‘ভালো’ কি জিনিস?

হুমায়ূন আহমেদের নভেল/নভেলাগুলারে ‘সমালোচকদের’ অপছন্দ করার একটা মেজর কারণ হইতেছে, উনার উপন্যাসগুলা’তে খেয়াল কইরা দেখবেন ‘বর্ণনা’র চাইতে ডায়লগ বেশি। আমাদের ‘সমালোচনায়’ উপন্যাসের স্ট্রেংথ হইতেছে বর্ণনায়; মানে ‘বর্ণনা-ই উপন্যাস’ না হইলেও, মেজর একটা জিনিস। তো, হুমায়ূন আহমেদে যে বর্ণনা নাই – তা না, বর্ণনা উনার স্ট্রেংথের জায়গা না; উনার স্ট্রেংথ হইতেছে, কনভারসেশন, ডায়লগ। কিন্তু এইটা তো নাটকের জিনিস! – এইটা মনেহয় ভাবতে পারি আমরা, যার ফলে ‘উপন্যাসের মানদন্ডে’ জিনিসটা বাজে হইতে পারে। (অন্য অনেক কারণেই উনার উপন্যাস ভালো বা খারাপ হইতে পারে, আমি জাস্ট এই পার্টিকুলার জিনিসটারে হাইলাইট করতে চাইতেছি এইখানে।) 

 

মানে, খেয়াল কইরা দেখেন, একটা বা কিছু ‘মানদন্ড’ আছে এইখানে, বিচার করার; খালি উপন্যাস না, নাটক-সিনেমা-গান-কবিতা, অনেক জিনিস নিয়াই। সিনেমার মানদন্ড যেমন, একটা ভালো স্টোরি থাকতে হবে, একটা ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ থাকতে হবে, এইরকম; তো, এইগুলা বাজে জিনিস না, কিন্তু আর্টের এই ‘মানদন্ড’গুলাই যে আর্ট না – এইটা মনে রাখাটাও দরকার। মানে, আর্টের বিচার তো আপনি করবেন-ই; কিন্তু যেই বাটখারা দিয়া বিচার করতেছেন, শুধু সেইটা দিয়া মাপতে গেলে ঝামেলা হবে, সবসময়ই।

 

তো, আলমগীর কবিরের সিনেমা মাপা’র বাটখারা ছিল – ‘সমাজ-বাস্তবতা’।১ সিনেমা হইতেছে ‘সমাজ-বাস্তবতা’রে তুইলা ধরবে, বিপ্লবের হাতিয়ার হবে, এইসব বাল-ছাল।২ স্পেশালি দেখবেন, এই তরিকার লোকজন সিনেমা’তে গান জিনিসটারে খুব একটা পছন্দ করতেন না বা করেন না। কারণ, বিদেশের যেইগুলা ‘ভালো ভালো’ সিনেমা, অইগানে তো গান নাই! আর তাছাড়াও, গান তো অ-বাস্তব একটা জিনিস; বাস্তব জীবনে আবেগের চোটে গান গাইয়া উঠি নাকি আমরা! অথচ গান একটা দরকারি জিনিস আমাদের বাংলা-সিনেমায়; রূপবান, বেদের মেয়ে জোসনা হিট হইছে, খালি গানের কারণে না, বরং এই দুইটা সিনেমা মিউজিক্যাল ফিল্ম বইলা। মানে, আবেগের চোটে কারেক্টার’রা গান গাইয়া উঠে না; বরং উল্টাটা, উনাদের আবেগের জায়গা গিয়া কথাগুলা আর কাজ করে না, গান ছাড়া এইটা বলা যায় না, কারণ এইটা ডিপ ইমোশনের একটা ঘটনা।

 

কিন্তু এইটা ফর্ম হিসাবে ‘ভালো সিনেমা’র ডেফিনেশনের লগে তো মিলে না! এই কারণে উনার ইউরোপিয়ান বুদ্ধি দিয়া আলমগীর কবির রূপবান’রে কইছেন ‘যাত্রাসিনেমা’; ‘ভালো সিনেমা’ তো দূর কি বাত, ‘সিনেমা’ হিসাবে আইডেন্টিফাই করতে ব্যর্থ হইছেন। (কারণ তখনো মিউজিক্যাল ফিল্মের ডেফিনেশন চালু হইতে পারে নাই।) উনার এই ব্যর্থতা যে সত্যিকার অর্থেই ব্যর্থতা – সেইটারে রিকগনাইজ না কইরা, এখন গ্লোরিফাই করার যে মজমা চলতেছে, সেইটারেই নোটিশ করতে চাইতেছি আমি। যে, উনাদের বিচার’রে দেখার আগে, বিচারের বাটখারাগুলারে দেখেন।

 

আর ‘সমাজ-বাস্তবতা’র ঘটনাটাই দেখেন; আর্টের কাজ তো ‘সমাজ-বাস্তবতা’রে ঠিকঠাক মতো ফুটায়া তোলা বা তুইলা ধরা না; বরং ‘সমাজ-বাস্তবতা’ যে কি জিনিস – সেইটারে এগজামিন করা আর্টের একটা কাজ হিসাবে ভাবা যাইতে পারে, অনেক সময়। আর সেইটার স্ট্রেইট-কাট কোন ওয়ে তো নাই!

 

তো, আমার ধারণা, আলমগীর কবির যখন সিনেমা বানাইতে গেছেন, তখন নিজের সমালোচনার জায়গাগুলারে কম-বেশি বুঝতে পারছেন, কোন না কোন অজুহাতে এড়ানোর ট্রাইও করছেন। যেমন, পপুলার বইলা টিটকারি মারলেও শরৎচন্দ্রের উপন্যাস নিয়া সিনেমা বানাইছেন, বুলবুল আহমেদ’রে বাদ দিয়া ইলিয়াস কাঞ্চন, অঞ্জনা’রেও ‘আর্টিস্ট’ হিসাবে ভাবতে পারছেন; ট্রাডিশন্যাল যাত্রাগানের বদলে ক্ল্যাসিকাল মেজাজের গান ঢুকাইতে পারছেন… এইরকম। মানে, উনার ‘সমাজ-বাস্তবতা’র বাটখারা উনি ফালায়া দিতে পারছেন – এইরকম না; কিন্তু এইগুলা যে খুববেশি কাজের জিনিস না, বা এইগুলার বেসিসে কাজ করতে গেলে বাংলা-সিনেমার জায়গাটারে যে ধরা যাইতেছে না, সেইটা উনার ফিল করতে পারার কথা মনেহয়।

Continue reading