কায়েস আহমেদ যখন মৃত্যুর গল্প লিখতেন, তখন তার মনের অবস্থাটা কী রকম ছিল? মানে কী কারণে তখন তিনি চিন্তা করতেন এইরকম করে বা লিখতেন এইরকম করে। কী রকম করে লিখতেন তিনি, এই কথার উত্তর দিতে গেলে লাগবে তার গল্প থেকে উদ্ধৃতি, আক্ষরিক প্রমাণ। কেননা যেহেতু তিনি আত্মহত্যা করে মারা গেছেন, এর মানে তো এই নয় যে, তিনি কেবলমাত্র মৃত্যু নিয়াই ভাবছেন এবং লিখছেন। সুতরাং জরুরী, তার উদ্ধৃতি। আর এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে তার কোন গল্পের বই আমার কাছে নাই। হয়তো আর্কাভাইল টাইপের না আমি। নিশ্চয় অন্য কেউ কেউ সংগ্রহ করেছে বা পড়ছে তার গুমোট, দম-বন্ধ করা বনর্ণাগুলি, স্যাঁতস্যাঁতে প্রেক্ষাপটে কাহিনীর মোচড়া-মুচড়ি; আরে বাবা কী আর বলতে চাইছো তুমি; জীবন হঠকারী আর মৃত্যুটা সৎ! এইরকম ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট করে বলো না একটা কিছু! নাকি বলেছিলে?[pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]
আমি চিরায়ত সাহিত্যের ভিতর গুমটি মেরে বসে থাকা উইপোকা; বই খেতে খেতে অন্ধ; কী যেন বলেছিলে তুমি এইরকম ভাব করে মনে করার চেষ্টা করি। আসলে তো ভুলে আছি সমস্তই। দেখছো, কনফেস করতে শুরু করছি। মানে, দৃশ্যের যে বনর্ণারূপ তার ভিতরই আটকে পড়ে থাকা তোমার ব্যক্তি অনুভূতি। আর যে কাহিনীর আড়াল তাতে লুকানো তোমার সত্তা। কত যে চেষ্টা তবু পারছে না লুকাতে, পারছে না প্রকাশিত হতে।
আমিও পছন্দ করি মৃত্যু, বিশেষ করে যখন সে ঘাপটি মেরে বসে আছে, তোমার ঘাড়ের উপর ফেলছে তার গরম নিঃশ্বাস, কেবলই আরো একটা সম্ভাবনা; বিন্যাস, ছড়ানো পথের উপর, এইরকম একটা পরিস্থিতি। আর এই সম্ভাবনা ঘনীভুত হয়ে উঠেছিলো কেন তার অপশনগুলির মধ্যে; কী করে সে হয়ে উঠলো একক? একমাত্র অল্টারনেটিভ?
কায়েস আহমেদের বইগুলি কী প্রকাশ করেছিলেন মফিদুল হক? নাকি মাওলা? কী রকম বন্ধু ছিলেন তারা? অথবা তার অনান্য বন্ধু-বান্ধব? তারা নিশ্চয় কোন স্মৃতি পাঠাগার বানিয়েছেন? ইলিয়াসকে যখন সাজিয়ে রাখেন পটে, শেলফের উচ্চতর তাকে, হাসানকে দেন পুরস্কার, মাহমুদুলকেও ভুলে যেতে গিয়ে, যেতে দিয়ে, হারাইয়া ফেলেন না আর। হক ভাই তো জিন্দাবাদ; তাহলে কায়েস কেন এক কোনায়, একটা সাবজেক্ট নিয়া ক্রমশঃ দূরগামী, রামপুরা রোডের কাঠবডি বাসের মতোন, মেট্টো থেকে হারিয়ে, বি.বাড়িয়া-দেবীদ্বার রোডের অনিয়িমত ক্লায়কেশের বেঁচে থাকা সেই পাঁচ বছর আগে; এখনো আছেন নাকি, এই প্রশ্নবোধকতার ভিতর চাপা পড়ে আছেন কি নেই এই ভাবনার ভিতর, হয়রান আমার মন।
খুঁজলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে তার বই। কায়েস আহমেদ সমগ্র। শাহবাগে না হলে নিউ মার্কেটে হয়তো। কেননা ষাটের দশককে নিউ মার্কেট হয়তো এখনো ভুলতে পারে নাই। কিন্তু এই গুলশানে কিংবা ধানমণ্ডি, কিংবা ডিওএইচএস? যেখানে বাংলা-সাহিত্য প্রতিদিন গড়াগড়ি খাচ্ছে বলে ভাবছি আমি? যেহেতু আমি বাড্ডায় থাকি। আর যারা থাকেন ইউনিভার্সিটির শান্ত নিরব কোয়ার্টারে, জ্ঞান-চর্চার নিবিড় পরিবেশে কিংবা নিকুঞ্জে, উত্তরায় যাদের বসবাস, তারা কী করে কায়েস আহমেদের খোঁজ করবে? চিটাগাং-এ? রাজশাহী থেকে? কিংবা নেটে? তাকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? যাবে নিশ্চয়। কী বলেন, কায়েস আহমেদ, এই রাত্তিরে আপনি যখন একটি পার্শ্বরূপ হয়ে জেগে উঠতে চাইছেন, আমার সত্তার ভিতরে; আপনি নিশ্চয় পথ দেখাবেন। মানে, আপনি কি চান পুনারাবিষ্কৃত হতে? হতে দেবে তা সাহিত্য-সমাজ? ঘটা করে আপনার জন্ম-মৃত্যু দিনে কি ক্রোড়পত্র বের হবে, মিনিমাম ‘স্মরণ’ শিরোনামে বন্ধুকৃত্য; কতো ভালো ছিলি রে ওরে ময়না-টিয়া; লোল পড়ছে মুখ বেয়ে; কবর থেকে উঠে আসবে তুমি, তোমাতে ভর করে দিয়ে দেয়া যাবে আরো অনেক ডেথ সার্টিফিকেট…আরো কতো বাল-ছাল ছিলো না, ওদেরকেও নিয়া আসো…এইরকম কথাও কিন্তু বলবে লোকে…হুমম…
সুতরাং তুমি মারা গেছো। তুমি বিগত। এই কথা জানলো এখন পাঠক। বলদ লেখক হৈতে বিলাই পাঠকই উত্তম।
শুরু হোক তবে গালাগালি! কিন্তু কায়েস আহমেদ ছিলেন মধ্যবিত্ত রুচির অধিকারী। টান টান ছিল তার গদ্য। দৃশ্যকল্পের ঘন বুনোট। ফাঁসির দড়ির মতোই শক্ত ও ভার বহনে সক্ষম বস্তুর, অর্থাৎ মানুষের। মানুষ একটি সাবজেক্ট এবং তাকে অতিক্রম করে যেতে হবে। ক্রমাগত অতিক্রম করতে করতে, হোঁচট খেতে খেতে, নিটশে পড়তে পড়তে, কাম্যুতে ডিগবাজি দিতে দিতে, সার্ত্রকে আটকাতে আটকাতে, কুন্ডেরাকে কাণ্ডারি ভাবতে ভাবতেই কি আর কায়েস আহমেদ মার্কসকে আপন দাদা বলে ভাবতে পারেন নাই। স্রোতহীন জীবনের ভিতর যে লাশ পড়ে আছে, তার পা আর চলতে চায় না বলেই কি একাকীত্ব, দহন? বাসে চড়ার টিকিটটার মতোন উড়ে গেলো হায়, এই তো জীবন বলে ফুঁ করে সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়া যাই নাই বলে…ক্রমাগত অর্থ, প্রগমন; অর্থাৎ কিনা যেই সম্ভাবনাগুলির ভিতর এখনো আমার যাতায়াত শুরু হয় নাই, তুমি আসছো নিয়ে যেতে…দেখো, এই সেই পথ, তুমি দাঁড়িয়েছিলে আর আজ আমিও ভাবছি, যা কিছু অসম্পূর্ণ, তার নামই সত্য। সম্পূর্ণতাই মিথ্যা। স্থিরতা মানেই অনিদ্রা। নিদ্রার প্রবহমান জীবন। জীবন মানেই উইয়ের ঢিবি। মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা।
এত যে হল্লা-চিল্লা। দিন শেষে নিক্তি দিয়া মাপা জীবন। বলো হে উমাচরণ, এইটা কী? কোন গোল্লায় যাবে এই বোকাচোদা, কাঁদতে কাঁদতে গরুর মতোন। বেঁচে থাকা ছিল কি এইরকমই এক বিভীষিকা? মূল-উৎপাটিত, না-বোঝা, শেকলের জন্য কান্না, পরাও হে দড়ি, আমারে নিয়া চলো, জীবিকার কাছে…সারা দিন প্রাণপাত করি…অন্ন জোটে কি জোটে না…তারপর মুচি ছেঁড়া জুতা পায়ে ঢুকে পড়ি অন্দরমহলে…আসে না কোন কথা…কেবল অবলোকন করি…কী যে লীলা এই জগতদাত্রীর…মহামহিমের চিতায় বসে জ্বালাই আগুন…শালার জীবন একটা, তাও তো পোড়ে না অথবা শীতল, প্রাত্যহিক জীবন-বাসনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হচ্ছে যে বীজাণু, তার নকশাই কেবল ভাসছে চোখে…আসলে তুমি কী বলেছিলে কায়েস, তুমি কি সত্যিই মরতে চেয়েছিলে?
মৃত্যু-চিন্তা কিংবা মরণ এই শব্দসকল নিয়া ভাবতে ভাবতে মনে হইল, কায়েস আহমেদও ভাবতেছেন আমার সাথে সাথে, উস্কানি দিচ্ছেন, লেখো না…লেখো…লেখো…তারপর আমি দেখি তিনি কথা বলতে শুরু করলেন, অনেক অনেক কথা, মৃত্যুর কথা তিনি আর বলেন না, আর তিনি যা-ই বলেন না কেন আমি শুনি মৃত্যুর প্রতিধ্বনি। তার প্রতেকটা কথা একটা মৃত্যুর বীজাণু। তার প্রতেকটা দৃশ্যকল্প। প্রতেকটা শব্দ। এইরকম কেন যে হয়! এক একটা মানুষ, এক একটা শব্দ দিয়া ডিফাইন করা হয়। করা যায়। ডুপ্লিকেট তৈরি হয়। যমজ হয়। এ হয় ওর মতো। ও হয় এর মতো। জীবন হয় মৃত্যুর মতো। সবকিছুরই ব্যাখ্যা হয় রিলেটিভ টার্মে। জীবন মানেই তো মৃত্যু। মৃত্যু মানে কায়েস আহমেদ-এর গল্প। এই মুহূর্তে।
এইরকম একটা গরম লোডশেডিং এর রাতে। স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে। হারিকেনের আলোতে। ঝাপসা হয়ে ওঠা চোখে। বেদনা ও অনিদ্রায়। পরাজয় ও স্থবিরতায়। হঠকারী চিন্তাগুলির আড়ালে। কায়েস আহমেদ। তার অস্পষ্ট একটা ফটোগ্রাফ। উঁকি দিলো যেন। কোনো এক অন্ধকার থেকে। যার কোনো পরিচয় নাই। ম্লান একটা অবয়ব। অবোধ একটা চাহনী। যার সবই মুহূর্তের খেলা ও ফাঁকি। মারফতি।
বাঘের আক্রমণ থেকে রেহাই পেলো যে হরিণ মৌলবীর সহায়তায়, কিছুক্ষণ পর, শিকারীর তীর আবার বিধঁলো তাকেই।
নভেম্বর, ২০০৭
লেখাটা প্রচারিত হইছিল বিডিআর্টসে:
Leave a Reply