মোহাম্মদ আজমের ‘বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার’ বই নিয়া আলাপ

(২০১৯ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর এই আলাপটা করা হইছিল।)

মোহাম্মদ আজমের বইটা আমি কিনছিলাম ফেব্রুয়ারি মাসে যখন পাবলিশড হয়। তারপরে বইটা আসলে খুব বেশি দূর পড়া হয় নাই। ভূমিকাটা আমি একটা নাড়াচাড়া করছিলাম। তো, একটা বইয়ের ভূমিকার জায়গা দেখলে তো আসলে বুঝা যায় কোন জায়গা থিকা উনি কথাগুলা বলতেছেন। তো, ভূমিকাটা পইড়া আমি আসলে খুব বেশি আগ্রহী হই নাই বইটার ব্যাপারে। এখন এইটা নিয়া যেহেতু কথা বলতে হবে তখন মনে হইছে বইটা একটু পড়া দরকার। তখন বইটা একটু ব্রাউজ করছি। ব্রাউজ করতে গিয়া যেই কয়টা জিনিস মনে হইছে, সেইগুলা নিয়াই বলি।

মোহাম্মদ আজম তো বেটার বলতে পারবেন উনি কি বলতে চাইছেন, কোন জায়গা থিকা বলতে চাইছেন। কিন্তু আমি আমার রিডিংটাই বলতে চাইতেছি। আমার মনে হইছে, উনি ব্যাকরণের কথা বলছেন যে, বাংলা ভাষার একটা নিজস্ব ব্যাকরণ দরকার। এখন যে ব্যাকরণ আছে সেইটা আসলে অনেকটাই সংস্কৃত বেইজড। আর এই কথাগুলা যে উনি নতুন বলতেছেন – তা না, শ্যামাচরণ গাঙ্গুলি বলছেন, রবীন্দ্রনাথ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীরাও বলছেন। ব্যাকরণটা কেন দরকার? কারণ স্কুল-কলেজে পড়াইতে হয়, রাষ্ট্র চালাইতে হয়, আইন-আদালত চালাইতে হয়। তো, এইগুলা করতে গেলে একটা মান-ভাষা দরকার। এইগুলা হইতেছে উনার কথা। তো, মানভাষাটা কেমনে হবে? মানভাষাটা হবে এক ধরণের গণতন্ত্রায়ণের মধ্যে দিয়া। বেশিরভাগ মানুশ যেই ভাষা ইউজ করে, যেইভাবে ইউজ করে – সেইটার বেসিসে হইতে হবে।…

তো, এইসব জায়গা নিয়া বিতর্কের স্পেইসটা অনেক কম। বিতর্কের স্পেইসটা হইতেছে আসলে কে কোন জায়গা থিকা দেখতেছি। যেমন ধরেন, একজন বলতেছিলেন গণতন্ত্র মানে হইতেছে বেশিরভাগ মানুশ যেইভাবে কথা বলে। তো, আমার কাছে মনেহয় যে, পারসপেক্টিভগুলা হইতেছে ঝামেলার, যে, কোন জায়গা থিকা দেখতেছি। তো, গণতন্ত্র মানে এইটা না যে বেশিরভাগ মানুশের জিনিস। যেমন এইখানে আমরা একশজনের মতো লোক আছি, এখন একশজনের মধ্যে সত্তুর জনই যদি সিগ্রেট খাইতে পছন্দ করেন, তার মানে এই না যে সিগ্রেট খাওয়াটা এইখানে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র বরং হইতেছে, এইখানে যদি পাঁচজন লোকের শ্বাসকষ্ট থাকে, আর আমরা যদি একজন লোকও সিগ্রেট ধরাই তাইলে এই পাঁচজন লোকের সমস্যা হইতে পারে, এইটা মানতে পারাটা হইতেছে আমার কাছে গণতন্ত্র। তো, এইরকমের ঝামেলাগুলা আছে।

ধরেন, এই মান-ভাষাটার কথাই। মান-ভাষাটার দরকার হইতেছে রাষ্ট্রের কাজে, কিন্তু আমি মান-ভাষাটারে এইভাবে দেখি না। বা যেইটা প্রমিত ভাষা। প্রমিত ভাষা মানেই হইতেছে একটা ট্রাপ। ট্রাপ হইতেছে কি রকম, যেমন ধরেন, বাংলা একাডেমি প্রমিত ভাষার একটা ব্যাকরণ বাইর করলো, ডিকশনারি বাইর করলো। বাইর কইরা বললো যে, না, এইটা হইতেছে একটা ভালো জিনিস, এইটা ফলো করেন, করতেই হবে – এইরকম কোন কথা নাই। কিন্তু যখনই আপনি এইটার বাইরে যাবেন, তখন আপনারে আইসা ধরবে। মান-ভাষা মানে একটা স্ট্যান্ডার্ডাটাইজেশন না, স্ট্যান্ডার্ড বানানোর মানেই হইতেছে এক ধরণের ট্রাপ ক্রিয়েট করা। তো, সেইম জিনিসটা হইতেছে ভাষার ব্যাপারেও, ব্যাকরণের দরকার আছে কি নাই সেইটা পরের কথা, কিন্তু ভাষার আলাপ মানেই ব্যাকরণের আলাপ না। বরং ভাষার কথা যদি আমরা বলতে চাই, ভাষা ইন ইটস কোর তার ব্যাকরণরে কোন না কোনভাবে এড়াইতে না পারে, এইটারে ক্রস কইরা না যাইতে পারে, সেই ভাষার লাইভ থাকতে পারার কথা না।

তো, মুশকিল হইতেছে এই জায়গাগুলা। হিস্ট্রিগুলা কমবেশি আমাদের জানা, ফোর্ট উইলিয়ামের পরে বাংলার মানুশ হঠাৎ কইরা সংস্কৃত বেইজড ভাষায় কথা বলতে শুরু করে নাই। যেমনে বলতো অমনেই বলতেছে। আমরা যেইভাবে বলি, এইভাবেই বলতেছি। কিন্তু আমাদের ফোকাসটা চইলা গেছে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে। যে, ভাষা এইভাবে লিখতে হবে!

এখন তাইলে আমার প্রস্তাবটা কি? একটা অ্যানার্কি ক্রিয়েট হবে? না। বরং আমার তিনটা পয়েন্ট আছে।

প্রথম পয়েন্টটা হইতেছে, প্রমিত/অপ্রমিত, মান-ভাষা/আঞ্চলিক ভাষা… এই যে একটা স্ট্রাকচার তৈরি হইছে, এইটা একটা পাওয়ার স্ট্রাকচারের গেইম। এই স্ট্রাকচার থিকা বাইর হইতে হবে। এইখানে একটা প্রমিত ভাষা নাই, যার এগেনেস্টে অনেকগুলি অপ্রমিত ভাষা আছে। এইখানে কোন মান-ভাষা নাই যার এগেনেস্টে অনেকগুলা আঞ্চলিক ভাষা আছে। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা বিভিন্ন রকম। রংপুরের মানুশ একভাবে বলবে, বরিশালের মানুশ একরকম বলবে। হাজার বছর ধইরা এইটা বলতেই আছে। মানে, ব্যাকরণ আবিষ্কারের পরে ভাষা আবিষ্কার হয় নাই! খুবই সিলি এক্সাম্পাল, আজকে ফিজিক্স আবিষ্কারের পরে দুনিয়া সূর্যের চারপাশে ঘুরতে শুরু করে নাই। আমরা বাইর করছি জিনিসটা যে, এমনে দেখলে জিনিসটারে বেটার ওয়েতে দেখা যায়, বেটার ওয়েতে লোকেট করা যায়। ভাষারে আমরা রিড করতে পারি, ভাষা কোনদিকে যাবে সেইটার ব্যাপারে সাজেশন মেইক করতে পারি। কিন্তু তার মানে এই না যে, ভাষা ব্যাকরণ মাইনাই চলে!

তো, প্রথম কথা হইতেছে, আপনি যদি ভাষা নিয়া আলাপ করতে চান, এইটা প্রমিত ভাষা, এইটা অপ্রমিত ভাষা, এইটা মানভাষা, এইটা আঞ্চলিক ভাষা, এইটার যে একটা স্ট্রাকচার কইরা দেয়া আছে পাওয়ারের, আমাদেরকে এইটার বাইরে গিয়া কথা বলতে হবে। এই স্ট্রাকচারটাকে ইগনোর করতে হবে। এইটা হইতেছে আমার এক নাম্বার প্রপোজাল।

সেকেন্ড প্রপোজাল হইতেছে, তাইলে কি মানভাষা বইলা কিছু থাকবে না? আমি বরং মানভাষার জায়গায় প্রপোজ করতে চাই একটা কমন ভাষা থাকবে, কমন ভাষা অলরেডি আছে। কিন্তু ধরেন আমরা ভয় বলতে মনে করি শুদ্ধ, বা ভয় হইতেছে ব্যাকরণসম্মত, ডর শব্দটা না। কিন্তু ডর তো সবাই বুঝি ভাই! এমন তো না যে বুঝি না। কিন্তু এইটারে আমরা ‘ব্যাকরণসম্মত’, ‘শুদ্ধ’ ভাষা বলতে রাজি না। এই যে একটা জায়গা আছে, এইটারে একসেপ্টিবিলিটির ভিতরে নিয়া আসা। যে, আমরা চাইলে এইরকমের ভাষাগুলাতে কথা বলতে পারি। একটা ওপেন স্পেইপসের ক্রিয়েট করা। মানুশ মানভাষা দিয়া কথা বলতেছেও না। কিন্তু আপনি যে একটা বেড়া বসায়া দিতেছেন যে, এইটার মধ্যে থাকতে হবে – এই জিনিসটারে যতোটা সম্ভব এড়াইতে হবে, এইটারে যতোটা সম্ভব সরায়া দিতে হবে। এইটারে যদি সরাইতে পারেন, পিপল উইল পার্টিসিপেট এবং ভাষা আরো মানুশের কাছে যাইতে শুরু করবে। কিছুক্ষণ আগে কথা হইতেছিল এইটা যে ঠিক ভাষা বা শুদ্ধ ভাষা – এইটার রায়টা কে দিবে? বাংলা একাডেমি দিবে, কোন বড় পত্রিকা দিবে? বা কোন সাহিত্যিক দিবে? এইটা কোন প্রশ্ন না। আমার কাছে মনেহয়, একটা ভাষা থাকবে কি থাকবে সেইটা তার পিপলের ইউজের উপরে ডিপেন্ড করবে। সুতরাং পিপলের যেই ভাষা, সেইটারে একসেপ্ট করার জন্য করার কনটেক্সটটারে রেডি করেন। এইটা হইতেছে আমার প্রস্তাব।

আর এইটা করা সম্ভব শুধুমাত্র একটা কমনভাষার স্পেইসরে আপনি আইডেন্টিফাই করতে রাজি থাকেন। যে, এইটা হইতেছে গ্রাউন্ডটা, এইগুলা লোকজনের বলাবলির ভিতরে আছে। আর এই গ্রাউন্ডে আমি এই এই শব্দগুলারে একসেপ্ট করতে রাজি আছি। আর এইটারে যদি আপনি বেইজ হিসাবে নিতে চান তাইলে মিনিমামটারে নিতে হবে, ম্যাক্সিমামটারে না। শুদ্ধতার জায়গাটারে আইডেন্টিফাই করতে হবে না, আইডেন্টিফাই করতে হবে মিনিমাম বেইজটারে। যে না, এই মিনিমাম বেইজটারে আমরা একসেপ্ট করতে রাজি আছি। এইভাবে আমার মনেহয় যে, ভাষার আলাপটা আগাইতে পারে।

তো, এই হইতেছে মোটাদাগে, আমার কথা।

এখন এইটুক কথা বললে হয়তো মনে হইতে পারে, তেমন কিছুই তো বলা হইলো না। তো, আরেকটু ফেনাইতে চাইতেছি। মাইকেল হফম্যান নামে একজন অনুবাদক আছেন, যিনি মেইনলি জামার্নি থিকা ইংলিশে অনুবাদ করেন। তো, উনি বলতেছিলেন জামার্ন থিকা ইংলিশে আনতে গেলে মেজর যে সমস্যাটা হয়, জামার্নে আপনি যে রাইগা আছেন সেইটা বুঝাইতে হইলে তিনবার কইরা বুঝাইতে হয়, আর ইংলিশে সেইটারে বুঝাইতে হইলে নিরব হইতে হয়, একটা ফুলস্টপের জায়গায় তিনটা ফুলস্টপ দিতে হয়। তো, বাংলাভাষার মধ্যে আমি যদি দুই মিনিট কথা বলি, তাইলে মনে হবে যে, আমি আসলে কোন কথাই বলি নাই। বাংলাভাষাতে দেখবেন যত ফেনাইতে পারবেন মনে হবে যে, না, অনেক কথা বলতে পারতেছে! এখন একই কথা আপনি দশবার বলতেছেন না দশটা কথা দশবার বলতেছেন সেইটা খুব বেশি ম্যাটার করে না বেশিরভাগ সময়। (মানে, বেশি কথা বলতে পারাই মানে হইতেছে ইর্ম্পটেন্ট কথা বলা – এইরকমের একটা ব্যাপার আছে।) তো, এই রিস্কটা এইখানে ফিল করতেছি।

এমনিতে বইটা নিয়া যেহেতু আলাপ, বইটা পড়তে গিয়া আরো কয়েকটা জিনিস মনে হইছে। রবীন্দ্রনাথরে আজম যে বারবার টাইনা নিয়া আসছেন, সেইটা আমার কাছে আন-নেসেসারি মনে হইছে। উনার সেন্সে হয়তো দরকারি। কিন্তু আমার কাছে মনে হইছে আগেরদিনে টিচাররা যেমন একটা বেত নিয়া ক্লাসে ঢুকতেন, এইরকম আজমের কাছে রবীন্দ্রনাথ হইছেন বেত’টা। যে, উনিও আছেন। উনার কথাই উনি বলছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথরে সাক্ষী মানছেন যে, দেখেন, রবীন্দ্রনাথও কিন্তু এইরকম বলছেন! তো, এইটার কোন দরকার ছিল না। মেবি একসেপ্টেবল হওয়ার লাইগা এইরকম করছেন। কিন্তু একসেপ্টিবিলিট কার কাছে? ‘শিক্ষিত জনগোষ্ঠী’ বা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা হয়তো একটু মনোযোগ দিয়া শুনছে, আরে রবীন্দ্রনাথের লগেও মিলছে! নাম শুনলে একটা ব্যাপার আছে না! এইটা উনি এড়াইতে পারতেন। আমার কাছে একদমই জরুরি মনেহয় নাই এই জিনিসটা। বরং উনি যে পাওয়ার স্ট্রাকচারটারে সার্ভ করতেছেন তার একটা এক্মাম্পল হিসাবে রবীন্দ্রনাথ এইখানে রয়া গেছেন। রবীন্দ্রনাথ এখন কোন রিলিভেন্ট ব্যাপার না। আমি বলবো যে, রবীন্দ্রনাথের নাম দিয়া আপনি এখন শুধু এস্টাবলিশমেন্টরে, পাওয়ার স্ট্রাকচাররেই সার্ভ করতে পারেন। তো, রবীন্দ্রনাথের নাম নিয়া উনি আসলে এই কাজটা করছেন। এইটা একটা ঝামেলার জিনিস হইছে।
আরেকটা জিনিস বলা একটু রিস্কি। আমার মনে হইছে, ভাষার ভিতরে যেই জিনিসটা একবারও আলাপ হয় নাই সেইটা হইতেছে, জেন্ডার রোলের একটা ব্যাপার থাকতে পারে। ভাষা অবিশ্যসম্ভাবীভাবে যেইটা ধইরা নেয় যে, এইটা একটা ম্যাসকুলিন ব্যাপার।… সুধীর চক্রবর্তী নামে একজন আছেন, যিনি লালন নিয়া লেখেন। উনি একটা কাহিনি বলতেছেন, এক আলাপে বসছেন, তো উনারে একজন সাধু জিগাইতেছেন, মানুশের শরীরে ফুটা কয়টা? উনি ভাইবা বললেন, নয়টা। সাধু হাইসা বললেন, পুরুষ মানুশের নয়টা ফুটা, কিন্তু মেয়ে মানুশের তো দশটা ফুটা। তো, তখন উনি অবাক হইছেন, এই সহজ জিনিসটা আমি ভুল করলাম। তো, মানুশ বলতেই উনি ধইরা নিছেন, পুরুষ মানুশ। উনি জেন্ডারের জায়গাটারে রিকগনাইজই করেন নাই। তো, এই বইয়ে ভাষা নিয়া এতো যে আলোচনা, জেন্ডার পারসপেক্টিভ নিয়া একটা লাইনও নাই। তো, এইটা গ্রস একটা ব্যাপার।

তো, আমার কথাগুলারে যদি সামারাইজ করি। ভাষার আলাপটারে ব্যাকরণের আলাপের মধ্যে লিমিট করাটা উচিত না। এর মানে হইতেছে ভাষারে আরো স্কুইজ কইরা নেয়া। আপনি যদি মানভাষার কথাও বলেন, স্কুল-কলেজ, রাষ্ট্রের দরকার… কয়টা লোক আসলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, কলেজে পড়ে… ষোল কোটি মানুশের মধ্যে দশ লাখ, বিশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ? তো, আমরা আলোচনাটারে আসলে ন্যারো কইরা ফেলি, যখন ভাষা নিয়া কথা বলতে গিয়া ব্যাকরণের মধ্যে আনি, মানভাষার মধ্যে আনি। বরং এই স্ট্রাকচারগুলারে আপনারা যতো কোশ্চেন করতে পারেন, দূরে সরাইতে পারেন, ভাষার ততো ওপেন হওয়ার সম্ভাবনাটা বাড়ে।

Leave a Reply