ইন্টেলেকচুয়ালরা কেন ধরা খায় না, বরং কেন উনারা খুব বেশি ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারেন না আর, সোসাইটিতে? (মানে, কেন? – প্রশ্নটা এইটা না আর, বরং কোথায় ফেইল মারেন…)
এইটা নিয়া বছর তিনেক আগে একবার কথা হইতেছিল @A-Al Mamun’র সাথে, ২০১৭ সালের ঘটনা হবে। আমি একটা কাজে রাজশাহী গেছি। সন্ধ্যার পরে উনার সাথে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে দেখা হইছিল। পরে রাতে উনি আমারে হোটেলে পৌঁছায়া দেয়ার সময়, উনার গাড়িতে কইরা একটা বাঁধের উপর ঘুরতে নিয়া গেছিলেন। আমরা গাড়িতে যাইতে যাইতে আর এইদিক সেইদিক ঘুরতে ঘুরতে দুই তিনঘন্টা কথা বলছিলাম।
আমি বলতেছিলাম, আমার যেই ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাক্টিভিটি সেইটা আসলে আমার কবিতা লেখারই একটা এক্সটেনশন। কারণ, এই মিডল ক্লাস ক্রিয়েটিভ সাহিত্যরেই যদি আমরা আর্ট কালচার মনে করতে থাকি, তাই্লে আমার কবিতা এইখানে কোন মিনিং তৈরি করতে পারবে না। কবিতা লেখার বাইরেও কবিতা কোন কনটেক্সট থিকা পড়া হইতেছে বা পড়া যাইতে পারে, এইটা নিয়াও কাজ করতে গিয়া আমি ইন্টেলেকচুয়ালিটির জায়গাটারে এক্সপ্লোর করতে চাই।
তখন উনি বলতেছিলেন, ইন্টেলেকচুয়াল কাজকামের ইমপ্যাক্ট কেন কইমা আসতেছে দিন দিন? বা এইরকমের কিছু। উনিও হয়তো কিছু ধারণার কথা বলতেছিলেন। আমি যেইটা বলছিলাম, সেইটারে আরেকটু ইলাবরেট করি এখন।
সোসাইটির ফর্মেশন আর ইন্টেলেকচুয়ালের রোল যে চেইঞ্জ হইছে, এইটা তো আছেই। মানে, ইন্টেলেকচুয়ালের কাজ আসলে পাবলিকরে জানানো বা ইনফর্ম করা না, পাবলিক নানানভাবেই ইনফর্মড। অ্যানালাইসিসও করতে পারেন। মিলাইতে পারার বা বুঝতে পারার কিছু জায়গা হয়তো আছে, কিন্তু স্টিমুলেশনের জায়গাগুলা এতোটাই স্ট্রং যে, আলাদা করতে পারাটা মুশকিলেরই হয়। মানে, সোসাইটিতে ইন্টেলেকচুয়ালিটির যে নিড, সেইটা একভাবে কমছে। যার ফলে, ইন্টেলেকচুয়ালিটি সমাজের তেমন কোন কাজে আসে না, বরং অরেন্টামেন্টাল একটা জিনিস, এই জায়গাতে রিডিউসড হইতে পারছে। (প্রফেশনাল ইন্টেলেকচুয়ালিটির বাইরে।)
এর বাইরে, ইন্টেলেকচুয়ালের দিক থিকা আমার কাছে মেইন ক্রাইসিস মনেহয়, পাবলিক ও পারসোনাল লাইফের ডিলেমাটা। ইন্টেলেকচুয়ালিটি তো একটা পাবলিক অ্যাক্টিভিটি, কিন্তু যিনি করতেছেন তিনি নিজে তো একজন ব্যক্তি মানুশ। এখন হয় কি, একজন ব্যক্তি মানুশের কথারেও তো তার পারসোনালিটির বাইরে গিয়া ভাবা যায় না। কি বলতেছেন, এইটা দেখার আগে, বা সাথে সাথেই আমরা দেখি বা দেখতে চাই যে, কে বলতেছেন? মানে, কথা কি বলতেছেন, এইটা তো আছেই, কে বলতেছেন, এইটাও সমান বা তার চাইতে বেশি ইর্ম্পটেন্ট।* একটা কথার যেমন আপনি সোশ্যাল কনটেক্সটের বাইরে গিয়া কোন মিনিং বাইর করতে পারেন না, ব্যক্তিরও তো সোসাইটির বাইরে কোন পজিশন নাই। তো, ইন্টেলেকচুয়ালের একটা পজিশন আমরা এক্সপেক্ট করি না খালি, কোন একটা পজিশন ছাড়া ইন্টেলেকচুয়াল হিসাবে পারসিভড হওয়াটাও মুশকিলের।
একটা তো হইলো, প্রফেশন. আপনি ইউনিভার্সিটি টিচার, রিসার্চার, সাংবাদিক, বা আপনি যেই ফিল্ডে কাজকাম করেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাবলিক সার্ভিস – সেইখানে উপ্রের পজিশনের কেউ হইলে ইন্টেলেকচুয়াল হইতে পারবেন আপনি। একজন মানুশ, যিনি রিকশা চালান, সব্জি বেচেন বা ছোটখাট কোন ব্যবসা করেন, তারে কি ইন্টেলেকচুয়াল বইলা মানতে পারবো আমরা? পারবো না যে, তা না, একটু কঠিন হবে। (একাডেমিক কিছু ব্যাপার স্যাপারও তো আছে!)… মানে, ইন্টেলেকচুয়াল একটা সোশ্যাল পজিশনের ঘটনা। এখন ইন্টেলেকচুয়ালের পজিশন যদি সোশ্যাল মিনিংয়ের ভিতরে আটাকায়াই থাকে, তার কথা সোশ্যাল মিনিংগুলার বাইরে যাইতে পারার সম্ভাবনাও তো কমে, কিছুটা হইলেও। মানে, ইন্টেলেকচুয়ালের কথা তার সোশ্যাল পজিশন বা অ্যাক্টের বাইরে গিয়া পারসিভ করার জায়গাটা তো নাই! যেমন, উনি বড় চাকরি করেন, উনি তো এইরকম কথা কইবেনই, এইরকম সুডো লিবারাল গ্রাউন্ডে গিয়া বাতিল কইরা দেয়া যায়, বা উনি তো নিজেই কিছু করতে পারেন নাই, আবার কথা কইতে আইছেন! এইরকম।
আরেকটা জিনিস হইলো, কারেক্টার, বা ব্যক্তি চরিত্র। কয়েক বছর আগে ফরহাদ মজহার, এবং আলী রিয়াজও মনেহয় এক রকমের স্ক্যান্ডালের মধ্যে পইড়া গেছিলেন, … তো, আলী রিয়াজ সাহেব মনেহয় বাইর হয়া আসতে পারছিলেন, কিন্তু ফরহাদ মজহার সাহেবের ইমেজ অনেকদিন পর্যন্তই সাফার করছিল। মানে, ব্যক্তি হিসাবে ক্লিন থাকাটাও একটা ঘটনা। যেহেতু উনি ‘ভালো ভালো’ কথা কইতেছেন, ‘খারাপ কাজ’ কইরা এইটা কেমনে করতে পারেন উনি! বেশিরভাগ ইন্টেলেকচুয়ালও এই জায়গাটারে ডিল করতে পারেন নাই।
কবি আর ইন্টেলেকচুয়ালদের ব্যাপারে জিনিসটা দেখবেন পুরা উল্টা। রবীন্দ্রনাথরে যে গ্লোবাল কবি মনেহয় এর একটা কারণ কিন্তু যে, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো উনারে পছন্দ করতেন, নজরুলের বিদ্রোহী ইমেজে উনার তিন চাইরজন প্রেমিকা যে ছিল, এইটা একভাবে কন্ট্রিবিউট করে। মানে, কবি হইলে একটু লুইচ্চা হবে, এইটা বরং প্লাস পয়েন্ট। এমনকি যদি না থাকে, তখন সন্দেহও হওয়ার কথা এনাফ কবি কিনা! (যদিও এইগুলা পারসেপশন বইলা ডিনাই করতে পারি আমরা, কিন্তু পাবলিক কনশাসনেসে এই জিনিসগুলা আছে বা থাকে, একভাবে।) কিন্তু ইন্টেলেকচুয়ালের ব্যাপারটা একইরকমের না। কারণ, লেখক বা কবি’র কোন রেসন্সিবিলিটি নাই – এইরকম পারসেপশনের বাইরেও একটা লেখা তখনই সো-কল্ড ‘সার্বজনীন’ হয়া উঠতে পারে যখন লেখাটারে ব্যক্তি লেখক থিকা আলাদা করা যায়। এর একটা ইচ্ছাও ‘আর্ট’ জিনিসটার ভিতরে থাকে। লেখক মারা গেলে যে লেখার দাম বাড়ে এইটাও এই জায়গা থিকা আসছে, যে লেখাটা সবার লাইগাই, এইখানে লেখক মুখ্য না। কিন্তু ইন্টেলেকচুয়ালিটির ক্ষেত্রে বরং চাপ থাকে, অ্যাক্টিভিজমের। আলাদা তো না-ই, বরং উনি কি এইটা মানতেছেন নাকি উনার লাইফে? এই প্রশ্নটা আগে না আসলেও, একদম সাথে সাথে আসে।
তো, এই পাবলিক আর পারসোনাল লাইফের লিবারাল ডিলেমাটারে ইন্টেলেকচুয়ালরা এফেক্টিভলি ডিল করতে পারতেছেন বইলা আমার মনেহয় নাই। মানে, ‘ভালো’ মানুশ না হয়া আপনি ‘ভালো’ কথা বলতে পারবেন কি পারবেন না – এইটা নিয়া কোন আলাপ হাজির করতে পারেন নাই। নিজেদের কাজকামের ব্যাপারে ক্রিটিক্যাল হয়া রোলটারে রিডিফাইন করতে পারেন নাই।
এইটা করতেই হবে – এইরকম না, কিন্তু এইটা উনাদেরকে আরো খারিজ করতে পারতেছে মনেহয়, সোসাইটিতে।
২.
পাবলিক আর পারসোনাল লাইফ কমপ্লিটলি আলাদা – এইটা আমার ক্লেইম না। কিন্তু ডিফরেন্সিয়েশনের জায়গাগুলারে লোকেট করতে পারাটা জরুরি।
পারসোনাল লাইফের ইমপ্যাক্ট তো আছে পাবলিক লাইফে। কিছুদিন আগে দেখলাম একজন ইন্ডিয়ান মহিলা, যারে তার জামাই ঘর থিকা বাইর কইরা দিছিলো, উনি আশ্রম বানাইছেন, যাদের বাড়িঘর নাই, তাদের থাকার লাইগা। তো, উনার পারসোনাল পেইনটারে উনি পাবলিকলি ভালোভাবে ডিল করছেন। আবার ধরেন, ফজলে হাসান আবেদ যে ব্র্যাক বানাইছেন, সত্তুরের ঘূর্ণিঝড় আর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা থিকা উনি ভাবছেন, এইরকম দেখছি। মানে, একটা পাবলিক ইভেন্ট উনার পারসোনাল চয়েসের জায়গারে নাড়ায়া দিছে।
এর উল্টাটাও হয়, দেখবেন, পারসোনাল লাইফে অশান্তি, চাকরি বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য ঠিকঠাকমতো চলতেছে না, তখন মেজাজ খারাপ হয় তো, তখন ভাবা যায় তো, এর সবকিছুর পিছনে আছে ক্যাপিটালিজমের অশুভ শক্তি! মানে, আছে তো অনেক আগে থিকা, তখন আরো বেশি চেইতা যাওয়া যায়। ব্যবসা বা চাকরি ঠিক থাকলে এতোটা চেতা লাগতো না হয়তো। আবার, আপনার বন্ধুবান্ধব, চারপাশ প্লাস্টিক নিয়া চিন্তিত, আপনি নিজেও বাসায় ইউজ করা কমায়া দিবেন তো!
মানে, ইমপ্যাক্টগুলা তো আছে। কিন্তু এমন না যে, আমার চিন্তা আর কাজ, একটা আরেকটার সাবসিটিউট। বরং মিসিংলিংকের ভিতর দিয়াই কাজ করে। মিসিংলিংক বলাটাও হয়তো ঠিক হইতেছে না। চিন্তা ও কাজের ডিফরেন্সের জায়গাগুলারে লোকেট করা না খালি, কেমনে মাইনা নিতে পারি আমরা, সেই জায়গাটারে ক্রিয়েট করা। যেমন, আমি আমি হিন্দি গান শুইনা ইন্ডিয়ার বর্ডার কিলিং নিয়া খেপতে পারি। রিকশাঅলাদের অধিকার নিয়া সচেতন হয়া রিকশা ভাড়া নিয়া তর্কাতর্কি করতে পারি। এইরকম।
৩.
আর এইটা তো সত্যি যে, একজন ইন্টেলেকচুয়ালের কাজ হইতেছে প্রি ও পোস্ট। আগে কি হইছিল, আর পরে কি করা দরকার, সেই জায়গাগুলা নিয়া বলা। যখন ঘটনাটা ঘটতেছে, তখন একজন ইন্টেলেকচুয়াল আর অন্য যে কোন একজন মানুশের মতই। মানে, উমবের্তো একো যেইরকম কইছেন, যখন একটা থিয়েটার ঘরে নাটক চলার সময় ফাটল দেখা দিছে, তখন ইন্টেলেকচুয়ালের বলতে পারাটা দরকার যে, এইটা ভাইঙ্গা পড়তে পারে, কিন্তু যখন ভাইঙ্গা পড়তেছে, তারও অন্য সবার লগে দৌড়ায়া বাইর হওয়ার কাজটাই করা লাগবে।
এই মহামারী যখন শুরু হইতে নিছে, তখন অনেকেই অনেক কথা বলছেন। ফিউচার নিয়াও অনেক কথা বলা হবে। কিন্তু এখন, যখন ঘটনাটা আমাদের সামনে হাজির হইছে, ঘটতেছে, ইন্টেলেকচুয়ালদের কাজ বাঁইচা থাকাই, অন্য সবাইরে নিয়া। আর ফিউচার সোসাইটি নিয়া ভাবতে পারাটারে পসিবল কইরা তোলা।
মানে, এইরকম কিছু ভাবলাম।…
…………………………..
*এইখানে একটা ঘটনার কথা মনে হইলো। ছোটবেলা একবার জন্ডিসের মতো হইছিল আমার। তখন আমাদের বাসায় কাজ করতেন ফাতু খালাম্মা, উনি কইলেন, উনার পরিচিত এক কবিরাজ আছেন, জন্ডিস ভালো করতে পারেন। উনার কাছে দুইতিনবার গেছি, সকালবেলায়। ঝাঁড়ফুক কইরা দিতেন, আর কবিরাজি অষূধ দিতেন। পরে একদিন বাজারে দেখি যে, উনি থানার কনস্টেবল! কবিরাজ বইলা ভাবতে অনেক কষ্ট হইছিল তখন।
Leave a Reply