গল্পটা আসলে পুরির। চা-পুরি-সিঙ্গারা’র পুরি; সিলঅটি পুরি, উৎপলকুমারবসু’র পুরি-সিরিজের পুরি কিংবা অন্য আর কিছুই না। খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা এইটা। চূড়ান্ত অসাফল্যের একটা ইতিহাস, না-পারার একটা করুণ অধ্যায়।
তখন আমার বয়স দশ। শৈশব শেষ হচ্ছে প্রায়। একটু একটু কিশোর। পাড়ার মাঠ ছেড়ে রেলের মাঠে যাই মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে বাজারে যাই আব্বার সাথে। বাজার শেষে রিকশা করে দিলে একা একা বাসায় ফিরতে পারি। ইত্যাকার সব লক্ষণ। মানে আমি বোঝাতে চাইতেছি যে, আমি তখন আসলে আর শৈশবের ভিতর নাই। কিন্তু আমার সম্পর্কে তখনও নর-নারী ভেদ পুরাপুরি ঘটে নাই। নানুবাড়ি গেলে নানা-নানির সাথে এক বিছানাতেই থাকি। একটা বিহ্বল অবস্থার সূত্রপাতও হয় নাই। তখনও আমি কিশোর হওয়ার যোগ্যতাগুলির ভিতর দিয়ে যাওয়া শুরু করি নাই। [pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]
তখন আমি পড়ি ক্লাস ফাইভে। পৌরসভার মডেল প্রাইমারী স্কুলে। আমি বলছি, আশির দশকের মাঝামাঝির একটা সময়ের কথা। কিন্ডারগার্ডেন স্কুল তখনও চালু হয় নাই সেখানে। পৌরসভার মধ্যে নামকরা প্রাইমারী স্কুল। পৌরসভার তথা সমস্ত উপজেলার ট্যালেন্টপুল বৃত্তির একটা বড় অংশ এই স্কুল থেকে আসে। আমাদের আগের ব্যাচে উপজেলার সাতটা ট্যালেন্টপুল বৃত্তির পাঁচটাই এই স্কুলের ছিল। গল্পের এবং স্কুলের সাফল্যের সীমানাটুকু এই পর্যন্তই। এরপর থেকে আমার অধ্যায়, ব্যর্থতা আর অসাফল্যের গাঁথা। সেই ইতিহাসের বিবরণটা এবার পেশ করি।
আমি যখন ক্লাস ওয়ান থেকে প্রতিযোগিতার ভিতর যাত্রা শুরু করি, সম্ভবত তখন থেকেই ফার্স্ট হওয়ার প্রতি আমার এক ধরনের ভীতিই বলতে হবে এখন, তা ছিল। কারণ আমি কখনোই ফার্স্ট হতে পারতাম না, বিশেষ করে বার্ষিক পরীক্ষায়। যখন ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টু তে উঠি, ভুল করার সম্ভাবনা আমার খুবই কম ছিল, আম্মা-আব্বা, বিশেষ করে বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে। তথাপি আমি তা পারি নাই। কারণ আমার হাতের লেখা যথেষ্ঠ পরিমাণ খারাপ হওয়ায়, একই নম্বর পাওয়ার পরও আমাকে সেকেন্ড ঘোষণা করা হয়। তবে রোল নম্বর আমার এক থাকে, বি সেকশনে। ক্লাস টু থেকে আমি ফোর্থ হয়ে ক্লাস থ্রিতে উঠি, পরিবারের নানা কটুবাক্য সহ্য করে এবং নিজের দিক থেকে কোনোরকম গ্লানি ও জটিলতা ছাড়াই। থ্রি থেকে ফোর-এ ওঠার সময় আবারও সেকেন্ড হই, নিজের দিক থেকে কোনোরকম গ্লানি ও জটিলতা ছাড়াই। কিন্তু পরিবারে কিছুটা শান্তি আসে এবং পাশাপাশি এই বোধটা দৃঢ় হয় যে, এই ছেলে কখনোই ফার্স্ট হতে পারবে না। কেননা, ফার্স্টের সাথে আমার ব্যবধান ছিল যোজন যোজন। আর ফার্স্টওলাও আমার উপর খুব খুশি এইরকম সেকেন্ড পেয়ে। আর আমিও ঈর্ষান্বিত নই। এইরকম খুশি খুশি ফার্স্ট-সেকেন্ড আমার ধারণা খুব কমই দেখা যায়।
কিন্তু ট্রাডেজিটা ঘটে তার পরেই। এই কম্পিটিশন না থাকাটা ফার্স্টর পরিবার মানতে পারে না, একই ঘটনা ক্লাস ফ্লোর-এ ওঠার সময় ঘটলে, তারা তাকে নিকটস্থ হাইস্কুলের প্রাইমারী সেকশনে দাখিল করেন, আরো কম্পিটিশন মোকাবিলা করে হাইস্কুলের ভবিষ্যত প্রতিযোগিতার জন্য যোগ্য করে তুলবার আশায়। কিন্তু বিপদ হয় স্কুলের এবং আমার। আমি ফার্স্ট হতে পারি না আর ভালো স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করার মতো মেরিট ছাত্র আর খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরন্তু ভয়, যদি আমাকে কাট দেওয়ার প্ল্যান করেন, আমার পরিবার। কিন্তু আমার পরিবারে তখন স্বস্তির হাওয়া, এইবার তো অন্তঃত ফার্স্ট হতে পারবে! কারণ তৃতীয় বা চতুর্থ বলে কাউকে খুঁজে পাওয়া ছিল আরো মুশকিল। কিন্তু যথারীতি আমি ফার্স্ট হতে ব্যর্থ হই, প্রথম সাময়িকী পরীক্ষায়।
কারণ তখন উত্থান ঘটে নারীবাদের। দুই দুইজন নারী আমার সাথে ফার্স্ট হওয়ার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। একজন ফার্স্ট এবং একজন থার্ড হন। কম্পিটিশন জাগিয়ে তোলেন। যেহেতু তারা মেয়ে, আমি খুব একটা মাইন্ড করি না, কিন্তু একটু একটু খারাপ লাগে যখন লোকজন বলে যে, ‘শেষ পর্যন্ত মেয়েদের তলে পড়লি!’ সম্ভবত তখন থেকেই আমার মধ্যে নারীবাদের প্রতি সহানুভূতি জাগতে শুরু করে, পাল্টা যুক্তি দিতে গিয়ে যে, ‘মেয়েরা কী ছাত্র না! ওরা ফার্স্ট হতে পারবে না কেন?’ কিন্তু এই যুক্তি আমাকে শান্তি বা স্বস্তি কোনোটাই দিতে পারে না। এর পরিত্রাণ হিসাবে পড়াশোনার চিন্তা খানিকটা স্থগিত রেখে আমি খেলাধুলায় মনোনিবেশ করতে শুরু করি।
মোটা দাগে, পরিস্থিতিটা এই।
আর তখনই খবর আসে যে, ইন্টারস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে, উপজেলায়। এই প্রতিযোগিতাকে সামনে রেখে আমি দুইটা খেলায় পারদর্শিতা অর্জনের চেষ্টা করি। একটা হচ্ছে একশ মিটার লম্বা দৌড় আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে অংক দৌড়। প্রথমটা ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। কিন্তু দ্বিতীয়টার নিয়মগুলি সম্পর্কে একটু বলি। প্রত্যেক প্রতিযোগীর হাতে একটা খাতা এবং কলম থাকবে। মাঠের মাঝখানটাতে ব্ল্যাক বোর্ডে একটা অংক দেয়া থাকবে। বাঁশি ফু দেয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক প্রতিযোগীকে দৌড় শুরু করতে হবে। ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গিয়ে অংকটা দেখে, তার সমাধান করে বাকি মাঠ দৌড় দিয়ে শেষ করতে হবে। যে অংকটা ঠিকভাবে করে সবচেয়ে আগে দৌড়ে শেষ প্রান্তে পৌঁছতে পারবে, সে ফার্স্ট হবে। মানে, কেউ আগে দৌড় শেষ করতে পারে, কিন্তু অংক ভুল হলে কোনো লাভ নাই। প্রতিযোগিতায় ভালো করার মূল শর্ত দ্ইুটা, ভালো দৌড়াতে হবে এবং দ্রুত অংক করতে জানতে হবে। আমি যেহেতু একটু দৌড়াতেও পারি এবং ফার্স্ট/সেকেন্ড হওয়ার অভ্যাস আছে, আমার জন্য এই খেলায় ভালো করার সব সম্ভাবনাই ছিল। আর সত্যি সত্যি সেটা হয়েছিলও।
স্কুলের মধ্যে প্র্যাকটিস করার সময় দৌড়ে ফার্স্ট বা সেকেন্ড হতে শুরু করি; আর অংক দৌড়ে স্কুলে ফার্স্ট তো আমি হই-ই, কিন্তু সেকেন্ড আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। দেখা যায়, আমি অংক-দৌড় শেষ করে, কল থেকে পানি খেয়ে ফিরে আসার পরও যারা দৌড় শেষ করে আসছে, তাদের অংক পরীক্ষা করে সেকেন্ড নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিটি খেলায় প্রতি স্কুল থেকে দুইজন করে অংশ নিতে পারবে। আমি একশ মিটার লম্বা দৌড় এবং অংক দৌড়-এর প্লেয়ার। কিন্তু আমাদের স্কুল থেকে অংক দৌড়-এর জন্য সেকেন্ড আর কাউকে পাওয়াই গেলো না। তাই আমিই একমাত্র।
আমি খুবই খুশি হয়ে উঠি আমার নিজের কিছু করার মতো এই জায়গাটা পেয়ে। ভবিষ্যত সাফল্যের স্বপ্ন দিনে এবং রাতে সবসময় দেখতে শুরু করি। পরিকল্পনা করতে থাকি কী করে আমি আরো দ্রুত দৌড়াতে পারি, দৌড়টা কীভাবে শুরু করবো, অংক করার সময় কোন ভঙ্গিতে বসতে হবে, ইত্যাদি। আর অংক তো আমি পারিই। ফার্স্ট হই বা সেকেন্ড হই অংক পরীক্ষায় হায়েস্ট মার্কস আমার থাকেই। মেয়েরা এতটা ভালো অংক করা তখনও শেখে নাই।
দেখতে দেখতে একসময় প্রতিযোগিতার দিন চলে আসলো। প্রথমে পৌরসভা এবং ইউনিয়ন ভিত্তিক প্রতিযোগিতা হবে, তারপর উপজেলা পর্যায়ের খেলা। আমরা জানতাম যে, পৌরসভার প্রতিযোগিতাটা আমাদের স্কুলেই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর ঘটলো না। কারণ আমাদের স্কুলের মাঠটা আবার ঈদগা’রও মাঠ। খেলাধুলার প্রতিযোগিতা করে সেই মাঠ নষ্ট করা যাবে না। তাই অন্য আরেকটা স্কুল ঠিক করা হলো। যদিও সেই মাঠটা ছোট।
আমরা সকাল নয়টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেলাম। সব মিলিয়ে আট দশটা খেলা হবে হয়তো। কিন্তু আমার অন্য কোনো বিষয়েই মনোযোগ নাই। শুধুমাত্র আমার অংশগ্রহণের দুইটি খেলা ছাড়া।
প্রথমে হিট। মানে, বিশ/বাইশ জনের মধ্যে থেকে প্রথম আটজনকে মূল প্রতিযোগীতার জন্য বাছাই করা হবে। গোল-দৌড় আর মোরগের লড়াইয়ের পর একশ মিটার লম্বা দৌড়-এর ডাক পড়লো। হিটে আমি সপ্তম বা অষ্টম হয়ে মূল প্রতিযোগিতার জন্য কোয়ালিফাই করি। হিটের কিছুক্ষণ পরই মূল প্রতিযোগিতা। যথারীতি আটজনের মধ্যে আমি সপ্তম বা অষ্টম হই, তবে দৌড়টা শেষ করি। আমার তেমন কোনো খারাপ লাগে না। তারপরও হেডস্যার এসে সান্ত্বনা দেন, ‘এটা কিছু না, অংক দৌড়-এ ফার্স্ট হলেই হবে।’ আমারও প্ল্যান আসলে ওইটাই।
কিন্তু অংক-দৌড় হবে সবার শেষে। দুপুর প্রায় দুইটা। প্রথমে হিট। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমিও তৈরী। খাতা আছে। হার্ড কাভারের, বসে হাঁটুতে রেখে লিখতে সুবিধা হবে। কলম আছে দুইটা। হেডস্যার আরেকটা দিলেন। কলমের সমস্যার জন্য যাতে কোনো ঝামেলা না হয়।
লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাঁশিতে ফুঁ পড়লো। আমি দৌড় দিলাম। আমার আগে আরো দুই তিনজন পৌঁছে গেছে। আমি ঘাবড়াই না। জানি অংকটা ঠিক করতে হবে। অংকটা কঠিন না। আমি পারছি। এর মধ্যেই একজন উঠে দৌড় দিল। তাজ্জব ব্যাপার! এর মধ্যেই হয়ে গেল! আমার আরো কিছুক্ষণ সময় লাগবে। আর কেউ না গেলেই হয়! আমার হাত কাঁপছে। অংকটা হয়ে আসছে। সময় লাগছে। কিন্তু হয়ে যাবে। হয়ে যাচ্ছে প্রায়। আর এই সময়ই যে ছেলেটা শেষ করে চলে গিয়েছিলো সে আবার দৌড়ে আসছে। আমার অংক করা শেষ। আমি জানি আমার অংকটা ঠিক হয়েছে। এইবার উঠে দৌড় দিই। আমার আগে আর কেউ পৌঁছতে পারে নাই। আমার খাতা জমা দিয়ে দিই। আমার মুখে তৃপ্তির হাসি। এতক্ষণে আরো একজন দুইজন আসতে শুরু করেছে। সেই ছেলেটাও আসছে। অংক চেক করার পর দেখা গেলো অংক ঠিক হয়েছে। তার মানে আমিই র্ফাস্ট। তা তো আমি হবোই! এখন শুধু ফাইনালটা বাকি!!
ফাইনাল অংক-দৌড়, কিছুক্ষণ পর। পানি পিপাসা লাগছে। হেডস্যার বললো, বেশি পানি না খেতে। অল্প একটু খেলাম। তারপর লাইন গিয়ে দাঁড়ালাম। এখন প্রতিযোগী অনেক কম। যে ছেলেটা গতবার আগে দৌড় দিয়েছিল, এবার সে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খেয়াল করলাম। কিন্তু পাত্তা দিলাম না। আবারও সব কিছু তৈরী। র্বাঁশিতে ফুঁ পড়লো। দৌড় দিলাম। এবারও দুই তিনজনের পরই, অংকের কাছে পৌঁছলাম। কিন্তু আমলে নিলাম না, দৌড়বিদরা সব অংক করতে পারলেই হইতো! এবার অংকটা আগেরটার মতোই। একটু তাড়াতাড়ি করার চেষ্ট করলাম। আমার অংকটা শেষ হয়ে আসছে। শেষ করলাম। একটু চেক করতে করতে উঠে দাড়াচ্ছি, এমন সময় আমার পাশ থেকে সেই ছেলেটা দৌড় দিল। আমিও দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু তার থেকে একটু পিছনে। আমি বুঝতে পারলাম, কী ঘটেছে। কেন আমি এবারও সেকেন্ড হবো। ফার্স্ট হবো না এইবার আর। আমরা দুইজনই পৌঁছেছি, অংক শেষ করে। ওরটা আগে চেক হচ্ছে। আমি আমার খাতা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এরপর আমারটা চেক হবে। যদি ওর অংকটা এবারও ভুল হয়! কিন্তু সেটা যে হবে না তাও আমি বুঝতে পারছি। ছেলেটা আমার মতোই বা হয়তো আমার চেয়েও ভালো। প্রথমবার ও বেশি তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করেছিলো। দ্বিতীয়বার সে সেটাকে শুধরে নিয়েছে। স্পীড-এর স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে আমাকে বেছে নিয়েছে। আমি অংক শেষ না করা পর্যন্ত সে সময় নিয়ে তার অংকটা চেক করেছে। আর আমি ওঠার আগেই সে দৌড়টা শুরু করে দিয়েছে। আসলে প্রতিটা খেলাতেই জিততে হলে যোগ্যতার পাশাপাশি কম্পিটিশন-এর মাত্রাটা বোঝাও জরুরী। অংক চেক করার পর রেজাল্ট ঘোষণা করা হলো। ছেলেটা ফার্স্ট হয়েছে। আর আমি আবারও সেকেন্ড। তবে উপজেলার প্রতিযোগিতায় প্রথম দুইজন যাবে। তাই আরেকটা চান্স থাকলো।
সপ্তাহ খানেক পরে, উপজেলার প্রতিযোগিতা। তবে ওইখানে ইউনিয়ন পর্যায়ের স্কুলগুলি থেকে ছাত্ররা আসবে। যাদের অংক পরীক্ষায় পাশ করতেই জান বেরিয়ে যায়, তারা আবার অংক-দৌড় করবে! তাই ফার্স্ট-সেকেন্ড যা হওয়ার তা পৌরসভার থেকেই হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ের খেলাগুলিতে নাকি অংক-দৌড়ের প্লেয়ারই খুঁজে পাওয়া যায় নাই। একটা ইউনিয়নে নাকি এই খেলাটা বাদই গেছে প্রতিযোগী না পাওয়ার কারণে। তাই ঐ ছেলেটাই আমার মেইন কম্পিটিটর। মানে ফার্স্ট-সেকেন্ড যেহেতু আমাদের মধ্যে থেকেই হবে, এইবার সেকেন্ড থেকে ফার্স্ট হওয়ার গোল্ডেন চান্স সামনে। হেডস্যারও তার রুমে ডেকে নিয়ে আমাকে একদিন এই বিষয়ে বললেন। বললেন যে, ‘ঐ ছেলেটা চালাক আছে। তোর ধারে কাছে ঘেঁষতে দিবি না, উপজেলার খেলায়। তোকে দেখে দেখে ও ফার্স্ট হয়ে গেছে। সাবধান, এই ভুল আর পরে করবি না।’ আমিও বুঝতে পারলাম। ঠিক আছে। দেখা যাবে। ওর তো যোগ্যতা মনে হয় আমার চাইতে একটু কমই। কারণ ও প্রথমবার অংক ভুল করেছে। আমি তা করি নাই। তার মানে ওর ঝোঁকটা ফার্স্ট হওয়ার ব্যাপারে। ও ফার্স্ট হতে চায়, যে করেই হোক, এর জন্য ও ভুলও করতে পারে। কিন্তু আমার এটা করার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ আমি জানি, অংকটাও ঠিক করতে হবে, ফার্স্ট হতে হলে।
উপজেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতাটা হবে স্টেডিয়াম মাঠে। আমাদের স্কুল থেকে বেশ একটু দূরে। অনেক বড় মাঠ। কোরবানির ঈদে গরুর হাট বসে ঐ মাঠে। আমি সকালে স্কুলে যাবো। স্কুল থেকে হেডস্যারের সাথে স্টেডিয়ামে যাবো। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আব্বা পাঁচ টাকা দিলেন। বিশাল ব্যাপার। তখন প্রতিদিন আমি আব্বার কাছ থেকে আটআনা (৫০ পয়সা) করে পেতাম। ৫০ পয়সা একটু কম হলেও চলে, ২৫ পয়সা দামের দুইটি আইসক্রীম খাওয়া যায় বা পাঁচটা ঝাল আলু ১০ পয়সা করে এক একটা বা পঁচিশ পয়সা করে বড়ই বা জলপাই-এর আচার ইত্যাদি। মানে বেশি খাওয়া যায় না, কিন্তু চলে। আব্বা এই পাঁচ টাকা দেয়ার পর তার ব্যাখ্যা দিলেন। স্টেডিয়াম যেতে আসতে দুই টাকা করে লাগবে, চার টাকা। আর প্রতিযোগিতা শেষ হতে দুপুরের পরও হতে পারে। তাই টিফিনের জন্য এক টাকা। তারপরও পাঁচ টাকা। বিশাল ব্যাপার। আমি খুশীতে রওনা দিই।
স্টেডিয়ামে ঢুকে দেখি হাজার হাজার মানুষ। স্টেডিয়াম থই থই করছে। ঢোকার মুখে জিলাপীর দোকান। এক কোনায় চা বানাচ্ছে। আর ঢুকেই বাঁ দিকের কোণায় পুরি ভাজছে। হোটেলে গেলে বড়রা মিষ্টি বা জিলাপী খাওয়ায়, কিন্তু পুরি খাওয়ায় না। আমি প্ল্যান করলাম আজকে যে করেই হোক পুরি খেয়ে যাবো। আমি হেডস্যারের পিছন পিছন ডানদিকের এক জায়গায় চলে গেলাম। স্যার একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন, এখান থেকে নড়বি না। অংক-দৌড় শুরু হলে আমি এসে নিয়ে যাবো। আর মাইকে ঘোষণা করবে অংক দৌড়-এর কথা। আমি বসে রইলাম। পুরির কথা চিন্তা করলাম। এত এত মানুষ। আমি দেখতেই লাগলাম।
একসময় ঘোষণা হলো একটু পরেই অংক-দৌড় শুরু হবে। যে যে স্কুলের স্যারেরা তাদের প্রতিযোগীদের নিয়ে তৈরি হলেন। যেখান থেকে দৌড়টা শুরু হবে সেখানে যাচ্ছি, হেডস্যারের সাথে। এখানে হিট নাই। একটাই দৌড়। ওইটাই ফাইনাল। গিয়ে দেখি ওই ছেলেটা এসেছে। সে আমার কাছে এসে বললো, পৌরসভা থেকেই ফার্স্ট সেকেন্ড হতে হবে। আমরাই ফার্স্ট সেকেন্ড হবো। আর তুমি তো ভালোই পারো। কোনো সমস্যা হবে না। আমি বললাম, ঠিক আছে। দেখা যাক না। আমি ওর কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে আরো দুইজনের পরে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাঁশি ফুঁ দিবে। আমিও তৈরী। এইবার আমি ফার্স্ট হবোই। এছাড়া আর কোনো উপায়ই নাই। দৌড় শুরু হলো। এইবার দূরত্বটা অনেক বেশি। অনেক দূরে বোর্ডটা। আমি কয়েকজনের পরে গিয়ে পৌঁছলাম বোর্ডের কাছে। সমস্যা নাই। দৌড়টা মেইন না। অংকটা ঠিকমতো করতে হবে। কিন্তু এ কী! এ তো বিশাল একটা সরল অংক। অনেকগুলি যোগবিয়োগপুরণভাগ। এইটা করতে তো অনেক সময় লাগবে। সময় পার হচ্ছেও। কেউই দৌড় দিচ্ছে না। সবাই অংক করছে। আমার ভয় হচ্ছে অংকটা শেষ পর্যন্ত করতে পারবো তো। ভুল করছি না তো। আবার নতুন করে শুরু করবো নাকি। এই সময় একজন দৌড় দিল। আমি পাত্তা দিলাম না। অংকটা আগে মিলাই। তারপর আরেকজন দৌড় দিল। তারপর সেই ছেলেটা। আমার অংক এখনো শেষই হয়নি। আরো কিছু সময় লাগবে। আরেকটু বাকি। চিৎকার শুনে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি হেডস্যার চিল্লাচ্ছে, দৌড় দে, দৌড়াইতে দৌড়াইতে শেষ কর। আমারও শেষ হয়ে আসছে অংকটা। হয় নাই মনে হয়। তারপরও দৌড় দিলাম। সাত আটজনের পরে গিয়া দাঁড়াইলাম। একজন একজন করে চেক করা হচ্ছে। প্রথম দুইজনের অংক ভুল। ওই ছেলেটার চেক হচ্ছে। হেডস্যার আমার পাশে এসে অংকটা দেখার চেষ্টা করলেন। আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, হয়েছে কিনা। স্যার কিছু বলার আগেই আমার খাতা চেকের জন্যে চলে গেলো। এই পর্যন্ত কারোরটাই হয় নাই। আমারটাও ভুল হলো। আমার পিছনে আরো অনেকে। সবারটাই ভুল। এখন স্যারদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হলো। কে এই অংকটা দিছে? অংকটা ঠিক আছে কিনা, ইত্যাদি…।
হেডস্যার আমাকে এসে বললেন, আগের জায়গাটায় গিয়ে বসতে। প্রতিযোগিতা হয়তো আবার হবে, তখন ডাক দিবেন। বাসায় যাতে না চলে যাই।
আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়ে বসে পড়লাম। এবারের দৌড়ের জায়গাটা অনেক বড়। পানি পিপাসা লাগছে। প্রচণ্ড রোদ। গরম। ঘামছি বসে বসে। কখন যে ডাকবে আবার। বসা থেকে উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। চারপাশে আরো কত মানুষ। কাউকেই চিনি না। আধঘণ্টা। একঘণ্টা। দুইঘণ্টাও হয়ে যাচ্ছে হয়তো। এইবার হাঁটার সীমানাটা আরেকটু বাড়াইলাম। হঠাৎ মনে পড়লো। আরে! পুরি খেয়ে আসি না কেন! পকেটে তো পাঁচ টাকাই রয়ে গেছে। আমি খুঁজতে খুঁজতে বাম দিকে থেকে ডানদিকে যেতে লাগলাম। মানুষের ভিড়ে হাঁটাও মুশকিল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখলাম ভিড়ের শেষ মাথায় পুরির দোকান। প্রচণ্ড রোদে কেরোসিনের চুলাটা চলছে। আশপাশটা নরকের মতো প্রায়। চুলার কড়াইয়ে গরম তেল। এখন সিঙ্গাড়া ভাজা চলছে। পাশে টিনের থালায় বিশাল সাইজের বড় বড় পুরি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম দাম কত। দোকানি বললো এক টাকা। আমি দুইটা কিনলাম। কাগজের ভিতর ভরে দোকানি আমার হাতে দিলো। পুরিগুলি খুব একটা গরম না। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডাই। বেশ কিছুক্ষণ আগে ভাজা হয়েছে। তারপরও পুরি তো খাচ্ছি। আমার বেশ ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে আমি বড় হয়ে উঠছি। হাঁটতে হাঁটতে পুরি খাচ্ছি। আমার বহুদিনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। অংক-দৌড়টা তো আর হলো না। অন্তঃত পুরি খাওয়াটা হলো। আমি খেতে খেতে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছি।
এমনসময় হঠাৎ শুনি মাইকে করে আমার নাম ডাকা হচ্ছে। কী ব্যাপার? আমি আমার আগের জায়গাটায় যাওয়ার চেষ্টা করলাম। হাঁটতে থাকলাম আরো দ্রুত। দৌড়াচ্ছি রীতিমতো। মানুষের ভিড়ে পারছি না যেতে। এবার দৌড়ই দিলাম। দৌড়তে দৌড়তে যখন আমার আগের বসে থাকার জায়গাটাতে এলাম তখনও দেখি আরো দূরে সামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়ে হেডস্যার আমার নাম ধরে বলছেন, তুমি যেখানেই থাকো না কেন, এই মুহূর্তে এখানে চলে এসো। আর আমার সামনে, আরো দূরে প্রতিযোগিরা বসে অংক করছে। আমি বুঝতে পারছি, এখন আর যাওয়ার কোনো মানে হয় নাই। আমি আর প্রতিযোগিতার ভিতর নাই। প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। শেষও হয়ে যাবে একসময়। আমি আর এর ভিতরে নাই। প্রতিযোগিতার বাইরে ছিটকে গেছি আমি! এই প্রতিযোগিতাতে আমি আর প্রতিযোগী নই! আমি পুরি খাওয়ার জন্যে চলে যাওয়ার সময় দৌড় শুরু হয়ে গেছে। আর আমি মাইকে কথা শুনে দ্রুত দৌড়ে আসতে গিয়ে আমার অর্ধেক খাওয়া পুরিটা কোথাও ফেলে দিয়ে এসেছি। আমি আস্তে আস্তে ক্লান্ত হয়ে হেড স্যারের দিকে গেলাম। ততক্ষণে প্রতিযোগিরা অংক শেষ করে দৌড় দিয়েছে। পৌঁছে গেছে শেষ মাথায়। আর আমি হেডস্যারের সামনে। স্যার আমার দিকে তাকাতেও পারছেন না। বললেন শুধু, ‘এত বড় বেকুবিটা করলি!’ তারপর গিয়ে একে ওকে ধরার চেষ্টা করলেন। আবার কিছু করা যায় কিনা। দুপুর তিনটা প্রায় তখন। কাউকেই আর রাজি করাতে পারলেন না তিনি। আমাকে বললেন, যা বাসায় চলে যা। কালকে স্কুলে দেখা করিস। আমি প্রতিযোগীদের পাশ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে চলে যাচ্ছি। ঐ ছেলেটা এবারও ফার্স্ট হয়েছে। ফার্স্ট হওয়াটা তো খারাপ কিছু না। ভালোই হয়তো। আমার কিছু চিন্তা করতেও ভালো লাগছে না। এতো খারাপ লাগছে। বারাবার ভাবতে লাগলাম, কেন আমি পুরি খেতে গিয়েছিলাম। ওইটাই সব নষ্টের কারণ। আমি আর জীবনেও পুরি খাবো না।
অবশ্য এই ঘটনায় বাসায় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। মানে একদম কিছুই না। প্রতিযোগিতার ভিতর এইরকমটা যেন ঘটতেই পারে। কিন্তু আমিই মানতে পারছিলাম না। আমি আর কোনোদিনই পুরি খাবো না। এইটাই ভাবতে লাগলাম শুধু।
পরের দিন বেশ আগে আগে স্কুলে চলে গেলাম। আমাদের ক্লাসরুমে গিয়ে বসে থাকলাম। হেডস্যারের রুমের সামনে দিয়ে একটু হেঁটে আসলাম। দেখলাম স্যার খুব চিন্তামগ্নভাবে বসে আছেন। আমি তার রুমে ঢুকলাম না। আবার ক্লাসরুমে গিয়ে বসলাম। একটু পরে দপ্তরি এসে বললো, ‘হেডস্যার আপনারে ডাকতাছে।’ আমি খুব খুব আস্তে আস্তে হেঁটে স্যারের রুমে গেলাম। স্যারের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার চেয়ার থেকে উঠে বললেন, ‘এইটা তুই একটা কাজ করলি! একটা নিশ্চিত প্রাইজ তুই নষ্ট করে দিলি!’ আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যারের দিকে তাকানোর সাহসও হচ্ছে না। আমি জানি এইসবই সত্যি। শালা কেন যে আমি পুরি খেতে গেলাম! ‘বেয়াদব কোথাকার!’ বলে হেডস্যার বিশাল এক চড় দিলেন আমার গালে। অপমানে না, ব্যথায় আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসলো। কিছুক্ষণ পর শুনি স্যার বলছেন, ‘যা এখন।’ আমি চলে আসলাম, ক্লাসরুমে। আমার চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়ছে। একটা মেয়ে চলে আসছে। শে বিস্ময়াভূত হয়ে জজ্ঞেস করলো, ‘হেডস্যার তোমারে চড় দিছে!’ আমি ভাবলাম ঠিকই আছে। শালা, তুমি গেছো পুরি খাইতে!
সারাদিন স্কুলে এইটাই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলো যে স্কুলের সেরা ছাত্র হেডস্যারের চড় খাইছে। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে টিচারস রুম পর্যন্ত। বেশিরভাগেরই মতে, ঘটনা যা-ই হোক স্যারের চড় দেয়াটা ঠিক হয় নাই, ওর তো আর দোষ নাই, এইরকমটা হইতেই পারে। একজন আপা তো ডেকে নিয়ে একটু সান্ত্বনাও দিয়ে দিলেন, মন খারাপ করো না, এরকম হয়ই। আবার অনেকে বললেন, একজন স্যার তো একজন ছাত্রকে চড় দিতেই পারেন। স্যার তো আর এমনিতে রাগ করেন নাই। স্কুলের নিশ্চিত একটা প্রাইজ মিস হলো! এর পক্ষে ও বিপক্ষে এইরকম অনেক মতামত জড়ো হলো। বলা বাহুল্য আমি এই চড় দেয়ার পক্ষে ছিলাম। কারণ, শালা তুমি পুরি খাইতে যাও!
তবে যা-ই হোক। শেষ পর্যন্ত আমি আমার এই পণ-এ অটল থাকতে পারি নাই। এখনো রাস্তায় গরম পুরি দেখলে, কিনে নিয়ে খেতে খেতে বাসায় যাই। ভ্যারিয়েশন বাড়ছে। ঢাকা শহরে এখন নানারকম পুরি পাওয়া যায়। এখনো আটআনার পুরি পাওয়া যায় মৌচাক মার্কেটে। পাঁচ টাকার বিশাল কিমা পুরি পাওয়া যায় মিরপুরে। আলুপুরি কম পাওয়া যায়। বেশি পাওয়া যায়, ডালপুরি। তবে ভিতরে ডাল থাকে না। খালি ময়দার আটি। আর দুই টাকারটার চাইতে এক টাকারটাই ভালো। আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, পুরি আর খাবো না শালা। এইটা অপয়া। এর লোভ আমাকে প্রতিযোগিতা থেকে বের করে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও আমি পুরি খেয়েই চলি। ভাবি এই ঘটনার কথা। পরাজয়ের গ্লানির চাইতেও আরো রূঢ় সেই অভিজ্ঞতার কথা। আমার যাবতীয় অ-সাফল্য, না-পারা বেদনা যেন এই পুরি খাওয়ার দৃশ্যের ভিতর দিয়াই বাস্তবিক রূপ পায়।
এপ্রিল, ২০০৭
Leave a Reply