দোকানের লোকটা আমার ভাই

 

আমার যে তাড়াহুড়া আছে দোকানের লোকটা এইটা বুঝতেই ছিল না। লোকটার বয়স পঞ্চাশ-টঞ্চাশ হবে। এই বয়সে আসলে মানুষ এমনিতেই স্লো হয়া যায়। তারপরও মনেহয় নতুন। এইটা একটা চেইনশপ, কনফেকশনারি’র। স্ট্যটাস আছে একটা দোকানটার। আমি আগেও আসছি এইখানে। একটা কেক, দুইটা চকলেট পেস্ট্রি আর কিছু বিস্কিট কিনলাম। রাস্তার মধ্যে গাড়ি দাঁড়া করাইয়া আসছি, কোনসময় না ট্রাফিক পুলিশ ধরে, এই চিন্তা আছে। তারপরে অফিস থিকা বাইর হইতে দেরি করছি। এইটা ছাড়া আর টাইমও নাই এইসব জিনিস কিনার। বুঝলাম যে টাকা দিলে ভাংতি দিতে আরো দেরি করবে। এইজন্য জিগাইলাম, ভাই কার্ড নেন তো? উনি কন যে, না, ক্রেডিট কার্ড নেই না। আমি কইলাম, তাইলে ডেবিট কার্ড নেন? উনি কথা না কইয়া হাত বাড়াইয়া দিলেন। দোকানে আরো একজন লোক আছে, কাস্টমার, সবুজ রংয়ের স্যুট পড়া, টাইও আছে গলায়, শাদা শার্ট। বয়স দোকানদারের মতোই। একটু পরে পরে চোখ পিট পিট কইরা আমারে আর দোকানের লোকটা’রে দেখতেছে। লোকটার চোখে মুখে দুনিয়ার কনফিউশন। কি যে করতেছে, আল্লা জানে! উনার পিছে একটা ইয়াং পোলা, কি কি জিনিস জানি গুছাইতেছে; সেও তার ভয় দেইখা মজা পাইতেছে। লোকটা একটু পরে কাঁপতে কাঁপতে মার্চেন্ট কপি’তে সাইন করার লাইগা দিলো, যেহেতু তাড়াহুড়া আছে আমি অ্যামাউন্ট না দেইখাই সাইন কইরা দিলাম। তারপরে সে হ্যাপি হয়া আমারে বিলটা দিলো। বিলটা দেইখা তো আমি পুরা আকাশ থিকা পড়লাম। মানে, ফ্রম নো হোয়ার। আমি হ্যাজেলনাট কফি কোনসময় খাইলাম! ব্রেড কই নিলাম! এইটা কি!! মিয়া কাজ করতে জানেন না, খামাখা ঝামেলা করেন। মানে, মেজাজ পুরা বিলা হয়া গেলো! যাচ্ছে তাই কইতে লাগলাম। কারণ আমার ত টাকা আছে, তার উপরে সে ভুল করছে, আমার রাইট আছে ঝাড়ি দেয়ার, এই রাইট যে আছে, এইটা ভাইবা আমার ঝাড়ি’র জোর আরো বাইড়া যায়! যেহেতু আমি ঢাকাতে থাকি, সোবার ভাব নিয়া থাকা লাগে, গায়ে ত হাত তুলতে পারি না, মারামারিও করতে পারি না। এইজন্য কথার উপর দিয়াই পার করতে হবে।

লোকটা চুপ কইরা দাঁড়ায়া আমার কথা শুনতেছিল। মাথা নিচু কইরা। সে ত ভুলই করছে। তখন হঠাৎ পাশের সবুজ স্যুট পরা লোকটা দেখি কানতেছে। আমি ত অবাক, আমি আবার উনারে কি কইলাম! লোকটা কানতে কানতে পুরা কাঁপতেছে। আমি তার দুইহাতে গিয়া ধরলাম, বললাম, আরে, আরে, কি হইছে ভাই! তারে নিয়া একটা সিটে বসাইলাম, যেইটা সামনের দিকে সাইডে রাখা আছিলো। লোকটা বসার পরেও ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কানতেছিল। দোকানদার লোকটাও দেখি মাথা নিচু কইরা আছে। সেও কানতেছিল কিনা শিওর না।[pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

আমি লোকটারে জিগাইলাম যে, ভাই কি হইছে বলেন! উনি ত ভুল করছেন! আমি উনারে এইটা বলতে পারবো না! সবুজ স্যুট পড়া লোকটা তখন কান্নার দমক থামাইয়া কোনরকমে কইলেন, না আপনি এইটা করতে পারেন না! উনি আমার বড় ভাই। হায় হায়! তখন আমি ফিল করতে পারলাম, কি ঘটনা আমি ঘটাইছি। আমারও প্রচন্ড খারাপ লাগলো তখন। দোকানদার যদি আমার বড়ভাই হইতো বা আমি যদি ওই লোকটাই হইতাম যে গালি খাইতেছে তার ছোটভাইয়ের সামনে! আর গালি দেয়ার পরে বলতেছে, আমি কী বলতেও পারবো না! ছিঃ। আমি তখন সবুজ স্যুট পড়া লোকটার হাতে ধইরা কইলাম, সরি ভাই! আমার এইটা করা উচিত হয় নাই। আমি যদি জানতাম যে একজন ছোটভাইয়ের সামনে একজন বড়ভাইরে গাইল দিতেছি, তাইলে এই কাজ আমি করতাম না। এইটা শুইনা সবুজ স্যুট পড়া লোকটা চুপ কইরা বইসা আছে। হয়তো সে ভাবতেছে, বড়ভাইরে তার দোকানের কাজে লাগানোটা ঠিক হয় নাই। হয়তো এইখানে সে না থাকলেও পারতো।

আর আসলে আমি কি করবো এখন! দেরি’র চিন্তা আর নাই মাথাতে। আমি কি এখন গিয়া দোকানের লোকটার কাছেও মাফ চাইবো? টাকা লস গেছে যাক, মানবতা কেমনে আমি বাদ দিবো? আমি কি তাঁর কাছে গিয়াও বলবো, ভাই, আপনি আমার ভাই। আমারে মাফ কইরা দেন!

কিছুই করা হয় না আসলে। আমিও চুপ কইরাই বইসা থাকি, একটু হাঁটু ভাজ কইরা। আমি দেখি, সবুজ স্যুট পরা লোকটা স্ট্যাচু হয়া বইসা আছে। দোকানের লোকটাও একইরকমভাবে মাথা নিচু কইরা দাঁড়াইয়া আছে। পোলাটার মুখটাও দেখা যাইতেছে একটু; সে তার নিজের কাজই করতেছে। এইরকম একটা দোকানে কেন যে ঢুকছিলাম আমি! নাকি ওরাই ফাঁদটা বানাইছিলো আমার জন্য? এখন যে যার মতো দৃশ্য হয়া গেছে। আর আমিও এখন এই দৃ্শ্যটারই একটা পার্ট। কি করবো আমি, বুঝতেই পারতেছি না। একটা সময় পরে বাইর হয়া আসি আমি এই আটকাইয়া থাকা দৃশ্য থিকা। ওই দৃশ্যটা তারপরও আমার মনে থাইকা যায়।

 

Leave a Reply