গার্মেন্টসের গ্রাম

সাভারের ঘটনা ব্যক্তি-মানুষ হিসাবে ডিল করাটা খুবই অসহায় একটা বিষয়; এক একটা জীবন, এক একটা মৃত্যু কি রকম যে,  আমাদের সমস্ত চিন্তার বাইরে এই অস্তিত্বময়তা, এই নিয়া কোন কথা-বলা আসলেই যে সম্ভব না তা না, কিন্তু সেইটা জীবন এবং মৃত্যু নিয়া একটা আলাপ…[pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

তার বাইরে এই যে টিভিতে পত্রিকায় ফেসবুকে সারাক্ষণ একটা মাতম, দমবন্ধ করা অবস্থা; কি করবো আমরা? এই ধরণের একটা বিভীষিকা; যেইখানে পুরান-অবস্থা বাতিল হয়া যাইতেছে এবং সামনে নতুন বইলা নির্দিষ্ট কিছু নাই। এইরকম একটা অবস্থায় ‘ভবন’ বাদেও চিন্তার জায়গায় আরো কিছু প্রশ্নের ফাটল দেখা দিছে। খুব মাইনর যদিও, তারপরও বইলা রাখা যাইতে পারে।

প্রথমত, এই ঘটনার বিবেচনায় যে নৈতিক সাজেশনগুলা আসতেছে, সেই জায়গাটায়। এই সাজেশনগুলার প্যার্টানগুলা বিচ্ছিন্ন, মানে উনারা যে শলা-পরামর্শ কইরা এই একই ধরণের সাজেশনগুলা দিতেছেন, তা না; বরং বিভিন্ন উপায়ে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে, বিভিন্ন লোকেশন থিকা অনেকে একটা জায়গাতেই আসতেছেন, সেইটা হইলো – ‘তোমরা গ্রাম থিকা আসছো, গ্রামে ফিরা যাও’; কয়েকটা উদাহারণ দেই।

গার্মেন্টসে যারা কাজ করেন সেইসব নারীদের নিয়া লেখা দুইটাতে কবিতাতে বন্ধু রিফাত হাসান আমারে ট্যাগ করছিলেন*, যদিও অনেক আগের লেখা, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রিলেভেন্ট। কবিতার নৈতিক সাজেশনের জায়গাটাতে আমি চমকাইছি, কারণ ফর্মের দিক থিকা কবিতা খারাপ/ভালো যা-ই হোক, কবি তার ‘গ্রাম-ভাবনা’ গার্মেন্টেসের নারীর উপর চাপাইছেন এইভাবে যে, শহরে থাকতে থাকতে গ্রামের নদী, আষাঢ়ের ঢল, অচেনা মুকুল শে ভুইলা যাইতেছে; নট দ্যাট যে শে এই শহরের জীবন পছন্দ করে, কিন্তু এইখানে তারে নানান কিছু চিন্তা করা লাগে, বিবেচনা করা লাগে; এইটা হয়তো মিথ্যা না, কিন্তু এর বিপরীতে তার সম্ভাবনা হিসাবে দাঁড়াইয়া থাকে খালি চিন্তাহীন সরল প্রাকৃতিক গ্রাম, যেইটা হয়তো একটা বেটার অপশন হইতে পারে; যেইখানে ‘নারীর জীবন’ আছে এবং হয়তো সিঁড়ি’র ধুলায় বইসা দুপুরের খাবার খাইতে হইতো না। মানে, গ্রামরে গ্লোরিফাই করার একটা ব্যাপার আছে এবং সেইটা যতোটা না গার্মেন্টেসের নারীর বাসনা, তার চাইতে বেশি কবিরই ডিজায়ার।

আমরা যারা গ্রাম থিকা শহরে আসছি আমাদের গ্রাম-আকাংখা যে নাই তা না; একজন গার্মেন্টেসের নারী’র যেইরকম আছে, বেসরকারি অফিসে যারা কাজ-কাম করেন তাদেরও আছে। কিন্তু সেইটা নিয়া কবিতা লিখলে দুইজনের ক্ষেত্রে একই অর্থ দাঁড়ায় না; যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্য বেশি, তাদের জন্য এইটা ‘নস্টালজিয়া’ (কি সুন্দর শব্দটা!) আর তার বাইরে যারা ঢাকা শহরে বস্তিতে থাকেন, গার্মেন্টেসে কাজ করেন নস্টালজিয়ার পাশাপাশি তাদের পক্ষে এইটা একটা বাস্তব সাজেশন হিসাবেও নেয়া সম্ভব; কারণ তারা চাষবাস করতে পারেন কোন লজ্জা-শরম ছাড়াই, হয়তো মাছ ধরতে পারেন, তাদের ইন্টারনেট লাগে না, এইরকম।

এইরকম গ্রামের প্রেম শুধুমাত্র এই কবিতা না, আরো অন্যান্য জায়গায় আমি দেখছি। যেমন, একটা জায়গায়, অনলাইনে (ফেসবুকেই হয়তো) বলা হইতেছে যে, গ্রামে গেলে হয়তো না-খাইয়া মারা যাইতি রে বইন, এখন ত জানটাই গেল! খুবই গভীর আবেগ থিকা বলা কথা এইগুলা, তাদের আবেগের প্রতি আমার কোন অশ্রদ্ধা নাই। কিন্তু এই গ্রাম খালি একটা এস্কেপ পয়েন্ট না, বরং ভয়েসলেস যে জনগোষ্ঠী তারে আরো দূরে সইরা যাইতেও বলা একভাবে। বস্তিগুলা যেইরকম অদৃশ্য শহরের ভিতর, ইমাজিনারি রিয়ালিটি; গ্রাম সেইখানে এক ধরণের ইম্পসিবিলিটি।

আবার ধরেন এইরকমের চিন্তা-ভাবনারও দেখা পাওয়া যায়, যেইখানে কথা হইলো যে, শহরের চাল-চলন, মোবাইল, মেকাপ এইসবকিছুর লোভেই তাদের জীবনটা গেল। উইমেন এমপাওয়ামেন্টের প্রতি ক্রিটিক্যাল হইলেও এই ধরণের নৈতিকতার প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য আসলে একটা চোখ বন্ধ রাখাটা দরকার। এই অবস্থারই ক্রম এবং চূড়ান্ত দশা হইলো যে, এইটা আল্লার গজব! এই আল্লার গজব থিকা বাঁচার উপায় হিসাবে সবসময় সামনে আসে যে, ‘গ্রামে ফিরা যাও এবং ঘরে ফিরা যাও!’ যারা এইটা বলতেছেন এবং না-বইলাও ইনডিকেট করতে পারতেছেন, তারা অপশন হিসাবে এইটারে মাস্ট কইরা তুলতেছেন কিনা – এই প্রশ্নটা বিবেচনা করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, এর বিপরীতে পুঁজি’র প্রতি বিদ্বেষ এইরকম একটা চরম জায়গায় পৌঁছাইছে যেন আদিম সাম্যবাদী সমাজেই আমরা ফিরা যাইতে চাই; যেইখানে পুঁজি নাই, করাখানা নাই, টাকা-পয়সা নাই, এসি নাই, গাড়ি নাই, প্লেইন নাই (ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন থাকতে পারে হয়তো)… এইরকম একটা ব্যাপার; যেইটা এই ‘গ্রাম-ভাবনা’রই এক ধরণের পলিটিক্যাল এক্সটেনশন। পুঁজি শোষণ করে, পুঁজি খারাপ; এইজন্য পুঁজি’র বাইরে চইলা গেলেন নির্বাণ পাওয়া যাবে – এইটা পুঁজি’র চিন্তারই একটা এক্সটেনশন।

আর বড় পুঁজির জন্য শ্রম-শোষণ যে এখন আর জরুরি ব্যাপার না, ইউরোপ-আম্রিকা’র অর্থনৈতিক অবস্থা দেইখা এইটা বুঝতে পারা দরকার। মানে, পুঁজির জন্য যেই অপশন আছে, শ্রমের জন্য সেই অপশন বলতে গেলে নাই। পুঁজি মিনিমাম শ্রম দিয়াই নিজেরে মাল্টিপ্লাই করতে পারে এখন। এইজন্য পুঁজিরেই মানবিক করার আহ্ববান আছে। সে যাতে লাভ একটু কম করে, লোভ একটু কম করে। কিন্তু কেন সে এইটা করবে? মাল্টি-ন্যাশনাল পুঁজির যত অপশন আছে লোকাল পুঁজির অপশন তার চাইতে কম এবং শুধুমাত্র আরো বেশি মুনাফা করার মধ্যে দিয়াই সে টিইকা থাকতে পারে। এইটারে রেগুলেট করবে কে এবং কিভাবে?

এইক্ষেত্রে রাষ্ট্র কখনোই একটা রেগুলেটারি এজেন্সী হিসাবে কাজ করতে পারে নাই। গ্লোবাল লিবারাল ক্যাপিটালিজমের সময়ে তার সেই ক্ষমতা তার আছে কিনা সেইটা ভাবার বিষয়। মানে, পুঁজির এই সামগ্রিকতারে আমরা কেমনে মোকাবেলা করবো, সেইটার কোন মডেল নাই। বা অপশনগুলিরে এক্সপ্লোর করতে চাইতেছি না আর আমরা যার ফলে সেই শূন্যস্থানটা ফিল-আপ হইতেছে না, বরং এক্সপান্ড হইতেছে আরো; আরো আরো কল্পনার ভিতর, আমাদের গ্রাম-ভাবনার ভিতর।

 

* কবিতাটার লিংক: http://on.fb.me/17q2z15

 

বৈশাখ ১৪, ১৪২০/এপ্রিল ২৭, ২০১৩।

 

Leave a Reply