গৌতম ভদ্রের আইকন: আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

মুনশী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আত্মসত্তার রাজনীতি।। গৌতম ভদ্র।। প্রচ্ছদ: অমল আকাশ।। সংহতি।। সেপ্টেম্বর, ২০০৭।। পৃষ্টা: ৮৮।। দাম: একশত টাকা।।

 

“জাতি বলুন আর সমাজই বলুন, তাহাকে জাতীয় ভাষার সাহিত্য হইতে জীবনীশক্তি ও উহার আদর্শ খুঁজিয়া লইতে হইবে, জাতীয় ভাষার সাহিত্য হইতে রসাকর্ষণ করিতে হইবে, নচেৎ তাহার উন্নতি অসম্ভব। কেবল দুই-চারি জন শিক্ষিত ব্যক্তি লইয়া কিছু জাতি বা সমাজ হয় না, আপামর সাধারণ, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকলকে লইয়াই জাতি বা সমাজ গঠিত হয়। জাতীয় বা সমাজ দেহের অণুতে পরমাণুতে পর্য্যন্ত প্রবাহ সৃষ্টি করিবার একমাত্র উপায় মাতৃভাষা।”

“দেশপ্রচলিত আপামরসাধারণের বোধ্য ও নিত্য-ব্যবহৃত জীবন্ত ভাষাই সকল জাতির জাতীয় ভাষা হওয়া উচিত। তাহা হইলেই সেই জাতি সেই ভাষার সাহায্যে উন্নতির দিকে অগ্রসর হইতে পারে।”

“একমাত্র জাতীয় সাহিত্যের অভাবেই বঙ্গীয় মুসলমান-সমাজ আজও ‘যে তিমিরে সে তিমিরে’ রহিয়া গিয়াছে, এবং আরও বহুদিন এভাবে থাকিবে, তাহাতে আর সন্দেহ হইতে পারে না।”

 –  মুনশী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, বাংলার মুসলমানগণের মাতৃভাষা।

 

১. বইয়ের কথা

মুনশী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ নিয়া আলাপ করছেন গৌতম ভদ্র। কি এর কারণ? এই প্রশ্ন নিয়াই দেখলাম, বইটা আসলে গৌতম ভদ্রের একটা লেকচার, কিছু এডিট কইরা  ছাপাইছেন। লেকচারটা উনি দিছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ-অধ্যয়ন কেন্দ্রের একটা প্রোগ্রামে ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০০৩ সালে। এরপরে আরো দুই-একটা জায়গায় উনি এইটা পড়ছেন আর ছাপাও হইছে কয়েকটা পত্রিকায়। বইটাতে উনার  লেখাটার পরে আবদুল করিমের একটা লেখাও রাখা হইছে ।

 

২. জাতীয়তাবাদের আইকন

বইয়ের প্রথম লাইনটাই বেশ টাচি একটা জিনিস: আজ থেকে কত শত আলোকবর্ষ দূরে বাস করেন মুনশী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ?” তো, এই বিষাদের গর্তে আমিও পইড়া যাই, আসলেই তো তিনি কদ্দিন আগে বাঁইচা ছিলেন, থাকতেন চিটাগাংয়ে! উনার নাম পড়ছিলাম, স্কুলের কোন বইয়ে মনেহয়। উনি আজ কই?

কিন্তু কয়েক লাইন পরেই আবার খটকা লাগে, গৌতম ভদ্রের বিচারে। উনি লিখছেন, বাংলাদেশে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ জাতীয় ‘আইকন’ বলেই স্বীকৃত, তার জীবনপঞ্জির নানা ঘটনা সুপরিজ্ঞাত, এমনকি জন্মের সাল নিয়েও বির্তকটির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে বলে শুনতে পাই।”  মানে, কোন বিচারে, আবদুল করিম’রে গৌতম ভদ্র ‘আইকন’ বলেন সেইটা খোলাসা হয় না। ঠিক বলেনও না উনি। বইয়ের শেষের দিকে বলেন যে, চিটাগাংয়ের পুঁথি কালেক্ট করার ভিতর দিয়া বাঙালি মুসলমানের একটা ‘দায়িত্ববোধ’ উনি মাথায় নিছিলেন যেই কারণে উনি ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবোধের এক আদি কল্পপুরুষ।

জাতীয়তাবাদের একটা ‘আইকন’ এর দরকার পড়ে, গৌতম ভদ্র উনারে সাজেস্ট করতেছেন – আমার কাছে এইরকমই মনে হইছে। বরং ‘আইকন’ ব্যাপারটা’রে আমি ‘স্টার’-টাইপ কিছু ভাবছিলাম; সবাই চিনে, জানে – এইরকম। এই কারণে বেশ চমকাইছিলাম; কারণ বাংলা একাডেমি আর পাবলিক ইউনির্ভাসিটির বাংলা ডির্পাটমেন্টের বাইরে, পাবলিকের কাছে আবদুল করিম তেমন পরিচিত কোন নাম বইলা আমার মনে হয় নাই।

 

৩. অরিয়েন্টালিজম, পুঁথি কালেকশন এবং জাতীয় সাহিত্য

আবদুল করিম পুঁথি কালেক্ট করতেন। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইন্ডিয়ার বিভিন্ন ভাষায় পুঁথি কালেক্ট করার একটা ব্যাপার আছিলো, যেইটা অরিয়েন্টালিজমেরই একটা পার্ট; সেই হিস্ট্রিটা বেশ ডিটেইলে বলছেন গৌতম ভদ্র। বইটার বা লেকচারের মেজর পার্ট এইটাই যে, পুঁথি কালেকশনের কাজটা কেমনে শুরু হইছিল আর ইন প্রাকটিস ব্যাপারটা কেমনে ভচকাইয়া গেছিল।

এই কনটেক্সটে আবদুল করিমের দুইটা দিক গৌতম ভদ্র হাইলাইট করছেন: উনার লেখালেখির মধ্যে পাশ্চাত্যবিরোধিতার কোন উপাদান পাওয়া যায় না আর তার কাজ অরিয়েন্টালিজমের সাথে রিলিটেড কোন ঘটনা না, সেইটা খালি বাংলা পুঁথিচর্চা। যখন অরিয়েন্টালিজমের নানা বিভাগগুলি স্পষ্ট হয়া উঠতেছে, তখন শখের চর্চা ক্ষেত্র থেকে আবদুল করিমের মতো ব্যক্তিত্ব নিজের মতো করে পেশাদারিত্বের মোকাবিলা করছেন।’

গৌতম ভদ্রের অনুমানে  জ্ঞান-চর্চা ব্যাপারটা সবসময়ই একটা অ্যাকাডেমিক বিষয়; এইখানে অ্যাকাডেমিক ব্যাপারটা একটু লিমিটেড স্কেলেই অপারেট করতেছে মনেহয়; যেহেতু শখের জায়গা, এই কারণে অরিয়েন্টালিজমের পারপাসটারে খুবএকটা ফুলফিল করতে পারতেছে না বইলা উনি ভাবতে পারতেছেন। কিন্তু আমার ধারণা, ব্যাপারটা বেশ দূরবর্তীভাবেই কাজ করছে আবদুল করিমের ক্ষেত্রে। যেই জাতীয়তাবাদের আইকন হিসাবে উনারে প্রেইজ করা হইতেছে সেইটা অরিয়েন্টালিজমের বাই প্রডাক্ট হিসাবে ইমার্জ করতেছে কিনা, সেই দিকে গৌতম ভদ্র আর যান-ই নাই।

পুঁথি কালেক্ট করার কাজটা একটা লোকাল নলেজের ব্যাপার আর এইটাতে জ্ঞানের কিছু স্পেসিফিক নিয়ম-কানুনও তৈরি হইছে, যেইটা আবার পশ্চিমেরই আবিষ্কার। এই প্রক্রিয়ায় সাহিত্য হিসাবে পুঁথিসংগ্রহের আলাদা মর্যাদা বা অ-মর্যাদা তৈরি হয়। লোকাল নলেজের বিষয় হিসাবে তারা চিহ্নিত হইতে থাকে,  একটা গ্লোবাল নলেজের পারসপেক্টিভেই। কেন্দ্র মাইনা নিয়াই তারা হয়া উঠেন প্রান্ত। এখন, এই পুঁথি কালেকশন বা লোকাল নলেজটারেই জাতীয় সাহিত্যের বেইজ হিসাবে  নিয়া গৌতম ভদ্র কনক্লুড করছেন,  তাঁর পুথি সংগ্রহ ও পুথিসাহিত্য পরিচয়ে বাঙালি মুসলমানের ‘হীনমন্মন্যতা’ ঘুচেছেপূর্ব পাকিস্তানের আদি পর্বে অশীতিপর বৃদ্ধের তোলা এই দাবিকে আজকের বাংলাদেশে আহমদ শরীফের মতো উত্তরসূরিরা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়েছেন।

কিন্তু এই হীনমন্মন্যতার উৎসটা কি? সম্ভবত, হিন্দু সাহিত্যের যেই রুচি সেইখানে মুসলমানদের সাহিত্য যে নাই কোন, সেইটাই। এই পুঁথিগুলি আবিষ্কার হওয়ার পরে দেখা যাইতেছে, মুসলমানদেরও [ও’টারে ইগনোর কইরেন না] সাহিত্য আছিলো তো! আবদুল করিম’রে প্রেইজ করার তরিকাগুলিও ইন্টারেস্টিং; ব্যোমকেশ মুস্তফীর একটা বিবৃতির অংশ এইরকম: “…মুসলমান কবিরাও বাঙ্গালা ছন্দে হিন্দুদেবতার লীলা, হিন্দু সতীর মহিমা, হিন্দু নায়ক-নায়িকা লইয়া কাব্য রচনা করিতেন এবং হিন্দুশাস্ত্রের হদিস লইয়া সাধকের ভাবে সাধনগীত করিতেন।” [১৩২০]

আবদুর করিম’রে যেই জাতীয়তাবাদের আইকন বানাইছেন গৌতম ভদ্র সেই জাতীয়তাবাদ একদিক দিয়া হিন্দুর মর্যাদা চায় আর আরেকদিক দিয়া নিন্মবর্গীয়পণা থিকা আজাদি চায়। এই দুই জায়গা নিয়া গৌতম ভদ্র তেমন কোন আলাপ তুলেন নাই।

আর উত্তরসূরি আহমদ শরীফ নিয়া একটা কথাই বলার আছে, মধ্যযুগের বাংলা কবিতা সংকলনে উনি লালন আর হাছন রাজা’রে ইনক্লুড করছেন। মানে, এই সাহিত্য বোধ উনার কই থিকা আসছে – সেইটা তো কিছু অনুমান করা-ই যায়।

 

৪. লোকভাষা: জ্ঞান ও রস

এই পুঁথি কালেকশন সাহিত্যের দিক দিয়া নিন্মবর্গের সাহিত্য-অনুসন্ধান। যেহেতু সংস্কৃতের সার্চিং থিকা ব্যাপারটা ইনিশিয়েটেড হইছিল, ভাষার প্রশ্নটা বেশ ক্রুশিয়াল ছিল। এই আলাপে গৌতম ভদ্র ডিক্লেয়ার করছেন যে, ভারত সংস্কৃতির উৎসটি আছে ভুতভাষা তথা লোকভাষায়, দেবভাষায় নয়।’  এই ‘ভূতভাষা’ আর ‘দেবভাষা’র ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, ইউরোপিয়ান ‘মানবিকভাষা’ আসার আগে ব্যাপারগুলি কি রকম আছিলো!

সাহিত্যরে জ্ঞান আর রস – এই দুই জায়গায় ভাগ কইরা আবদুল করিম’রে রসের নাগর বানাইছেন গৌতম ভদ্র।  জ্ঞান’রে রসের ছ্যাবড়া বানাইছেন বা রস’রে জ্ঞানের বাহুল্য। বলছেন যে,  পুঁথি কালেকশনের ঘটনাটা আবদুল করিমের যোগ্যতা না, বরং তার চরিত্রটাই এইরকম। যেই চরিত্র  আসলে বাঙালি মুসলামনের, নিন্মবর্গের।  যেইখানে রস আর জ্ঞান’রে আলাদা করা লাগতেছে। এমনিতে দেখবেন, জ্ঞানী লোকরাই একটু রসিক-ই হন; গৌতম ভদ্র জ্ঞানী বইলাই এই রস করছেন কিনা শিওর না।

কিন্তু এই দেখাটা ‘প্রতিষ্ঠান’-এর জায়গা থিকা দেখতেছেন বইলাই লোক-সাহিত্য বলা লাগতেছে। এই লোক-সাহিত্যরে বেইজ বইলা মাইনা নিলেও, বেইজের জায়গা থিকা দেখার কোন ভিউ উনি ক্রিয়েট করতে পারতেছেন না। পারলে, পুঁথি সাহিত্যরে একটা সার্টেন হিস্ট্রিক্যাল পিরিয়ডের ফর্ম হিসাবে রিকগনাইজ করতে পারার কথা। মানে, উনি যে করছেন সেইটার কোন সিগনিফিকেন্স নাই এই টেক্সটে।

 

৫. বাঙ্গালী মুসলমান: দ্বন্দ্ব ও বিষাদ

আবদুল করিম মুসলমানদের বাঙালি বইলা ক্লেইম করার আর আর্ট-কালচারে হিন্দুদের সাথে ফাইট করতে পারার প্রমাণ যোগাড় কইরা দিতে পারছেন বইলাই তার গুরুত্ব  আবিষ্কার হইছে – এইরকম মনে হইছে আমার।  তো, নিন্মবর্গের সাহিত্য-আবিষ্কার যদি আবদুল করিমের বিশেষত্ব হয়া থাকে, তাইলে সে নিন্মবর্গ এখনো নিন্মবর্গই আছে, জাতীয় সাহিত্যে তার অধিষ্ঠান হইছে বললে ভুলই বলা হবে; বরং এইটা বলার ভিতর দিয়া পাবলিকের চাইতে প্রতিষ্ঠানরেই বেশি হাইলাইট করা হয়; এইটা যা করতে পারে না, তারে সেই পাওয়ার’টা দিয়া দেয়া হয়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটারে বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদরে গৌতম ভদ্র একটা মুসলমান আইডেন্টিটি হিসাবে নিছেন। এমন ‘মুসলমান’ যে আবার বাঙালিও হইতে চাইতেছে; অথচ ব্যাপারটা উল্টাই, জাতীয়তাবাদের জায়গাটাতে ক্রিটিক্যাল না হইয়াই বলা যায় [গৌতম ভদ্রও হইতে চান নাই আসলে] ‘বাঙালি মুসলমান’ বইলা যদি কোন জাতীয়তাবাদী আইডেন্টিটি থাকে, সেইটার ক্লেইম হওয়ার কথা –  মুসলমান বইলাই সে বাঙালি। কিন্তু এই মুসলমান কতদূর পর্যন্ত ধর্ম আর কতদূর পর্যন্ত নিন্মবর্গ সেই আলাপ এইখানে আর রিলিভেন্ট না মনেহয়।

 

 

 

Leave a Reply