শনিবারের চিঠি নিয়া শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী কিছু কথা বলছেন উনার বই ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’তে। চ্যাপ্টারটার নাম “শনিবারের চিঠি’: অভিযান ও পরাজয়”। ১৯২৭ সন থিকা সম্ভবত ১৯৩২ সন পর্যন্ত উনি ‘শনিবারের চিঠি’র সাথে সম্পৃত্ত আছিলেন। সম্ভবত, কারণ শনিবারের চিঠি’তে ‘যোগ’ দেওয়ার সময়টার কথা উনি বলছেন ১৯২৭; কিন্তু আবার বলছেন যে, ১৯২২ সনের জুন মাসে উনি শনিবারের চিঠি ছাইড়া দেন; এইখানে ১৯২২ সম্ভবত প্রিণ্টিং মিসটেক, কারণ ১৯২২ সালে শনিবারের চিঠি’র প্রকাশ শুরু হয় নাই, এইটা ১৯৩২ হওয়ার কথা। [ref] শনিবারের চিঠি’র কিছু সংখ্যা পাওয়া যায় পশ্চিমবাংলার পাবলিক লাইব্রেরীর একটা ওয়েবসাইটে (http://dspace.wbpublibnet.gov.in)। সেইখানে রাখা সংখ্যাগুলার হিসাব মতে, শনিবারের চিঠি’র প্রকাশ শুরু হয় ১৯২৭ সালেই (বাংলা ১৩৩৫ সন) এবং বর্ষ ২২ পর্যন্ত সংখ্যা আছে। পত্রিকার সংখ্যাগুলাতে সম্পাদকের নাম উল্লেখ নাই। [/ref]
উনার বলার জায়গাটা বেশ ছোট, কিন্তু বাংলাসাহিত্যে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা স্টেটমেন্ট এইখানে আছে। উনি বলছেন যে, শনিবারের চিঠিতে উনি যোগ দিছিলেন একটা আদর্শ থিকা, খামকা ‘সাহিত্যিক দলাদলি’র রেজাল্ট ছিল না এই পত্রিকা। [ref]“আমরা যে একটা সাহিত্যিক অভিযান শুরু করিয়াছিলাম তাহা সাহিত্যিক দলাদলি হইতে নয়।” [/ref] মানে, সাহিত্যে যে দলাদলি হয় এর একটা স্বীকার আছে, উনার কথায়। আর সাহিত্যিক দলাদলি এবং এসথেটিক্যাল কোলাবোরেশ যে দুই ব্যাপার এইটাও আছে। প্রায় সব সাহিত্যিকদের কথা-বার্তাতেই এইটা নিয়া কথা থাকে না, মানে শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরীরে ‘সাহিত্যিক’ মর্যাদা দিতে আমার কোন সমস্যা নাই!
ত, শনিবারের চিঠি’র আদর্শটা কি ছিল? অ্যাকোরডিং টু শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী উনারা দেখতেছিলেন যে, ‘বাংলাভাষা ও সাহিত্য অবনতি’র দিকে যাইতেছে; উনারা সেই অবনতি রুখতে চাইছিলেন। [ref] “আমি তখনকার লেখার দুই চারিটা দৃষ্টান্ত যা দেখিলাম তাহাতে আমারও মনে হইল বাংলাভাষা ও সাহিত্য অবনতির পথে চলিয়াছে। ১৯২৭ সনে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হওয়াতেই আমি ‘শনিবারের চিঠি’তে যোগ দিলাম।” [/ref] মানে, একদিক দিয়া উনারা ‘উন্নতি’র পক্ষে থাকতে চাইছিলেন। ‘অবনতি’টা ছিল সাহিত্যে পশ্চিমবাংলার ভাষারীতির বাইরে পূর্ববঙ্গের ভাষা-ভঙ্গি লিখিত হইতে শুরু হওয়া, যেইটা পশ্চিমবাংলার ভাষার যে স্থায়ী রীতি ও ভঙ্গিমা, সেইটারে ইগনোর করতেছিল। [ref] “বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিতেছিল। ইহার কথা কেহই আলোচনা করে নাই। ব্যাপারটা এই – নূতন বাংলাসাহিত্যের পাঠক-পাঠিকা পূর্ববঙ্গে অগণিত হইলেও, পূর্ববঙ্গ হইতে উচ্চস্তরের কোনো লেখক দেখা যায় নাই, সকলেই পশ্চিমবঙ্গের, এক নবীনচন্দ্র সেন ছাড়া।… ১৯২৫ সনের পর হইতে পূর্ববঙ্গের অর্বাচীন যুবকেরা বাংলাসাহিত্যে পূর্ববঙ্গের দাবি আছে মনে করিয়া তাঁহাদের রুচি ও ভাষা অনুযায়ী লেখা শুরু করিলেন।” [/ref] এই প্রবণতার পক্ষে কয়েকটা উদাহারণও দিছেন তিনি, পূর্ববঙ্গীয় ভাষা-রীতি’র ডিফারেন্সের জায়গাটার। [ref]“মোহিতবাবু একদিন ‘প্রগতি’ পত্রিকায় একটা গল্প পড়িতে পড়িতে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ওহে নীরদ, এটা কি লিখেছে বল তো?’ একটি শিশুকে কোলে তুলিয়া এক যুবতী বলিতেছে, ‘একে আলগাতেও সুখ!” মোহিতবাবু বলিলেন, ‘এ কি ‘আগলাতে’র ছাপার ভুল?’ আমি বাঙ্গাল, বুঝিলাম, উত্তর দিলাম, ‘না, মাস্টারমশায়, আমরা তোলাকে আলগানো বলি, যেমন ‘এই বাক্সটা এত ভারী যে, আমি আলগাতে পারি না।” [/ref]
এই পূর্ববঙ্গের ভাষারীতি ব্যবহারের বিরোধিতার প্রধান হিসাবে শ্রীনীরচন্দ্র চৌধুরী মোহিতলাল মজুমদার’রে মনোনয়ন দিছেন। [ref] “মোহিতলাল মজুমদার মহাশয় কিন্তু এই সব লেখার ভঙ্গী দেখিয়া অত্যন্ত বিরূপ হইয়াছিলেন। তিনি ১৯২৮ সনের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাসাহিত্যের অধ্যাপকত্ব পাইয়া কলিকাতার স্কুল মাস্টারি ছাড়িয়া ঢাকা গিয়াছিলেন। তাঁহার বৈষয়িক উন্নতি ঢাকায় হইলেও তিনি ঢাকাই সাহিত্যকে ঢাকাই পরোটার মতো গ্রাহ্য করিলেন না। পরবর্তী ছুটির সময়ে কলিকাতায় আসিয়া তিনি আমাকে একটি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন যাহা ঢাকার সাহিত্যিকদের উপর উগ্র আক্রমণ। এই কবিতাটার প্রথম দুইটি লাইন এইরূপ ছিল –
‘শুনরে পুঙ্গীর পুত,
কোন পদ্মার পার হতে এলে
বুড়ীগঙ্গার ভূত।’” [/ref]
এইখানে আমার খেয়াল করার জায়গা দুইটা: শনিবারের চিঠি নিয়া যে কথা-বার্তা শুনছি, সেইখানে এই পূর্ববঙ্গের ভাষারীতির বিরোধিতার কথা কখনোই শুনি নাই। (আমার মূর্খতারে সালাম!) শুনছি যে, উনারা ইউরোপিয়-পণার বিরোধিতা করতেন এবং ভারত-মাতা’র সন্তান ছিলেন। কিন্তু এই আর্গুমেন্টে, উনারা ত ইউরোপিয়ান-মৌলবাদী হইলেন, যারা ‘উন্নয়ন’ (ডেভেলাপমেন্ট অর্থে)এর যাত্রী! উন্নয়ন এই অর্থে যে, পূবর্বঙ্গের ভাষারীতি’র ব্যবহার বাংলাভাষারে একটা ‘অবনতি’র দিকে নিয়া যাইতেছে, যার বিপরীতে এক ধরণের ‘উন্নতি’রে এক্সপেক্ট না করলেও, ভাষা’র রীতি ও ভঙ্গিমা যে ‘উন্নতি/অবনতি’র মান নির্ধারক এইরকম একটা ভুল ধারণা যাওয়া যায়। যদিও এই তর্ক আরো অনেকদূর পর্যন্তই যাইতে পারে। কিন্তু ভাষার ‘উন্নতি’রে সে ছাড়তে পারে না। সাহিত্যের উন্নতি বা অবনতি’র কথা বরং ভাবা যাইতে পারে তার ইন্টেলেকচুয়ালিটিরে বেইস কইরা, ভঙ্গিমারে কনসার্ন কইরা তোলাটা এক ধরনের রাজনৈতিক (অ-সাহিত্যিক না হইলেও) ইস্যু বরং।
আরেকটা গুরুত্বের জায়গা হইলো, পূর্ববঙ্গের ভাষারীতির আধিপত্যকামী ( 🙂 ) মনোভাবের কথা বলা হইতেছে ১৯২৫ সালে! ১৯৯০ এর পর থিকা বরং কলকাতার সাহিত্যিকদের মুখে এই টাইপের কথা শোনা যাইতেছিলো যে, ‘বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হইবে ঢাকা’। [শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী’র বইটা ছাপা হইছে ১৯৯৪ সালে।] অবশ্য বাংলা-সাহিত্যের বাজার হিসাবে ঢাকা এখন প্রমিনেন্ট, আরো হইতে পারে। মানে, ঢাকার সাহিত্যিক প্রডাক্টগুলা অন্যান্যদেশে বিক্রয়যোগ্য হয়া উঠে নাই বা বাইরের (একসেপ্ট কলকাতা) সাহিত্যগুলারও এক্সপ্লোরেশনটা এখনো ঘটার বাকি আছে। আশা করি হয়া উঠবে তাড়াতাড়িই। কিন্তু এখন থিকা প্রায় ৯০ বছর আগেই পূর্ববঙ্গের ভাষারীতি’র বিপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের ভাষারীতির ধারক হইতে চাওয়া শনিবারের চিঠি ফেইল মারছিলো, [ref]“কিন্তু আমি কয়েকমাস পরেই বুঝিলাম যে, আমাদের শত্রুপক্ষই জয়ী হইবে, আমরা পরাজিত হইব।… সকল সাহিত্যেরই জন্ম, বাল্য, যৌবন, পৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য ও মৃত্যু আছে – ইহার ব্যতিক্রম কখনও হয় নাই। তাই আমার ধারণা জন্মিল, বাংলাসাহিত্যের অকাল জরা আরম্ভ হইয়াছে, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।” [/ref] শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী’র এই ক্লেইম ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না। কারণ, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সাহিত্যের ডমিনেন্ট ভাষারীতি পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষারীতিরই এক্সটেনশন। হয়তো তখনই একটা শুরু হইছিল, কিন্তু একটা মাইনর হিসাবেই ছিল এবং এখনো সেইটা কোন ধারা হয়া উঠতে পারে নাই, কলিকাতার কথা বাদই দিলাম, ইভেন বাংলাদেশেও। এইটা নিয়া ভাষাবিদরা হয়তো আরো ভালোভাবে বলতে পারবেন। কিন্তু আমি আমার জেনারেল অবজারভেশনই রাখলাম।
বাংলা-সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের ভাষারীতি’র ব্যবহারের বিরোধিতার কারণেই শনিবারের চিঠি ব্যর্থ হয় নাই (যদি ব্যর্থ মনে করি), নিশ্চয় অনান্য আরো অনেক কারণ আছে। বর্তমানে শনিবারের চিঠি বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে যে একটা নেগেটিভ ফেনোমেনা (এটলিস্ট পাবলিকলি), তার একটা বড় কারণ জীবনানন্দ দাশের কবিতার বিরোধিতা। তবে সেই আলাপ শুরু করলে শনিবারের চিঠি’র পুরা ব্যাপারটা নিয়াই কথা বলা দরকার।
আপাতত, এই একটা জিনিসেই থাকলাম।
নভেম্বর, ২০১২।
——————
ফুটনোট:
আরো কয়েকটা জিনিস যোগ করা যাইতে পারে এইখানে, পরে ভাবলাম। এক হইলো, শ্রীনীরদচন্দ্র তো একটা আইডিয়ালিস্টিক জায়গা থিকা দেখছেন ভাষারে; মানে, শুদ্ধতা আছে একটা ভাষার এবং সাহিত্যের, আর এই জিনিসটা লোকাল ফেনোমেনা দিয়া দূষিত হইতেছে। এইটা একটা কোর পয়েণ্ট।
আরেকটা জিনিস হইলো, পূর্ববঙ্গ নিয়া ভয়’টা। এইটা ইংরেজদের ছিল। সিপাহী বিদ্রোহ থিকা শুরু কইরা সূর্যসেন পর্যন্ত। এই যে ভয়, এইটা টেক্সটের মধ্যেও চইলা আসতে পারে। মানে, এই সম্ভাবনাগুলাও আছে এইখানে।
মে, ২০১৬।
Leave a Reply