সাহিত্যের রিডিং

জগদীশ গুপ্তরে নিয়া বলা প্রেমেন্দ্র মিত্র’র এই কথাগুলা খুবই সত্যি; আর্ট কালচারে কার নাম কয়দিন টিইকা থাকে! কিন্তু দ্যান এগেইন, উনি যেমনে কথাগুলা বলতেছেন, ক্যাচ’টা অই জায়গাতেই। আগে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথাগুলা দেখি:
“…জগদীশ ও তাঁর জীবনকালেই খ্যাতির প্রশস্ত রাজপথ থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন। গুণগ্রাহী সন্ধানী রসিকের দূরবীক্ষণে ছাড়া সর্বসাধারণের তিনি প্রায় অগোচরে ছিলেন বললেই হয়। ছিলেন, তার নিজের স্বভাবে কতকটা আর, সাহিত্য-লোকের দুর্জ্ঞেয় নিয়তিতে।
সাহিত্যের এই নিয়তির রহস্য সত্যিই বোঝা কঠিন। সুবিচার অন্তত যে তার ধর্ম নয় তার দৃষ্টান্ত অজস্র। সোন্ ফেলে আঁচলে গেরো সে অহরহই আমাদের দেওয়ায়।
জগদীশ গুপ্তের বেলায় এই নিয়তির একটি নির্মম ঔদাস্যের উদাহরণ আমরা দেখলাম।
অন্তিম বহ্নিদীপ্ত তার নাম আবার যদি অন্ধকারে মুছে যায়, সত্যি কথা বলতে গেলে তাতে দুঃখের এমন কিছু নেই। সব নামই তাই যায়, কিছু আগে পরে। দু-একটি যা থাকে তা শুধ আক্ষরিক পরিচয়ে নয়, থাকে, চিরন্তন জীবন প্রবাহের সঙ্গে এমন একটি বেগ হয়ে মিশে, যার নাম অবান্তর। আক্ষরিক নাম যাদের মুছে যায়, তারাও সেই প্রবাহে নিজেদের স্বল্পাধিক দানে অমর।
জগদীশ গুপ্তের মত লেখকের ভাবী বিস্মৃতি-সম্ভাবনায় দুঃখ তাই নেই। জীবনকালেই যে বিস্মৃতির কুঙ্কুটিকা যেমন করে তাকে আচ্ছাদিত করেছিল, বিস্ময় শুধু তাইতে।”
তো, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথাগুলারে সত্যি বইলা মানার পরেই উনার বলার জায়গাটায় আরো কিছু জিনিস চোখে পড়তে পারে। যেমন, জগদীশ গুপ্তের নাম যে কেউ নেয় না এইটা যেন উনারই দোষ 🙂 উনার ‘অজ্ঞাতবাস’ আর তা নাইলে ‘দুর্জ্ঞেয় নিয়তি’! কিন্তু এখন তো আমরা কিছুটা অনুমান করতে পারি যে জিনিসগুলা বরং উনার ‘লোয়ার ক্লাস’ আর ‘সাহিত্য রাজনীতি’র ঘটনাও। রবীন্দ্রনাথের সাথে উনার মতো আর কোন ফিকশন-রাইটারের তর্কের কথা আমার জানা নাই, যদিও থাকতেই পারে; কিন্তু এই বিরোধিতার কোন এফেক্ট যে উনার স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির উপ্রে পড়ে নাই, এই ব্যাপারে চুপ থাকাটাই একটা ঘটনা মনেহয়। সাহিত্যের ইতিহাসে কি কি জিনিস বলা হইছে, সেইটার সাথে কি কি জিনিস বলা হয় নাই – সেইটার এনকোয়ারিরও তো দরকার আছে।…

প্রমথ চৌধুরী’র ‘মুখের ভাষা’

বাংলাভাষা লেখার এখনকার যে তরিকা সেইটা মোস্টলি প্রমথ চৌধুরী’র (১৮৬৮ – ১৯৪৬) আর্গুমেন্টগুলির উপর বেইস কইরাই চলতেছে। ভাষা নিয়া চাইরটা লেখা আছে উনার- কথার কথা (১৩০৯), বঙ্গভাষা বনাম বাবু-বাংলা ওরফে সাধুভাষা (১৩১৯), সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা (১৩১৯) আর আমাদের ভাষাসংকট (১৩২৯)। উনার মেইন আর্গুমেন্টগুলি বেশ স্ট্রং, ওই সময়ের কথা চিন্তা করলে তো রেভিউলেশনারিই।

তখন বাংলাভাষা লেখা হইতো মোস্টলি সাধুরীতি’তে। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার’রা সংস্কৃত কলেজে যেহেতু অনুবাদ করতে করতে বাংলাভাষা বানাইছিলেন ওইটা ডিকশনারি বেইজড একটা জিনিস ছিলো। লেখার ভাষা ছিলো মুখের ভাষা থিকা ডিফরেন্ট একটা জিনিস, যত ডিফরেন্ট তত বেশি লিখিত, মানে সাহিত্য – বিচারের ধরণটা এইরকমই ছিল (এখনো আছে মনেহয় কিছুটা; দাঁত-ভাঙা কবিতা দেখা তো যায়)। প্রমথ চৌধুরীরা (লগে আরো কয়েকজন আছিলো) কইলেন এইসব বাদ দিতে হবে, মানুষ তো আগে কথা কয়, তারপরে লিখে; আর মানুষ লেখে মানুষরেই বোঝানো লাইগা, সো যেমনে মানুষ বাংলাভাষাতে কথা কয় লিখিত বাংলাভাষা সেইটার কাছাকাছি হওয়া লাগবে, ডিফরেন্স কমানো লাগবে।

তো, যখনই মুখের ভাষা’র কথা বলতেছেন তখন নরমালি প্রশ্ন আসে, কার মুখের ভাষা? কোন জায়গার মুখের ভাষা? এর উত্তরও উনি দিছেন; বলছেন, যেইখানকার উচ্চারণ স্পষ্ট, যেমন দক্ষিণবঙ্গের মানুষের উচ্চারণ, সেইটারে নিতে হবে। আর বেশ কয়েকবারই বলছেন যে, ‘কলিকাতার ভদ্রসমাজের ভাষা’রেই নিতে হবে। কারণ কলকাতা হইতেছে সেন্টার (বঙ্গভঙ্গ হয়া গেছিলো ততদিনে, কিন্তু উনি যেহেতু বঙ্গভঙ্গ মানেন নাই, ঢাকারে সেন্টার ভাবতে পারেন নাই আর); ‘বাংলাদেশের সকল প্রদেশের অসংখ্য শিক্ষিত ভদ্রলোক’রা কলকাতায় থাকেন।

আমার সমস্যাটা এই ‘ভদ্রলোক’দের নিয়াই। তার মানে এই না যে, প্রমথ চৌধুরী খালি ভদ্রলোকদের শব্দই নিতে কইছেন; উনি ‘ইতর শব্দ’ বাদে সমাজে অন্য সব ক্লাসের মধ্যে চালু থাকা শব্দও লেখায় নিতে চাইছেন। কিন্তু যখনই আপনি ‘মুখের ভাষা’ নিতেছেন একটা ডমিনেন্ট ক্লাসের ভাষারে না নিয়া আপনার উপায় নাই। না চাইলেও মনেহয় এইটা অটোমেটিক্যালি চইলা আসার কথা, কারণ অ্যাজ অ্যা ভদ্রলোক আমি চাইলে সিলঅটি ভাষা লিখতে পারবো না (লন্ডনীরা বলেন, কিন্তু লেখেন না)। ‘ভদ্রলোক’ ক্লাসটা সাম সর্ট অফ সুপিরিয়রিটি ছাড়া একজিস্ট করতে পারার কথা না। আর সেই সুপিরিয়রিটিরে সেন্টারে রাইখা যখন ভাষার মধ্যে অন্য ক্লাসের শব্দগুলিরে ইনসার্ট করতে থাকবেন দেখবেন খুবই ফানি লাগতেছে ব্যাপারটা। ‘আপনি’ না কইয়া ‘আপনে’ কইলেই এনাফ অপমান/ফান করা যাইতেছে, জাস্ট পেরিফেরির শব্দগুলা ইউজ কইরাই। (ইভেন আপনি ফান না করতে চাইলেও এরা ফানি, বেশিরভাগ সময়।) Continue reading