অমর প্রেম অথবা আমার প্রেম

 

কথা ও কাহিনি

এইরম গাদলা দিনে বসে আবার মনে পড়লো লিবা’র কথা। আসলে এই কাহিনির কোন মাথা-মুণ্ডু নাই। আমি যত ভাবি আর বলতে চাই, ততই অবাক হই। কিভাবে এই কাহিনি বলা যাইতে পারে, যেখানে সমস্তু কিছুই অনির্দিষ্টতা, মনে করে নেয়া অথবা যেখানে অস্তিত্ব এতোটাই বিহ্বল যে চেতনা আর সাড়া দেয় না, সবকিছু এতোটাই স্পষ্ট এবং ধোঁয়াটেও একইসাথে… ভালোবাসার আসলেই কি কোন বর্নণা সম্ভব আর? এই দ্বিধা কাহিনিটার পরতে পরতে আর মাঝে মাঝে ভাবি এইখানে শুধু পরির্পাশ্বই আছে, কোন ঘটনা আর নাই। তারপরও অব্যক্ততার আরো আছে, থাকে, কত যে কথা!

অথচ কথাগুলি কি আর বলতে পারে, যা বলতে চায়। অথবা যে দ্বৈততার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে সময়, শব্দ ও তার নিহিত অর্থগুলি তারা তো অসম্পূর্ণ, ব্যক্তির আড়াল খুঁজে। খুঁজে ভঙ্গিমার প্রশয়, যেন এই করে করেই পার পাওয়া গেলো!

কি বলতে বসেছি, আর বলছি কি! সবসময় এমনটাই ঘটে। কাহিনিটা আর বলা হয় না। বলার মতো কোন ঘটনাও আসলে নাই। আসলে কোন কাহিনি-ই না, এইটা। কারণ আবার মনেহয় এইটা এখনো ঘটতেছে, প্রতিদিন। কথার ভিতরে জমা কাহিনি কি বাইর হয়া আসতে পারবে আর, অথবা ধরো এই যে কাহিনি, সে কি আর কথার ধার ধারে নাকি! ফাঁপা গহ্বর একটা, জীবনের – তারেই প্রেম বলে নাম দিছে লোকে?

 

বাইনোকুলার

বৃষ্টিতে ঝিরিঝিরি শব্দ। একদম সকাল থিকাই। দুপুরে একটু কমলো কি আবার বিকাল না হইতেই শুরু। এই অবস্থা গত তিন-চাইর দিন। বৃষ্টির উছিলা আর কত! আজকে তো যাওয়াই লাগে। কি উপায়? শিমা’র মাথায় বুদ্ধির অভাব নাই। কইলো, বৃষ্টির দিন সবকিছুই ঝাপসা, একটু দূরের জিনিসই দেখা যায় না, তার উপর সন্ধ্যার আগে যাওয়া যাইবো না, তাই দুইটা জিনিস লাগবো, একটা ছাতি আর একটা বাইনোকুলার। বাইনোকুলার? দুপুর বারোটার সময় বইসা বইসা এই প্ল্যান করতেছি।

বাইনোকুলারটা শিমার দুলাভাই আনছে, এখন ওর হেফাজতে আছে, বিকালবেলা ওইটারে কামে লাগাইতে হইবো। আমার মাথা আর তখন কোন কাজ করে না। ঠিক আছে, এইটাই প্ল্যান। ছাতিও আমি নিতে পারবো না। যেহেতু বাইনোকুলার নিবে শিমা, ছাতি নেওয়ার দায়িত্বও ওর।

তিনটা না বাজতেই বৃষ্টি যেন তুফান ছুটাইলো। চারদিক অন্ধকার করা বৃষ্টি! যেন আর থামবেই না। হৃদয় এখন মূঢ়তার চূড়ান্ত। চারটা বাজতে, অন্ধকার কমলো; কিন্তু তেজ আছে একই। দুমদাম বৃষ্টি। পাঁচটার দিকে একটু ঢিমেতাল ধরে আসলো একটু। আর দেরি নাই, শুয়ে শুয়ে এর অপেক্ষায় ছিলাম…

অর্ধেক পথ যাইতে গিয়া দেখি ছাতি হাতে শিমাও আসতেছে… হাতে একটা গুটলি পাকানো প্যাকেট… কি এইটা?… বাইনোকুলার… দেখা যাইবো তো?… হ।

বৃষ্টি আবার শুরু হইছে। দাঁড়াইবারও কোন জায়গা নাই। কই গিয়া একটু দাঁড়াই বা বসি! খাঁড়ির ভিতর আইসা নোঙর করছে কয়েকটা লঞ্চ, যদিও একটু দূরে, কিন্তু তার ডেকের উপরই একটু দাঁড়ানো যাইবো তা না হইলে তো আর কোন উপায় নাই।

বৃষ্টির দিন একটা ছাতি লইয়া ঘুরাফিরা করতাছে দুইটা মানুষ, তাঁর বাসার পিছনে, এই দৃশ্য কি চোখে পড়বে না লিবা’র? শে কি আসবো না তাঁর ছাদের কোণায়? না-দেখার মতো কইরা একটুও কি দেখবো না?

আবার শুরু হইছে বৃষ্টি! এই কমে তো এই বাড়ে। ঘাপটি মাইরা বইসা আছি লঞ্চের কেবিনের বাইরের জায়গাটাতে। শালার বাইনোকুলার খুইলা চোখে দিয়া দেখি, খালি চোখে যা দেখা যায়, এইটা দিয়া তো তাও চোখে পড়ে না! বারবার কাঁচ মুইছা দেয় শিমা, একবার আমি দেখি, আরেকবার সে, কিন্তু কিছুই দেখি না, শাদা, ঝাপসা সবকিছু…

হঠাৎ আমার মনে হইলো যেন দুইটা ছায়ামূর্তি ঘুরাফিরা করতেছে ছাদের উপর, হেঁটে হেঁটে আবার ফিরে আসছে, দেখছে আমাদেরকেও, শিমাও দেখলো অস্পষ্ট, কিন্তু ওরা কি ডাকতেছে আমাদেরকে, হাত তুলে কি নাড়লো, বললো কি কিছু… একে তো বৃষ্টি, তার উপর সন্ধ্যা… দিনের শেষ ছায়ায় বামপাশের মূর্তির দিকে নির্নিমেষ তাকায়ে আছি, শে কি কিছু বলতেছে আমারে; বলতেছে কি, চলে আসো; দূরত্ব মহান না, যেখানে সমস্তই ঝাপসা, সেই দূরত্ব পার হয়া আসো!

আমি স্তম্ভিত, বইসা আছি, কালো কালো অন্ধকার তেড়েফুড়ে আসতেছে, লোডশেডিং-এর ম্লান আলোতে, থিক থিক কাদার ভিতর হেঁটে হেঁটে ফিরে যাবো বাসায়। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা পড়ে আসবে। তোমার মায়া’র দেশে আমি যাইতে পারবো না, কখনোই!

 

হয়তো সে আমি বলি নাই

এর আসলে কোন শুরু নাই, যেমন শেষটাও এখনো আমার জানা নাই। আমি কিছু শব্দ উচ্চারণের ভূত মাথায় নিয়া রওনা দিছিলাম আর তোমারে যা বলছিলাম, তাও আর শোনা যায় নাই। কথাগুলাই পইড়া আছে, শব্দ-সম্মোহন এর মতো যার অর্থ-উৎপাদনের কোন ক্ষমতা আর নাই।

সন্ধ্যাবেলা একে তো লোডশেডিং, তার উপর মেঘ করছে ভীষণ, বিদুৎ চমকাইতাছে। তাতে ড্রেনের ময়লা পানিতে বারবার মনে হয় ভাসতেছে লিবা’র মুখ। মনে হচ্ছে গড়াগড়ি যাই। একটু আগে কি কথা তারে বলতে গেছিলাম। আর ফিরা আসছি হতভম্ব হয়া। তারপর দিনমান চেতনা আমার পাকুড় বটের মতন ক্রমশঃ তার শিকড় গাড়তেছে গভীর থেকে গভীরে আর হাওয়া বয় শন শন, বৈশাখের।

মনে হয় তোমার কথা আমি কোনদিন শুনি নাই। এখন তো মনেই পড়ে না, কিরকম ছিল তোমার গলার স্বর। হাস্কি টাইপের, নাকি খুবই ঘরোয়া। যে কথা আমি বলতে গেছি, মনে হইতো তুমি তা শোনো নাই। তাই তোমার নাম নিয়া আমি নিজেরেই বলছি। হয়তো আমিই বলতে পারি নাই। কিরকম যে একটা অস্থিরতা! এইটা হচ্ছে ভাষা আর অ-জ্ঞানতার খেলা!! বলবেন হয়তো মনীষীরা। আমি তাদের দূর থিকা সেলাম জানাই। তারা কতই না চিন্তাশীল, অথচ আমার কোনকিছুই চিন্তা করার ক্ষমতা নাই। কারণ কোন ভাষার দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করতে ইচ্ছুক ছিল না এই মনোকামনা। কেন শে হৃদয় দিয়া হৃদয়েরই কথা শোনে নাই? যেখানে কোন ভাষা নাই, সেখানেই তো ছিল, আমাদের ভালোবাসা!

 

হলুদ স্কার্ট

এইটা তো সত্যি কথা-ই যে, আমার কেউই শহুরে ছিলাম না। এই কথা শুনলে লিবা’র হাড্ডি পর্যন্ত জ্বইলা উঠতে পারে। কেননা তাঁর শৈশবকাল শহরের মায়ায় ভরা। পুকুর-পার আর কলোনীর কোয়ার্টারগুলির মতো শান্ত, মধ্যবিত্ত। তার পরিবার কোন এক কারণে হিজরত করে আমাদের মরা বন্দরে।

আর তার যে পোশাক চোখে ভাসে এখনো, তার রং হলুদ। সেই পোশাকটা হয়তো কবেই বিলীন! তোমার বয়স আমি ভালোবাসি! কি লাবণ্যময় সেই দিনগুলি। যেমন কাঁটাঝোপের ভিতর হালকা পাতার হলুদ ফুল। এতই নরোম যে, হাতে নিলেই ঘামে ভিজে কুকঁড়াইয়া যায়। আমি চেষ্টা করি, যদি একটু শহুরে হইতে পারতাম আমি। একটু শুদ্ধভাষায় কথা বলা-ই তো। কনফিডেন্স হয়তো বাড়তো তাইলে। হয়তো কথা বলা যাইতো তোমার সাথে। যেমন রুদ্র বলতে পারে।

সামাজিকতাকেই ছিল ঘৃণা আমার। ছিল নিজেকে আরো কতো ছেঁটে ফেলা যায়, তার উপায় বাইর করা। এর ভিতর থিকাই দেখতাম, তুমি যাও সরিষার ফুল পড়ে শরীরে। শীতের দুপুরে। তাকাইতে তাকাইতে চোখ ব্যথা করে। জেগে থাকার নানান পেরেশানি। অব্যক্ততার কঠিন গোর্য়াতুমি। বাঙ্গালি মাত্রই অবদমনে পারদর্শী। হস্তবিশারদ। ঐদিনও দেখলাম বলছেন একজন। ঠিক আছে, তা-ই সই। আমিও বাঙ্গালি। মরার আগে তাইলে একবার অন্তঃত কই, ভালোবাসি!

আর তাতেই সকল বিপত্তি। মরা তো গেলো না। দুনিয়া উল্টাইলো। বাঙ্গালি’র পোলা কয় কি! তখন তো এর একটা বিহিত করা লাগে। মন্ত্রণাসভায়, আমিই উহ্য। আর সকলই পেয়, লেহ্য, ইত্যাকার…বমি-ই আসে এখন, যখন চারপাশে দেখি আরো কত কত উদাহারণ ভীড় করে আছে। ভালোবাসার যে সামাজিকতা তার ভিতরই তো হাবুডুবু সারাক্ষণ।

 

তোমার প্রেমিকসকল

তোমার প্রেমিকদের লিস্ট দিতে গেলে, আঁতকে উঠে মন। মনে হয়, চারপাশের সবাই শুধু তোমারেই ভালোবাসে। সন্দেহ ভরা আমার মন।

নিঃসন্দেহে সবচে’ বেশি ঈর্ষা আমি করি, নসা’কে। সে তোমার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করছে। তাঁর ছিল বিশাল ভক্তকুল, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং যে কোন সময় তোমাদের বাসায় যাওয়ার অবারিত সুযোগ। তারে আমি ঈর্ষা করছি। মনে হইছে, যদি সে তোমারে চায়, তুমি কি কইরা না করবা! এইটা কি সম্ভব? কিন্তু সে এতটাই বোকাচোদা, থরথর কইরা কাঁপলো, এমনকি মনে হয়, আমার চাইতেও বেশি। তার এই থরথর প্রেম তারে আর প্রেমিকই থাকতে দিলো না; তুমি তারে ভাই-ই বানাইলা, প্রেমিক না বানাইয়া।

লারু তো সিল-সাপ্পর মারা তোমার প্রেমিক। মানে সে তোমার প্রেমিক, দুনিয়াতে এইটাই তাঁর একমাত্র পরিচয়। সে যে প্রেমে পড়ছে এবং স্ট্রিকলি মনোগ্যামিক এই ফান্ডা সে ভাঙতে নারাজ। থাকুক না বেচারা, থাকুক তোমার প্রেমিক হিসাবে উল্লেখিত হইবার মতো তাঁর একমাত্র যোগ্যতা নিয়া।

এদেরকে পিছনে ফালাইয়া, তুমি কিনা সাড়া দিলা, ভেদা’রে! সন্দেহ নাই, সে স্মার্ট। কথা বলে চিবাইয়া চিবাইয়া। আমাদের মফস্বলী টোন তাঁর নাই। সে একটু একটু কইরা সুতা ছাড়ে আর তুমি ভাবো কি না জানি সে জানে, যাদুটোনা! কিন্তু সে তিন নাম্বারেই থাকলো আমার কাছে।

সবচে’ বাজে যে প্রেমিক ছিল তোমার, সে সাংবাদিক। তোমার নানা কুকীর্তির খবর আমারে দিতো, যেন আমি তোমার প্রেমে না পইরা যাই। একইসাথে অনেক পাড়াতো বড়বোনের সাথে আমার সর্ম্পক নিয়া কাহিনি বলতো সে তোমার বন্ধুদের যাতে এর ছিঁটাফোটাও যদি পৌছায় তোমার কাছে যাতে তুমি একটা খারাপ মনোভাব নিয়াই থাকতে পারো আমার সর্ম্পকে। সে কখনোই তোমার প্রেমে পরে নাই, কিন্তু সে তোমার প্রেমিক হিসাবে নিজেরে জাহির করতে চাইতো। তাঁর নাম এইখানে উচ্চারিত হইবার কোন যোগ্যতা সে রাখে নাই। আমি ভাবি, সে তো অন্তঃত তোমার প্রেমেও পড়তে পারতো!

 

রেললাইনের পাশে গাছগুলি তখনো কৈশোরকাল পার করে নাই

হঠাৎ কইরা একদিন দেখি, রেললাইনের ধারে গাছ লাগানো প্রকল্প শুরু হইছে। যে রেললাইনে বসলে তোমার দালানবাড়ি দেখা যায়। দেখা যায়, দূরের নদী। বাজার-ঘাট। খাঁড়ির পানি। মেথর-পট্টি। সেই রেললাইনে পোতা হইলো গাছের চারা। এরা বড় হইতে হইতে আমরা সবাই সমূলে উৎখাত হয়া যাবো, এই কথা তখন কি আর ভাবা গেছিল। কচি গাছের চারাগুলিকে তখন ভালোই লাগতো যখন শোঁ শোঁ বাতাসে তারা ঘাড় বাঁকাইয়া দুলতো। অথচ সেইটা ছিল তাদের অস্তিত্বের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার মর্মান্তিক প্রচেষ্টা যেন কোনকিছু তাদেরকে উপড়ে না ফেলে। এই করে করে দিনগুলি পার হইতে লাগলো। পাঠ্যপুস্তকের বোঝায় বসে আমি ভাবতাম, শে কি আহা, পড়ছে নাকি ভাবছেই কেবল, এইমতো কচি কচি গাছগুলির মতো, আমরা বড় হয়া যাবো, তখন কে আর আটকাবে আমারে।

অথবা ভাবি, বিশাল অন্ধকারে, পাকুড় হবো, খাঁড়ির কিনারে দাঁড়াইয়া থাকবো, ঝড়ের আগের বাতাসে জানালার পর্দা উড়ে উড়ে গেলে দেখবো, কি মনোযোগ, অথচ পড়তেই পারতেছো না, আমি জানি, আমি জানি… এইমতোন কলরোল উঠে, আর বোকাপাঠার প্রেমকাহিনি ছড়াইতেই থাকে হয়তো পারিপার্শ্বে, কে কে আর জানার বাকি?

 

এসেছিলে, তবু আসো নাই

কি আর করবো, দেবব্রতের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনি। সাগর সেন ভালো, সেইটা শোনো। হেমন্তও গাইছে। রাজেশ্বরী দত্ত। ঐ বেটি আবার সুধীন্দ্রনাথের বউ। চিন্তা করো। চিনিময়, চিনিময়; কাদেরীয়া, ওরাও… বন্যার সে কি ঢলঢল কণ্ঠ, পাপিয়া সারোয়ার আর খালেদ খানের বউটা, ও ওতো ভালো গান গায়, ফর্দ হাজির করো… রবিবাবুর হাত থিকা আর নিস্তার নাই!

কেননা লিবা’র বড় বইন গান গায়। রবীন্দ্রনাথের নাম লইলে যে গোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্ত হওয়া যায় সেইখানে একটা উভলিঙ্গ বা ক্লীবভাব আছে বলে মনে হয় যাতে করে ড্রইংরুম পর্যন্ত অবাধ যাতায়ত খুবই সম্ভব হয়া উঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। পুরুষ ও নারী প্রকৃত পুরুষ ও নারী হয়া উঠতে পারে টাইম মতোন। সেই গোষ্ঠীতে তখন চলে মঞ্চ নাটক, আবৃত্তি অনুষ্ঠান আর সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

পারর্ফমার না হও, দর্শক তো হইতে পারে! মনরে ফুসলায় মন। আমার মন রাজি হয় না। কেননা যে প্রেম অমর সে কি কোন কাল্টের সদস্য হইতে পারে? বরং আমাদেরকে নিয়াই কাল্ট তৈরি হয়।

আবার রবীন্দ্রনাথ কি আর এমন চ্যাটের বাল এইরকমও ভাবতে পারি না। কারণ, এক মুহূর্তে যেই লোকের ব্যক্তির ৫৮টা গান মনে করা গেলো, সময় দিলে হয়তো আরো বেশি মনে করা যাবে, অন্তঃত ১০০ কাছাকাছি যাওয়াটা অস্বাভাবিক না, তিনিই কি রবীন্দ্রনাথ? আমার ধারণা, এর চাইতে বেশি আরো অনেকেই পারবেন। তো তারে কোন বিষয়ের প্রেক্ষিতে ভালো বা খারাপ এইভাবে বিবেচনা করাটা কতোটা সম্ভব, আমার পক্ষে?

তারে আমি মানুষ হিসাবেই জানি এবং তার দুর্বলতাগুলিই তারে আরো শক্তিশালী দেবতা বলে প্রমাণ করে বলে আমার ধারণা। তারে মানুষ বলামাত্রই দেবতাগুণ আরোপ হইতে থাকে তার উপর। তিনি তাঁর সময়ের চাইতে বাইরের কিছু না এবং তার-ই প্রতিনিধি হইয়াও, তিনি ছড়াইয়া থাকেন সোশ্যাল কনটেক্সটে, তার ব্যবহরযোগ্যতা দিয়া।

তাঁর যে প্রভাব ও প্রতিপত্তি তা আমার প্রেমের উপরও চইলা আসতে চাইলো তার সেই বীজ লুকানো বর্তমান সময়ের নৈতিকতার ভিতরে না, কারণ কোনভাবেই এর প্রতিনিধিত্ব তিনি করেন না; যেইখানে তিনি সমস্তকিছুকে ধারণ করার মতো বিশালতায় বসে আছেন। আমি বুঝতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথ একজন ব্যক্তি নন, একটা ভাবধারা। তাকে আমি গ্রহণই করতে চাই, এর কোন বিকল্প আমার কাছে নাই। কিন্তু নিতে গেলেই দেখা যায় এই নেয়ার ভিতর দিয়াই তিনি অ-কার্যকর হয়া উঠেন যে, তারে মডিফাই করা লাগে, তিনি আর থাকেন না, তার ভাবধারা তবু টিকেই থাকতে চায়! অমরতার এ এক কঠিন বিপত্তি!

এইরকম করে তাই রবীন্দ্রনাথরে ভালোবাসার মতো যথেষ্ঠ মার্জিত ও ভদ্র আমি কখনোই হইতে পারি নাই এবং লিবা যে তার বড় বোনের মতো গান গাইয়া পাড়া বেড়াইতো না, তা এক ধরণের শান্তি দিতো আমারে, এক ধরণের ঐক্যবোধ জাগতো, আমার মনে, আমাদের মনে (মানে লিবা আর আমি তখন একই তো ব্যাপার)।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ে আর ঘাসগুলি আরো তাজা সবুজ হয়া উঠে। দূরে কোথাও কোন প্রতিকৃতি দেখি, দূরের দিকে তাকাইয়া থাকতে থাকতে, দূরত্বে চোখ বন্ধ হয়া আসে, দিগন্তে, আকাশের ঐপাড়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি করুণ ও কালো হইতে হইতে মুছে যাইতে থাকে, লিবা কি তাইলে ঘর-বন্দী? আসবে না আর ছাদে?

 

ছাদের আড্ডায়

ময়মনসিংহ এখনো দূর কোন পরবাস। যেখানে চলে যাওয়া যাইতো। একটা আড়ালের ভিতর বসে, বক্ষ্মপুত্রের ধারে। কি যে সব ভাবনা! নিজেরে জাহির করা খালি। কত যে কথা। আসলে কোন কথাই আর কথা ছিল না তখন, ছিল নরোম মোলায়েম কোন পাখি। উচ্চারণমাত্রই তারা উড়ে যায়। রাই, তুমি কথা বলো না কেন? এই প্রশ্নে আমার আড়ষ্টতা বাড়ে। বলতে তো চাই আমি। আমি পাখির কথাই বলি। কিন্তু যিনি বলছেন, অবদমনকারী, তার বমিতে ভেসে গিয়ে কোন ভাষা কি আর জন্ম নিতে পারে?

আমরা স্বপ্ন সাজাই। আর কি কি করতে পারি আমরা, আমি ও আমার বন্ধুরা, একটা দমকা হাসির ভিতর দিয়েই উড়িয়ে দিতে পারি সমস্ত সন্দেহ লিবা’র, একটানা বিকাল থেকে শুরু করে, রাত অবধি। লোডশেডিং এর আধাঁর যখন নামে, চাঁদের ফকফকা আলোতে তখন লিবারে জিগাই, আজ কি পূর্ণিমা? তোমারে এমন সুন্দর লাগতেছে কেন? যদি আমি মরে যাই!

এত বিহ্বলতা। এত কাছ থেকে দেখা। তোমার চুল বারবার সরে আসতে চাইছে, ঢেকে দিতে চাইছে তোমার মুখ। তুমি হেসে বারবার সরাইতে চাইছো। তবু তাকাতেই পারছো না। কাঁপছে কন্ঠ। বন্ধুদের কাছ থেকে আমরা চাইছি একটু আড়াল। আর এই এইটুকু ছাদের উপর, পাষান্ডরাও পাচ্ছে না যেন কোন লুকানোর জায়গা। ঝিঁঝিঁ পোকাদের মতো কথাই বলে যাইতেছে, জোনাকিদের মতো তারা জ্বলতেই আছে। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে থেকে, অন্যদের কথা শুনে শুনে, তাকিয়ে থাকতে থাকতে, নিজেদের দেখতে দেখতে, কথাগুলি হারাতে লাগলো, যদি পাইতাম কোন আড়াল, ময়মনসিংহে, বক্ষ্মপুত্র তীরে… মেঘনার বাতাসে সেই আহাজারি, কল্পনাই এখন!

 

লাল টিনের গুদামঘর

স্বর্গ হইতে বিদায়! ছাদ থিকা নামতে হইলো। আশ্রয় নিলাম, লাল টিনের গুদাম ঘরের পাশে। পাশে বস্তি। মাগিপাড়াই এক রকম। কাঁটাঝোপের ভিতর দিয়া চলে গেছে রাস্তা। ব্রীজের গোড়ায়। সেইখানে পেশাব করা শেষে গিয়ে বসি সান্ধ্য-আড্ডায়। শর্ত একটা অবশ্যই সূর্য ডুবে যেতে হবে। আবছা অন্ধকারে যেন দেখা যায়, শুধু প্রতিকৃতিই।

ভাবি, এই টিনের ঘরের ভিতর ভূত হবো। সারারাত নেচে-কুঁদে ডর দেখাবো, লিবা’রে। প্রচন্ড শব্দে জেগে উঠবে শে। ঘুমের ভিতর থেকে। বুঝবে, এই ভূত তার প্রেমিকের। পুরাপুরি লোকাল।

দূরেই যাইতে চাই, অথচ কাছাকাছি এসে বসে থাকি। গ্রাম ছেড়ে দিয়ে গ্রামের মায়ায় শহরের ভিতর গ্রাম পুষে রাখে মানুষ যেমন। ফিরে ফিরে আসি। চলে যাওয়ার ব্যস্ততায় সামাজিক হওয়ার শেষ চেষ্টা চালাই। তোমার চোখের দিকে আর তাকাইতেই পারি না আমি। আর লিবা ভাবে, যেন আমি উদ্ধমুখী কোন বাষ্প, চায়ের কেটলি থিকা বাইর হয়া যাইতেছি।

যখন ফিরা আসি, মনে হয় সে কি মুগ্ধতা! শে কি আমারে ভালোবাসে? প্রশ্ন তো জাগতেই পারে মনে। তাই না? যেহেতু শেও ছলনাময়ী আর আমি সবসময়ই বোকা হইতে রাজি, এমনকি লাল টিনের গুদাম ঘরে গ্রাম থেকে উঠে আসা মফস্বলী ভুত পর্যন্ত!

 

ক্লাসরুমের বোকা বেঞ্চিগুলা

: তোমার সাথে আমারে আম্মা এই অবস্থায় দেখলে কাইটা মেঘনা নদীতে ফালাইয়া দিবো!

আহ্‌। বিষয়টা তাইলে আমি বা তুমি না অথবা রাই বা লিবা না, বিষয়টা হইতেছে তোমার আম্মা। তুমি ভালো বাসতেই চাও আমাকে, কেবল তিনি, যে তোমার সিদ্ধান্ত-কর্তা দোষটা শুধু তারই, আর কেউ-ই না!… কত যে ভালো লাগলো এই কথা তোমার, এই প্রথমবারের মতো আমার মনে হলো, এই মুহূর্তেই তোমার হাসিটাকে একটা দমকা দীর্ঘ চুমুতে শেষ করে দিই!

চুপ করে বসে আছি। দরজায় পাহারা দিচ্ছে রুদ্র আর শিমা। আমি জানি, তুমি সিদ্ধান্ত নিয়াই আসছো। তোমার প্রেমিকের কথাই তুমি ভাবতেছো এখন। এইটা তো বদলানোই যায়, কিন্তু কেন আমি জোর করবো তোমাকে! কেন তোমার পথই তোমাকে আমার দিকে নিয়ে আসে না?

 

সিঁড়ির গোড়ায়

: আচ্ছা বলো, কি বলবে তুমি?
: হ্যাঁ, বলবো…
: বলো, তাহলে, তাড়াতাড়ি বলো, কেউ কিন্তু চলে আসবে
: হ্যাঁ, ই-ই-য়ে, মা-নে, মানে আমি আসলে, তুমি তো জানো

লিবা দাঁড়ায়ে আছে দুইটা সিঁড়ি উপরে। আর তার নিচে রাই দাঁড়াইছে। মনে হয় অনেক অনেক দূর থেকে রাই মুখ তুললো। দেখলো, লিবা সরাসরি তাকিয়ে আছে তার চোখে। কৌতুক খেলছে তাঁর চোখগুলিতে। চকচক করছে রাতের হাজার তারা। কি সুন্দর তাঁর ঠোট! ঠোঁটও হাসছে, ভাঁজ পড়ছে গালে, কি মসৃন তাঁর গালের ত্বক! শে যা জানে বা যা শে শুনতে চাইছে বা আমি যা বলতে চাইছি, কেন রাই বলতে পারতেছে না আটকে আছে আর তোতলাচ্ছে, কছ না শালার ব্যাটা, আর একবার অন্তঃত…

: হ্যাঁ, বাবা জানি, বুঝচ্ছি, উপর থেকে কে যেন আসছে, তুমি যাও!
: হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তো কিছু বললা না!!
: ঠিক আছে আমি পরে জানাবো (হাসি)… কে জানি আসছে… তুমি যাও…
: হ্যাঁ, কিন্তু…
: কালকে কলেজে দেখা হবে, ক্লাসের শেষে, যাও এখন…

বলেই লিবা উঠে গেলে উপরে।

বন্ধুগণ এতক্ষণ ছিলেন ভেড়ার সঙ্গী। এখন আমিও তাই। শিমা’র গর্জন, কথা কইচছ তো ঠিক মতো… হ, কইছি… কী কইলো… কালকা দেহা করবো… ঠিক আছে, এহন খুশি তো, মুখ ব্যাজার কেন… রাই ভাবতেছিল যে, লিবা কেন এত হাসতেছিলো, কেন? ছাগল তো ছিলামই, গরুও ছিলাম, এইবার ভেড়া হইলাম, নির্বিরোধ ফ্রেন্ডশীপের অফার দিবে না তো আবার?

 

বিচ্যুতি ও বিচ্ছেদ

আমি যে ভুলে যাবো তোমারে, এইটা আর অন্যরকম কিছু না। সন্দেহের দড়িতে বান্ধা যে জীবন, মে বি তার আর অন্য কোন উপায়ই নাই। একটা সুতা থিকা আরেকটা সুতায়, ঘুরতে ঘুরতে ভাবনার কতদূর পর্যন্ত যে যায়। ভাবনারা খুবই বিপদজনক। আর তার চাইতেও ঘটনাগুলি। তারা ক্রমশঃ দূরতিক্রম্ম্য হইতে থাকে। একটু একটু করে সরে আসা আর একসময় নিজেকে দেখতে পাওয়া খাদের কিনারে…

ভুলে যাওয়া যে, যে কোনকিছুই হারিয়ে যেতে পারে, যে কেউই হারিয়ে যেতে পারে

আর এটা এমন একটা বিষয় যে, অনুপস্থিতি ক্রমশঃ স্বাভাবিক হয়া আসে। বিচ্যুতির ভিতর বিচ্যুতিটাই স্বাভাবিক, সেটা আর বিচ্যুতি না কোন। একইভাবে বিচ্ছেদ এরও কোন অন্ত নাই। নিস্তরঙ্গ নদীর জল, শীতের বিকালবেলায়, যেন কোনকিছুই ঘটে নাই কোনদিন।

 

ডায়েরী যদি লিখা হতো, তাইলে হয়তো লিবা এইরমও লিখতো পারতো

সারা বিকাল ধরে শুধু তার জন্য অপেক্ষা; হয়তো সে চলেই আসতে পারে। ছাদে, ব্যালকনিতে হাওয়াদের লুটোপুটির সাথে ঘুরে ঘুরে, অনেক দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে, যখন সন্ধ্যায় আলোগুলি নিভে এলো দিনের, সবকিছু ভারী হয়ে উঠলো ক্রমশঃ। তারপরও সে হয়তো চলে আসতে পারে, রাতের গুমটি ঘরে ফিরে যাবার আগে হয়তো ছায়া ফেলে চলে যাবে। সামনে রাস্তা, লোডশেডিংয়ের করুণ আলো, ঘিঞ্জি বস্তি, লাল টিনের বিশাল সরকারী গুদামঘর; তখন হয়তো ভূতেরা জেগে উঠবে এইখানে, যখন সে চলে যেতে পারে। একটিই তো মাত্র এই দিনের প্রতীক্ষা, অথচ কত সংশয়, আত্মচিত্তের বিক্ষেপ, শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে, বারবার পায়চারি করে, উদ্বেগের বিন্দুগুলিকে আরো জ্বলজ্বলে করে তোলা। গাছের পাতাগুলি ঘন হয়ে আরো অন্ধকার ডেকে নিয়ে এলো, এখন সামনে দুইহাত দূরের কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, আর সে তো কোন অধ্যায়, অব্যয়ের কাছে নত; ফিরে আসার কথায় কেবলি গড়িয়ে গড়িয়ে সরে যাচ্ছে, কোন দূরে; পিষ্ট চাকার দাগ কাদায়, থলথলে বৃষ্টির জলে, ডুবে যাচ্ছে; অন্য কোন আকার, পরিবর্তিত ও শংকাময়, এইভাবে একদিন হারিয়েই তো যাবে, সে ও তার প্রতিপক্ষ পরিপার্শ্ব। ক্লান্ত, ভাবনারাও থেমে থেমে আসে; যদি সে চলে আসে, যদি সে চলে আসতে পারে!

সকালবেলাটা আরো বিশ্রী, কড়কড়ে রোদের মাঝে গা ব্যাথা নিয়ে জেগে উঠা; তারপর ভয়াবহ শূন্যতায় নিজেকেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এই শ্বাপদসংকুল অঞ্চলে, যেইখানে পরিচিত মুখগুলির দিকে তাকিয়ে ভয়ে বিহ্বল হয়ে আসে আত্মা; পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সুদূরের কাছে, যেইখানে হয়তো সে নিরুদ্রুব জীবন-সংসারে বেঁচে আছে, আর আমিও তার ছায়ায় পাশাপাশি। অথচ সেই ইচ্ছেগুলি ঝাঁঝালো রোদ হয়ে দিন বাড়তে থাকার সাথে সাথে উত্তপ্ত হয়ে নিজেদেরই গিলে খায়। একটা গোলকের ভিতর আবারও প্রত্যাবর্তন। যদি আমিই বেরিয়ে আসতে পারতাম, উন্মুখ প্রান্তরের কাছে এসে নত হয়ে পড়ে থাকতে পারতাম; তাহলে সে না-ই আসলো, আমি জগতদাত্রীর এই লীলায় মিশে গিয়ে তাকে ফিরে পেতে পারতাম।

 

চিঠিগুলি

————————–

নিস্তরঙ্গ ঘুমের ভিতর, চিঠির দিনগুলি ফুরিয়ে গেলে আবার, মৃদু পায়ে কারা উঠে আসে
ডাকঘরের বা থেকে ঘরে ঘরে, বিলীয়মান শব্দে, আবারও মুছে যায়;
প্রভাতের আলো আসে জানালা গলে, শীতের নরম দিন, বানর নাচছে সকালে…

————————————————

জবাব লিখছি তোমার চিঠির
ঘর-সংসারের আরো কত কথা তুমি জানতে চেয়েছো
আমিও এখন বলতে পারি অনেককিছু
যেমন ধরো, এখনো বর্ষার নদী ছড়ায়নি তার আঁচল
সবুজ ধানের ক্ষেত সোনালি হয়ে উঠেনি পেকে আর
নতুন রাস্তার বুকে মাটি জমা করার পর সবে ইট ফেলা হয়েছে
ঢালাইয়ের কাজ শেষ হতে না হতেই বৃষ্টি চলে আসবে
তোমার রিকশা খানা-খন্দে আটকে বারবার ঢেকুর তুলবে
ওর বারোটা বাজবেই, যদি ওই পথে তোমার চিঠি না এসে তুমিই চলে আসো
দেখবে মলিন হাওয়ারা পাল্টাছে ডানা
কতকিছু থেমে আছে, কতকিছু থেমে নেই

পোস্টকার্ড পাঠিয়ো আরো, সম্ভব হলে
চিঠি লিখবার দিনগুলি শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত

——————————————————-

সেলাই মেশিনে করা ফুল তোলা নকশা পাঠিয়েছো।
বারান্দায় বসে করা, তাই তাতে ফুটেছে নানা আকৃতি, বিক্ষিপ্ত ও চঞ্চল মন।
ফুল আছে তিনটা, লাল রংয়ের, পাতাগুলি সবুজ আর হলুদ সুতায় তোলা।

সেলাইমেশিনে হাত রেখে অনেকসময় কাটলো তোমার
মেঘনাব্রীজ পার হয়ে ট্রেন ছুটে গেলো ষ্টেশনের দিকে।

গাঢ় সেন্টের গন্ধমাখা তোমার রুমাল পোস্টম্যান দিয়ে গেলো
কী লিখবো এর প্রত্যুত্তর, ‘আর কবিতা নয়
তুমি লিখো অনেক দীর্ঘ, দি-ই-র-ঘ আমার চিঠি’
প্রত্যাভিক্ষা তোমার!

 

বহুদিন, অনেকদিন, তারও পরে আরো অনেকদিন পরএকটি বিকেলবেলা

একদিন বিকালবেলায়, লিবা আমারে একটা গল্প শুনাইলো। লিবা বলতেছিলো, একদিন দুপুরবেলা বাসায় শুয়ে শুয়ে রেডিওতে একটা নাটক শুনছিলাম (এককালে রেডিওতেও নাটক প্রচারিত হইতো, ভুইলেন না পাঠক!)। নতুন বিয়ে হয়েছে, এক দম্পতির, তাদের গল্প। দু’জনেই তরুণ। স্বামীটা ভালো চাকরি করে। বউও সুন্দরী। এমন একটা সংসার। কিন্তু কোন একটা কারণে বউটার ভালো লাগে না। মন-মরা থাকে। কারণ স্বামীটা তার সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, কিন্তু বাড়তি কোন কথা নাই। বউটার অস্বস্তি দিন দিন বাড়তে থাকে। এমন করেই দিন কাটে। দেখতে দেখতে একদিন তাদের সংসারে আসে নতুন অতিথি…

তোমার কি নাটকের গল্পটা শুনতে ভালো লাগছে না? … না, না বলো, শুনতেছি তো; কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারতেছি না… পুরাটা শুনো তাহলে আগে…

তো ছোট্ট শিশুর আগমনে তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা খুব খুশি হলো। আগে তো বউটা একটা অস্বস্তি নিয়ে থাকতো, হয়তো এবার এটা কেটে যাবে, শে নিজেও এটা ভাবলো। সত্যি সত্যি নতুন জন্ম দেখে, শিশুটিকে দেখে, স্বামীটা খুবই খুশি হলো। অফিস থেকে ফিরে সারাদিন বাচ্চাটাকে নিয়ে মেতে থাকে। বাচ্চাটার জন্য তার সে কি ভালোবাসা! কখনো একটু কাঁদলে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখে, সারাক্ষণ খেলা করে, এইসব। কিন্তু বউয়ের দিকে তার কোন নজরই নাই। যেন আগের থেকে অনেক কমে গেছে। আগে তো তাও কথা বললে জবাব দিতো, এখন বাচ্চা নিয়ে সে এতই মশগুল যে অনেকসময় খেয়ালই করে না। যখন এইরকম পরিস্থিতি তখন একদিন বউটা বাচ্চাটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসলো। তার বাবা-মা জিজ্ঞেস করলো, চলে এলি কেন? তখন শে বললো যে, যে স্বামী তাকে ভালোবাসে না, তার সাথে ঘর করা যায় না। কয়েকদিন পর স্বামী আসলো। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, কেন শে চলে এসছে? বউটা অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। বললো, তুমি আমাকে যখন ভালোবাসো না তখন এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছো? স্বামীটা বললো, কে বলেছে যে আমি তোমাকে ভালোবাসি না? … কিন্তু ভালো যে বাসো এই কথা কি কখনো বলেছো? … এই কথা শুনেই স্বামীটা আকাশ থেকে পড়লো, বললো, কেন? ভালো যে বাসি এই কথাটা কি তুমি বুঝতে পারো নাই? … তুমি যদি না-ই বলো আমি বুঝবো কেমন করে? বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো বউটা … তখন স্বামীটা তাকে জড়িয়ে ধরে, কানে কানে বললো, ভালোবাসি, ভালোবাসি…

তো এই হচ্ছে গল্প। এই বলে লিবা সরাসরি তাকালো আমার চোখে। বললো, আর তোমার প্রতি আমার উপদেশ হচ্ছে, তুমি যাকে বিয়ে করবে, তাকে প্রতিদিন না হোক, প্রতি সপ্তাহে না হোক, অন্তঃত মাসে একবার বলো যে, তুমি তাকে ভালোবাসো। তা নাহলে বেচারা বুঝতেই পারবে না, তুমি তাকে ভালোবাসো কিনা। তারপর, চোখ নামায়া, একটু গলা নিচু করে বললো, এই নাটকটা শোনার পর আমার তোমার কথা মনে হয়েছিল।

আসলে আমি এর কি-ই বা জবাব দিতে পারতাম। নতমুখ চিবাচ্ছি ঘাস, যেন তোমার গলির মুখে দাঁড়ানো কেবলই একটি ছাগল… যে কোন উচ্চারণ মাত্রই অব্যক্ততা, অর্থহীনতা।

একসময় উঠে আসি মাঠ ছেড়ে আমরা। রাস্তা দিয়া হাঁটি, চারপাশে কতই না মানুষ, কতই না গাড়ি, প্রাইভেট কার, বাস, টেম্পু, রিকশা, এর ভিতর দিয়াই শেষ হলো ভালোবাসার একটা বিকেল। এইরকম ঘটনা, খুবই অ-পার্থিব একটা ব্যাপার, তাই না? এই যে গল্প বলা, মানে এইটাই তো একমাত্র কথোপকথন এর স্মৃতি। এর আগের দিন যে, লারুরে দেখছিলাম তোমার পাশে বসা, সেইটা এখন আমি ভুইলাই গেছি!

 

শেষ চিঠি

ভুলে যাবো বলেই লিখেছিলাম একটা চিঠি। সেই চিঠি যার একটা অক্ষরও আমি আর মনে রাখতে চাই নাই। আর সেই প্রতিজ্ঞা এতোটাই সর্বগ্রাসী ছিল যে, এখন চাইলেও তার কোনকিছুই আর মনে করা সম্ভব না। তারচে’ একটা উপকথা-ই বলি!

একটা লোক হাঁটতে হাঁটতে তার জীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসছে। তখন সামনে সমুদ্র। সূর্যাস্তের আকাশ। বালিতে বসে বসে সে তার জীবনের পার হওয়া পায়ের ছাপগুলি দেখতে পাচ্ছে। সে খুব অবাক হয়ে দেখলো, সারাটা জীবন তাঁর দুইটা পায়ের ছাপের পাশে চলে আসছে আরো দুইটা পায়ের ছাপ। সে অবাক হয়ে খোদাকে জিজ্ঞাসা করলো, হে খোদা, এইটা কি? সূর্যাস্তের আকাশ বললো, সারা জীবনে তুমি কখনোই একা ছিলে না; সবসময় আমি-ই ছিলাম তোমার পাশে। তখন সে খুব ভালো করে আবারো দেখলো তার জীবনের পার হয়ে আসা পায়ের ছাপগুলি। তখন সে আরো অবাক হয়ে দেখলো, তাঁর জীবনের দুইটা জায়গায় শুধু এক জোড়া পায়ের ছাপ। আর সে দেখলো, ঐ দুইটা সময়ই ছিল তাঁর জীবনের সবচে’ কষ্টের সময়, সবচে’ বেদনার মুহূর্ত আর তা দেখে সে খুবই মর্মাহত হলো। বললো, হে খোদা, আমার এইরকম বিপদের দিনে, তুমি কেন আমার পাশে ছিলে না! সূর্যাস্তের আকাশ বললো, আমি তোমার পাশে ছিলাম না, কারণ তখন আমি নিজে তোমার সত্তাকে ধারণ করেছিলাম আমার ভিতর আর তোমাকে রেখেছিলাম আমার কোলে, যাতে জীবনের এই কষ্টগুলি, বেদনাগুলি তোমাকে গ্রাস করতে না পারে।

এই উপকথা পড়েই আমার মনে হয়েছিল, আসলে হয়তো আমি তোমার প্রেমিক হইতে চাই নাই; চাইছিলাম তোমার ঈশ্বর হইতে আর তোমার কাছে সর্মপিত করতে চাইছিলাম আমার আত্মাকে!

 

তোমারে দেখেছে কেউ

স্টেশনে যখনই আসি, ভাবি দেখা তো আমাদের হয়াও যাইতে পারে! দেখা যে হয় না, এইটা অনেক ভালো একটা ব্যাপার। মনে যে হয়, দেখা তো আমাদের হয়াও যাইতে পারে, এতে কিছুটা বিহ্বলতা আসে, ভাবনা আসে, রাগও লাগে যে কেন এই চিন্তা! ষ্টেশন এর পাশে হরি’র বাড়ি। হরি’র কথা আর মনে হয় না। মনে হয় যে, সে একদিন তোমারে চিৎকার করে বলতে চাইছিলো, আমার নাম; রররররাইইইইইই… তুমি ধবলা, আমি শ্যাম কই পাই?

এই করে করেই আসলে সময় পার হয়। আমি ভাবি যে, ‘যদি দেখা হয়’, এই চিন্তাটাও যে মাঝে মাঝে আসে, তার আর কোন কারণই নাই। কারণ নাই অথচ ভাবি, উদ্দেশ্য ছাড়া যেমন হাঁটি, ঘুরাফিরা করি। এই যেমন আর ভাবতেই চাই না, থেমে পড়ি। আমি না দেখি, তোমারে তো দেখছে কেউ। তখন খুবই খারাপ লাগে। আমি কি এতোটাই পাপী? আমার প্রায়শ্চিত্তের আর কি কোন শেষ নাই? এতোটাই দূরে কেন আমি এখন, যেখানে দূরত্ব এক মাইলও না?

 

শালা, মিলিটারি!

: এর পিছনে কি মিলিটারি আছে নাকি?

: শালার মিলিটারিই তো এই দেশটারে খাইছে।

: মিলিটারির উপর তোর এত ক্ষোভ কেন?

: শালার লিবাও তো একটা মিলিটারিরেই বিয়া করছে। শে চাইতেছিলো একটা নিশ্চিন্ত জীবন।

: ওর হাজব্যান্ড মিলিটারি হইলেও মেইন স্ট্রিমে নাই। সাকসেসফুল হইতে পারে নাই।

: পারে নাই তো কি হইছে। ও তো লিবারে পাইছে!

: ব্যাপারটা কিন্তু এইরকম না। শেষদিকে ওর ফ্যামিলিও রাজি ছিলো না, বরং লিবা’র ফ্যামালিরই আগ্রহ ছিলো বেশি।

: যা-ই হোক। ব্যাপারটা ভাবতে আমার ভালো লাগে না।

: তুই এখনো এইটারে ধইরা রাখচোছ।

: না, আসলে এইরকমও না। আমি যে সবসময় লিবা’র কথা ভাবি এইরকমও না। বা কোনসময় যে খুব বেশি মনে হয়, এইরকমও না। এই যেমন তুই কথাডা তুললি তখনই মনে হইলো। মনে হইলে কেমন জানি একটা শূন্যতা লাগে খালি। এর বেশি আর কোনকিছুই না। আসলে ব্যাপারটা বুঝানো যাইবো না। একটা বিশাল হা করা গর্ত, এইটুকুই… মাহমুদুল হকের গদ্যের লাগান কাব্যময় না, একটা অব্যক্ততা, হাসফাঁস করার মতো, যা থিকা বাইর হওয়া যায় না আর…

: শেষদিকে লিবা তো ওদের বাড়িতে গিয়া বইসা থাকতো, ওর মা-বাপের মন জয় করার লাইগা।

: ঠিক আছে, যা হওয়ার হইছে, বেটির তো বিয়া করা লাগবো, নাকি? তবে যা-ই কছ, মিলিটারিরা আসলে এক একটা বাইনচোত।

: হা হা হা, তুই আসলেই ক্ষেপছোছ!

: এইখানে না খেইপা কোন উপায় নাই। ওরা তো সব দিক দিয়াই প্রিভিলাইজড। লিবা যদি কোন মিলিটারিরে বিয়া করতে চায় ওর তো কোন দোষ নাই। শে একটা সিকিওরড লাইফই তো চাইছে।

: ভেদারে শে হয়তো পছন্দও করতো, ভালোও বাসতো।

: লিবা’র যদি ভালবাসার কোন বিষয় থাকে, সেইটা শুধুমাত্র আমার সাথেই জড়িত। এর বাইরে তার জীবন আছে, কিন্তু ভালোবাসার কোন বিষয় আছে বইলা আমার মনে হয় না।

: ঠিক আছে, বাপ! ও এমনেতেই বাস্তববাদী ছিল। আর ওর সিদ্ধান্ত তো ভুল কিছু হয় নাই। বিয়ার পরে একটু মোটা হইছে, এই আর কি! এইটা তো তুইও হইছোছ।

: হহ্‌! এতক্ষণে ভালোবাসা ব্যাপারটার একটু টাচ্‌ তুই পাইলি!! শালার তরার লাইগাই আমার প্রেমটা হইতে পারে নাই। আমি একলা গেলে ঠিকই পারতাম। সবসময় তরার জ্বালায় আমি তো কোন কথাই কইতে পারতাম না। মজাডা তো তরাই লইচছ।

: তুই শালা, এহনো এইরহমই মনে করিস!

: আমার মনে করা দিয়া কিছু যায় আসে না। বিষয়টার তো একটা শেষ হইছে। আমিও আর লিবা’র কথা ভাবি না। শালার তুই-ই তো মনে করাইলি।

: আমি তো মিলিটারির কথা কইছি। তুই না লিবা’র কথা আনলি।

: শালা, মিলিটারি!!

 

সময়ের ঢেউ

একটা সার্টেন টাইম পরে নিজেদরকে ভুইলা থাকতে পারাটাই আসলে প্রেম। বালির উপর লিবা’র নাম লিখে বসে আছি, অপেক্ষা করছি সময়ের পরবর্তী ঢেউ কখোন আসবে; মুছে দিবে এই শব্দ, আহাজারি, কথা ও কাহিনিগুলি…

 

মার্চ, ২০০৮

Leave a Reply