ফিকশন: মুজিবর্ষের গল্প

[ভাবতেছি, এই বছরে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে লোকমুখে চালু থাকা কিছু কাহিনি বা মিথ কম্পাইল করবো। মুশকিল হইলো, এইগুলারে ‘গুজব’ বইলা আইডেন্টিফাই করলে বিপদে পইড়া যাবো আর কি! 🙁

ফিকশন বলা’টা মেবি বেটার। 🙂

মানে, কোন অথেনটিসিটির ক্লেইম এইখানে নাই। শুনছি, বা লোকজন বলাবলি করে – এইরকম জিনিস, মোস্টলি।]

~ ২০ টাকা কেমনে ১০ টাকা হইলো? ~

স্বাধীনতার পরের ঘটনা, ১৯৭২ সালের দিকের কথা।

বাংলাদেশের অনেক মানুশের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান খালি দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী না, খুবই আপন-জন, নিজের আত্মীয়-স্বজনের মতন। তখনকার দিনে, মানুশ তার আপনজন, আত্মীয়স্বজনদের জন্য ফিল করতো অনেক, ফিল করাটারে ভিজিবল করতে চাইতো, ভালো-মন্দ কিছু দিতে চাইতো। (এখনো আছে তো কিছু, এই অভ্যাস।)

তো, মৈমনসিংহের এক সব্জি-চাষি’র ক্ষেতে অনেক সব্জি হইলো আর সে শেখ মুজিবের খুব ভক্ত ছিল। তার মনে হইলো, শেখ মুজিব’রে এই ভালো সব্জিগুলা দেয়া দরকার, আর এই উছিলায় উনার লগে দেখাও করা হইলো! এই ভাইবা, একদিন ভোরবেলা, বউ-বাচ্চার কাছ থিকা বিদায় নিয়া, একটা খাঁচিতে অনেকগুলা টাটকা সব্জি মাথায় নিয়া, ট্রেনে সে ঢাকার দিকে রওনা দিলো। সবাইরে কইলো, “শেখ মুজিবের লগে দেখা করতে যাইতেছি! উনার লাইগা আমার খেতের সব্জি নিয়া যাইতেছি!”

সকালবেলা আইসা সে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে পৌঁছাইল। কিন্তু বাড়ির ভিতরে তো আর ঢুকতে পারে না, গার্ড আটকায়া দিছে। শেখ মুজিব তো আর খালি শেখ মুজিব না, দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টারও তো তখন।

কিন্তু দেশের সিকিউরিটি এখনকার মতন এতো কড়া ছিল না। বাড়ির সামনে খাঁচি-ভর্তি সব্জি নিয়া বইসা থাকতে দেইখা একজন তারে জিগাইলো, কি করতেছে সে এইখানে বইসা? তখন সে কইলো, মৈমনসিংহ থিকা শেখ মুজিবের লাইগা ভালোবাইসা খেতের সব্জি নিয়া আসছে সে; যদি শেখ মুজিব তার খেতের সব্জি একটু তরকারি রাইন্ধা খান, তাইলে তার জীবনে আর কোন চাওয়া-পাওয়া থাকবো না।

অই লোক, আওয়ামী লীগেরই কেউ, শেখ মুজিবের বাসায় নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন, গার্ড’রে বইলা দিলেন, যাইতে দিতে। দেশের মানুশ যদি শেখ মুজিবের লগে দেখা করতে না পারে, তাইলে কে করবে!

মৈমনসিংহের সব্জি-চাষি তো খুশির চোটে দৌড়ায়া দুইতলায় উইঠা গেল। বসার রুমে গিয়া বসল, সব্জি’র খাঁচি নিয়া।

শেখ মুজিব তখন গোসল-টোসল কইরা বাইর হইছেন। পায়জামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পইরা বসার ঘরে আসছেন। শেখ মুজিবরে দেইখা সব্জি-চাষি তো পায়ে গিয়া পড়ল! তার স্বপ্নের মানুশটারে সে তার চোখের সামনে দেখতেছে! শেখ মুজিব সব্জি’র খাঁচি দেইখা কইলো, “এইগুলা কি আনছোছ?” সব্জি-চাষি কইল, “ভাই, আমার খেতের লাউ, কুমড়া। আপনার লাইগা আনছি। আপনি যদি রাইন্ধা খান, আমার জীবনটা ধন্য হয়।”

মুজিব তখন তারে তার খোঁজ-খবর জিগাইলেন, বউ-বাচ্চার খবর নিলেন, সব্জির দাম কেমন জানলেন। তারপরে জিগাইলেন, “মৈমনসিংহ থিকা তুই যে ঢাকা আইলি, টাকা-পয়সা কই পাইলি? ট্রেনে টিটি ধরে নাই তোরে?” সব্জি-চাষি তখন হাইসা কইলো, “সবাইরে কইছি, আপনার লগে দেখা করতে যাইতেছি, তখন ছাইড়া দিছে।”

মুজিব তখন ভিতরের ঘরে গেলেন। ফিরা আইসা তারে ২২ টাকা হাতে দিলেন। কইলেন, “এই ধর, ২০ টাকা হইতেছে তোর সব্জি’র দাম। আর ১টাকা যাওয়ার সময় রেলওয়ে’র জরিমানার বাক্সে দিয়া যাবি, আর ১টাকা ভাড়া দিয়া যাবি। আমার নাম নিয়া যদি সরকারের টাকা ফাঁকি দেস, তাইলে আমার মান-সম্মান কই থাকে?”

সব্জি-চাষি বুঝলো, সে যে অন্যায় করছে। সে ২টাকা নিলো মুজিবের কাছ থিকা, কিন্তু কইলো, “ভাই, সব্জি’র টাকা তো আমি নিতে পারমু না! আমি তো আপনার লাইগা ভালোবাইসা নিয়া আসছি, এখন যদি আপনার কাছ থিকা টাকা নেই, বাড়িতে গিয়া বউ-বাচ্চারে কি কমু? অরা তো এই টাকা নিবো না ভাই। আপনে আমারে মাফ কইরা দেন!” মুজিব জোর কইরা তার হাতে টাকা দিয়া কইলেন, “কইবি, আমি দিছি! যা এখন! আমারে কাজকাম করতে দে।”

মনে না মানলেও টাকা’টা সে নিলো, শেখ মুজিবের মুখের উপ্রে সে কেমনে কথা বলবে!

সিঁড়ি দিয়া নামার সময়, যেই লোক তারে বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থা কইরা দিছিলো, তার লগে দেখা। চাষি তারে থ্যাংকস-ট্যাংকস দিলো, কইলো, মুজিব ভাই তারে ২০ টাকা দিছে, সে নিতে চায় নাই… এই সেই। (গ্রামের লোক যেমন হয়, আমার মতো, একটু বেশি কথা বলে আর কি!) তখন আওয়ামীলীগের লিডার কইলেন, ২০ টাকা কই, দেখি? আমি যে তোমারে দেখা করায়া দিছি, সেইটার ফি দিবা না? বইলা তার কাছ থিকা ১০ টাকা নিয়া নিল। সব্জি-চাষিও দিয়া দিলো। টাকা নিয়া সে করবো! সে তো টাকা নিতেই চায় নাই!

কিছু দূর যাওয়ার পরে তার মনে হইলো, টাকা নেয়াটা তার ঠিক হয় নাই। বউ-বাচ্চারে যদি বলে, শেখ মুজিবের কাছ থিকা টাকা নিছে, অরাও তো জিগাইবো, উনার কাছ থিকা তুমি টাকা কেমনে নিলা! না, টাকা’টা ফেরত দেয়া দরকার।

তো, সে আবার ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে গেল।

আগেরবার যেহেতু গেছে, গার্ড আর তারে আটকাইলো না। সে সরাসরি দোতালায় উইঠা গেল। গিয়া শেখ মুজিবের পায়ে পইড়া গেল, “ভাই, এই টাকা আমি নিতে পারমু না! আপনি আমারে মাফ কইরা দেন!…” শেখ মুজিব কইলেন, “ঠিকাছে।” তখন সব্জি-চাষি উনার হাতে ১০ দিল।

শেখ মুজিব কইলেন, “কি রে, তুই আমার কাছ থিকা নিলি ২০ টাকা, ১০ টাকা ফেরত দিতেছোস ক্যান! ২০ টাকা কেমনে ১০ টাকা হইলো?”

সব্জি-চাষি তখন উনারে কাহিনি’টা কইলো। গ্রামের মানুশ যেহেতু, অনেক ইনায়া-বিনায়াই কইলো, আমার মতো। 🙂

শুইনা শেখ মুজিব কইলেন, “আমার বাসার সিঁড়ি দিয়া নামতে নামতেই যদি ২০ টাকা ১০ টাকা হয়া যায়, সারা দেশের তাইলে কি অবস্থা!”

Leave a Reply