বইটা ছাপাইছিলাম ২০১০ এর বইমেলায়। সুমন ভাই (সুমন রহমান – কবি, কথাসাহিত্যিক ও জনসংস্কৃতির বিশ্লেষক) বাঙলায়ন-এর অস্ট্রিক আর্যুর সাথে যোগাযোগ করাইয়া দিছিলেন। বইয়ের কাভার করে দিছিলেন শিবু কুমার শীল। অস্ট্রিক আর্যু অল্প টাকা নিয়া বইটা ছাপাইয়া দিছিলেন। বইমেলায় উনার স্টলেও রাখছিলেন। ছাপানোর পরে আমারে ৫০/৬০ কপি দিছিলেন। বেশ কিছু বইয়ের ছাপা ঠিকমতো হয় নাই, ডাবল শেড চইলা আসছিলো। যা-ই হোক, বন্ধু-বান্ধবদেরকে দেয়া গেছিল বইটা; বলা গেছিল, একটা কবিতার বই ছাপাইছি আমি।
বইয়ের ফ্ল্যাপে ফেসবুকের নোটে করা ফ্রেন্ডদের (সুমন রহমান, জিফরান খালেদ, কাজল শাহনেওয়াজ, আবু আহসান মিশু, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, আমিনুল বারী শুভ্র, আবদুর রব, ভাস্কর আবেদীন) কমেন্ট ছাপাইয়া দিছিলাম। ফ্রেন্ড বইলাই হয়তো প্রেইজ করছিলেন উনারা। বা এমন তো হইতেই পারে, খালি ফ্রেন্ড বইলা না, এমনিতেও কবিতাগুলি আসলেই পছন্দ করছিলেন – এই বেনিফিট অফ ডাউটও তো থাকেই সবসময়। যেহেতু লিখছি, কেউ না কেউ পছন্দ তো করতেই পারেন।
কবিতাগুলি ২০০৬ থিকা ২০১০ এর মধ্যে লেখা। অনেকদিন না-লিখার পরে লিখতে শুরু করার সময়ের লেখা এইগুলি।
১৯৯৩ থিকা ১৯৯৯-এর শেষ বা ২০০০-এর শুরু পর্যন্ত প্রচুর লিখতাম আমি। তখন কাগজ কলমে লিখতাম। তারপরে ২০০৩-এ একটা কবিতা লিখি। তারপর মেইনলি ২০০৭-এ আবার লিখতে শুরু করি; কম্পিউটারে। তো, ২০১০-এ আইসা মনে হইলো কিছু কবিতা তো লেখা হইছে, একসাথে কইরা বই ছাপায়া ফেলি। বইয়ে ২৫টা কবিতা রাখা আছে।
এই বই আর কিনতে পাওয়া যায় না। আমার কাছেও একটাই কপি আছে। তো, গত ফেব্রুয়ারিতে বইটার ই-বুক আর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ বানানো হইছিল। কেউ ইন্টারেস্টেড হইলে পড়তে পারেন।
কবিতাগুলি পোস্টের সাথেও রাখা হইলো নিচে।
—————————————————————————–
মন তুমি করো মনোনিবেশ ।। গুরুর চরণ ।। এইখানে ।। গাধা ।। গরিমা ।। পা ও পাজামা ।। পরিস্থিতি ।। বনানী ১১ ।। সত্যবাদী ।। ভূতু-মন ।। যেন আমি ।। দুপুরের বারান্দা ।। বাতাসে উড়ছে তোমার চুল ।। শে ।। তোমার মুখের পানে চেয়ে ।। কবিতা-লেখা ।। নিরবতা ।। না-লিখা ।। দুই/চার লাইন ।। গ্রাম ও শহরের গল্প ।। সিন্ডিকেট কাহিনি ।। বন্ধুত্বের সময় ।। সকালবেলা ।। তারাগঞ্জ টু দিনাজপুর ।। অশ্বত্থ বটের কাছে এসে ।।
—————————————————————————–
মন তুমি করো মনোনিবেশ
যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসেছি,
পালিয়ে কৃষিকাজে করেছি মনোনিবেশ
কিছুদিন কেটে গেলো এই করে
ভাবছি পালানোর সময় এলো, আবারো
যুদ্ধ থেকে পালাবো
কৃষিকাজ থেকে পালাবো
সবকিছু থেকে সরায়া নিবো নিজেরে
আসলে নিজ বলে তো কিছু নাই
যুদ্ধ আর কৃষিকাজ পড়ে আছে।
গুরুর চরণ
গুরুমুখী বিদ্যা, গোঁয়ার্তুমি সকল
এলো নম্র পায়ে
কী করে তারে চিহ্নিত করি
বলি, এই যে অনুরণন, তা সঙ্গ-আশ্রিত
প্রতিক্রিয়া বিন্যাস
ছলচাতুরী
কাঁপাকাঁপা অভিজ্ঞান
তোমারো প্রাণেরো ধারা
আসলে তা পারিপার্শ্বিকতা
ঝুল ধরে বসে থাকা
প্রাচীন বটের
তার তলায় বসে
শিখাচ্ছেন গুরু, নিষ্ঠতা বাক্যের
আর আমি চিৎপটাং
সম্মুখে তার
বলে যাই শিখানো লিপি
হামাগুড়ি দিই
তড়পাই
তারপর ছেড়ে আসি তারে
গুরুর চরণ আমায় তো ছাড়ে না।
এইখানে
আমি ও অনন্তকাল পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি;
তার পিঠে বর্শার ফলা, উড়ন্ত জানালায়
মুগ্ধ লাল জবাফুল, টিনের গেট;
তার ওইপাশে দৈবের শব্দগুলি চলাচল করে,
সাবধান করে ছোট্ট শিশু আর মুর্গি-পাখিদের
আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি।
গাধা
গাধা দিয়া হইতেছে হালচাষ
চাষী বুড়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পরবর্তী এরিয়া
সময় বিকালবেলা।
তার পাশে
দৃশ্যের বোঝা টানতেছি
আমি আরেক গাধা।
মাটির উর্বরতায় গেঁথে যাচ্ছে মন
দিগন্তব্যাপী ফসলের মাঠ
দূরে দূরে একটি একটি মানুষ।
গাধা ঘুরছে চক্রাকারে
ছোট্ট জমি, আয়তকার;
তার চলাফেরায় চিরে যাচ্ছে
মাটি, মায়ের মতোন বসুন্ধরা।
গরিমা
একি গরিমায় পৃষ্ট বেঁধে দিলে!
পশ্চাতে যাই তার লাগি
দেখি, সে কি হেলে পড়ে কিনা
নুব্জ্যতায় স্থায়ী তার দেয়াল
উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে;
তার কাছে যাই, কারাগারে
সম্মিলিত হতে
আমাদের গরিমা সকল পদচ্ছাপে,
কথ্য-রীতি, ভাষার ভিতর
ফুলে-ফেঁপে উঠছে, বাঁকিয়ে
সরে সরে যাওয়ার আগে…
তাকে বেঁধে দেয়া হলো
ব্যাকুল পৃষ্টদেশে!
পা ও পাজামা
চিন্তা নাই, সকলই গড়িমসি
গড়াতে গড়াতে যাই
ফিরে আসি, টাল খেয়ে
ভাবি, নির্বাণ আরো কত দূর!
নিশ্চিন্তে পড়ে আছে পাজামা
পায়ের বাহির
অস্তিত্ব তার, দুলছে দড়িতে
পাজামা ছাড়া
পা দুইটাই আমার, স্পেয়ার হয়ে গেছে।
পরিস্থিতি
তোমার শরীর নরোম, এত্তোটুকু
নুয়ে আসে;
আগুনে ঘি ঢেলে বাড়তে দিই তাকে
আগুন পোহাই
আমি দূরত্বে নতজানু
অলস, বিভ্রান্ত।
বনানী ১১
একজন সোনম কাপুর বসে আছে
ঠোঁট বাকাচ্ছে, চুলে হাত দিচ্ছে …
পিজাতে কামড় দিয়া ঘোরাচ্ছে চোখ
ডানা ভেঙ্গে, খোঁড়াচ্ছে পা
দিল্লী 6 দেখতেছি
কফি ওয়ার্ল্ড, বনানী ১১’তে বইসা
সত্যবাদী
যে বাক্যে তোমার অধিষ্ঠান
যে বাক্যে আমি মরে ভূত
কেবল তুমি আছ, মানব-প্রেমিক
আমি গ্রুপ-পলিটিক্সের শিকার,
আইডেনটিটিবিহীন আমার বাক্য
আমি তো মরে ভূত, কি আর বাক্য
যেহেতু কে আর আমি
ভুতু–মন
যে কল্পনাগুলি মৃত, যারা ভূত হয়ে গেছে
আর মানুষ-জন্ম পাবে না বলে যাদের
হাহাকার নাই। ভূত-জন্মে স্থিত
মেনে নিছে ভাগ্যলিপি
পতন ও বিহ্বলতা তাদের
আর উৎকণ্ঠিত না – তেমনই
স্থির হয়ে যেতে চায় মন।
পূর্বস্থিত বেদনা যেন অপহৃত হয়েছে
এমনই সুস্থিতি চেয়ে
মৌন; চাইছে এই প্রণতিটুকু
পার্শ্ব-চরিত্রের।
যেন প্রতিসরণে বেঁকে গেলে বাক্য
তার অবলোকনে
আর হয়রানি না হয়।
তার উপরে, মাছ-গন্ধের লোভে
জৈষ্ঠ্যের রাত্তিরে
যদি জেগে থাকে কেউ
নিরাপদে তার ঘাড়ও মটকাতে
পারবে সে, কৌশলে।
এই নিশ্চিতিটুকু উপরি পাওনার মতো
সুগন্ধি ছড়ায়।
ভূত-জন্মে আগ্রহী মন
আজ পুলকিত, এই ভেবে।
হা রে রে রে রে
ভুতুম ভুতুম মনরে আমার
ভূত হতে যে চায় রে
যেন আমি
আমার পালানোর পথে তুমি কাঁটা বিছায়ে রাখো
প্রতিদিন পালিয়ে যাওয়ার কথা মনে আসলেই
যেন সেই কাঁটাগুলির কথা ভাবি,
আমার পা রক্তাক্ত হয়া ওঠে
ভাবনা আর আগায় না …
তোমার ভাবনার কথাগুলি যেন আমি কাঁটা দিয়া তুলে ফেলি।
দুপুরের বারান্দা
মনে হলো এক্ষুণি হলুদ স্কার্ট পড়ে বারান্দায় আসবে তুমি;
টবে ফুটে থাকা ফুলগুলি উপেক্ষা করে
হবে উদাস; এমন-ই দুপুরবেলা বইবে বাতাস
কি যেন নাই, কেন যেন নাই …
এইরকম ভাবনায়, না-থাকাটাই পড়ে আছে, বারান্দা জুড়ে
আমি ভাবছি, হলুদ স্কার্ট পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো তুমি!
রিকশা করে যাচ্ছে মা ও মেয়ে
একটা খালি রিকশা, তারপর
ঘণ্টা বাজাচ্ছে, কে যাবে, কে যাবে …
ত্রস্ত শূন্যতা বসে নড়েচড়ে
আইসক্রীম-ওয়ালাও …
চলে যাচ্ছে গাড়িগুলা
কে যাবে, কে যাবে …
মন্থর মন আমার দুপুরের রোদে
চা-এর দোকানের ছোট্ট ছেলেটাকে দেখে;
নিরব বারান্দার নিচে কথা বলে যাচ্ছে যারা
টেনে নিয়ে গেলো তারা আমাকে তাদের দলে
কথায় কথায় আমি ফেলে যাই তাকে,
কথার শূন্যতায় … হলুদ স্কার্ট-পড়া একটা মেয়ে
বারান্দায় জড়োসড়ো দাঁড়িয়েই থাকে …
বাতাসে উড়ছে তোমার চুল
বাতাস এসে লুকালো তোমার চুলে
সারি সারি গাছেদের কাছ থেকে তারা
নিয়ে এসেছিলো অজস্র কথা
তাদের অব্যক্ততার ভার ঘুর্ণায়নমান প্রপেলার হয়ে
উড়াউড়ি করে অরণ্যের গোলকধাঁধার মতো তোমার চুলে
একে অন্যের গায়ে লেপ্টালেপ্টি করে, আবার বিশ্লিষ্ট হয়ে
তারা ভুলে যাচ্ছে সে গোপন-বার্তা
খেই হারালো, দিগভ্রান্ত; ক্রমশ একলা
স্তম্ভিত, হতবিহ্বল; কী কথা, ওগো চুল, কী কথা?
শে
বসে বসে সময় গুনি
কখন যে বেরিয়ে গেছো তুমি
কখন যে চাপা পায়ে
শব্দ না করে, না-তাকিয়ে
অথবা না-তাকানোর চে’ আরো বেশি উপেক্ষা
আরো বেশি অভিমান …
কখন যে চাপা পড়ে, গেছে হারিয়ে
যে সর্বনাম-প্রিয়
শে
তোমার মুখের পানে চেয়ে
যদি লিখতাম একটা কবিতা
তোমার মুখের পানে চেয়ে;
তোমার মুখ থেকে যেই হাসি ঝরে গেছে
তার স্মৃতি মনে করে…
যদি এই রাতটাই আটকে যেত
সময়ের গলি-ঘুপচিতে ঢুকে
বসে থাকতাম, নিরুপায়
যেন কিছুই করার নাই
দুঃখ-র্দুদশা নাই
চুপ করে থাকা,
হাত-পা বাঁধা দিনগুলির মতোন
কি আর করি তখন!
তোমার মুখের পানে চেয়ে
তোমার মুখ থেকে যেই হাসি ঝরে গেছে
তার স্মৃতি মনে করে
লিখি আমি একটা কবিতা-ই, নাহয়।
কবিতা–লেখা
আসলে মাঝে মাঝে কিছু রাত আসে, আসে দিন-যাপন; মনে হয় সবটাই কবিতার। যে কোন কিছু লেখা সম্ভব। আর যা কিছু ভাবছি, তার সবটাই কবিতা। এক রাতে একটা কবিতার বই লিখে শেষ করে উঠার মতো বিষয়। এত যে কবিতা, লিখে শেষ করা যায় না। হতচকিত, একটার পর একটা, ভাসছে দুর্দমনীয় ভাবনাগুলি, আকাঙ্খার; কাকে-ই বা আটকাই; বলি, একটু দাঁড়াও! দুইহাত দিয়ে যা পাই, তার সবটাই নিতে চাই। বলি; সময়, ডাইনী বুড়ি, তুই একটু দাঁড়া। রাতগুলি দীর্ঘ হয়ে ওঠে, দিনের ক্লান্তিগুলিও ম্লান হয়ে আসতে থাকে। কী যে বিহ্বলতায়, মুহূর্তগুলি কেঁপে কেঁপে ওঠে, মোহগ্রস্থতায়, স্থাণুর মতো বসে থেকে থেকে। তবু সে কি আসে? হৃদয়হরণ, চপলচরণ, অন্য কারো প্রেমিকার মতোন; হেসে হেসে প্রতিচ্ছায়া ফেলে যায়; বলে, আসছিলাম তো!
এই শুনে মূঢ় প্রেমিকের মতোই হতবিহ্বল, ভাবি; তাহলে কে সত্যি, আমি, প্রেম না কবিতা?
নিরবতা
সবকিছুই যে লিখতে হবে এইরকম কোন কিছু মনে হয় না, মাঝে মাঝে মনে হয় দিনগুলি বিস্মৃতির, অস্তিত্বগুলি অসংলগ্ন, পাঠগুলি মৌন, নিরবতাগুলি জরুরি ও অভিব্যক্তিময়; জরুরি যে কথাগুলি, তা হচ্ছে, নিরবতা… শব্দগুলি, অস্তিত্বগুলি, বর্ণনাগুলি এতোটাই অসম্পূর্ণ যে প্রকাশমাত্রই তা বিহ্বল… এইরকম নিরবতার ঘোরটোপে আটকে পড়ে আছে দিন, তার বাগবিধি ও প্রকরণ ভাষার দৃশ্যমান প্রকোষ্ঠে, শব্দের অর্থবোধকতার পাশে… মসৃণ, পেলব হয়ে থাকে… এইভাবে ভাষার ভিতরে নিরবতাগুলি জরুরি… জরুরি নিরবতাগুলির ভাষা হয়ে ওঠাটাও… কথার মাঝখানে বিরতিগুলি… শ্বাস নেয়ার অভিঘাতগুলি… ক্রোধে বিস্ফোরিত হওয়ার আগে সঞ্চিত শক্তিগুলি… অন্তিম উচ্চারণের আগে কেঁপে ওঠার ভিতর স্থবিরতাগুলি… কথা বলতে বলতে ডুবে যাবার ভিতর আরো কথা খুঁজে নেবার অভিযাত্রাগুলি… মৌন, নিরবতার ক্লেদ নিয়ে শুধুই নিরব, নিরবতাগুলি… উচ্চারণের পূর্ব-মুহূর্তগুলি… যেন এখনই কথা বলে ওঠতে চাইছে… আর কথাগুলিও বলছে, নিরবতা… দ্রুত ও অভিঘাতময় নিরবতার শব্দগুলি আছড়ে পড়ছে… ছন্দ-আকুল তার একটি… কর্কশ বেয়াদবি… মিহি মিছরির ছুরি… গোপন মলম… প্রলেপ বন্ধুত্বের… আশ্বাস ও সাত্বনাবাণী… হুশিয়ারি… আর বলো না কোন কথা তুমি… নিরবতার ঘর বাড়ি ডুবে যাচ্ছে সময়ের পানিতে আবার… ভেসে ওঠছে নৌকা কথার… নিরবতার ভিতর কত যে কথা… কথাগুলি বলছে, ‘নিরবতা, তুমি চুপ করবে নাকি?’
না–লিখা
না-লিখার গর্তে পড়ে এরা আছে ঠিকই; লিখা নাই, না-লিখার হতাশা তো আছে! আছে কবিজন্ম, কবিতা মুহূর্ত। অশরীরী বোধ নাই, আছে ভাবনাহীন অস্তিত্ব বিন্যাস। না-লিখা তো ভালোই, যখন লিখার ভিতরকার জলজ্যান্ত সাপগুলি ওঠে এসে দাঁড়িয়ে আছে, ছোবল দিচ্ছে, ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভিতর না-লিখার বিষ। যারা লিখছে, তারা লিখছে তাদেরটাই, আমার না-লিখা লিখার অতীত, চলছে ভবিষ্যতে; হাত-পা নিয়া আগাইয়া যাচ্ছে… ভুসভুস করে যাচ্ছে সময়… যাক না বাবা, কোথায় যাবে তারা… আমাকে ফেলে দিলে আমার না-লিখাও লিখার ভিতর থেকে ওঠে আসতে থাকবে…
দুই/চারলাইন
বহুত্ব
ইচ্ছা হয় গর্ত ছেড়ে বের হয়ে আসি
ইচ্ছা হয় গর্তের ভিতর কাটিয়ে দিই সারাটা জীবন
জীবনের বহুত্ব খোঁচাচ্ছে আমারে এখন।
সকালবেলা
ডিম হয়ে ভেঙ্গে পড়ি
গরম কড়াইয়ের তেলে
বলি মন উঠো, সকাল হয়েছে!
গানের পাখি
শচিন-কর্তা গাইলেন,
মুগ্ধ হয়া শুনলেন যিনি, তিনি পাখি
পাখি কখোন জানি উড়ে যায়!
দৈনিক পত্রিকা
দিন শেষ তাই
দিনের পত্রিকা তুলে রাখি
দেয়ালের পাশে স্তুপ জমে যাচ্ছে ক্রমশঃ
গান
দূর থেকে শোনা গান, দূরত্ব মহান!
কে আর তবে আসবে কাছে, কে আর তবে গাইবে গান?
গান তো তবু ছুটছেই; মহা গ্যাঞ্জাম!
শরীর
এই শরীর আমি চিনি না, এই গন্ধ …
এই শরীরকেই আমি ভুলে যেতে চাই,
এইটা আসলে নাই-ই!
অর্ধস্ফুট
শিখছি চুপ করে থাকা, কি করে কথা না বলে থাকা যায়;
তারপরও কথা বের হয়, যদিও আটকে আসে…
আমি ভাবি, এইরম করে আর কদ্দিন!
চিম্বুক পাহাড়ে
একটা পাহাড় ডাকছে, ‘ও ভাই, যাও কন্ডে?’
আরেকটা পাহাড় বলে, ‘মেঘ ধরতে দাঁড়ায়া আছি’
মেঘগুলি উড়ে উড়ে … পাহাড় থেকে পাহাড়ে …
টাইম–আউট
সময়ের বাইরে এসে বসছি
প্লাস্টিকের টেবিল চেয়ারে বসে ভাবছি, এইটাই তো অবসর
এক টুকরা খোলা আকাশের নিচে ছোট ছোট খুপচি আড্ডা
গ্রাম ও শহরের গল্প
ঘিঞ্জি বস্তির শহরগুলি, আমি ভালোবাসি
যেখানে শহর-এর ভিতর আটকে আছে গ্রাম, আমি ভাবি
গ্রাম নিয়া চিন্তা আমার ভর করে ওই বস্তির ভিতর, যা আমি দেখি না
অ্যাজিউম করি যে, ওইটাই একটা প্রটোটাইপ, শহরের সৌন্দর্য্য নষ্ট করে
নিজেদেরকে গড়ে তোলার চেষ্ট করে; ওইটা একটা অহেতুক বাস্তবতা
যত দ্রুত পারি, আমি তাদেরকে শহরের অর্ন্তভুক্ত করে দিতে চাই
আর তারাও খুব দ্রুতই গ্রাম্যতা নিয়া আসে শহরের ভিতর
আইল্যান্ড ধরে এমন বেখেয়ালে হাঁটে যেন ক্ষেতের আইল
ময়লা পানির খাল পার হয় ডিঙি নৌকায়, যেন বর্ষার নতুন পানি
আর বৃষ্টিতে পানি জমলে কি যে খুশি, বড় বড় রাস্তাগুলি তো এক একটা নদী!
বস্তির মানুষজন এই শহরটারেই নানান ফন্দি-ফিকিরে একটা গ্রাম বানাইয়া ফেলে
ছুটির দিনে ওরা ঢুকে পড়ে সুপারশপ আর শপিংমলে
এইটা-ওইটা দেখার ভান করে দেখে শহরের মানুষগুলি, ফলো করে যে
হাফপ্যান্ট পড়েই শহরের মানুষগুলি এখন বাইরে চলে আসছে
ওদের আর ঘর-বাহির নাই, রাস্তা-বাড়ি নাই, নারী-পুরুষ নাই, স্ট্রেট-গে নাই …
আর কি যে উত্তেজনা, ওদের চকচক করা চোখে
নুডুলস-এর বাটিতে, স্যুপের চামচে ওরা একটু একটু করে শহর খেয়ে নিচ্ছে
আর শহর ছুটে যাচ্ছে, বেড়িবাঁধের ওই পাড়ে
নিষকন্টক জমি খুঁজতে খুঁজতে এক্সপান্ড করে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল
ওইখানে কি আর গ্রাম আছে?
গ্রাম খুঁজতে খুঁজতে শহর ছেড়ে একদিন গেছি
বাড্ডা পার হয়ে সাতাঁরকুল ইউনিয়নের ভিতরে
গিয়ে দেখি সাইনবোর্ড, শহর আসছে!
উত্তেজনায় কাঁপছে মানুষজন, এইটা আর গ্রাম নাকি!
দুইদিন পর পাঁচশ ফুটের রাস্তাটা হইলে, এইটাই তো হবে মূল শহর…
হাঁটতে হাঁটতে যত দূরই যাই, দেখি বড় বড় বিলবোর্ড
শহর আসছে!
গ্রামের মানুষগুলি কিলবিল করে ঢুকছে শহরে
আরো আরো শহর ঢুকে যাচেছ আরো আরো গ্রামের ভিতর
সাব-আরবান এরিয়াগুলিও চাচ্ছে মেট্রো-রেলের অপশন
গ্রাম্যতাই আসলে শহরের রিয়েল অবশেসন!
সিন্ডিকেট কাহিনি
এই সিন্ডিকেটের ভিতরে আমি ঢুকে যেতে চাই!
হয়ে উঠতে চাই এর অংশ
কি করে যে মৃদুমন্দ সফিশটিকেশন ভিতর এটা নিজেদের প্রটেক্ট করে
শুনলেই আমোদ লাগে, কাদা জলে ছোটাছুটি করা
শাদা শুয়োরের বাচ্চার মতো লাগে
হা হা হি হি করে করে কেটে যাবে কত যে সময়
সময়ের পাঙ্খা আর নাই সময়ের ভিতর!
অনেকদিন আগে, কত দিন যে আগে
বসেছিলাম সেই বারান্দায়
টুং টাং গ্লাসের শব্দে উঠেছিল আমার ঢেঁকুর
পড়িমড়ি করে করে ছুটে ছুটে
আমি আবার চলে যেতে চাই যে সেই সিন্ডিকেটের ভিতর
পুরাতন সমাজ থেকে
ব্য-সম্প্রদায় ডাকে
ওরাও তো হতে চায় সিন্ডিকেটের বাছুর!
মাদী-ঘোড়া আসে
আরও আসে যার নাই কোন পাছা
আসে আর যায় যারা
তাদের গমনাগমণে
উৎসুক হয় মন আরো, নানান জিজ্ঞাসা…
ওই যে বক্তব্য-প্রধান
ছিঁড়ে যাচ্ছে নিজের চুল, ক্রমাগত
ওই যে ভন ভন মাছি
ওই লাজুক মোরগ, প্যাঁক প্যাঁক হাঁস, বিগলিত হাসি
এঁরাও তো বিনীত অংশীদার
সিন্ডিকেটর কালচার গড়ে তুলছে
ছোট ছোট বাঁশের বেড়ায়
গরুর উলান থেকে জাগিয়ে তুলছে ক্ষিরি কাবাবের অগ্রিম গন্ধ
সেই গন্ধেই মন উচাটন,
অমরত্ব-লোভী পোকা-মাকড়গুলি
দিয়ে যাচ্ছে জৈবিক সারের যোগান
সিন্ডিকেটের মহত্বে আমিও আভিভুত
রাত বারোটায় লাইনে দাঁড়ানো বাংলাদেশীর মতো
হীনমন্ম্য, অস্বস্তিকর (দুই সপ্তাহের জন্যে হলেও) একটা এন্ট্রি চাই, ইন্ডিয়ার
দেখে আসতে চাই
কেমন যে ওই শাদা, বরফ-পাহাড়!
যারা নাই তারা আসলে কেমন?
কেমন এই সিন্ডিকেটের আদল?
বন্ধুত্বের সময়
অনেক কমলো বন্ধু, হৃদয়ের ক্ষোভ
তোমাদের কাছে বসে থেকে থেকে
কথা শুনে শুনে তোমাদের
ভোলা গেলো নিজের সংকীর্ণতা
যে অব্যক্ততা, মৃতকল্প ভাবনারা ছিল
তার দমবন্ধ-রূপ, পরিত্রাণ পেলো
ধোঁয়ায় মিশিয়ে দিয়ে তাদের
বাঁচা গেলো, এইবারের মতোন!
এখন ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে চলে যাওয়া
রৌদ্র-তপ্ত দিনের ভিতর;
বালিতে পা পুড়ে যাওয়ার আগে,
তেষ্টায় গলা শুকানোর আগে
এই এতটুকু সময় গেলো, স্পর্শ-ব্যাকুল …
সকালবেলা
ভোরের হাওয়া
অস্থিরতা জড়ো হচ্ছে তোমার গায়ে;
একটু পর হাঁটতে বের হবো।
দেখবো কী সূর্যমুখী ক্ষেতে ফুলেদের হাসি?
নমনীয় আলোগুলি জেগে ওঠছে আবারো?
শুরু হচ্ছে দিন, ক্রমান্বয়ের পথে?
রাত্রির পতনের পর জেগে-ওঠা ভোর
নিয়ে এলো দিনের প্রান্তে
পাখির আওয়াজ শুনছি, চারপাশে
তারা কথা বলছে,
ভেঙ্গে পড়ছে নিরবতা, ক্রুদ্ধ স্তব্ধতার আড়াল।
নিরবতার ধ্বনি ভাঙতে ভাঙতে এই এতদূর আসা
এখন হাঁফাচ্ছে শরীর, রাতের অতিক্রান্ত ভালোবাসা
সকাল হয়ে এলো মুহূর্তেই, ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে
সূর্য, আলো, অস্থিরতা।
তারাগঞ্জ টু দিনাজপুর
তারাগঞ্জের সুন্দরীরা তারা হয়ে বসে আছে টিনের বাড়িগুলির ভিতর …
রোদের আলোয় হেসে উঠছে ধান …
দেয়ালে দেয়ালে তেলের শিশি খাড়া হয়ে আছে, কোথাও ডিটারজেন্ট পাউডার, স্বাস্থ্যসচেতন বিজ্ঞাপনগুলি…
দূর ফসলের মাঠে একটানা পল্লী-বিদুতের কালো তার, হঠাৎ-ই দাঁড়ায়ে গেছে মোবাইল কোম্পানীর টাওয়ার…
টেম্পোতে করে যাচ্ছে মহিষ একটা …
মাটি সরে গিয়ে মৃত্যুর দাঁড়প্রান্তে, পানির ওপর ঝুঁকে দাঁড়ায়া আছে একটা গাছ, নতুন সবুজ পাতায় ভরা …
রাইস মিলে শুকাচ্ছে ধান, জড়ো হচ্ছে বস্তায় বস্তায়, ওরা ঢুকবে সরকারী গুদামে, হা-পিত্যেশ ছাড়াই কাটিয়ে দেবে অনেকগুলি বছর
দশমাইল ছেড়ে এসে, লিচুবাগানের গাছগুলি পার হয়ে, শস্য-প্রদর্শনীর মাঠ দেখতে দেখতে ঢুকে পড়ছি শহরে
দেখছি স্কুল-ব্যাগ কাঁধে করে যাচ্ছে ছেলে-মেয়ে, গমগম করছে মানুষ-জন, হর্ণ দিচ্ছে গাড়ি, রিকশা বাজাচ্ছে ঘন্টি…
তারাগঞ্জ থেকে আমি দিনাজপুর আসছি, মেডিকেলের মোড়ে দাঁড়ায়েই খুঁজতে নামছি তোমারে…
অশ্বত্থ বটের কাছে এসে
আহ্, অশ্বত্থ
সকাল হয়ে এলে আমি কোথায় লুকাবো!
কোথায় আস্তানা গড়ে পালিয়ে গেলো অভিব্যক্তি সকল!
সকালের দিকভ্রান্ত রোদের ভিতর আমি যাবো কোন দিকে?
পূবদিক থেকে ধেয়ে আসছে বিকট প্রার্থনা
পশ্চিমে বিশাল মাঠ
উত্তরের হাহাকার শোনা যাচ্ছে এখনই
আর দক্ষিণে ফুঁসে ওঠছে নদী
সামনের অশ্বত্থ একা ওঠে যেতে চাইছে আকাশে…
অথচ নিরুপায় বট তার শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে মাটিতেই শুধু!
ঘাসগুলি তাদের শিশিরের নির্লিপ্ততা ফেলে
হয়ে ওঠছে হাসি-খুশি ঝলমলে
বিগত রাতের নুয়ে-পড়া, ভুলে গেছে তারা
বারান্দা থেকে সরে যাচ্ছে চেয়ার
জড়ো হচ্ছে ভেজা করুণ পোশাকগুলি
শুধু অশ্বত্থ, মূক ও বধির
বলতে গিয়ে কিছু
তার ডানা হেলে উঠলো এদিক-ওদিক
সকাল হয়ে এলো,
আমি যাবো কোন দিকে, প্রস্তুতিহীন।
————————————————-
ফেসবুক নোটের লিংক:
https://goo.gl/JACYwB
Leave a Reply