পার্টি শেষ হইয়া যাওয়ার পরে পিতলা রংয়ের বিলাইটা আমার ছোট বইনরে কইলো, ‘আমারে জোরে একটা লাত্থি দিয়া গেইটটা পার কইরা দেন। এই বাড়ির মালিকে আমারে লাত্থি দিলে বাঘের গুহায় গিয়া আমি পড়ি। আর বাঘ-বাঘিনীর প্যাঁচের মধ্যে পইড়া যাই…’ বাড়ির মালিকও আমারার লগে দাঁড়ায়া ছিল। উনিই পার্টিটা দিছিলেন। উনি আমাদের ফ্রেন্ডদের ফ্রেন্ড। উনি হাসলেন। আমার ছোট বইন কোন হেসিটেশন ছাড়াই লাত্থি দিলো বিলাইটারে। জাপানি ডিজাইনের একটা গেইট। ওই গেইটটা পার হইয়া বিলাইটা সাপের গুহায় গিয়া পড়লো। যদিও এতদূরে দেখতে পাওয়ার কথা না, তারপরও আমরা তিনজনেই দেখতে পারতেছিলাম বিশাল একটা অজগর ওই গুহার ভিতরে। চোখ বন্ধ কইরা শুইয়া ছিল। বিলাইটা একদম তার মুখের কাছে গিয়া পড়লো। যেন এইটা আসবেই, সাপটা জানতো আগে থিকা। চোখ বন্ধ কইরা, ঘুমঘোরে এলে মোর স্বপ্ন মনোহর টাইপ, ইজি এবং নরমালভাবে সাপটা তার জিভ দিয়া টান মাইরা বিলাইটারে মুখের ভিতর নিয়া গেলো। তারপর আবার ঘুমাইতে লাগলো। চাবাইলো না, মানে, মুখের কোন নড়াচড়া নাই। হয়তো ঘুম থিকা উইঠা খাবে, এখন আপাতত মুখের ভিতর নিয়া রাখলো।
একটু পরেই দেখি বিলাইটা লাফ মাইরা সাপের মুখের ভিতর থিকা বাইর হইয়া আসলো। গুহার ভিতরেই বালুতে ছিটকাইয়া পড়লো। বিলাইটা নরমাল, চোখে একটু ভয় থাকলেও তেমন কোন টেনশন নাই। সাপটার দিকে তাকায়া রইলো। সাপটারও কোন বিরক্তি নাই। ঠাস কইরা জিভ বাইর কইরা আবার বিলাইটারে মুখের ভিতর নিয়া নিলো। আমরা বুঝতে পারলাম এইটা একটা গেইম। আমরা হাসলাম একটু। জাপানি গেইটের ভিতর দিয়া বাইরে রাস্তায় চইলা আসলাম।
২.
তখনো রাত শেষ হয় নাই। কই ঘুমাবো আমরা বুঝতেছিলাম না। বাজারের মতো একটা এলাকায় চইলা আসছি আমরা। রাস্তার একপাশে মার্কেট, দোকানগুলির শাটার নামানো। স্ট্রীট লাইট জ্বলতেছে। আরেকপাশে পুলিশ ফাঁড়ির দেয়াল, উপরে কাঁটাতার। সাইডে ড্রেন, বালি জইমা আছে ওইখানে, গাছের পাতা… ইউজ হয় না এখন আর। তার পাশে একটা চৌকি। ভাবলাম ওইখানেই শুইয়া পড়ি। ওইখানে কাঁথা দিয়া ছোট বইন শুইয়া রইলো। আমি বইসা সিগ্রেট ধরাবো কিনা ভাবতেছিলাম। ভাবতে ভাবতে দেখি সকাল হইয়া আসতেছে। বা সকাল না হইলেও কেমন জানি সকালের আলো আছে। একটা মাইয়া আইসা আমার বইনের লগে কথা কওয়া শুরু করলো। মে বি আমারে শুনাইয়া শুনাইয়া কইতেছিল, ফোম কাইটা সোফা বানামু আজকে! আমি কইলাম, একলা একলা কেমনে এই কাম করবেন আপনি? শে কইলো, এইজন্যেই তো তোমরা’র কাছে আসছি। আমারে হেল্প করো তোমরা! আমি ভাবলাম, এইটাই চান্স, ফ্লার্ট করি একটু। কইলাম, হেল্প তো করতেই পারি, ফ্রি আছি যেহেতু; কিন্তু আমাদেরকে কি দিবেন আপনি হেল্প করলে? আমার ছোট বইনের খুবএকটা ইন্টারেস্ট নাই, শে উইঠা বইসা কাঁথার একটা কোণা হাত দিয়া ধইরা দাঁত দিয়া কামড়াইতেছিল। আর নাটকটা দেখতেছিল। মাইয়াটা তো খুবই চিন্তায় পইড়া গেলো, কি করবো শে। কইলো, না, না… হেল্প করলে একটাকিছু তো দিবোই। আমি কইলাম, ঠিকাছে এইখানে নিয়া আসেন তাইলে। খুব চিন্তিতভাবে মাইয়াটা চইলা গেলো। এমনে রাজি হইয়া যাবো এইটা শে ভাবতে পারে নাই। বা বুঝতেছে না আমার লগে ফ্লার্ট করাটা ঠিক হইবো কিনা।
একটু পরে সত্যি সত্যি সকাল হইতেছিল। পাশে চায়ের দোকানটাতে গরম পানির কেটলি বসলো। পাশের নাস্তার দোকানের পরোটা ভাজার গন্ধ আসতেছিল। কাস্টমাররা নাই তখনো। মাইয়াটাও আসলো ততক্ষণে। ওর কাজটা কইরা দিছি আমি। বড় কাঁচি দিয়া মাপমতো ফোমগুলি কাইটা দিছি। একহাত দিয়া ও ধরছে আর আরেকহাত দিয়া আমি ধরছিলাম আর কাটছিলাম। ওর কনফিউশনের কারণেই মনে হইছিল, ফ্লার্ট আর না করি; প্রফেশনালি কামটা কইরা দেই। ও যখন আসছে তখন ওর হাতে একটা মানিব্যাগ। কতগুলি পাঁচশ টাকা আর একহাজার টাকার নোট। ডিসাইড করতে পারতেছে না কোনটা দিবো। একবার একহাজার টাকার নোট হাতে নিয়া রাইখা দিলো, তারপরে আবার পাঁচশ টাকার নোট’টা নিলো। চা’য়ের দোকানটা ওর চাচার। মানিব্যাগটা ওর চাচার দোকানে রাইখা নোটটা নিয়া আমার দিকে আসতে লাগলো। এমন সময় মাইয়াটার বাপও আমার চৌকিতে আইসা বসলো। মাইয়াটা আইসা আমারে টাকাটা দেয়ার আগেই খুব ক্লোজ ফ্রেন্ডের মতো আমার খুব কাছাকাছি আইসা কইতে লাগলো, এট্টুক কাজের লাইগা কেউ কাউরে পাঁচশ টাকা দেয়, বলেন? মানে, সে তার মাইয়ারে তো আটকাইতে পারে নাই, এইজন্য এখন আমারে আইসা ইনসিস্ট করতেছে আমি যাতে টাকাটা না নেই। মাইয়াটা মনেহয় আমারে টাকাটা দিবোই। শে কোনো না কোনোভাবে আমারে অবলিগেটেড ফিল করাইতে চায়। এরা বাপ বেটি দুইজনেই পাগল। পুরা গুষ্টিই মনেহয় পাগল। চাচা’টা কোনদিকে না তাকায়া নিজের মনে গান গাইতেছে। এইখানে থাকা যাইবো না আর। যাই গা বাল।
সকাল হইলে আমার বইন আর আমার লগে থাকে না। দেখলাম ওর কাঁথাটা পইড়া আছে। ও গেছে গা অন্য কোথাও।
৩.
অফিসে যাওয়ার লাইগা বাইর হইছি এক কলিগের লগে। রাস্তায় বাজে রকমের ট্রাফিক জ্যাম। গলি থিকা আমাদের রিকশাটা মেইন রোডে উঠতেই পারতেছে না। মেইন রোডে উইঠা রোডক্রসিংটা দিয়া ডাইনে যাইতে হবে। ওইটা আরো টাফ। বামে গেলে ফ্লো’টার ভিতর ঢুইকা যাইতে পারলেই হইতো, কিন্তু ফ্লো’টার মধ্যে ঢুইকা ওইটার এগেনেস্টে গিয়া ওইপারের ফ্লো’টার সাথে কনসিসটেন্ট হইয়া তারপরে যাইতে হবে। কোন নিয়ম নাই এইখানে, ট্রাফিক পুলিশও নাই। জাস্ট চান্সটা নিতে হবে।
রিকশাওলা তো চান্স নিতে চাইলো একবার। তখন একটা ময়লার ট্রাক ওইপাশ থিকা এইপাশে আইসা রিকশাটারে চাপা দিতে নিছিলো। ভাগ্য ভালো সা্ইডে একটু জায়গা আছিলো, এই চান্সে অন্য সাইডটা ব্লক হওয়াতে বাম পাশের প্রাইভেট কার, রিকশাগুলিও সরতে পারলো। আমরা’র রিকশাওলা আর অন্যান্যরাও ময়লার ট্রাকের এই স্ট্রাটেজিক বেনিফিটের সুবিধা নিলেও ইচ্ছামতো গাল্লাইতে লাগলো। এতে কইরা সবাই যে সুবিধাটা নিলো সেইটাতে আর নজর দেয়া লাগলো না। সবাই গন্ধে নাক চাইপা ধরলো। এতগুলি মানুষ, কারোরই নাক দেখা যাইতেছে না। এক ময়লার ট্রাকের ড্রাইভারের ছাড়া। সে মোটামুটি জীবনানন্দের কবিতার মতোই উদাস। মানে, এতোসব চিল্লা-পাল্লা, আমিও হইতে চাইলাম কিছুটা তার মতো, তাহার মতো। কিন্তু আমরা চেহারা বরং ভচকাইন্না টাইপ হইয়া রইলো। আমাদের রিকশাওলাও ময়লার ট্রাকটারে গাল্লাইতে গাল্লাইতে রাস্তাটা ক্রস কইরা ফেলতেছিলো।
ওইপারে আইসা যখন ডাইনে চইলা যাইতেছি তখন দেখি ফুটপাতে পরিচিত একজন লোক’রে তার সেকেন্ড ওয়াইফ চেঁচাইয়া চেঁচাইয়া কি জানি কইতেছে। ‘তুমি পারো না এইটা তোমার সমস্যা, আমারে নিয়া কেন টানা-হ্যাঁচড়া করো…’ এইরকম টাইপ কিছু। রাস্তায় অন্যান্য ক্যাঁচালের কারণে এনাফ অডিয়েন্স পাইতেছিলেন না সেকেন্ড ওয়াইফ, কিন্তু পরিচিত লোকটারে হিউমিলেট করার জন্য এনাফ ছিলো। আসলে লোকটাও হয়তো চাইতেছিল পাবলিক প্লেইসে ঝামেলাটা সাইরা ফেলতে; যে, পাবলিক প্লেইসে কথা কইলে তো পাবলিক কি ভাববো এই ডরে তেমনকিছু কইতে পারবো না সকালবেলা আর বিকালবেলা অফিস থিকা ফিরা আসার পরে কিছুটা ভুইলাই যাবে। কিন্তু শে মে বি এনাফ ফেড-আপ, পাবলিকরে আর কোন কেয়ার করে না। যেইটা বলার রাস্তা-ঘাটে, মানে ফুটপাতেই বইলা ফেলতে পারে। এই ঘটনাটা কিছু মানুষ দেখতেছিল, কিছু মানুষ দেখতেছিল না। কিন্তু আমার পরিচিত লোকটার টেকনিকটা যে কাজে লাগে নাই সেইটা বোঝা যাইতেছিল।
আমার কলিগ এইটা দেখলে বেশি খুশি হইতো। সে একবার খুব বাজে সমালোচনা করতেছিল ওই পরিচিত লোকটারে নিয়া। তারে এই মজা দেয়াটা ঠিক হইবো কিনা বুঝতেছিলাম না। তো, পরে কইলাম, আপনি তো মিয়া মজাটাই মিস করলেন, ঘটনাটাই তো দেখলেন না! তারপরে কইলাম ব্যাপারটা। সে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। আমি বুঝলাম না, এইটাতে তার কোন কন্ট্রিবিউশন আছে কিনা।
অফিসে পৌঁছাইয়া সে ওই পরিচিত লোকটারে ফোন কইরা এমনেই গ্যাঁজাইলো কিছুক্ষণ। আমি দূর থিকা খালি কিছু কথা শুনলাম। ব্যাপারটা ধরতেই পারলাম না।
৪.
নিচে চা খাইতে নাইমা ইউনির্ভাসিটির বড়ভাইয়ের লগে দেখা। উনি এখন বড় সাংবাদিক। উনার বড়নেস দেখানোর লাইগা কিনা জানি না কানে ব্লু-টুথ লাগাইয়া আমাদের (আমার লগে আমার কলিগও আছিলো) দিকে তাকায়া আরেকজনের লগে কথা কইতে লাগলেন। উনার অবস্থা দেইখা মনে হইলো, ব্লু-টুথে কথা কইতে উনি খুব একটা ইউজড-টু না। সিগ্রেটও খাইতেছিলেন। খুব মনোযোগ দিয়া কঠিন একটা সমস্যার কথা শুনতেছিলেন মনেহয়। এই মনোযোগের কারণে নাকি জোরে জোরে হুঁ-হ্যাঁ বলার কারণে ব্লু-টুথটা উনার কান থিকা পইড়া গেলো। উনি একটু ব্লাশ করলেন, আন-ইজি ফিল করলেও মানাই্য়া নিলেন সিচুয়েশনটার সাথে। ব্লু-টুথ তুইলা পকেটে রাইখা দিলেন। তারপরে মোবাইলটা কানে লাগায়া কথাটা শেষ করলেন। তেমন কিছুই না আসলে। এইরকম ঘটনা ঘটতেই পারে। এইটা নিয়া কোন কথাই আমরা কইলাম না। উনি চা খাওয়াইলেন আমাদেরকে, সিগ্রেট অফার করলেন। বগুড়ার হাইওয়েতে কি রকম রোড অ্যাকসিডেন্ট হয় এখন, এইটা নিয়া কথা কইলাম কিছুক্ষণ।
আমার নিজেরেই খুব আন-ফিট টাইপের মনে হইতে লাগলো। এইরকম চান্স পাইয়াও কোন টিটকারি করতে পারলাম না কোন। বড়ভাই বুঝতে পারবেন নিশ্চয় কত ছোট চাকরি করতে হয় আমারে।
৫.
মনে হইলো হাত ভাইঙ্গা পইড়া রইছি হসপিটালের বেডে। ঘন কালো পিচের একটা রাস্তা। রাতের বেলা। তা নাইলে এতো কালো তো হওয়ার কথা না, রাস্তা।
উল্টা-পাল্টা কত কিছু যে আসলো। তারপর চইলা গেলো। যাওয়ার সময় কইলো, ‘যা তরে মাফ কইরা দিলাম…’
রাতের বেলা বইলা স্বপ্ন বইলা ভাবতে পারলাম।
৬.
আবার একটা ভোর হইলো। আবার একটা সকাল। চারপাশে এতো এতো ধোঁয়া…। কনজিউজমড হয়ে গেছি আমি। কোন আগুন নাই।
রেভিউলেশনে পুড়বে বইলা দৌড়াইতেছে সবাই। আমি বইসা বইসা দেখলাম। হিরোইনের লাস্ট শট’টা মাইরা দৌড় লাগাইতেছে দুইজন। ওরা সোলজার, মার্চ করতে করতে যাইতেছে। ল’ফ্যাকাল্টি থিকা ইউনির্ভাসিটির এক টিচার বাইর হইয়া কইতেছে, এইটা ত বুঝলাম না, এইটা ত বুঝলাম না… কি হইতেছে…
যে বুঝলো, সে মে বি চুপ কইরা বইসা ছিল এনেক্স বিল্ডিংয়ের মাঠে। বা কিছু বলে নাই বইলা মনে হইতেছিল, ও বুঝছে, বুঝছে…
৭.
এতোদিন পরে টের পাইতেছি আমি, আমার ছোট বইন একটা শ্যাডোই আমার। ছিলো না কখনোই।
একটা ইমাজিনেশনই।
তাও ঠিকঠাকমতো করতে পারতেছিলাম না আমি।
Leave a Reply