, ফরমালিনের। আইসা পড়ি, শি’র সামনে। উহারে আমি বলি, আমার বেদনারে তুমি দশ হাত দিয়া সামলাও! সে খালি উপচাইয়া পইড়া যাইতে চায়। সে দেখে, এইসব আজাইরা কথার কিছুই শুনে না। তারপরে কনভারসেশন হয়।

 

হেঁটেই নামলেন?

হ্যাঁ। লিফটে নামতে গেলেও একই সময় লাগে। হাঁটাটাই বেটার।

হুম। নামা যায়, কিন্তু ওঠা যায় না।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, উঠতে গেলে সমস্যা হয়।

পাঁচতলা পর্যন্ত পারা যায়।

হ্যাঁ, পাঁচতলা পর্যন্ত ম্যাক্সিমাম। এর পরে উঠতে গেলে, হার্ট ধুঁকফুঁক করে।

ধুঁকফুঁক শব্দটাতে কনভারসেশন আটকাইয়া যায়। আমার হার্ট কি পাঁচ থিকা ছয়তলা পর্যন্ত যাইতে পারবে না আর?

অসুখ নিয়া চিন্তাটা হয়তো ফিরা আসবে এখন। নাকি এটিএমে গিয়াই আবার ট্রাই কইরা দেখবো? পায়রা নদীতে তখন, বরিশালে, কি যে ঢেউ, এর উপ্রে আবার বৃষ্টি। স্বরূপকাঠিতে, সন্ধ্যা নদীর খালে গিয়া মনে হয় যেন তামিলনাডুতে আসছি, ঘুরতে। বর্ষাটা কোনোরকম পার করতে পারলেই হয়, আল্লা বাঁচাইলে কোথাও দুর্গা আসিতেছেন নিশ্চয়ই। দুর্গতিনাশিনী।

 

 

 

জুন, ২০১৪।

Leave a Reply