উচ্চ-প্রযুক্তির সমাজগুলিতে একজন ইন্টেলেকচুয়ালের কোনো দরকার নাই – ভি.এস.নাইপল

নাইপল এর কথা বলা

নাইপলের এই কথা-বার্তা অন্য কোন একটা জিনিস খুঁজতে গিয়া পাইছিলাম, তেহেলকা ওয়েব-এ।  কপি কইরা রাইখা দিছিলাম, পড়লাম কিছুদিন আগে। নোবেল পাওয়ার পর তার কিছু কথা এবং তার সম্পর্কে নানাজনের মন্তব্য দেখছিলাম, যেইটা পইড়া উনারে নিয়া আগ্রহ হয় নাই খুববেশি। কিন্তু এই ইন্টারভিউটা ইন্টারেস্টিং। তার ভাষা, এতোটাই সহজ যে,  এর অনুবাদ বাহুল্য মনে হয়। আর. কে. নারায়ন-এর ইংরেজীর মতোন। এইরকম ইন্ডিয়ান ইংরেজীর বাংলা করার তেমন দরকার আসলে নাই। তারপরও মনেহয় যেই লেখার উপর বেইজ কইরা আমি  বলতে চাইতেছি সেইটারে বাংলায় আইনা না কইলে একটা ফাঁক থাকে। আমি আলোচনা করতেছি বাংলাতে আর বাংলাতেই সেই লেখাটা নাই; থাকতেই হবে এইরকম কোন শর্ত নাই, কিন্তু থাকলে মনেহয় ভালোই।

সাক্ষাতকার যিনি নিছেন, ফারুক ধন্দী, একজন ইন্ডিয়ান রাইটার, ট্রান্সলেটর। নাইপল নিয়া বেশ উৎসাহী। নাইপলরে নিয়া উনার এক বিশাল লেখা আছে। তেহেলকাতেই ছাপা হইছে সেটা, বেশ কয়েকটা পর্বে।

নাইপল এর কথা বলায় শেষ দিকে আসছে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। একটা জাতির ক্ষেত্রে বা জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ‘সুখ’ হিসাবে যে জিনিসটারে উনি প্রাধান্য দিছেন, সেইটা মনে হইছে,  ইকোনমিক ডেভলাপমেন্টের একটা ব্যাপার। যেইখানে মোকাবিলার কিছু আছে, সেইটা ইন্টায়ারলি ইকোনমিক একটা ঘটনা। উদাহারণ হিসাবে, তিনি আঠারো শতকের ইউরোপের কথা বলছেন, যখন তারা গরিব আছিল আর তারা (ইউরোপিয়ানরা) এখন সুখী কারণ তারা এখন আর গরিব নাই। একইভাবে তিনি বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আনছেন। কিন্তু এক ধরণের শ্লেষ আসলে এইটা, প্রান্তিকতার প্রতি উনার এই লোভ। মোকাবিলা করার মতো কিছুই যে আর উনি খুঁইজা পাইতেছেন না, এইটা পুরান শত্রুতার প্রতি উনার ভালোবাসাই। উনি এমন একটা জায়গা জায়গা থিকা ইস্যুগুলিরে ডিল করতেছেন, যেইটা আর এগজিস্ট করে না। তো, এইটা যে নাই তা না; বরং যা আছে, তারে নতুনভাবে লোকট করার একটা আর্জও হইতে পারে এইটা। যদিও সেই পসিবিলিটি বেশ কমই, উনার টেক্সটে।

এই কারণে নাইপলের কমেন্টগুলিরে ফাঁপা বুলি বইলাই মনে হইছে। কোনকিছু চিন্তা না করতে চাওয়ার একটা প্রবণতারে উনি হাইলাইট করছেন। উনার চিন্তার ভিত্তিটা পশ্চিমা ধরণের লিনিয়ার একটা রুচিবোধ। যেইটা সবসময়ই একটা ভ্যালু তৈরি করতে আগ্রহী। কিন্তু যেই জিনিসটা ইন্টারেস্টিং,  চিন্তার জায়গা থিকা নাইপলকে বাতিল কইরা দেয়া যায় এবং তাঁর সমালোচনাও করা যায়; কিন্তু যেভাবে উনি কথা বলেন, সেইটাতে চিন্তার চাইতেও তাঁর যে ভঙ্গিমা, ভাষা ও ভাবনা, তার একটা ব্যাপার থাইকা যায়।

এইখানে দ্বন্দ্বটা আসে – চিন্তার  আর বোধ বা ভাষার। কেউ একজন চিন্তাবিদ হইতে পারেন, এই অর্থে যে তিনি নতুন ভাবনাগুলিরে এক্সপ্লোর করতেছেন, কিন্তু তাঁর বলবার বিষয়টা সবসময়ই ‘সাহিত্য’ হয়া উঠতে পারে না। আবার বিপরীতভাবে, সব সাহিত্যকর্মই চিন্তার জায়গাটারে এক্সপ্লোর করতে পারে না বা এইটার কি কোন দরকার আছে কিনা? রণজিৎ দাশ একবার খুব চেইতা গিয়াই কইতেছিলেন, একমাত্র উৎকর্ষতা ছাড়া কবিতার আর অন্য কোন বিচার হইতে পারে না। [‘উৎকর্ষতা’ 🙂 ] অথচ ‘সাহিত্য’ সবসময় রাজনীতি, দর্শন আর সামাজিকতার সাথে রিলিটেড একটা ব্যাপার। হয়তো একজনের রাজনীতি’রে আপনি সার্পোট করতে পারতেছেন না, তাই বইলা ‘সাহিত্য’রেও কি ঠেলা দিয়া সরাইয়া দেয়া যায় কিনা?

নাইপল এর কথাগুলি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নাই আমার কাছে, কিন্তু যেভাবে একটা অভিজ্ঞতার জায়গা তিনি বলেন তা খুবই আর্কষণীয় একটা ব্যাপার। তবে এইভাবে ফর্মের যে এক্সপ্লোরেশন, সেইটা নতুন চিন্তারেও জায়গা দিতে পারে – এইটারেও বাদ দিতে চাইলাম না।

২৪.০৩.২০০৮

——————————————

 

উচ্চ-প্রযুক্তির সমাজগুলিতে একজন ইন্টেলেকচুয়ালের কোন দরকার নাই

নোবেল বিজয়ী ভি এস নাইপলের সাথে কথা বলছেন ফারুক ধন্দী ।

অগাস্টাস নামের বিলাইটা ডাইনিং রুমের একটা চেয়ারের উপর বইসা আছে যেইখানে নাদিরা, লেডি নাইপল আমাকে এক কাপ চা এবং অমলেট বিস্কিট দিতেছেন। আমি লন্ডন থেকে হুইলসারে ড্রাইভ করে আসছি আর উনি বললেন আমার গা গরম করা দরকার, ইংল্যান্ডে এখন একটা শৈত্যপ্রবাহ চলতেছে। অগাস্টাস স্বাভাবিক, নিজের শান্তির ভিতরে বইসা আছে, যদিও নাদিরা কইলেন যে, ও এখন পায়খানা করতেছে।

‘যাও, সানরুমে দেইখা আসো’ তিনি বললেন। আমি এই বাড়িটার সাথে পরিচিত এবং কিচেন ও ইউলিটি রুমের মাঝখান দিয়ে কোজি রোদেলা জায়গাটাতে গেলাম, এটা বিদ্যা এবং নাদিরার যেমন, তেমনি অগাস্টাসের এলাকাও। অগাস্টাসের খাবারের পাত্রে একটা মৃত রেন্ পাখি পড়ে আছে, বিলাইয়ের সুস্বাদু খাবারের উপর। আরেকটার কিছুটা ছোট পা উপরের দিকে উঠতে চাইতেছে, একটা গোলা শরীর থিকা,  এক পা দূরে মইরা পড়ে আছে।

“ও রেন্‌দের একটা আস্তানা খুঁইজা পাইছে।” আমার পিছন দিক থিকা বিদ্যা কইলেন। “আমার কাছে যদি বন্দুক থাকতো তাইলে গতকাল রাইতে আমি ওরে গুলি করতাম।”

বিদ্যা ঠাট্টা করতেছেন না। তিনি কঠোর কিন্তু একজন কনর্ভাটেড ভেজিটেরিয়ান না। প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতারে উনি ঘৃণা করেন এবং যদিও তিনি কখেনোই চান না  “একজন সিদ্ধান্তে অনঢ় বাতিকগ্রস্ত লোক হিসেবে পরিচিত হইতে”; বললেন যে তিনি পশুদের প্রেমের লাইগা তাঁর নাম এবং ভালোবাসা ধার দিতে পারেন।
“আমি মেনেকা গান্ধীরে পছন্দ করি র্ফামের পশুদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এটা জায়েজ হওয়া উচিত না।” উনি বললেন।

পরে পলেন্টা এবং চিংড়িমাছ দিয়া দুপুরে খাওয়ার সময় উনি পশুদের ভাবনায় ফিরা গেলেন।

“আমি তোমারে বলছিলাম যে আমি প্লুর্তাক-এর গ্রীসে ভ্রমণের বর্ণনাটা পড়তেছিলাম; উনি গ্রীক থিয়েটার দেইখা খুব মুগ্ধ হইছিলেন। সেইখান থিকা ফিরার পরে তার পরামর্শে সম্রাট রোমে একটি থিয়েটার তৈরী করেন।”

“তার উদ্বোধনের সময়” বিদ্যা বললেন “পঞ্চাশটা সিংহ জবাই করা হইছিল – অনুষ্ঠানটা জাঁকজমকপূর্ণ করার লাইগা। জায়গাটা অবশ্যই তাদের রক্ত দিয়া ধোয়া হইয়া গেছিল… ”

বিদ্যা খাওয়া বন্ধ করলেন। তার চেহারাটা বিষণ্ন আর চিন্তিত দেখাইতেছিল।

দুপুরের খাবারের পর বিদ্যা আমারে কইলেন আমার নোটগুলি দেইখা নিতে, ঠিকঠাক করার কিছু আছে কিনা। আমি তাঁর কাছ থিকা ইন্সট্রাকশনগুলি নিলাম আর টেপ রেকর্ডার বাইর করলাম। শেষবার যখন আমি তার ইন্টারভিউ নিতেছিলাম, তখন আমাদের কথা-বার্তার মাঝখানে, এইটা বাজতে শুরু করছিলো। তখন বারবার এইটার কভারের উপর চাপ দিতে হইছিল এইটারে ঠিক রাখার লাইগা আর বিদ্যা বেশ বিরক্ত হইছিলেন। তিনি কইলেন,  এইটা বরং বন্ধ করো আর উনি আমার সাথে বাইর হইছিলেন আরেকটা টেপ রেকর্ডার কিনার লাইগা। আমরা স্যালসবেরী থিকা পাঁচ মাইল ড্রাইভ কইরা গিয়া নতুন একটা কিনছিলাম।

“নোট নিও” বিদ্যা বললেন; তার নিজস্ব পদ্ধতিগুলি থিকা একটা পরামর্শ দিয়া। “এইভাবে তুমি চিন্তা করতে পারবা কী বলা হইছিল, তোমার মনের ভিতর পরবর্তী প্রশ্ন করার লাইগা দৌড়াতে থাকার চাইতে।”

উনি উপরের রুমে গেলেন আর আমি নিচে সিটিং রুমে তার লাইগা অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি বললেন যে তিনি আমাকে তার নোটবইগুলি দেখাবেন, আমি হয়তো বুঝতে পারবো যে তিনি আসলে কী বোঝাতে চাইছেন নোট নেয়া বলতে। তিনি চারটা নীল মলাটের নোটবুক নিয়া ফিরা আসলেন, এক একটা একশ রুপির নোটের মতোন সাইজের।

“এইটা বিয়ন্ড বিলিভ এর জিনিস” উনি বললেন, “পুরা বইটা এইরকম নয়টাতে লেখা হইছে।”

এইগুলি লেখা হইছে খুবই সাবধানী, পরিচ্ছন্ন হাতে আর মাত্র একটা শব্দে করা প্রশ্ন থিকা উত্তরগুলি বাইর হইয়া আসছে যার উত্তর উনি লিখেছেন পুরা পৃষ্টা ধইরা।

“আর এই উত্তরগুলি, তারা কী কথার কথা (‘verbatim’)?” আমি জিজ্ঞেস করি।

উনি আমার ‘verbatim’ শব্দটির উচ্চারণটা ঠিক কইরা দিয়া কইলেন যে এইটা তা-ই।

আমার নিজের নোটবুক রেডি আছে। আমার কলমও কাজ করতেছে – গুড!

————————

“আপনি এখন কি কাজ করতেছেন, বিদ্যা?” আমার প্রথম প্রশ্ন।

“আমার নতুন উপন্যাসটা লেখা শেষ করার (যেইটা এখনো পাবলিশড হয় নাই) পরে আমি সেইটা গিল্যেনরে (গিল্যেন অ্যাটকিন হইতেছেন তার লিটারারি এজেন্ট) পাঠাইয়া দেই আর ওয়েট করতে থাকি। আমি খুব ক্লান্ত আছিলাম। কিছুদিন আমি কিছুই করি নাই। তারপর আমি পড়তে শুরু করলাম। আগের দিনে, যখন আমি লিখতাম টাকা কামানোর লাইগা, তুমি জানো, আমি একটা বই শেষ করতাম আর তারপর দৈনিক পত্রিকার কাছ থিকা কমিশন পাওয়ার লাইগা অপেক্ষা করতাম। এডিটরদের সাথে যোগাযোগ রাখতাম আর ভ্রমণের একটা অ্যাসাইন্টমেন্ট পাইতাম। একটা বই শেষ করার পরে আমার মন ক্লান্ত হইয়া উঠতো। আমি মানসিকভাবে মারা যাইতাম আর এইটা খুব বাজে যখন তুমি বুড়া হইয়া যাইতেছো। এই শেষটার পর আমি তিন সপ্তাহ রেস্ট নিছি। আমি ড্রাই হইয়া উঠি আর গিল্যেন এর কাছে থেকে খবর পাওয়ার লাইগা অপেক্ষা করতে থাকি। তারপর আমি আবার ফ্লবেয়ার পড়তে শুরু করি।”

তিনি রুমের বুকশেলফের দিকে যান, ভলিউমগুলি নামান এবং আমার হাতে তুইলা দেন।

“অরিজিনালটা পড়তেছেন আপনি?”

“আমি ফ্রেঞ্চ আর স্পেনিশ পড়তে পারি, স্কুলে শিখছিলাম।”

“ফ্রেঞ্চ পড়তে পারি না আমি” আমি বললাম।

“এর আসলে কোন দরকার নাই।” তিনি উত্তর দিলেন।

“তো, আপনি কী পড়তেছিলেন?”

“আমি মাদাম বোভারি আর দ্য সেন্টিমেন্টাল এডুকেশন  পড়তেছিলাম। আমি খুবই হতাশ হইছি। আমি বিধস্ত হইয়া তার শত্রুদের দলে ভিড়ছি। তারে আমি আমার লাইফে চূড়ান্তভাবে পছন্দ করতাম। কিন্তু আমি দেখলাম যে,  ফ্লবেয়ার ক্লান্তিহীনভাবে নিজেরে পপুলার করার ট্রাই করছেন। তুমি যদি ১৮৪০ সালের ফ্রান্সের ব্যাপারে আগ্রহী না হও, তাইলে এইটা পড়া খুব মুশকিল। এইটা খুব ছোটমনের ব্যাপার। যেহেতু যৌনতা নিয়া আমাদের পজিশনটা চেইঞ্জ হইছে আর কোন খুঁত না থাকার কারণে ফ্লবেয়ার’রে জীবনে প্যাশনের সাথে পড়াটা খুব কঠিন। তারে আমি পছন্দ করতাম তাঁর সিলেক্টিভিটি, তাঁর ডিটেইলস এবং বর্ণনার গতির লাইগা। মাদাম বোভারির প্রথম অংশটা এখনো আমার কাছে সত্যি মনে হয়। আমি মাঝে-মধ্যে লোকজনরে বলি এই দৃশ্যটার কথা যখন বোভারি – তরুণ ডাক্তার – যখন  ডাইকা নেয়া হয় আর সে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে দেখা করে। ঐ দৃশ্যটার সবটাই বাছাই করা। প্রতিটা ডিটেইল। তারপর বইটার দ্বিতীয় অংশে বড় কোন গন্ডগোল আছে। ফ্লবেয়ার হইতেছেন সেইসব লেখকদের পূর্বসুরী এখন যারা নিজেদেরকে ইউনির্ভাসিটিগুলিতে লুকাইয়া রাখেন। উনি রৌন-এ উনার মায়ের বাড়িতে লুকাইয়া থাকতেন। মাঝে-মধ্যে উনি মাঝে প্যারিসে যাইতেন আর লোকজনের সাথে দেখা করতেন, কিন্তু পৃথিবীর খুব কম মানুষেরই চিনতেন।

কিছু লেখক, যারা ইউনির্ভাসিটিগুলিতে ঘাপটি মাইরা আছেন তারা খালি তাদের আর্গুমেন্টগুলি নিয়া লেখেন, যা তারা মনে করেন অথবা সেই ছাত্রদের নিয়াই থাকেন যাদেরকে উনারা বখাইতে পারছেন। উনারা ইউনির্ভাসিটিগুলিতে থাকেন, কারণ উনারা নিরাপত্তা চান। আর তুমি জানো, তুমি কখনোই একজন লেখক হতে পারবা না যদি তুমি নিরাপদ হইতে চাও। শেষ পর্যন্ত তুমি থামবা গিয়া মর্টগেজ আর নিরাপদ চাকরি নিয়া লেখাগুলাতে।

ইংলিশ ট্রাডিশনে ইউনির্ভাসিটিগুলি থিকা খুব কম জিনিসই বাইর হইছে। গিবনের ইউনির্ভাসিটি নিয়া কিছুই করার আছিল না যদিও উনি বিশাল পান্ড্যিতপূর্ণ কাজ কইরা গেছেন। ডিকেন্সও ইউনির্ভাসিটি থিকা আসেন নাই।

ইংল্যান্ডে গভীর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে লেখা কোন বিশেষ বই প্রায় সবসময়ই একাডেমি থেকে বের হওয়া বই থিকা ভালো। আমি ভাবছিলাম Mungo Park-এর কথা এবং আফ্রিকা বিষয়ে তার অর্ন্তদৃষ্টি নিয়া।

“সবসময় কি এইরকমই হয়?”

“আমার মন হয় এখানে একটা পার্থক্য আছে ১৯৪০ এর আগে আর পরে ইউনির্ভাসিটিগুলি যা পয়দা করতেছে তার মধ্যে।

আরো অদ্ভুত সেইটা হইতেছে কিছু ইন্ডিয়ানরা, যারা এই ইউনির্ভাসিটিগুলিতে চাকরি চায় আর এই কারণে ওরা এই নকল ভাষা তৈরী করে, এই শূণ্যগর্ভ ভাষা আর ওরা শেষমেশ বান্দরে পরিণত হয়। ওয়েস্টার্ন ইউনির্ভাসিটিগুলির ইন্ডিয়ার উপর প্রভাব খুবই বাজে। এইটা আরোপ করে চিন্তা কী, ইতিহাস কী,  এইরকম কিছু ধারণা। ইতিহাসের ধারণাটা ইন্ডিয়ার সাথে যায় না। এইখানে একটা ইন্ডিয়ান ইতিহাস আছে, যেইটা এখনো লিখিত হয় নাই, একটা বড় দৃষ্টিভঙ্গী, কিছু মানুষজন যে মনোগ্রাফ লিখছে তার চাইতে বেশি কিছু। এই মনোগ্রাফের পদ্ধতি আর ফর্ম প্রয়োজন মিটায় না। ইন্ডিয়ার দরকার ছিলো বা পাইতে পারতো একজন গিবন।

“ঐতিহাসিক পাণিকর এর ক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন? নিশ্চয়, তার অনেক বড় দৃষ্টিভঙ্গিী ছিল?”

“পাণিকরের ক্ষেত্রে আমি যেটার প্রশংসা করি তা হচ্ছে তার এশিয়া অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন ডমিনেন্স (Asia and Western Dominance) বইটা।

এইটা জাভা এবং সুমাত্রা বিষয়ে, এই দ্বীপগুলির বাসিন্দারা ডাচদের কারণে ওইখানে আবাদী হইছিল, ওরা ওদের আত্মাগুলিরে বাঁচায়া রাখছিল। তিনি বলছেন যে,  ওরা এইটা করতে পারছিল ওদের ধর্মের কারণে আর এইটা সত্যিও, কিন্তু তিনি ধর্মের ব্যাপারে ভুল করছেন। উনি মনে করেছিলেন এইটা ইসলাম। জাভানিস এবং সুমাত্রিয়ানরা ছিলেন সর্বপ্রাণবাদী, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং ইসলাম ছিল একটা আরোপিত, জাতিগুলির আত্মা ধ্বংসকারী। ইসলাম ছিল একটা ধমান্তরিতের ধর্ম।

এটা মৌলবাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে। লোকজনরে বারবার বলা লাগবো তাদের পুরানো শয়তানির পথগুলি ছাইড়া দেয়ার লাইগা এবং নিজেদেরকে আরবের মরুভূমিতে ছড়াইয়া দেয়ার লাইগা।

তোমারে একটা গল্প বলি। ‘৯৫ এ আমার একজন ইরানি মহিলার সাথে দেখা হয়, যিনি পশ্চিম থেকে ইরানে ফিরা যাইতেছিলেন। শে ফিরা আসছিল ধর্মীয় রাষ্ট্রের জুলুমের প্রতি ক্রোধ নিয়া। “আমাদেরকে, আমাদের বউ এবং মাইয়াদেরকে আরবদের হাতে তুইলা দিতে হয় না, কিন্তু আমাদের নিজেদেরকেই সেইটা করা লাগে” শে কইছিল।

শে বোঝাতে চাইছিল যে, চুপ কইরা থাকা, মাথা নিচু কইরা থাকা এবং নিজেরে সাবমিসিভ রাখা। ইরানের বিপ্লব কোন পরিবির্তনই আনতে পারে নাই এই ধারণার মধ্যে যে, এইটা আনুগত্য দাবি করে। এইখানে রেভ্যুউলেশনারী গার্ডরা আছে আপনারে এইটা করতে বাধ্য করার লাইগা। আপনি জানেন, তারা একটা সিন তৈরী করতে পারলে খুশি হয়। তারা হঠাৎ কইরা হোটেল এবং রেস্তোরাগুলি ঢুইকা পড়ে। আপনি হয়তো সাইরাজ বা অন্য কোথাও আছেন, তারা খালি এইটা দেখার লাইগা আসবে যে, পুরুষ আর মহিলারা একসাথে আছে কিনা।”

এর আগে আমরা ভারতীয় লেখালেখি আর এর প্যাটার্ন নিয়া কথা বলছি; এখন আমরা এই বিষয়ে কিছু কথা বলবো। বিদ্যা এই ধারণা পোষন করেন যে, ভারতীয় লেখালেখির কোন সিগনিফিকেন্স এখনো শুরু হওয়ার অপেক্ষায় আছে। “যেসব লেখকদের লেখা আমি ইংরেজীতে পড়েছি মনে হইছে, সবাই অহংকারী। ওরা ওদের পরিবার আর ওদের বংশের লাইগা গর্বিত। ওদের কোন ঐতিহাসিক ধারণাই নাই যে ওরা কই থিকা আইছে বা ওদের সমাজের অসম্পূর্ণতার উৎসটা কী, এইটাও তারা জানে না। ওরা ওদের নিচের পেটের দিকে তাকিয়ে আছে, ওরা আটকাইয়া আছে ওদের নিজেদের দিকে তাকায়ে থাকাটাতে। ওদের আসলে দুনিয়ারে বলার কিছু নাই।

এই প্রেক্ষিতে উনি সবসময় মনে করেন উনিশ শতকের রাশিয়ার কথা, যারা সত্যিকারের বিকাশ-পর্ব দেখছে। “ওদের মতোন এখনকার ভারতীয় লেখকদের কী আছে ভারত আর তার ইতিহাস যা নিয়া ওরা লিখবে আর রিয়াল হইয়া উঠবে?”

“আমি মনে করতাম যে, ওরা এইটা করতেছে” বিদ্যা বললেন, “কিন্তু আমার মনে হয় আমি ভুল ছিলাম। উনিশ শতকের রাশিয়া হইতেছে উনিশ শতকের রাশিয়া আর স্বাধীন ইন্ডিয়া হইতেছে স্বাধীন ইন্ডিয়া। উনিশ শতকের রাশিয়াতে সাহিত্য আর বইপত্র আছিলো বাঁচা-মরার  একটা ব্যাপার। তারা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা বিস্ময়কর জিনিস আমি আবিষ্কার করছি যে, রাশিয়ান লেখকরা লেখার লাইগা ভালো টাকা-পয়সা পাইতেন। যখন তুর্গেনেভ প্যারিসে যান আর কথা বলেন, তখন প্রসঙ্গ আসে যে, ফরাসী লেখকরা কতোটা কম টাকা পান। তুর্গেনেভ অস্বস্তি বোধ করছিলেন ওদেরকে বলতে যে রাশিয়ান পত্রিকাগুলি তারে কতো টাকা দেয়। রাশিয়ানরা তাদের লেখকদের উপর নির্ভর করতো ওদেরকে একটা পারসপেক্টিভ দেয়ার লাইগা, বলার লাইগা যে তারা কে আর তাদের ইন্টেলেকচুয়াল লাইফরে বাঁচায়ে রাখার লাইগা। রাশিয়ান সমালোচক বেলোনেস্কি যিনি দস্তয়েভস্কি এবং তলস্তয়ের আগে লেখালেখির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে লিখছিলেন, মারা গেছিলেন টাকার অভাবে। তার বিধবা স্ত্রী একজন প্রকাশক পাইছিলেন তার রিভিউগুলি এবং লেখাগুলি নিয়া বই ছাপানোর লাইগা আর তিনি এর জন্য ভালো টাকা পাইছিলেন। তুমি জানো, শে ভালোভাবেই বাঁইচা ছিল।

ইন্ডিয়ান পত্রিকাগুলি – তুমি ভালো কইরাই জানো যে – একদম কিছুই দেয় না। ইন্ডিয়ান লেখালেখির একমাত্র যে কাহিনি আছে সেইটা হইতেছে এক মিলিয়ন ডলার অ্যাডভান্স পাওয়া। অ্যাডভান্স বিষয়ে বেশিরভাগ গল্পগুলি অবশ্যই সত্যি না – তারা শুধুমাত্র ফাঁপানো কথা। কিন্তু এইটা হইতেছে কারণ পশ্চিমের এজেন্ট এবং প্রকাশকরা যেইজন্য হতভম্ব হইয়া পড়েন জোয়ার-ভাটার চিঠি দিয়া, ‘মামাজি’ এবং ‘চাচাজি’র এবং ‘আবু’ এবং ‘পাপাজি’র। মামাজি এবং চাচাজি সম্পর্কে যে বিষয় সেইটা হইতেছে যে,  ওরাও অন্যান্য মামাজি এবং চাচাজির মতোই। এই লেখকদের নিয়া কিছুই বলার নাই। তারা দেখাইতে চায় যে, তারাও এইটা করতে পারে। যেইসব ইন্ডিয়ানরা ইংরেজীতে লেখেন, তারা বিদেশ’রে উদ্দেশ্য কইরা লিখেন। লোকাল ইন্ডিয়ানদের ‘মামাজি’ নিয়া পড়ার কিছু নাই।

“আমার মনে হয় এই ধারাটা যিনি প্রথম শুরু করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন বেদ মেহতা” আমি বললাম। “এর মাধ্যেমে তিনি ভালো লাভ করেছিলেন।”

“হ্যাঁ – তিনি ভালো ব্যবসা করেছিলেন” বিদ্যা বললেন, “কিন্তু তুমি কী মনে করো যে সে এটা শুরু করছিল? সত্যিকারভাবে তার একটা বই এই বিষয়ে ছিল না – আমি বলছি The Mahatma and his Disciples এর কথা। এইটা খুবই ভালো একটা বই। তিনি এমন লোকদের সাথে কথা বলেছিলেন যারা গান্ধীকে চিনতো, তারা মারা যাওয়ার আগেই। এইটা একটা জীবন্ত ইতিহাস। কিন্তু তুমি যদি একাট মনোগ্রাফের সংস্কৃতির ভিতর বসবাস করো, তুমি এইটারে কোন ইতিহাস হিসাবে দেখতে পাইবা না।

আমার মনে হয় অনেক বছর ধরেই ইন্ডিয়ান লেখকদের একটা বিশেষ পেশা আছিলো। কিন্তু এই চূড়ান্ত টেকনোলজিক্যাল সময়ে যা ঘটেছে তা লেখকদের আবশ্যিকভাবে থাকাটারে বাতিল করে দিছে। এটা খালি ইন্ডিয়ার লাইগাই সত্য না, যে কোন জায়গার জন্যই সত্য। একটা উচ্চ-প্রযুক্তির সমাজে একটা ইন্টেলেকচুয়াল লাইফের কোনো দরকার নাই… ”

“অবশ্যই সবসময় একটা প্রয়োজন তো থাকে” আমি দায়িত্বপরায়ণতার সাথে বললাম।

“তুমি তা-ই মনে করো? আমি ফিল করি যে প্রযুক্তি দখল করে নিছে আর ইন্টেলেকচুয়াল লাইফটা কমপ্লিট হইয়া উঠছে। ই-মেইল, মোবাইল ফোন, মানুষজন ছোট-যন্ত্রগুলি নিয়ে খেলতে ভালোবাসে, এই ছোট-যন্ত্রগুলি প্রলুদ্ধ করে কিনতে আর ব্যবহার করতে। এরা সবার কাছেই উন্মুক্ত যারা তাদের কিনতে পারে – হাতের তালু আছে এমন যে কোন বান্দর। টিভি আমাদেরকে খবরগুলি দিতেছে, এইটা দিনের ভিতর আমাদেরকে পঞ্চাশটা গল্প দিতেছে নাটকগুলিতে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা খবরের বিশ্লেষন করতেছে। লেখকের আর কোন দরকারই নাই।

আর এমনকি উচ্চ প্রযুক্তির সময়ে বিষয়গুলি ভুলও হইতে পারে। মিলিটারী বিপর্যয়গুলি, রাজনৈতিক দুর্যোগগুলিও আছে এইখানে, যে কোন ধরণের বিপদ এবং এমন একটা জায়গা যেইখানে ইন্ডিয়া নিজেরে টাইনা নিয়া যাইতেছে দুনিয়ার সাথে বোঝাপড়া করার জন্য। ভারতের সবচে পবিত্র মানুষগুলি আছে। পশ্চিম আফ্রিকাতে জ্যোতিষীরা জ্যোতিষীদেরকে পিটাইতেছে – তথাকথিত আফ্রিকান আধ্যাত্মবাদীরা – কোর্টের ঠিক বাইরেই। টেকনোলজিক্যাল সমাজের পরিপূরক হইতেছে যাদু আর কাল্ট। মানুষজন মনে করে এখানে একটা বৈপরীত্য আছে, কিন্তু আসলে তা নাই, ভারতে অথবা ইউএসএ তে এই জিনিসগুলি পাশাপাশিই থাকে।”

“আর ইংল্যান্ডেও?”

“হ্যাঁ, ইংল্যান্ডেও। কিন্তু ইংরেজ লোকজন ইংল্যান্ডকে দেখে একটা বিরাট সাফল্য হিসাবে – একটা সম্পূর্ণভাবে গড়ে উঠা একটা সমাজ যা ঘটছিল একশ বছর কিংবা তারও আগে। ডিকেন্সসিয়ান ইংল্যান্ড। মানুষজন থাকতো ত্যানার ভিতর, কোন জ্বালানী ছিল না তাদেরকে গরম রাখার জন্য। বার্লিন, সেন্ট পির্টাসবার্গ – তারা সবাই, একই – তারা সবাই ডুইবা ছিল মর্মান্তিক গরিবি’র ভিতর। তারা এইসব কিছুরে পরিবর্তন করেছিল। এইটা একটা বিশাল সাফল্য। তারা এখন সুখী।”

মুর্হূতের জন্য আমি বলতে পারবো না যে উনি ঠাট্টা করতেছিল কিনা।

“আপনি মনে করেন, তারা সুখী?”

“হ্যাঁ, তারা সুখী। হয়তো তাদের চেয়ে সুখী আছে একমাত্র বাংলাদেশীরাই। বাইরের দুনিয়া বাংলাদেশকে দেখে একটা বির্পযয়ের দেশ হিসাবে। তাদের ওইখানে ঘূর্ণিঝড়  হয়, বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। কিন্তু যখন সবকিছু থাইমা আসে তারা চালাগুলি আর ঘরগুলিকে আবার গইড়া তোলে, তাদের গ্রামে; সন্ধ্যাবেলায় যখন মুয়াজ্জিন ডাক দেয় মিনার থিকা নামাজের লাইগা, ওরা ওদের হৃদয়ের ভিতর থিকা জানে যে, কাফেরদেরকে তাড়ানো হইছে তাদের মাটি থিকা – আর তারা সুখী থাকে।”

এইরকম সুখের একটা কথার উপর আমরা শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিদ্যা আমাকে ডাইনিং রুমের দিকে নিয়ে গেলেন পলেন্টা এবং ডাল খাওয়ার জন্য।

“ওরে স্মার্ট লাগতেছে না?” নাদিয়া জিজ্ঞাসা করলেন।

“আমি হয়তো বলবো পরিপাটি, কালো ভেড়ার লোমের মতো ছাঁটা এবং ধূসর চেহারায়…”

“আরে বোকা, আমি ওর চুলের কথা বলতেছি” নাদিরা বললেন। “আমি নিজে কাইটা দিছি। এর জন্য ওরে হয়তো চল্লিশ পাউন্ড দিতে হইতো।”

“সতেরো” বিদ্যা বললেন, একদম ঠিক কইরা বলার জন্য উনি নাছোড়বান্দা “আমি সতেরো দেই।”

 

Leave a Reply