জহির রায়হান

গতকালকে (৩০শে জানুয়ারি) ছিল জহির রায়হানের (১৯৩৫ – ১৯৭২) অফিসিয়াল মৃত্যু দিবস। উনারে আমার পছন্দ উনার এডাপ্টিবিলিটির কারণে; উনি উনার আর্টের জায়গাতে ফেক্সিবল হইতে পারছেন; প্রথমে আর্ট-ফিল্ম বানাইছেন, পরে বাণিজ্যিক উর্দু সিনেমা (সঙ্গম) বানাইছেন, রূপবানের পরে ফোক সিনেমা (বেহুলা) বানাইছেন, বাংলাদেশে ফিল্ম বিজনেসটারে অনেকটাই বুঝতে পারছিলেন, ইনভেস্ট করছেন; সামাজিক এবং পলিটিক্যাল সিনেমা বানাইছেন। মানে, ছড়াইতে পারছেন একভাবে।

উনারে নিয়া অনেকে অনেক কথা কইছেন, উনি অনেক বড় ফিল্ম-মেকার ছিলেন, রাইটার ছিলেন… কিন্তু উনার সিগনিফিকেন্স নিয়া আমার ধারণা কথা খুব কম হইছে; যে, কেন উনি গ্রেট ছিলেন? কোন জায়গাটারে উনি নতুনভাবে আবিষ্কার করছিলেন?… এইরকম আইডেন্টিফিকেশনগুলা কম, বা এখনো বলা’টারে ‘গুনাহ’ বইলা মনে করতে পারি মনেহয় আমরা।

তো, আমি এর বাইরেই মোটামুটি আরেকটা জিনিস নিয়া কথা বলতে চাইতেছি। কয়দিন আগে Ibrakor Jhilli একটা লেখা লেখছেন, ‘রিডিং বিয়ন্ড দ্যা লাইনস’ নামে। (লেখাটার লিংক কমেন্টে দিতেছি।) অই লেখাটার প্রপোজিশনটারে কেমনে এপ্লাই করা যাইতে পারে, তার একটা উদাহারণ হিসাবে দেখতে পারেন। যে, আর্ট জিনিসটা বাইরের কোন ঘটনা না; বরং লাইফের লগে বা অন্য সব আর্টের লগেও এইটা কেমনে কানেক্টেড বইলা রিড করি আমরা।

জিনিসটা ফার্স্ট মনে হইছিল, জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) সিনেমাটা দেখতে গিয়া। অই সিনেমাতে উনার ফার্স্ট ওয়াইফ সুমিতা দেবী (১৯৩৬ – ২০০৪) অভিনয় করছিলেন দেবী মনসার রোলে। সুমিতা দেবী, হেনা ভট্টাচার্য, নিলুফার বেগম’রে (এই তিন নাম ছিল উনার) বিয়া করেন ১৯৬০ সালে, মগবাজার কাজী অফিসে, কিন্তু জানাজানি হয় মেবি ১৯৬২ সালে আর একলগে থাকতে শুরু করেন, ১৯৬৩/৬৪’র দিকে। আর উনার সেকেন্ড ওয়াইফ সুচন্দা (১৯৪৭) ছিলেন বেহুলার রোলে। শ্যুটিং চলার সময়ে বা তার আগেই মেবি সুচন্দার লগে উনার রিলেশন শুরু হইছিল। আর সিনেমা রিলিজ হওয়ার পরে সুমিতা দেবীর লগে থাকা ছাইড়া দেন। অফিসিয়ালি ডিভোর্স মনেহয় হয় নাই।…

তো, এই ইনফরমেশন যদি মাথায় রাখেন, দেখবেন ক্যামেরা কি সুন্দর কইরা সুচন্দা’রে দেখাইতে চাইতেছে। বেহুলা’র শুরু’র গানটাই সুচন্দার রূপ বর্ণনা এবং তা দেখানোর ভিতর দিয়া শুরু হয়। মানে, সুচন্দা আর জহির রায়হানের মধ্যে তখন প্রেম চলতেছে, এই ইনফরমেশন বেহুলা সিনেমাটারে দেখার ব্যাপারে এফেক্ট করার কথা, কিছুটা হইলেও।

এইখানে আবার আরো কিছু ইনফরমেশনের কথাও বলা হয় না। বেসিক্যালি ৩টা ইনফরমেশনের কথা আমি বলতে চাইতেছি। তিনটা ইনফরমেশনই আছে সুমিতা দেবী’র “জীবন নদীর তীরে” নামে লেখাটাতে; যেইটা উনার বর্ণনায় উনার ছোট ছেলে অনল রায়হান লেখছিলেন; সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যা ১৯৯১’তে ছাপা হইছিল। পরে অনুপম হায়াৎ উনার “চিত্রপরিচালক ও তারকাদের আত্মকথা” বইয়ে (৩৪- ৫৭) রাখছেন। ইনফরমেশনগুলা অইখান থিকা নেয়া।

এক নাম্বার ইনফরমেশন হইলো, বিয়ার পরে, মুসলমান হওয়ার পরে সুমিতা দেবী’রে অভিনয় ছাইড়া দিতে হইছিল। কারণ উনার শ্বশুর এবং জহির রায়হানের আব্বা “…ছিলেন একজন আলেম মানুষ”। সুমিতা দেবী’রে দুই বাচ্চাসহ জহির রায়হান বিয়া করছিলেন আর বিয়ার পরে তারে নিয়া বাপের বাড়িতে উঠছিলেন। ১৯৬৪ সালের “সঙ্গম” সিনেমার পরে সুমিতা দেবী আর কোন সিনেমাতে অভিনয় করেন নাই, এর পরে জহির রায়হানের বেহুলাতেই অভিনয় করছিলেন, ১৯৬৬ সালে।

তো, জহির রায়হান এই ব্যাপারে সুমিতা দেবীরে কোন হেল্প করেন নাই। বরং অই সময় আরো একটা বাজে কাজ উনি করছিলেন। “জহির একদিন আমাকে এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে অন্য কোথাও একটা বাড়ি করে থাকতে বলে।… আমি প্রথমে রাজী হচ্ছিলাম না দেখে সে বিরক্ত হয়ে জানায় যদি আমি অন্য কোথাও বাসা ভাড়া না করি তাহলে সে কবরীকে বিয়ে করে ফেলবে।… জহির আমাকে বারণ করেছিলো, বাড়ির লোকেরা যেন আমার চলে যাওয়ার মূল কারণটা জানতে না পারে। ফলে, শ্বশুর বাড়ির প্রত্যেকেই ধারণা করেছিল যে আমি স্ব-ইচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ঐ সময়টাতে আমাকে নিদারুণ আর্থিক কষ্ট ভোগ করতে হয়। আমি জানতাম জহির আসবে না। সে আসেওনি।”

তো, কবরী’রে বিয়া করতে পারেন নাই জহির রায়হান, বরং কবরী’র হাজব্যান্ড উনার নামে মামলা করার কারণে বরং তারে ঝামেলায় পড়তে হইছিল। এইটা হইতেছে সেকেন্ড ইনফরমেশন। জহির রায়হান কবরীর প্রেমে পড়ছিলেন – এইটা না; উনি সুমিতা দেবীর ক্যারিয়ার শেষ কইরা দিছিলেন। দুইটা বাচ্চা নিয়া চলাফেরা করার মতো টাকা ছিল না বইলা “চরিত্রাভিনয়ে কাজ করতে” শুরু করলেন তখন। “নায়িকা জীবনের সমাপ্তি ঘটে আমার এভাবেই, অতি দ্রুত।”

জহির রায়হান আবার সুমিতা দেবী’র কাছে ফিরা আসেন। কিন্তু তার কিছুদিন পরেই সুচন্দার লগে উনার প্রেম শুরু হয়। সুমিতা দেবী’র বান্ধবী রাণী সরকার জহির রায়হানের এই কাজের নিন্দা করেন বইলা জহির রায়হান রাণী সরকার’রে পরে আর কোন সিনেমাতে কোন কাজে নেন নাই। এইটা হইতেছে, থার্ড ইনফরমেশন।
যে, পারসোনাল লাইফে জহির রায়হান প্রতারণা করতেন এবং প্রতিশোধ-পরায়ণ আছিলেন। সুমিতা দেবী অর্থনৈতিকভাবে খুবই বাজে অবস্থায় ছিলেন। অথচ জহির রায়হানের তখন টাকা-পয়সার তেমন কোন অভাব থাকার কথা না, কিন্তু উনি তেমন কোন হেল্প আসলে করেন নাই সুমিতা দেবীরে। ১৯৬০-এ জহির রায়হানের আগ্রহে এবং একরকমের জোরাজুরিতেই বিয়া’টা হইছিল। সুমিতা দেবীও কোন কমপ্লেইন করেন নাই জহির রায়হানের পরের ঘটনাগুলা নিয়া, জাস্ট মেনশন করছেন। কিন্তু এই ইনফরমেশনগুলারে যদি মাথায় রাখেন, জহির রায়হানের যে কোন কাজরেই কিছুটা হইলেও একটু ‘প্রতারণা-মূলক’ ভাবতে পারার কথা মনেহয় 🙂 যেই সন্দেহ, আমার ধারণা, বাংলাদেশের আইডিয়ালিস্টরা করেনও মাঝে-মধ্যে, কিন্তু ভাবের মূর্তি ভাইঙ্গা যাবে বইলা মুখ ফুইটা বলতে পারেন না। স্যাড ঘটনাই এইটা।

তবে জহির রায়হান যে গ্রেট, এইটা ভাবতে পারা’র পিছনে দুইজন হিট নায়িকারে বিয়া করতে পারার ঘটনার কোন কন্ট্রিবিউশন যে নাই, এইটা ভাবা’টারে আমার জেলাসি বইলা বাতিল কইরা দেয়াটা মনেহয় পুরাপুরি ঠিক হবে না 😛

(এইরকম বিয়া করতে পারাটা যে একটা এচিভমেন্ট সেইটা উইকিপিডিয়ার বাক্য’টাতেও কিছুটা খেয়াল করতে পারার কথা: তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু’বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।)

২.
তো, এইভাবে তার লাইফের ঘটনাগুলা দিয়া একজন আর্টিস্টের আর্ট’রে কি রিড করা যাবে না তাইলে? বা ‘ভালো ভালো’ ঘটনাগুলারেই নিতে হবে? বা খুঁইজা খুঁইজা তার ডার্ক ও ‘গোপন’ জিনিসগুলারে রিলিভেন্ট কইরা তুলতে হবে?

আমার কনসার্নটা আসলে এই জায়গাটাতে না যে, একটা সমাজ, সময়, আর্টিস্টের পারসোনাল লাইফ এবং তার লাইফ কানেক্টেড ঘটনা কিনা; মানে, এইটা নিয়া কোন সন্দেহ আমার নাই যে, এইগুলা কানেক্টেড ঘটনা। বরং আর্টের কনজামশন বেশিরভাগ সময় এইভাবেই হয়; আর্টিস্টের বাঁইচা থাকার টাইমে বা তার পরের দুয়েক্টা জেনারেশন এই ইনফরমেশনগুলা আর্টের বিচার’রে এফেক্ট করে। পরে হয়তো কিছু জিনিস মিথও হয়া উঠতে পারে। কিন্তু আর্টের বিচার এইভাবে না। মানে, অ্যাজ অ্যা পারসন আপনি ভালো না খারাপ, সেইটা আপনার আর্ট’রে অবশ্যই এফেক্ট করে; কিন্তু সেই জিনিসগুলারে আপনি আপনার আর্টে কেমনে রিফ্লেক্ট করতেছেন, সেইটা বিচারের ঘটনা হয়া উঠে।

(মানে, একটা সময়ের পরে আর্টের জিনিসগুলাই মিথগুলারে বানাইতে থাকে। যেমন, উকিল মুন্সির যেই বিরহের গান’টা – “আমার গায়ে যত দুখ্খ সয়/ করো বন্ধু তোমার মনে যাহা লয়…”; লোকে বলাবলি করে উনার বউ মারা যাওয়ার দুখ্খে উনি লেখছিলেন, অনেকে কয়, উনার ওস্তাদ মারা যাওয়ার দুক্খে উনি লেখছেন। মানে, গানে উনার যেই কষ্ট’টা সেইটা রিয়েল, সেইটার লগে কানেক্ট করার লাইগা একটা মিথ লাগে। এইরকম।)

৩.
জহির রায়হানের আর্ট সবসময় ছিল বাংলাদেশি উঠতি মিডল-ক্লাসের একটা ঘটনা। এই মিডল-ক্লাসের রুচি যদ্দিন বাঁইচা থাকবে, জহির রায়হানের সিনেমা ততদিন সেলিব্রেটেড হইতে পারবে বইলা আমার ধারণা।
এই রুচি’টা কি রকম? পলিটিক্যালি এনলাইটমেন্টের মুরিদ, ইউরোপিয়ান আর্টের সমঝদার এবং মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি, পুরুষালি। এখনো বাঙালি (মুসলমান বলেন আর হিন্দু) মিডল-ক্লাসের আইডেন্টিটি মোটামুটি এই তিনটাই।…

তো, এইটা আরেকটা আলাপ। সেই আলাপ করতে গেলেও জহির রায়হানের কথা আসবে আসলে।

 

Leave a Reply