যুদ্ধ ও শান্তি

ফটো: খেয়া মেজবা।

 

ছিলাম অফিসের একটা উইকলি মিটিংয়ে। মিটিংরুমে আমার ঢুকতে একটু দেরিই হইছিল। অফিসে গেছি দেরিতে। তারপর ভাবলাম যে ডেস্ক থিকা ল্যাপটপটা নিয়াই যাই। কেউ না কইলেও, মিটিং মিনিটস লিখতে পারা একটা অ্যাডিশন্যাল সুবিধার ব্যাপার; যেহেতু লিখতে হয়, এই কারণে কথা-বার্তা একটু কম শুনলেও হয়। এমন না যে, কথা-বার্তা শোনাটা ইর্ম্পটেন্ট না; যা লিখতে হইবো, ওইটুক শুনলেই হয়, মানুষজনের ইন্ডিভিজ্যুয়াল পারসপেক্টিভগুলা এবং পারসেপক্টিভের ভিতরে উনারাদের মিনিংগুলা না শুনলেও হয় হয় আর কী; মানে, শোনাই যায় না তখন, টাইমই পাওয়া যায় না; একটা পরে একটা আসতেই থাকে। লিখবো না শুনবো এইরকম একটা ব্যাপার। মনোটোনাস লাগে এই রেট-রেস। একটা প্রমোশনই ত, এর লাইগা বুদ্ধির এতো এতো কসরত, বিপর্যয়। ভাবতেই ক্লান্ত লাগে। মিনিটস নিতে কিছু ভুলও হয়, পারসপেক্টিভগুলা ঠিকমতো আর্টিকুলেট না করতে পারলে। কিছু ভুল থাকাটা মনে হয় ভালো। আল্লার দুনিয়ায় পারফেক্ট আর কে হইতে চায়, সবাই ত চায় ডিজায়ারেবল হইতে, কনশাস কিছু ভুলসহ। কারণ যে ভুল ধরতে পারলো, সে ভালোও বাসতে পারে ত, একটু। এইরকম সম্ভাবনাগুলা না রাইখা দিতে পারলে, বাঁইচা থাকা কেন আর! এইরকম মনে হয়, মাঝে-মধ্যেই। আমাদের বাস্তবতা এইসব ঠেসগুলারে অ্যাকোমোডেড কইরাই চলে, কোন না কোন ভাবে; এইটা বেসিক পয়েণ্ট না অবশ্যই, কিন্তু একটা পয়েণ্ট ত![pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

আমি যাওয়ার পরে একটা পয়েণ্টই আলাপ হইলো। তারপরই শেষ-শেষ ভাব। স্পিকার ত বস একলাই। বাকি আট-দশজন মুড বুইঝা খালি হুঁ-হা করে। যেই ঈদ গিফটগুলা পাঠানো হইবো, সেই অ্যাড্রেসগুলা একটা এক্সেল ফাইলে রাইখা দিতে কইলেন। যে, কে কে কারে কারে কয়টা কইরা গিফট পাঠাইতেছে, এইটা ডকুমেন্টেট থাকাটা দরকার। যদিও মাইনর ইস্যু, কিন্তু এইরকম মাইনর ইস্যুতেও অডিট হইলে যাতে কোন ঝামেলা না হয় বা পরবর্তীতে নানান কাজে লাগতে পারে। কাজটা যে কারে করতে বললেন, আমারে নাকি শেরিল’রে ঠিক বুঝতে পারা গেলো না। শেরিল চোখের কোণা দিয়া আমার দিকে তাকাইয়া হাসলো, মানে, এইটা ত আপনারেই করা লাগবো! কাজকাম কইরা প্রমোশন যেহেতু চান আপনি। আর শেরিল জানে, প্রমোশন একটা ডিফরেন্ট গেইম। আমি সেইটা শিখতে পারি নাই। এখন মিড-এইজে আইসা নতুন কইরা শিখারও উপায় নাই। সিনসিয়ারিটি, ডেডিকেশন ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী, যা ছিল সিক্সটিইজের ইনোভেশন; এইগুলা বেইচাই চাকরি টিকাইয়া রাখতে হবে। শেরিলের এইসব না করলেও চলে যেন। ও মনে হয়, স্যান্ডবার্গের লিন ইন বইটা পুরাটাই পইড়া ফেলছে, আমি ভাবি। ভাবি যে, কেন আমি আরো লিবারাল হইতে পারি না; নারী বিষয়ে।

প্রতিবার উইকলি মিটিং শেষে এইরকম পরাজয়ের একটা ফিলিংস হয়। কাফকার মতো লাগে নিজেরে, অফিসে। আছি, কিন্তু থাকাটার সবসময় ভিতর না-থাকাই থাইকা যাইতেছে। সিনসিয়ারিটি, ডেডিকেশন আছে, কিন্তু আমি ত নাই! এইরকম হযবরল থাকা নিয়া কি তরুণ-কবিদের ওপর আস্থা রাখাটা ঠিক হবে? বড়জোর আরেকটা অ্যাভারেজ গল্পই লেখা যাবে, ঈদসংখ্যার। বিশ হাজার মানুষ দেখছে বইলা ভাইবা আনন্দ পাওয়া যাবে, ফেইসবুকের নোটে শেয়ার করলে অন্তঃত শ’খানেক আইডি’র লাইক পাওয়া যাবে যাতে কইরা প্রমাণযোগ্য করা যাবে গল্পটা ভালোই হইছে। আর এর লাইগা আমি আমার জীবন পগার পার কইরা রসাতলে যাইতে থাকবো! কাভি নেহি! এইরকম একটা জিহাদি জোশ চইলা আসলো শরীরে। অফিসে বইসা জিহাদ করা সম্ভব না; সম্ভব, তবে অনলাইনে। এইগুলা দিয়া হবে না। পলিটিক্যালি অ্যাক্টিভ হইতে হইলে রাস্তায় নামতে হবে।

অফিস থিকা বাইর হয়া আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে আসছি। পার হয়া যাবো; অ-পারে থাকবো না আর। ফেরিও আছে ঘাটে। ছাড়তে এখনো দেরি আছে। একটা সিগারেট ধরানোর কথা ভাবলাম। নদীরপাড়ে আসলে ত এমনিতেই সিগারেট খাইতে হয়। এইটা গল্পে বইলা রাখাটা দরকার যে, চরিত্রের প্রয়োজনে এই সিগারেট খাওয়া ব্যাপারটা আসছে, এমনিতে সিগারেটে প্যাকেটে লেখা আছে: সিগারেট খাইলে ক্যান্সার হয়; হিন্দিতে ক্যান্সাররে ওরা কর্করোগ বলে; কী আজিব, এই ভাষা-প্রক্রিয়া। এইরকম অনিশ্চয়তায় দাঁড়াইয়া আছি যখন, এমন সময় দেখি ইকবালভাই আর মনিরমামা আসতেছেন। উনাদের দুইজন এখনো তরুণ। আমার সমান বয়সই উনাদের। আমি যখন ছোট আছিলাম, তখনো উনারা একইরকম বয়সের আছিলেন। একইরকম আছেন অনেক দিন ধইরা। বাজার থিকা আসছেন মনে হয়। বাড়িতে যাইবেন। একটু তাড়াতাড়ি’র মধ্যেই আছেন উনারা। আমারে দেইখা ইকবাল ভাই হাসলেন। মনিরমামা কইলেন, ‘কিও, তুমি এইখানে দাঁড়াইয়া কি কর? যাবা না?’ আর এই কমিউনিকেশনের কারণে তখনই মনে হইলো; আরে, আমার মোবাইলটা কই! অফিসে ফেলে আসছি! তাইলে ত আবার অফিসে যাইতে হবে। উনারা এইটা বুঝতে পারলেন। যে, আমি এইবার যাইতে পারবো না। ফেরিটা ছাইড়া দেয়ার পর বুঝতে পারলাম, বেশ ছোট ছিল ফেরিটা। একটা মাইক্রোবাস আর প্রাইভেট কার ছিল। আর উনারা দুইজন – ইকবালভাই আর মনিরমামা। চইলা যাইতে থাকলেন। ধীরে ধীরে।

উনাদের তাড়াহুড়াটা তখনো বুঝতে পারি নাই। অফিসে ফেরত যাওয়ার পথে দেখি, কেউ নাই। এইরকম ফাঁকা, বিকালবেলায়, সন্ধ্যাও ত হয় নাই! তখনো আমি বুঝতে পারি নাই যে, ধর্মযুদ্ধটা শুরু হয়া গেছে। কিন্তু ফিলিংসটা হইতেছিল। অফিস আর নাই, ছোট ছোট কাজের বড় বড় ব্যস্ততা নাই। মোবাইল ফোনেরও আর দরকার নাই এখন। আমাদের বিচ্ছিন্নতার ভিতর দিয়াই নিজেদেরকে বাঁচাইতে হবে এখন। এখন সংগ্রাম এগজিসটেন্সের!

ধর্মযুদ্ধটা যে শুরু হবে, এইটা অনেকেই অ্যাজিউম করছিল। হঠাৎ কইরা যখন শুরু হয়া গেলো, তখন দেখা গেলো, জানলেও, নিজেদের কথা আসলে তখন নিজেরাই অনেকে বিশ্বাস করে নাই। ভাবছিলো যে, এইভাবে বলতে বলতে হয়তো আটকাইয়া ফেলা যাবে, ঘটনাটারে। যারা জানতেন, আমি তাদের দলে ছিলাম না। আমার ধারণা, এইটা উনারাই শুরু করছেন, যাঁরা জানতেন, যা তাঁদের জানার কথা ছিল না, এইভাবে ঘটনাটারে উনারা আগাইয়া নিয়া আসছিলেন। একটা সেন্স অফ অরিজিনালিটি থিকা এইটা শুরু হইছিল। যে, আসলে ঘটনাটা কী! কোন অ্যাজাম্পশনটা অ্যাকচুয়ালি অপারেট করতেছে! সব ইল্যুশনরে ঘুটা দিয়া পরিস্থিতিরে ব্যাখ্যা করার মতো স্যালাইন উনারা আবিষ্কার কইরা ফেলতে পারতেছিলেন। বাংলাদেশের ইউনির্ভাসিটি’র কোন একটা সেমিনারেরও কন্ট্রিবিউশন ছিল ওই আবিষ্কারে। আর সেইটা খুব দ্রুতই ছড়াইয়া পড়তেছিলো, সুপার শপে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, মুদির দোকানে, ফার্মেসীতে, চা-সিগ্রেটের দোকানে সবাই তখন অরিজিনালিটিরেই খুঁইজা পাইতে থাকলো। এখন ধর্মের চাইতে কোর অরিজিনাল আর কী আছে! সবাই নিজেদের অনুমানের অস্ত্র নিয়া ঝাঁপাইয়া পড়লো। একজন আরেকজনের রিয়ালিটির দিকে। একদিন বিকালবেলায়। পৃথিবীতে ধর্মযুদ্ধ শুরু হইলো। এইভাবে। একটা আন-আইডেন্টিফাইড ভাইরাসের মতো, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের নিউজের মতো ছড়াইয়া পড়লো দ্রুত।

শহরে তেমন কেউ নাই আমার। এক চাচার বাসায় গেলাম। মেইনলি পরামর্শ করতেই। যে, আমি বা আমরা এখন কি করবো! তিনি চুপচাপ স্বভাবের। একলাই থাকেন। উনার বাসার বসার ঘর পর্যন্তই আমরা গেছি। এর ভিতরে আর কেউ যাই নাই। সুতরাং আর কেউ থাকলেও আমরা দেখি নাই। এইভাবে জানি যে, উনি একলাই থাকেন। গিয়া বুঝলাম যে, আর যা-ই হোক, উনার এইখানে থাকার কথা ভাবা যায় না। উনি আমারে শেল্টার দিবেন না। কিন্তু উনি নিজের সিকিউরিটি নিয়া বেশ কনফিডেন্ট। অন্তঃত পারসোনালি কোন রিস্ক উনার নাই, এইরকম একটা ব্যাপার আছে। এই অঞ্চলে যারা প্রভাবশালী তাদের সাথে উনার এক ধরণের আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। বেশি মানুষরে সিকিউরড করতে গেলে নিজের সিকিউরিটিই ঝামেলায় পড়ার কথা। এমনিতে উনারে ঝামেলায় ফেলতেও চাই না। তবে ভাবছিলাম যে, ভদ্রতার খাতিরেও মানুষ রিকোয়েস্ট করতে পারতো ত! যা-ই হোক, এইটা ব্যাপার না। নিজে বাঁচলে তারপর না ভাতিজা’র নাম। উনারে দোষ দেই না আমি। বেশি বিপদে পড়লে, মানে মারা যাওয়ার সিচুয়েশনে পড়লে কখনো আসবো নে।

বাইর হয়া আরেকটা বাসায় যাই। বাসাটার দরজা খুললেই বিশাল একটা ড্রইংরুম। তার জামাইয়ের সাথে গা ঘেঁষাঘেষি কইরা বইসা আছে আমারই সমান বয়সী একজন নারী। আমার ছোট বোন। ওর বাসাতেই থাকবো আমি। ওরা খুব হ্যাপি কাপল। ওদের বাসা দেখলেই বোঝা যায়। কয়েকটা জামা-কাপড় পইড়া আছে সোফার ওপর, ডাইনিং টেবিলে কয়েকটা বাটি, খাওয়া-দাওয়ার পরে বাসনগুলাও ওঠানো হয় নাই আর তারপরও ওদের মুখে কোন অপরাধবোধের হাসি নাই, নিজেদের গোছানো গোছানো দেখানোর কোন তাড়াহুড়া নাই। প্রেমের বাস্তবতা ত এইরকমই, একটু অগোছালো ধরণের। আমার সাথে বইসা গল্প করতেছে, একজন আরেকজনের কোলের উপ্রে প্রায় আর একইসাথে ভাবতেছে আমি এই রুম ছাইড়া গেলেই ওদের আনফিনিশড ফোরপ্লে’টা আবার শুরু করতে পারবে। এইরকম স্মুথনেন্স ভালো লাগে। খালি মন-ই না, ভালোবাসার মতো শরীরও ওদের আছে।

 

২.

আমরা থাকতে শুরু করি ওদের বাসায় – আমি, আমার বউ আর মেয়ে। অবশ্য নিজেরে ছাড়া আর কাউরেই দেখতে পাওয়া যায় না। ঘরেই থাকি যদিও। কারো সাথেই কোন কথা নাই। বাইরেও খুব একটা যাই না। যাওয়া যায় না আসলে। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা, হঠাৎ হঠাৎ কয়েকটা মানুষ তাড়াতাড়ি হাঁইটা যায়। রিকশাও যায় দুই একটা। প্রাইভেট কার দেখাই যায় না, রাস্তায়। সারাদিন বাসায় বইসা কী যে করি! মাঝে-মধ্যে বাইরে যাই এই দমবন্ধ অবস্থা কাটাইতে। বাজারে দোকান নাই। আছে পজিশন হিসাবে, কিন্তু বন্ধ সব। শাটার নামানো। কিন্তু শাটারে আবার তালাও লাগানো নাই। দুই একটা শাটার পুরাটা লাগানো না। ভিতরে লাশ থাকতে পারে, মানুষের। কুত্তা বিলাই ইন্দুরের বাসা ওইগুলা; আমাদের মুদিদোকান আর ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর। এমনিতে রাস্তার কয়েকজন মানুষ বেতের ঝুড়িতে কিছু সব্জি নিয়া বইসা থাকে। বইসা থাকা দেইখা মনে হয় মরার অপেক্ষা করতেছে। বাসায় বইসা বইসা বাঁইচা থাকতে আর ভাল্লাগতেছে না ওদের। এই সব্জিগুলাতে ফরমালিন আছে কি নাই, এইরকম কোন সাইনবোর্ডও নাই। কেউ জিজ্ঞাসাও করে না মনে হয়, ফরমালিন আছে কি নাই। নিলে নেন ভাই, না নিলে নাই। আজাইরা কথার কি কাম! দুনিয়া এইরকম, যেন কোথাও কোনদিন কিছুই ঘটে নাই!

এমনকি কোন উইকলি মিটিংও হইতো না কোনদিন!

রাস্তায় রক্ত জইমা থাকতে থাকতে শুকাইয়া গেছে। মানুষ দেখলেই ভয় করে। মারতে আসতেছে না তো। ঘটনা মনে হয় এখনই ঘটতে যাইতেছে। তার মানে, ঘটনা ঘটতেছে আসলে। আমি দেখি না বইলা মনে হয় যেন ঘটে না। ভয়ে ভয়ে আমরা সবাই ঘটনার বাইরে চইলা যাইতেছি। আর ঘটনা ছুরি-পিস্তল-বন্দুক-কামান-ট্যাংক-মিসাইল-যুদ্ধবিমান ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়া আমাদের দিয়া ছুইটা আসতেছে। আমরা ভয়ে ভয়ে আবার বাসার ভিতরে পায়খানায় গিয়া বইসা থাকি। দুই হাঁটুর চিপায় নিজের মুখ গুঁইজা নিজের ধোন চুষি। নিজের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে দেখি অন্য আরেকটা দুনিয়া; গু-মুতই বেসিক্যালি। ওইখানেও। বর্তমানের দুনিয়া ছাইড়া আর কদ্দূরই বা যাইতে পারি আমরা।

যখন আমরা আর যাইতে পারি না, তখন ঘটনাগুলা চইলা আসতে থাকে আমাদের কাছে। এইরকমই একটা দিনে চাচার বাসায় যাই আবার। তখন দেখি আমার বড় বইনও আসছে তার জামাই নিয়া। জামাইটা কী রকম জানি! উদাসিও না ঠিক, থতমত রকমের; বিয়া যে কইরা ফেলছে মনে হয় বুঝতে পারে না। লাতিন আম্রিকার উপন্যাস নিয়া উত্তেজিত হইতে হইতে, স্বপ্নে মার্কেজের কথা ভাবতে ভাবতে, মাল আউট হইয়া যাওয়ার মতো, যুদ্ধের দিনগুলিতে বিয়া – এইরকম একটা উল্টাপাল্টা উপন্যাস লিইখা ফেলছে। এখন ছাপাইবো কিনা, বুঝতে পারতেছে না। এইজন্য সিনিয়র ঔপন্যাসিকের কাছে পরামর্শ নিতে আসছে। এইরকম। ওরা দুইজনে তিনজনের একটা সোফায় বইসা আছে। চাচা সামনে, অন্যদিকে তাকাইয়া আছে। উনি সবসময় সিঙ্গেল সোফাতে বসেন। কেন করতে গেলা তোমরা এই বিয়া, এইরকম একটা ভাব উনার। বিয়া ছাড়াও ত চলতো। একসাথে থাকতা, ওইটাও ত এনাফ। এখনকার সময়ে কেউ আবার বিয়া করে নাকি, লিভ টুগেদার ছাইড়া; এতে কইরা লিগ্যাল কমপ্লিকেসিগুলা বাড়ে তো! যদিও তিনি বলেন না, এইগুলা। কেমন একটা ডিন্যায়ালের ভঙ্গিতে বইসা থাকেন। আমার মনে হয়, খারাপ করে নাই ওরা। এইরকম যুদ্ধের সময়, বীরঙ্গনা হওয়ার চেষ্টা করার চাইতে, বিয়া করা ভালো। কিন্তু বিয়া কইরা ওরা বাঁচতে পারবে তো! ওরা ত বিয়া করছে, বাঁচতে চায় বইলা। এই পারসপেক্টিভ থিকা এইটা প্রায় মিনিংলেস একটা ব্যাপার। আমি সেইটা ভাবি। তাছাড়া, আমাদের প্রেম কোনদিনই আমাদের বাঁচাইতে রাখতে পারে না। ঈর্ষা, ঘৃণা, হঠকারিতা, পাপ এবং পূণ্য যতোটা বাঁচাইয়া রাখতে পারে, প্রেম সেইটা পারে না। আরো, স্পেশালি ধর্মযুদ্ধের সময়টাতে। অথচ ওরা কি জড়োসড়ো, প্রেমে পড়তে চাইতেছে, একজন আরেকজনের। এবং একটা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের ভিতরে!

‘চাচা, আমরা এখন যাই। আপনি দোয়া কইরেন!’ বড় বইন’টা বইলা তার জামাই’রে ওঠতে ইশারা করে। নিজেও ওইঠা দাঁড়ায়। আমারে কিছু কয় না, চাচার সামনে। আমিও বলি না কিছু। কি বলবো ওরে, ও-ই ত আমার সাথে কথা কইতে চায় না। ও বড় বইন না, কথা ত ও কইবো; আমি ছোট হইয়াও ওর সামনে আবার ছোট কেমনে হইবো! বড় বইন’টা এতো বোকা যে আমার খারাপ লাগে। মনে হয় যে, ওরে কই, তুই ক্যান এইসব করতেচছ; তুই কি ভাবিস যে, নিজের সাথে প্রতারণা করা গেলেই বাঁইচা থাকা গেল! ও তো, আমার কথা শুনে না। আমাদের নিজেদের মধ্যে কোন কনর্ভাসেশনই হয় না। হওয়াটা যে সম্ভব না, এইটা আমরা বুঝতে পারি। কমিউনিজমের পতন হইছে সেই নাইনটিইজে, বার্লিন ওয়ালও ভাঙ্গছে; কিন্তু নদ্দা আর বারিধারার যেই কূটনৈতিক দেয়াল সেইটা জানি কখনোই ভাঙ্গিবে না! এই নিশ্চয়তা আছে আমাদের মনে। শে বাইর হইয়া যায়। নরমাল একটা শাড়ি, অথচ কী সুন্দর কইরা পড়ছে, আমার বইনটা!

আনিসুল হকের কথার মতো আমি লিখি আর কান্দি। আমিও ফিরা আসি আমার ছোটবোনের ঘরে।

দেখি, ওর শ্বশুর শাশুড়ি আসছে। ছোট শহর থিকা। ওইখানে আরো বেশি ঝামেলা। সবাই সবাইরে চিনে। যুদ্ধের নাম দিয়া যে যারে খুশি মারতেছে। পারসোনাল প্রতিশোধ নিতেছে। কাউরে বিশ্বাস করা যায় না। স্কুলবেলার ফ্রেন্ড, যারে ফুটবল খেলতে গিয়া ফাউল করছিল, সে এখন সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চায়। বাড়ির চাকর, যারে ছোট থাকতে থাপ্পড় মারছিল, সে আরব গেরিলাদের সমর্থন করে এখন। সন্দীপণ চট্টোপাধ্যায় পড়ে নাই এখনো। কিন্তু প্রিপারেশন নিতেছে। বইটা খুঁজতেছে অ্যাক্টিভলি, পড়ার লাইগা। যদি পইড়াই ফেলে, তাইলে ত শেষ! এইরকম বিপদজনক পরিস্থিতি। এইজন্য উনারা ফেরি পার হইয়া এই শহরে চইলা আসছে, ছেলের কাছে। উনারা যেহেতু ভয়ের দুনিয়া থিকা আসছে আমাদেরকে আরো বড় বড় ভয় দেখাইতে চায়। কয়, এইটা করো, ওইটা করো; বাথরুমে গেলে অন্তঃত এক ঘণ্টা বইসা থাকতে হইবো; তারপর সোফাতে বইলে একটা পা ভাঁজ কইরা বসতে হইবো, পূবদিকে বইলে বাম পা; আর পশ্চিমে ডান পা। কারণ পূর্ব-পশ্চিম ত ডিফরেন্ট। কেউ রিজন নিয়া আসলে তারে ভাবের কথা দিয়া ঠেকাইতে হইবো; আর কেউ মেটাজিক্যাল আলাপ শুরু করলে, কড়া যুক্তির আলাপ শুরু করা লাগবো। তা না হইলে সেইফ থাকা যাইবো না। তুমি যা না, সেইটা প্রুফ করা লাগবো। বুইঝা ফেলেলেই শেষ! এইরকম বুদ্ধিমান রকমের মানুষ উনারা। যুদ্ধ-ব্যবসায়ীরা এখনো কনসালটেন্সির লাইগা কেন যে উনাদের ভাড়া করে না! ছোটবোন আর বইনের জামাই পাত্তা দেয় না অবশ্য। বুড়া মানুষ, তারপর আবার বাপ-মা। উনাদের কথা শোনা লাগে। এইটা একটা নিয়ম। আইন না। কারণ আইনের রেমিডি আছে, অমান্য করলে ফাইন দিবেন। কিন্তু আইনের বাইরে যেই নিয়ম সেইগুলা অনেকবেশি সেনসেটিভ।

একদিন খাইতে বইসা ওর শ্বশুর কয়, সবাইরে শান্তিতে থাকতে হইলে, ফ্যামিলির কাউরে না কাউরে কোরবানি দিতে হয়; এইটারে বলে সদকা। একটু একটু কয়, আর আমার দিকে তাকায়। বুইড়া বেটার বাঁচার কেন এতো শখ! সে বাঁইচা থাইকা কী করবে! এইটা উনার আসল উদ্দেশ্য না। যেহেতু উনি নিজ’রে গোপন করতে চান। উপমা-উৎপ্রেক্ষার ভিতর দিয়া নিজের মনের রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ-হতাশারে পগার-পার কইরা দেন; সেইরকম কবিতার ব্যাখ্যার মতো, যা কিছু বলতে গিয়া বলেন নাই, সেইটারে খুঁইজা বাইর করতে হবে। আমি বুঝতে পারি, সে আসলে বাঁচতে চায় না, অন্যদের বাঁইচা থাকার গ্লানিটারে সে দেখতে চায়। এর চে ত মরণ-ই ভালো, শ্যামো সমান গান শুনতে চায়। রবীন্দ্রনাথের আলি স্টেইজের কবিতা আর কি! সে স্পষ্ট কইরা কিছু কয় না; কয় যে, কয়েকদিনের মধ্যে যুদ্ধটা আমাদের গলিতে চইলা আসবে। তখন যাঁরা যুদ্ধ করতে চায়, তাদেরকে ঘরে আটকাইয়া রাখতে হইলে, যুদ্ধ-বিয়ার ব্যবস্থা করতে হইবো। আমি বুঝি যে, ওই শুয়োরের বাচ্চা আমার বউ’রে বিয়া দিতে চায় যাতে কইরা আমার বাঁইচা থাকাটা ওরই সমান গ্লানিময় হইতে পারে। আমার যে হতাশা কম, এইটা তারে বেশি হতাশাগ্রস্থ করে। সে এই ট্রাপ থিকা বাইর হইতে চায়। সাম্যবাদ চায়; ডেফিনেটলি একটা রংওয়েতে। মানুষ ভুলপখে যাইতে থাকলে এতো দ্রুত যাইতে থাকে যে তার আটকানো মুশকিল। যেমন পাঠক গল্প পড়তে পড়তে অর্ধেক শব্দই এভয়েড কইরা যাবে, এইটা আমি বুঝতে পারি। তারপরও আবার গল্পে ব্যাক করি।

আমি দাঁতে দাঁত চাইপা ভাত খাই। যেন সে কী বলছে আমি বুঝি নাই। শুনিই নাই। অফিসের মিটিং মিনিটস নেয়ার মতো। আমি জানি তার দ্বিতীয়বার বলার সাহস নাই। যদি বইলাই ফেলে, শালারে আমি খাইছি! ডিপজলের মতো চোখ চোখ বড় বড় কইরা ফেলি মনে মনে! ওই অশ্লীল ডিপজল না, ফ্যামিলি ড্রামা, চাচ্চু সিনেমার পোস্টারের মতো!

আমার আর আমার বউয়ের একটা পিস্তল আছে। ওয়ারড্রোবের ড্রয়ারে রাখছি সেইটা। শুয়োরের বাচ্চা যদি আরেকটা কথা কয়, পিস্তল নিয়া আইসা ওরেই গুলি করবো আমি। আমার ছোটবোন, তার জামাই আর তার মা সবাই চুপচাপ খাইতে থাকে। আমার মনে হয়, আমার বউ পিস্তলটা নিয়া আইসা ওরে গুলি করুক। তারপর ওর রক্ত দিয়া ভাত মাইখা খাই আমরা। দুধের মধ্যে আম দিয়া মাইখা খাওয়ার মতো। অথবা গরুর মাংসের ঝোলের মতো। বারবার গরম করতে করতে ঘন হইয়া যাওয়া ঝোলের মতো। আমি আরো দ্রুত ভাত খাইতে থাকি। ভাত-খাওয়ার ভিতর দিয়া তার ইশারা-ইঙ্গিতময় বাক্যরে আমি ইগনোর করতে করতে শেষ কইরা দিতে থাকি। ঈদসংখ্যার গল্প ফেইসবুকের নোটে দেয়ার মতো; তাও ট্যাগ দেয়া নাই কাউরে, কোন লাইক নাই, শেয়ার নাই; অটোম্যাটিক্যালি অনলি মি হইয়া যাওয়া অপশনের মতো অস্তিত্বহীন কইরা দিতে থাকি তার অস্তিত্বরে।

কোনকিছুই ঘটে না আর। ক্লান্ত লাগে। আমরা যার যার মতো শুইয়া পড়ি। ঘুম আসে না।

 

৩.

সুড়ঙ্গের কথা মনে হয় তখন। বাসার নিচ দিয়া যেইটা আছে। আরো আরো বাসার সাথে কান্টেটেড। প্রতিটা বাসার ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে অনেক দূরে। তিন মাস হাঁইটা গেলে পরে নাকি দুইটা ডেস্টিনেশন আছে। একটা গিয়া মরভূমিতে ওঠছে। আরেকটা সমুদ্রের পারে। অনেকদিন ধইরা, অনেক মানুষ মিইলা এই সুড়ঙ্গটা বানাইছিল। যাঁরা মূলত এক্সেপিস্ট। কিন্তু ছাইড়াও যাইতে চায় নাই এই সাধের দুনিয়া। তারা ইন্ডিভিজ্যুয়ালি যার যার সুড়ঙ্গ বানাইয়া ঢাকনা দিয়া রাখছে। চাইলে যে কেউই এই পথ দিয়া চইলা যাইতে পারে। একটা সুড়ঙ্গের শেষে আরেকটা সুড়ঙ্গের কোড দেয়া আছে। এইভাবে কইরা যাইতে হয়। কিন্তু কেউ-ই যায় না। কেন যে যায় না, এইটাও কেউ জানে না। কিন্তু জানে যে, যাওয়া যায়। ইচ্ছা করলেই। ইচ্ছা কি করে না কারোরই!

এখন ইউজ করা যাইতে পারে ত। ভাবি আমি। পালাইয়াই যাই। নিজের ছোট বইনের শ্বশুররে গুলি করার চাইতে ভালো আমরাই চইলা যাই। আমি আর আমার বউ। তাইলে মেয়েটার কি হবে! ওরে রাইখা ত যাইতে পারবো না আমরা। নিয়াও যাইতে পারবো না। তাইলে কেন আর এইটার কথা ভাবি আমি! সম্ভবত এই কারণেই ভাবি যে, এইটা শান্তি দেয়, একটা লাস্ট অপশন ত আছে! কিন্তু সেই অপশনটা কেউ আর ইউজ করি না। করা যাবে, কিন্তু করি না আর কী, এইরকম সম্ভাবনাময় কবি’র মতো দিন পার করি। সবাই।

যদ্দূর মনে হয়, সুড়ঙ্গের এই আইডিয়াটা ইনভেন্ট করার সাথে আমার পরিচিতদের মধ্যে জড়িত ছিলেন ইউসুফ ভাই। আমরা তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, সেভেনে উঠব। ইউসুফ ভাই ক্লাস সেভেনে পড়েন, এইটে উঠবেন। একদিন খবর আসলো যে, উনি ত হাওয়া! বাসা থিকা পালাইয়া গেছেন। ত, এইরকম আমরাও পালাইছি, রেলষ্টেশনে গিয়া রাত বারোটা পর্যন্ত বইসা রইছি। পরে ষ্টেশন মাস্টার দেইখা কয়, বাসা থিকা রাগ কইরা চইলা আসছো, বাসায় যাও, নাইলে পুলিশে ধইরা লইয়া যাইবো। ফেরিঘাটে যাইতে গিয়া, অর্ধেক পথে পরিচিত মানুষজন দেইখা আবার বাসার সিঁড়িতে আইসা বইসা থাকতে থাকতে ঘুমাইয়া পড়ছি। পরে মারুফ ভাই আইসা ঠেলা দিছে, এইখানে বইসা কি কর? আমি গেইট খুইলা দিবো? ভিতরে আসো! পরে লজ্জার মাথা খাইয়া বাসায় ঢুকছি আবার। কিন্তু ইউসুফ ভাইয়ের ঘটনাটা এইরকম না। আজকে নিয়া পাঁচদিন হইছে। কোন খোঁজ-খবরই নাই। তারো আট-দশদিন পরে, এয়ারপোর্ট এলাকা থিকা পাওয়া গেছে তারে। উনি প্যালেস্টাইনে যাইতে নিছিলেন, ইনতিফাদায় যোগ দিবেন বইলা। বয়স কম, এইজন্য উনারে নেয় নাই। কিন্তু উনি যোগাযোগ কইরা আসছিলেন। কিছুদিন পরেই আবার চইলা যাবেন। আমরা তখন উনারে পাগল ঘোষণা দিয়া ছাড়িই নাই সবাই, পরিত্যাগই করছি একযোগে; কারণ আমরা তখন পাঠাগারে যাই, কবিতা আবৃত্তি করি, ব্যাডমিন্টন খেলি, আমরা কেন প্যালেস্টাইন যামু, কুত্তায় কামড়াইছে নাকি! তাও স্কুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা বাদ দিয়া! তখন ফেসবুক থাকলে নাহয় লিখতাম, আই অ্যাম চুদুরবুদুর ফ্রম দ্য ল্যান্ড অফ নোহ্যয়ার অ্যান্ড আই সার্পোট গাজা! কারণ কদ্দিন পরেই যেহেতু এইটা থাকবো না, তখন নাতি-নাতনিদের কইতে পারবো যে, সুনীল গঙ্গো’র কবিতার মতো একবার অ্যাক্ট করতে পারছিলাম রে লাইফে; প্যানকেইকের মতো পুরুষ বুক ফুলাইয়া কইছিলাম যে, দেখিস একদিন আমরাও! আর এইরকম কথার ভিতর দিয়াই লাইফরে ফুললি কনজিউমড কইরা ফেলতে পারছিলাম আমরা।

ইউসুফ ভাই এইরকম ফাও কথার পাবলিক না। উনি যে ফাও কথা বলেনও নাই এর নজির পাওয়া গেলো তারো এগারো-বারো বছর পরে। ইউপিএলে’র মহিউদ্দিন সাহেব কেন্দ্রীয় গ্রন্থকেন্দ্রে পাবলিকেশন্সের ক্লাশ নিতে আইসা বলেন; গতকাল রাতে বিবিসি’র নিউজ দেখছেন? আপনি খালি ত এমটিভি আর চ্যানেল ভি দেখেন; ঢাকা ইউনির্ভাসিটিতে ইকনিকমসে পড়েন কিন্তু মিডিল-ইস্ট সম্পর্কে আগ্রহ দেখান না, এইটা কেমনে হয়; অর্ধ-নগ্ন নাচ-গান দেখেন, সমস্যা নাই, কিন্তু ইসরাইল-প্যালেস্টাইনের খবরটা অন্তঃত নিয়েন। আমি ভোর চারটার সময় উঠি খালি প্রাইম নিউজটা দেখার লাইগা। তাহাজ্জুদের নামাজ পইড়াও লাভ হবে না মুসলমানদের। খবর-টবর রাখতে হবে। রেজর শার্প হইতে হবে, জিলেটের ফাইভ ব্লেডের মতো। তখন কিছুটা টের পাইছিলাম যে, ইউসুফ ভাই আসলেই একটা যোগাযোগ রাইখা গেছিলো। তারপরও আমি কখনোই ইন্টারেস্টেড হইতে পারি নাই খুব একটা।

ইউসুফ ভাই সত্যিকারের পাগল হওয়ার আগে আমারে খবরটা দিয়া গেছিলো। কইলো যে, মিয়া, তোমারে না কইলে ত তুমি জিন্দেগীতেও জানতে পারবা না! কোন দুনিয়ায় যে থাকো! তখন ডিটেইলসটা কইলেন আমারে সুড়ঙ্গ বিষয়ে। আমি ত তখন বিস্ময়ে পাদ দিয়া দেই; কই, এইটা কেমনে সম্ভব! ইউসুফ ভাই কয়, সবাই এইটা জানে; তুমিই খালি আবাল; কোন দুনিয়ায় যে থাকো! একই কথা কয়েকবার কইরা কন উনি; যেন এক একবার কইলে এক একটা আলাদা মানে ক্রিয়েট হয়। কবিতার লাইনের মতো। সুড়ঙ্গগুলার সূত্র উনারে আউলাইয়া দিছিলো আসলে। কারণ সুড়ঙ্গের একটা ডেস্টিনেশন হওয়ার কথা ছিল প্যালেস্টাইনের কাছাকাছিতে, সিরিয়া বা জর্ডানে গিয়া। ওইটা আর পারা যায় নাই; আটকাইয়া গেছে কেমনে জানি। কোন একটা কোডে ভুল করতে পারলেই খালি যাওয়া সম্ভব। উনি চেষ্টা করতেছেন অনেকদিন ধইরা, কিন্তু বারবার আটকাইয়া যাইতেছেন। ব্রদিয়াঁর বইটই পড়লে হয়তো কিছু কাজে দিতো। উনি আসছিলেন মূলতঃ এইসব নিয়া আমার সাথে আলাপ করার লাইগা। কিন্তু উনার প্যাঁচ-গোচ দেইখা আমিও কনফিউজড হইয়া যাই। আমাদের অস্তিত্বও যখন আটকাইয়া যায়, যুদ্ধটা যখন হাঁসফাঁস লাগে তখন সুড়ঙ্গগুলার চিন্তা আইসা আমাদের বাঁচাইয়া দেয়। নিজেদের বাসার নিচে সুড়ঙ্গ নিয়া আমরা বাঁইচা থাকতে থাকি।

আর পিস্তল ত আছেই। শুয়োরের বাচ্চা যদি আরেকদিন এইগুলা নিয়া কোন কথা কয়, তাইলে ওরে আমি গুলিই কইরা দিবো। ছোটবোনের জামাইরে মনে মনে কইলাম আমি।

 

৪.

মানুষ না ইহুদি ওরা জিজ্ঞাসে কোনজন?

মুসলমান নাকি ওরা?

হিঁদু নয় ত রে?

হইতে পারে। বুডিস্ট আর হিন্দুরা ত একইরকম।

নিজেদের মিস্টিক মাইনরিটি ঘোষণা কইরা কন্টিনেন্টালের সুবিধা নিতেছে।

সুবিধা কে না নেয়!

এর লাইগা মানুষ মারবো?

মানুষ আবার মারা যায় নাকি। অ-মানুষ মারতে হয়।

যার মনের হুঁশ নাই, সে কেমনে মানুষ হয়।

শব্দের অরিজিনালিটি দেখেন; তারপরে কন এইসব কথা।

তাই তো, যে যুদ্ধ করে, সে বালের কিসের মানুষ!

শিশু আর নারী!

নারী আর শিশু!

উহারা উহ্য! সমবেদনা স্বরূপ।

মানুষ মারা যায়, কিন্তু নারী ও শিশু, দেখো!

ওরা ত আধা-মানুষ!

যুদ্ধ কি খারাপ দেখো; আধা-মানুষরেও মানুষ বানাইয়া ফেলে।

তারপরও আমরা যুদ্ধ করতে থাকি।

অফিস থিকা রাস্তায় চইলা আসি।

বড়রাস্তার থিকা ছোটরাস্তায়।

ছোটরাস্তা থিকা বাসায়।

বাসা থিকা বিছানায়।

সরতে সরতে জায়গা আর নাই।

যুদ্ধ আইসা আমরা’র গায়ের উপ্রে পড়ে।

আমরা যুদ্ধ করি না ত!

হ্যাঁ, হ্যাঁ… এইটাই ত!

একটা উদাহারণ দেই:

ডাইনপাশ পুরা ফাঁকা দেখেন! ওইপাশে আরেকটা ঈদসংখ্যার উপন্যাস ছাপানো যাইবো প্যারালালি। দেখেন, দেখেন! আরে ভাই, কই যান! গল্প ছাপাইবেন না! আত্মস্মৃতি এবং জার্নালমূলক জবরদস্তি, অ্যাকাডেমিক্যালিও রিলিভেন্ট। সাহিত্য ত এখন এইগুলাই।

ক্ল্যাসিক আর কেডা পড়ে! উদাহারণ হিসাবে দুই একটা লিইখা রাখা যায় হয়তো।

গল্পলেখকরা সবাই ত স্ট্যাটাসরাইটার, ষ্টোরিওটাইপ…

ওদের ক্যাপাবিলিটি আসলে নষ্ট হইয়া গেছে।

লিখতেই পারে না।

যেহেতু আমি-ই লিখতে পারি না। অরা কেমনে লেখে!

লিখলেও লেখা হয় নাকি!

ওদের বাচ্চাকাল দেখা আছে আমার।

কিন্তু অরাও ত যুদ্ধ করবো, করবো না?

প্রতিবাদ করতে করতে শব্দরে গোলা বানাইয়া ফেলবো।

তারপর মনে হইবো, হইছে ত প্রতিবাদী-সাহিত্য!

বরফের গোলার মতো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই আইসবলের মতো না? তুষার ঝড়ের সময়

হলিউডের সিনেমাতে দেখছি ত আমরা।

হিস্ট্রিক্যালি কি এই আইডিয়াটা ওই জায়গা থিকাই আসছে?

হিস্ট্রিক্যাল ফ্যাক্টের চাইতে ন্যারেটিভ ফ্যাক্টগুলা গুরুত্বপূর্ণ অনেক। মনে রাইখেন।

মনে আর কতোকিছু রাখবো রে, ভাই! মার্ক্সই ভালো ছিলো, আবার ফুকো-দেরিদারেও আনলেন!

লিস্টে ত আরো আছে, পুরাণের ভিতর থিকা জাইগা ওঠতেছেন, হেগেল!

দেখেন ভাই, গল্প-লেখকের মনে এইসবকিছুর কোন ইমপ্যাক্ট নাই।

মন-ই ত নাই!

আমরা এখন যুদ্ধের ভিতর আছি ত এই কারণেই।

কিন্তু শান্তিও ত আসবে।

শেফালি’র পুটকিজাত সন্তান নাকি সে!

হেরোইনখোরের কবিতা বলেন?

না, না; উনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান…

অরিজিনালটারে ইগনোর করেন

আপনার ভাই মুখ খারাপ

যুদ্ধের সময় না এখন; জায়েজ এইটা!

জায়েজ না, সিদ্ধ বলেন!

ডাইনপাশ পুরা ফাঁকা দেখেন! ওইপাশে আরেকটা ঈদসংখ্যার উপন্যাস ছাপানো যাইবো প্যারালালি। দেখেন, দেখেন! আরে ভাই, কই যান! গল্প ছাপাইবেন না! আত্মস্মৃতি এবং জার্নালমূলক জবরদস্তি, অ্যাকাডেমিক্যালিও রিলিভেন্ট। সাহিত্য ত এখন এইগুলাই।

কে যে কথা বলে। কে যে প্রশ্ন করে। আর কে উত্তর দেয়। কেউ জানে না। নিজে নিজেই মানুষ এইগুলা বানায় আসলে। বানাইয়া বানাইয়া কথা বলে। মানুষজন খুব বোরড থাকে আসলে যুদ্ধের সময়। রেডিও টিভি নাই, কম্পিউটার নাই, ইন্টারনেট নাই, সোশ্যাল মিডিয়া নাই যে রিভিল করবে, আমাদের শংকা ও আশংকার রিলিভেন্সগুলা। আমাদের ভরপুর কইরা রাখবে নিউজের পর নিউজ দিয়া; লোনলিনেসরে বাড়াইয়া তুলবে, আটকাইয়া দিবে। মনে হবে, কমিউনিকেশনই জীবন! আই কমিউনিকেট, দেয়ারফোর আই এগজিস্ট! আরে ভাই, মোবাইল ফোন-ই ত নাই! কমিউনিকেশন কেমনে হবে! দেখেন না, গল্পে কোন ডায়ালগ নাই, যা আছে তাও কাল্পনিক! মোবাইলা ফোন ছাড়া কোন কথা বলা যায় নাকি। না যায় গরিব-দুঃখীদের লাইগা ঈদের জামা কিনা! উনাদের প্রতি আমাদের অফুরন্ত ভালোবাসাও ত আমরা এখন এক্সপ্রেস করতে পারি না, উনাদের কনজামশন করতে না দিতে পাইরা। এইটাই আসলে যুদ্ধের সবচে’ ওরস্ট পার্ট। আরো হয়তো আছে। কিন্তু এইটাই সবচে’ বেশি ভিজিবল, ইন আওয়ার লিটারেচার। আপনারাই দেখেন! হে পাঠক, বোবা-বন্ধু আমার!

 

৫.

কমিউনিকেশন ত করা লাগবে। মোবাইল যেহেতু নাই। আবার একদিন হাঁটতে হাঁটতেই আমি চাচার বাসায় যাই। উনারও চেহারার কোন চেইঞ্জ নাই। একইরকম আছে। বড় বইন আবার বিয়া কইরা চাচার বাসায় দেখা করতে আসছে। এইবারের জামাইটা ধুরন্ধর। কথা-বার্তা কম কয়। এইদিক-ওইদিক তাকায় বারবার। সবজানি সববুঝি এইরকম একটা ভাব। আগের জামাইটা মারা গেছে। বা মাইরা ফেলছে আসলে। কয়েকদিন পরে জামাইয়ের এই বড়ভাইটা তারে আবার বিয়া করছে। যুদ্ধের সময়, যুদ্ধের নাম দিয়া কতকিছু যে হয়!

আমার বড় বইনটা খুবই সাদাসিধা, বেক্কল টাইপ। এই কারণে হিংসুক; ভাবে যে, ভাই-বইনের সাথে দূরত্বই ওরে বাঁচাইয়া রাখবো। অথবা ছোটবেলা আমরা যে ওরে খুব একটা পাত্তা দিতাম না, এইটা ভাইবা শে এখনো কষ্ট পায়। আমারারে দেখলেই এভেয়ড করে। মাঝে মাঝে খালি মনে করায় যে আমরা এইরকম পাত্তা না দেয়ার পরেও শে বাঁইচা আছে। এতে কইরা আমরা যাতে নিজেদেরকে আরো অপরাধী ভাবতে পারি। শে মনে করে যে এইটা আমরারে আরো ছোট কইরা ফেলে। আমরা মানে, আমি আর আমার ছোটবোন। কিন্তু আমরারও যে ভাল্লাগে সেইটা না। এইটা ত ফ্যাক্ট না। ওরে ত আমরা ফিল করি। শে নাই, কিন্তু তারে ছাড়া আমরা ত কমপ্লিট হইতে পারি না। এইরকম ইনকমপ্লিটনেসের ফিলিংসটা যখন তৈরি হয়, তখন আর কিছুই করা যায় না। আমরা একলা হইয়া যাইতে থাকি। আমরা আলাদা আলাদাভাবে ওর লাইগা কান্দি। আমাদের ধারণা, আমরা কান্তে কান্তে ওর সাথে মিলতে পারি। আমাদের কান্না ওরেও কি দুর্বল কইরা ফেলে না! ও যে আমরারই বড় বইন এইটা কি শে বুঝতে পারার কথা না! ও বড় বইন; কিন্তু ও ত আসলে ছোট। কারণ ও ছিল একলা, অনেকদিন। ওই একলা সময়টা ওরে দখল কইরা ফেলছে। ও আর বাইর হইতে পারে না। আমরার কাছে আসতে পারে না। তারপরে, আবার এই যুদ্ধ।

ও ওর জামাইরে নিয়া বইসা থাকে। বড় চাচা অন্যদিকে তাকাইয়া থাকে। বড় চাচারেও কেন জানি শুয়োরের বাচ্চা মনে হয় হঠাৎ। বয়স বাড়তে থাকলে মানুষ আরো নিজের খাঁচার ভিতর ঢুকতে থাকে। সে আমার বড় বইনের সাথে যা করছে, এইটার লাইগা সে মাফও চাইতে পারে না। অন্যদিকে তাকাইয়া থাকে। আব্বা মারা যাওয়ার পরে বড় বইনরে সে পালক নিছিলো, নিজেই মানুষ করছে, বিয়া দিছে। আর সে আলাদা কইরা ফেলছে তারে আমরার কাছ থিকা। আমরা যে একটা ফ্যামিলি এইটারে সে ভাইঙা ফেলছে। শুয়োরের বাচ্চা একটা! এখন অন্যদিকে তাকাইয়া থাকে।

বড় বইন যখনই চাচার বাসায় আসে, আমি তখনই কেমনে জানি চইলা আসি। ছোটবোন কোনসময়ই আসে না। আমি বাইর হইলে শে বুঝতে পারে। শে বাথরুমে চইলা যায়। ঢুকার সাথে সাথেই ট্যাপ থিকা পানি পড়ার আওয়াজ আসতে থাকে। বাথরুমের ফ্লোরে গিয়া পানি পড়ার শব্দ হয়। আমার ছোটবোন প্যানের ওপর বইসা থাকে। দুইহাতে চোখ-নাক-ঠোঁট-গাল চাইপা ধইরা বইসা থাকে। চিৎকার কইরা শে কান্দে। আমার ইচ্ছা হয়, তার পায়ের কাছে গিয়া বইসা থাকি। শে আমার গলা জড়াইয়া কান্দুক। অথবা ট্যাপের পানিতে হাত দিয়া রাখি। তার শুনতে না-পাওয়া কান্নাটা শুনি আমি। কারণ আমি কানতে পারি না। আনিসুল হকের পুতুপুতু রোমাণ্টিকতা আমার আর আসে না, সেকেন্ড টাইমে। একদিন পিস্তলটা নিয়া আসবো আমি। বড়চাচার একটা চোখে গুলি কইরা দিবো। আরেকটা চোখে সে আমার দিকে তাকাইয়া থাকবো। লিটারালি, টারানটিনো’র সিনেমার মতো; আসবো আর গুলি কইরা দিবো। আজাইরা কোন সাসপেন্স নাই। রক্ত হইলো লাল, টমেটো সস না আর!

আমি ত ফ্যামিলির লাইগাই যুদ্ধে যাই নাই। তো এখন বুঝতে পারি, ফ্যামিলি ত আগে থিকাই নাই। আমি যুদ্ধেই চইলা যাবো। একটা একটা কইরা সবগুলা গুলি শেষ কইরা ফেলবো। সবগুলা গুলি শেষ হইয়া গেলে পরে যুদ্ধ শেষ হইয়া যাবে। আরো অনেকগুলি গুলি যোগাড় না করা পর্যন্ত থাইমা থাকবে যুদ্ধ আমার। আবার শুরু হবে। আমি অফিস থিকা রাস্তায় আইসা দাঁড়াইয়া থাকবো। ফেরি পার হইতে গিয়া হইবো না। ইকবালভাই আর মনিরমামা কথা কইতে কইতে চইলা যাবে। আমি অফিসে যাইতে গিয়া বড়চাচার বাসায় চইলা যাবো। ছোটবোন আর ওর জামাইয়ের প্রেম দেখবো। দেইখা থাইকা যাবো ওদের বাসায়। চক্রে ও চক্রান্তে আমি বন্দী হইয়া যাবো, এই ওয়ার অ্যান্ড পিস সিচুয়েশনের।

 

৬.

একদিন টিভি’টা চালু হয় হঠাৎ। টিভি ষ্টেশনে মনে হয় কাজকাম চলতেইছিল। ব্রডকাস্ট হয় নাই খালি। সাতটার খবর সাতটার সময়ই হইছে, নয়টার খবর নয়টায়। এক সেকেন্ডও নড়চড় হয় নাই। এইজন্য ওদের কোন জড়তা নাই বা আনন্দও নাই কোন। যে, এইটা স্পেশাল একটা কিছু। এই কামই ত করতেছিলাম আমরা। তখন বিকাল পাঁচটার খবরের সময়। নতুন সংবাদপাঠিকা। পাঁচটার খবরে ভালো করলে সাতটার খবরে প্রমোশন দিবে। ক্যামেরা যে চালু হইয়া গেছে সংবাদপাঠিকা টের পায় নাই। নতুনদের এইরকম হয়। ইশারাগুলা ঠিকমতো ঠাহর করতে পারে না। দাদী-নানীদের কথা মনে হয়, ঠাহর শব্দটাতে আইসা ট্রান্সমিশনটা আটকাইয়া আটকাইয়া আসে। নতুন শাড়ি পড়া শিখছে মনে হয়। এইজন্য বুঝতে পারে না, ঠিকঠাক মতো হইলো কিনা। শাড়িপড়াটা ঠিক পছন্দের জিনিসও না। কিন্তু পড়তে হয়। পুরান ট্রাডিশন একটু রাখতে হয়। যেমন, জয় বাংলা শ্লোগান যেমন পছন্দ করেন না হয়তো। জিন্দাবাদও না। এখন কি আর লোকালের টাইম আছে নাকি রে ভাই! কিন্তু, তবুও লোকালরে ধরিয়া রাখিতে হয়, শাড়ির ভাঁজটা আর কেমনে সম্ভব, স্পেশালি আপনি যখন পাঁচটার খবর থিকা সাতটার খবরে প্রমোশন চান, এইরকম একটা ক্রুসিয়াল সময়!

ছোট স্ক্রিপ্ট দেইখা শে একটু অবাক হয়; কয়, যুদ্ধ শেষ; এইবার আপনেরা হাসতে পারেন। উনিও হাসেন মৃদু, রবীন্দ্রনাথ-সাহিত্য যতোটা পারমিশন দেয় আর কী। এবং সাথে সাথেই তার ছায়ানটের স্মৃতি এবং অপ্রিমত প্রেমিকের কথা মনে হয়, সিগারেটের প্যাকেটে কর্করোগের কোশনের মতো কয়, হিন্দি সিরিয়াল দেখবেন না কিন্তু আবার; খবরদার! তারপর জীবনানন্দীয় বিষাদের ভিতর উনি হারাইয়া যাইতে থাকেন ধীরে ধীরে, হাজার বছর ধইরা। উনার নাম খবরের শুরুতে কইছিলেন উনি বা স্ক্রীণে দেখাইছিল; এই পৃথিবী একবারই চান্স পাইছিল তারে দেখার; পায় নাকো আর!

যুদ্ধ যেমন, শান্তি ত এইরকমই। বোরিং আসলে। হঠাৎ কইরাই আশা জাগে, এইটিসে দক্ষিণ তালপট্টি’র মতোন; আবার পূর্বাশা নিউমুর হইয়া সে ডুইবা যায। সমুদ্রবিজয়ের আগে আগে।

এতো এতোদিন পরে টিভি যখন আসছে, তখন বারবার আবার এবং আবার তারা আসতেই থাকবো নিশ্চয়। ফ্যামিলি’র সবাই আবার নড়াচড়া করা শুরু করে। আরে টিভি ছাড়া ফ্যামিলি আবার চলে নাকি! টিভিই আমাদের ফ্যামিলি লাইফ টিকাইয়া রাখছে। খাওয়ার সময়ও সবাই যে যার মতো খাইয়া ফেলে। এক টিভি দেখার সময়েই একসাথে বসা যায়। ফ্যামিলি যে আছে, সেই ইউনিটি’টা ফিল করা যায়। অবশ্য যাঁরা টিভিতে থাকেন, উনাদের ফ্যামিলি না হইলেও চলে। উনারা ত ফ্যামিলি ড্রিমটারে প্রডিউস করেন; এই কারণে উনারা বেশিরভাগই লিভ টুগেদার করেন; ফ্যামিলি বিষয়টারে মোর মিস করার জন্য, যাতে সেইটা অন-স্ক্রিণে রিফ্লেক্ট করতে পারেন। বিয়া করলেও করেন মিনিমাম, দুইতিনটা। চাইরটা পর্যন্ত যাইতে চান না অবশ্য। ওইটা নবীজি’র সুন্নত! মৌলবাদী মৌলবাদী লাগতে পারে; লিবারাল লাগিবে না আর তখন! আল-জাজিরা কেমন করে, সেইটা জানি না। অবশ্য একইরকম হওয়ার কথা তো; ফম্যার্ট’টা একই যেহেতু।

আমারেও ত অফিসে যাইতে হবে তাইলে। ব্যস্ততা আমি ভালোবাসি। তাড়াহুড়া কইরা গল্প লিখার মতো; ডেপথ নাই কোন। প্লট’টা স্থির হইতে পারে না, কারেক্টার বিল্ড-আপ হওয়া টাইমই পায় না। একটা একটা ঘটনা আসে আর শাট শাট কইরা চইলা যাইতে থাকে। কই যে যায় তারা!

দৃশ্য মুছে গেলে দৃশ্যের কথা আর মনে থাকে না।

 

৭.

একটা মাঠ। ধানখেত আসলে। এখন ধান নাই আর কী! চারা লাগাইলে তারপর ধানগাছ হইবো। তখন বলা যাইবো, এইটা ধানখেত! এখন দূরে একটা ছোট গাছ। অথবা একজন মানুষ। নড়াচড়া নাই অথবা এতোটাই দূর যে ঠিক বোঝা যায় না; জীব, জড় ও উদ্ভিদের সূত্রগুলা একটা লেভেলে গিয়া একইরকমভাবে অপারেট করে যেহেতু; এইরকম মনে হইতে পারে। এইরকম দূরত্ব নিয়া টিভি ক্যামেরা একটা ঘুরতেছে পাশের হাইওয়ে দিয়া। যুদ্ধের রিপোর্টিং করতে আসছিল তারা গ্রামে; মানে, যুদ্ধ নিয়া আসছিল। এখন শহরে ফেরত যাইতেছে। নাগরিক অধিকার আন্দোলন শুরু করতে। শোঁ শোঁ বাতাস বাইরে। আবার আসিব ফিরে! গাড়িটা ভাবতেছে, মনে মনে।

 

Leave a Reply