ন্যাড়া ও নিউটন

 

ন্যাড়া ও নিউটন (সেলিম রেজা নিউটন না, আইজ্যাক নিউটন) এর কাহিনিটা আজকে আবার বলার ইচ্ছা হইলো। এমন কিছুই না আজ। পবিত্র আশুরা’র পরের দিন। মনের মধ্যে এখনো হায় হোসেন! হায় হোসেন! এমনও হইতে পারে যে, সেই বেদনার সঙ্গী হইতে চায় এই কাহিনি। যা-ই হোক, সেইটা ভিন্ন আলোচনা…

পৃথিবীর পাশাপাশি দুইটা গ্রামে তারা থাকতো, ন্যাড়া ও নিউটন। পৃথিবী ত তখনো গ্রাম, শহর-পর্যায়ে পৌঁছায় নাই। ন্যাড়ার গ্রামে ছিল বেলগাছ। আর নিউটনের গ্রামে ছিল আপেলগাছ। ফল হিসাবে বেল অনেক বড় এবং শক্ত; এইরকমের একটা জাগতিক ভাবনা ছিল ন্যাড়ার মনে। আর আপেল হইতাছে বেহেশতী ফল; এইরকমটা ভাবতো, নিউটনে।

দুইজনেই বেলগাছতলায় এবং আপেলগাছতলায় বসতো, সময় পাইলে। নানান জাগতিক এবং বেহেশতী ভাবনা ভাবতো। তাদের ভাবনা শুইনা বেল ভাবতো, আমারে আরো বড় হইতে হইবো, আরো শক্ত! আপেল ভাবতো, বেহেশতী-ফলে থাকে না কি আরো সুগন্ধ!

ভাবতে ভাবতে ঝিমানি আসতো, ন্যাড়া ও নিউটন, উভয়েরই। ঝিমানি কাটলে ন্যাড়া যাইতো ক্ষেত নিড়াইতে, নিউটন দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটতে। কিন্তু তাদের মন ও ভাবনা ছিল বেলগাছতলায় এবং আপেলগাছতলায়, যথাক্রমে।

তারপর একদিন সেই ঘটনাটা ঘটলো!

ন্যাড়া বিকালবেলা ক্ষেত নিড়ানির কাম সাইরা বেলতলা দিয়া বাড়ি যাইতেছিল। ভাবতেছিল যে, বেলতলায় বসবো কি বসবো না; এমন সময় একটা কাক কা কা কইরা উঠলো; ন্যাড়া কইলো, ‘ব্যাটা, বেল পাকছে ত তোর কি?’ আর এমনই সময়, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, একটি অথবা একটা বেল পইড়া গেল, হয়তো বা কাকেরই চেঁচামেচিতে আর সেইটা মালিরই ঘাড়ে, মানে ন্যাড়ার মাথাতে… ন্যাড়া ত বেঁহুশ…

একটু পরেই তার হুঁশ ফিরলো; মাথার ফোলাটাতে হাত দিয়া সে কইলো, ‘এইটা কি হইলো!’ যেহেতু তার শরীর জড়িত, সে সরাসরি ঘটনার ভিতর ঢুইকা পড়লো; ভাবলো, কাক কি দিব্যজ্ঞানী? নাকি সে কাক না, জ্বীন ছিল? বেল কি আসলেই বাস্তবিক কোন ফল? নাকি তার বীজ নরক থিকা আগত? এইসবসকিছু …

একই সময়ে, মানে সেইম টাইম না হইলেও, পাশাপাশি কোন একটা সময়ে (যেহেতু সময় ভার্টিকাল না, হরাইজেন্টালও) নিউটন দলিল-দস্তাবেজ নিয়া আর না পাইরা আপেলগাছতলায় গেলো; যা হয়, একটু পরেই সে ঝিমাইতে লাগলো; ঝিমানোর মধ্যেই চোখের কোনা দিয়া আবছাভাবে দেখলো যে, একটি অথবা একটা আপেল টুপ কইরা পইড়া গেলো… সে আবারো ঝিমাইতে লাগলো… একটু পরে যখন ঝিমানি শেষ হইলো, তখন সে দেখলো যে, একটি বা একটা নয়, একখানা আপেল পইড়া আছে…

বেহেশতের আপেল ছিল গাছে, মাটিতে কেমনে আসলো সে!

নিউটন ভাবলো, কিসের টানে বেহেশতের জিনিসপত্র টুপ টুপ কইরা পড়ে মাটিতে? যেহেতু তার শরীরের উপর আপেল পড়ে নাই, সে নিজেরে ঘটনা থিকা বিযুক্ত কইরা নিলো, ঘটনার ভার চাপাইলো তার ভাবনার উপর, তার দলিল-দস্তাবেজের পাঠের উপর।

ঘটনা যা-ই হোক, তারপর থিকা ন্যাড়া বেল খাওয়া ছাইড়া দিলো, প্রচার করতে লাগলো যে, বেল সম্ভবত নরকের কোন ফল; এইটাতে কোন আনন্দ নাই, এইটার প্রাচীর অনেক শক্ত এবং ফলটা অযথাই অনেক বড়… যেহেতু তার বাস্তবিক অভিজ্ঞতা ছিল এই বিষয়ে, তার সম্ভাবনা’রে সবাই প্রামাণ্য হিসাবে মাইনা নিতে শুরু করলো; তবে কিছু লোক ত সবসময়ই থাকে, যারা মানে না, ফলে বেল বিলুপ্ত হয় নাই, একটা মাইনর ফল হিসাবে সে তার অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখে, গ্রাম ও গ্রামান্তরে।

আর নিউটন প্রচার করতে লাগলো যে, আপেল ফলটা আসলেই বেহেশতী; এইটা এতো আলতোভাবে টুপ কইরা পড়ে যে, আপনি টেরও পাইবেন না, ঘুমের ভিতরে স্বপ্নের মতো সে; এর স্কিন খুবই মসৃণ, মাংসল বডি, কোন চর্বি নাই আর কতোই না চিন্তা জাগাইতে সক্ষম সে… ফলে একখানা আপেল থিকা আরো অনেক আপেলগাছ হইলো, অনেক আপেলগাছ থিকা আপেলবন গইড়া উঠলো, গ্রাম ও গ্রামান্তরে।

 

এই ঘটনার বহু বহু দিন পর…

একদিন ন্যাড়ার নাতনির নাতনির সাথে নিউটনের নাতনির নাতনির দেখা। যেহেতু পৃথিবী গোল, যেহেতু মানুষ মাইগ্রেশনপ্রিয়, যেহেতু এইসবকিছুই (মানে, ঘটনা মানেই তো র‌্যাশানালিটির চাষাবাস)।

উনারা একটা পার্কে বইসা ছিলেন, বেঞ্চিতে, পাশাপাশি (সময়েরই মতো)। ন্যাড়ার নাতনির নাতনি নিউটনের নাতনির নাতিনরে জিগাইলো, ‘তুমি কি খাও?’

‘বেলের জুস খাই। তুমি খাইতে চাও? আমার ব্যাগে আরো ২/৩টা আছে। বেলের জুস আমার খুব প্রিয়…’

‘না, আমি ত আপেল খাই। আমার ব্যাগে সবসময় আপেল থাকে…’

‘ও, তুমি জানো, আমার পূর্বপুরুষদের আপেলের বাগান ছিল…’

‘তাই নাকি, আমার পূর্বপুরুষদের গ্রামেও নাকি অনেক বেল গাছ ছিল…’

‘কও কি, তাইলে তোমার বেল আমি খাইতেছি, আর তুমি আমরার আপেল খাও! ওএমজি!!…’

এই কথার পরে দুইজনেই হাসতে লাগলো। তারপর ন্যাড়ার নাতনির নাতনি কইলো, ‘কিন্তু আমার ধারণা, আমার পূর্বপুরুষরা কোনদিন আপেল খায় নাই এবং তোমার পূর্বপুরুষরাও হয়তো কোনদিন বেল খায় নাই…’

নিউটনের নাতনির নাতনি চিন্তায় পইড়া গেলো, কইলো, ‘হ্যাঁ, হয়তো বেল না, বেলের মতো অন্য কোন ফল খাইয়া থাকতে পারে…’

ন্যাড়ার নাতনির নাতনি কইলো, ‘হ্যাঁ, হয়তো আপেল নয়, আপেলের মতো অন্য কোন ফল, হয়তোবা নাশপাতি খাইয়া থাকতে পারে…’

তারপর নানান কথায় দুইজনেই একমত হইলো যে, খাওয়া-দাওয়া বড় কোন ব্যাপার না।

 

এই ঘটনারও বহু বহু দিন পর…

ন্যাড়ার নাতনির নাতনির নাতি আপেলগাছ তলায় বইসা ছিল, ঝিমাইতেছিল। তখন টুপ কইরা একটা আপেল পড়লো…

নিউটনের নাতনির নাতনির নাতি বেলগাছ তলা দিয়া যাইতেছিল। তখন একখানা বেল তার মাথায় পড়লো…

 

 

Leave a Reply