এই সিরিজটার নাম হইতে পারতো – পুরুষের প্রেম বা অন্য আরো অনেককিছুই। এই টানাগদ্যের ফর্মটাও অনেক কমন একটা ন্যারেটিভ ফর্ম আর সাবজেক্টটাও – না-পাওয়া প্রেম [প্রেম পাওয়া যায়, এই ব্যাপারটাই কি রকম না! এইখানে গরুর (ইদানিং অ্যাট একচুয়াল লিখতে গিয়া লিখে – গাভী’র) দুধের চা পাওয়া যায়’র মতোন]।
তো, আমি হয়তো ভাবছিলাম যে, একটাকিছু ইনসার্ট করতে পারবো, কিছু একটা কি হবে না? – আমি লিখলে? হয় নাই আসলে। এই রায় আমি-ই দিতে চাই। কমপ্লিটও হয় নাই পুরা সার্কেলটা, লেখার। সিরিয়ালটাও হয়তো ঠিক করা লাগবে। কিন্তু অনেক তো হইছে আসলে। ২০১৩-তে শুরু করছিলাম, ২০১৪-তেই লেখা মোস্টলি, তারপরে ২০১৫ আর ২০১৬-তেও লিখা হইছে কয়েকটা। তো, লিখছি যেহেতু থাকলো, একটা জায়গায়। এর বেশি কোনকিছু না।
————————-
————————-
ক্রসরোড
যদি দেখা হয়েই যায়; ক্রসরোডে এসে আমরা দাঁড়াই। তখন দুনিয়া থামতে পারে কি আবার? আর তারপর উল্টা ঘুরতে ঘুরতে সময় আইসা থামলো ধরো, একটা খেলার মাঠের পাশে, কনসার্টের ভীড়ে, সন্ধ্যায়। কে আর কারে খুঁজে তখন! এইরকম একটা পাবলিক গোপনীয়তায় আমরা বইসা পড়তে পারলাম। একসাথে। আর কথাগুলাই আমাদের জীবন, শব্দ হইলো খোদাতালার জবান; বলামাত্র তুমি আমি পয়দা হইলাম, আবার। বলা গেলো; ভালোবাসি, কনিকা বন্দোপাধ্যায়। আমি কইলাম, দেবব্রত বিশ্বাস। যা-ই হোক, হিন্দুনামই ত; অনুপ্রাস ক্রিয়েট হয়। বলা মাত্র। আমরা ঝইরা পড়লাম, বকুলফুলের মতোন। ক্রসরোডে তোমার সাথে দেখা যে হইলো, তখন মনে হইলো, সময় ত অফুরান! অকূল মেঘনা নদীতে আমরা আব্বাসউদ্দিনের গানের মত ভাসতে লাগলাম। ব্রীজের পিলারে ধাক্কা লাইগা থামলাম। তুমি ত ভালোই ভাসতে পারো; হাসিতে কণ্ঠ ভাইঙা শি বলে। ক্রসরোডে থামছিলো যদিও শে, থেমে ত থাকে নাই শেষে।
ইমেজ
একটা ইমেজ দেখি বারবার; শি দাঁড়াইয়া আছে আমার সামনে। তার পাতলা গালের চামড়া, লাল রগ দেখা যায়। যখনই আমি তারে ছুঁইতে থাকি ওই জায়গাটা হাত দিয়া, দেয়ালের চুনার মত উঠে আসে শাদা, সরে যায়। ডেন্টাল হসপিটালের বিজ্ঞাপনের মতো দাঁত দেখা যায় না, খালি কালো ফাঁকা একটা জায়গা। শি কি পাথর? – এই বিস্ময় আমার হয় না। মনেহয় খালি কেন ধরতে গেলাম আমি তারে! আমি ত ভাবতামই যে সবকিছুই ঝরে যায়, যা কিছু আমরা ধরতে যাই ভালোবাসায়। পাথরের চোখ দিয়া শি দেখতেছে আমারে। আমাদের মেশিন-জীবন শেষ হইতে যাচ্ছে অথবা হবে ত একদিন। এইরকম জানার ভিতর আটকাইয়া আছি আমরা। নড়াচড়া নাই। শি দাঁড়াইয়া আছে, চোয়ালে ফাঁকা নিরবতা নিয়া। আর আমিও তব্দা হয়া ভাবতেছি একই কথা। কী ভুল করলাম আমরা। কী ভুল! এই সামনাসামনি দাঁড়াইয়া থাকা; কোন ছোঁয়াছুঁয়ি ছাড়া।
চীনদেশে জন্মাইছিলাম আমরা
আজকে শি’র মন ভালো থাকতে পারে; আমি ভাবি, কারণ বৃষ্টি হইছে সকালে। আর শীতের বাতাস আসতে শুরু করছে। এমন একটা রিলিফ কিছুদিনের, যখন স্যাড ছাড়া পাইছে বাস্তিল থিকা। যদিও আবার তারে জেলখানাতেই ঢুকতে হইবো। তারপরো, জীবনে কয়টা দিন যদি এইরকম কাটানো যায়, খারাপ কি! দুইটা জেলখানার মাঝখানের সময়টাই আমাদের জীবন। এমন একটা সময় প্রেমের, যখন কিছুই বলতে পারবো না আর আমাদেরকে আমরা। যারে দেখবো, তারেই ভালোলাগবে; ভালোবাসতে পারবো। ধোঁয়ায় ভাসতে ভাসতে আমরা নিজেরাই ধোঁয়া হয়া ভাইসা যাবো। আর আমরা ত সেইটাই চাইতেছি, তাই না?
চাইনিজ ইঞ্জিনিয়ারের গার্লফ্রেন্ড আসছে ঢাকায়। তারে নিয়া সে আসছে শপিংমলে। চোখ পিটপিট কইরা তাকায় শে। বাংলাদেশি জিনিসপত্র কিনতে চায়। বাংলা তেমন বুঝে না। মঙ্গোলয়েড এই মেয়েরে দেইখা আমার মনেহয়, চীনদেশে জন্মাইছিলাম আমরা, হইতে পারে জাপানে অথবা সাউথ কোরিয়ায়। আমি ডিপ্লোমা পাস কইরা যমুনা ব্রীজের মেরামত করতে আসছি। আর শি, তুমিও আসছো কলেজ ছুটির এক সপ্তাহ সময়ে। ঘুরে বেড়াইতেছি। কী রকম সমতলভূমি, ভাঙা রাস্তা, বৃষ্টি আর কাদা। নিজেদের মাইক্রোবাস রাইখা রিকশায় হুড তুইলা পলিথিন জড়াইয়া ঘুরতে বাইর হইছি আমরা। কীরকম যে এই দিন, আমাদের চাইনিজ-জন্ম ত জানে না!
চামার
ঠোঁট পুড়ে যাচ্ছে। জিহ্বা পুড়ে যাচ্ছে। শি’র মুখের ভিতর আমার মুখ পুড়ে যাচ্ছে। জানালার কাঁচে বৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। ইটের চুলার আগুনে পুড়তেছে ডেকচির মতো শরীর আমাদের। একবার পিঠে আর একবার বুকে। আমি সারা শরীর ঘুরে ঘুরে খুঁজতেছি তোমারে! কোন পাতাল থিকা আসে এমন মায়াবী মশলার ঘ্রাণ? কালো কালো দাগ জেগে উঠে শরীরে আমরার। মাথার পিছনের চুল টাইনা ধরে শি আমার; কয়, শালা চামার, শরীর ছাড়া তুমি কিচ্ছু বুঝো না আর! চোখ দিয়া পিইষা মারতে চায় আমারে। ঠোঁট আবার ডুবতে থাকে আমার ঠোঁটে। ঠোঁট পুড়ে যাচ্ছে আমাদের। জিহ্বা পুড়ে যাচ্ছে। আবার।
শাদা, শংকাগুলি
এই যে শাদা, শংকাগুলি জাগছে আবার। তোমার জামার ফুল, তোমার খোঁপার কাঁটা ভয়ংকর হয়া উঠতেছে আবার। তারা চইলা যাইতে চায় দূরে। বরফের দেশে। ধরো, গেলো পিএইচডি করতেই। চাইর-পাঁচ বছর পরে ফিরা আসবে বা ধরো, ভালোলাগলে থাইকাও যাইতে পারে। গ্যারাণ্টি নাই কোন। এইরকম।
———-
বরফে কালো সন্ধ্যা নামতেছে। আমরা যে যার পথে, যে যার মতো যে যার দিকে যে যার কথা মনে করতে করতে যে যে যাকে যাকে ফেলে যাইতেছি, মনে করতে পারবো ত, আবার; যে বৃষ্টির আঁধার আইসা ঘিইরা ফেলার আগে আমরা নিজেদেরকে লুকাইয়া ফেলতে ফেলতে ভাবতেছিলাম যে যে যার যার মতো; অথচ আমরা একটা মুহূর্তে আটকাইয়া ছিলাম, বৃষ্টির ভিতর, বরফের কালো সন্ধ্যায়।
…আর নিরবতা আমাদের, চৌচির হয়া ফেটে পড়তেছে।
————
কী ভুল! কী ভুল! ফুটতেছে ফুল, এই সন্ধ্যায়; বাতিগুলা জ্বলে ওঠার আগে। চলে যায় দিন। বৃষ্টি; অন্ধকারে। কে আর থাকবে পড়ে? কাচের দেয়ালে কাঁপতেছে ছবি, চলে যাওয়ার। সেও পারে না যাইতে, খুববেশি দূরে।
কথাগুলি হইলো গান
শি’র কথা শুনি। কোন কারণ ছাড়াই জিগাই বারবার। একই প্রশ্ন। আমি চাই তুমি কথা বলতে থাকো। কেননা, কথাগুলি হইলো গান। যা কিছুই তুমি বলো। এইটাই ভালো। শাদা আর কালো। স্বরগুলা ভাইঙা আসে। উচ্চারণগুলাতে তোমার নাকের সর্দি ইন্টারফেয়ার করে বারবার। এইটা ছাড়া সে পারেই না আর নিজেরে এক্সপ্রেস করতে। এই যে অসম্পূর্ণতা, স্বর যার পুরাটা বলতে পারে না, এইটাই আমি শুনতে থাকি। আর একটা সময় পর পর জিগাই, তারপর? তারপর? একটা সময় পরে শি টের পায় বা হয়তো বুঝতে পারতেছিলো আগে থিকাই, কিন্তু একটা পয়েণ্টে আইসা ভাবতে পারে যে, এইটুক পর্যন্তই লিমিট, এনাফ। তুমি কি ফাইজলামি করো আমার সাথে? এই নিয়া তিনবার কইলাম; তারপরও তোমার তারপর শেষ হয় না ক্যান? হেমন্ত মুর্খাজী সাব, আপনি কি এইবার আপনার গানটা গাইবেন? আমি কই, তোমার কথাগুলিই ত গান, আমি শুনতেছিলাম। শি শুনে। কিন্তু বিশ্বাস করে না। এই কারণে কথা বলে না আর। আর টেলিফোন কি জিনিস! খালি ত একটা বোবা পেঁচানো তার, যদি শি’র কথাই আমি না শুনলাম, এর আর কী দরকার! একটা মোবাইলফোন হইলেই হয়।
আদার
আদার বইলা কিছু নাই। একবার বলছি ত তোমারে। না-পাইরা শি বলে। এই যে আমারে দেখতেছো, আলু-থালু হাঁইটা বেড়াই। চুলে ব্যান্ড বাঁধি তিন গিট্টু দিয়া, নাক টানি ঠান্ডা লাগছে বইলা – এইটাই আমি। এর বাইরে আর কোন আমি নাই। যে আদার, সে তোমার। তুমি তারে নিয়া দক্ষিণ তালপট্টি যাও, তারপর ডুইবা মর, উধাও হও মানচিত্র থিকা। আমারে আর ডির্স্টাব কইরো না! আমি কই, বুঝছি; তুমি ইন্ডিয়া থিকা আইছো না; তালপট্টি ডুবলে ত নিউ মূর হয়া ভাইসা উঠতে পারবা। শি কয়, ঠিক আছে; তাইলে আসো সীমান্ত চুক্তি করি। আমি কই, আমার আর কি কোন অপশন আছে! এইবার শি সত্যি সত্যি মাইন্ড করে, তুমি তাইলে জাতীয়তাবাদী; আমি ত ভাবছিলাম তোমারে গ্রে কালারের কালচারাল অ্যাক্টিভিস্ট। নামে মুসলমান আর মনে মনে হিন্দু, মানে বাঙালিই ত, একটু উদারমনা! আমারই মনের ভুল। কল্পনাতেও তুমি মানুষ হইতে পারলা না! আমি কই, আদার-এর কাজ কি জানো? ঠিক সময়ে গায়েব হইতে পারা। নৌকা কইরা যাইতেছিলাম একবার আমরা। শোঁ শোঁ বাতাস। উল্টা-পাল্টা। এর ভিতরই একটা সময় হারাইয়া ফেললাম, আমাদের আদারকে আমরা। শি কয়, তুমি শিওর? নদীতে নৌকা ডুইবা যাওয়ার পরেই ভাইসা উঠলাম আমরা? মানে, এই যে ডুইবা-যাওয়া, এইটা কি মাস্ট? আমি কই, তুমি তোমার কালচারাল অ্যাক্টিভিস্টরে জিগাও! ইমেজের রাখাল আইছে রে, আমার! শি কয়, লাত্থি মাইরা আমার পাছায়। কোণাকুণি দাঁড়ানো আমি। ভাগ্য ভালো, শি কখনোই হাইহিল পড়ে না, পাতলা স্যান্ডেল ছাড়া। আর কিশোর ক্ল্যাসিকে পড়া ফ্লাইং সসারের মতো ওর একটা পা যখন ভাসতে থাকে বাতাসে, আমি তারে ধইরা ফেলি। দেখি, কী যে মসৃণ চামড়া, মনেহয় শেভ করা। পড়বো ত আমি! একটু দূরে চেয়ারে বইসা নড়াচড়া করে শে। আমি কই, না, না, আদার আইসা উদ্ধার করবো তোমারে, তুমি চিন্তা কইরো না! আমার ফ্যাটিশ মনেহয় টের পায় শে; কয়, ছিঃছিঃ, তুমি পা ছাড়ো! নাকি তার শেভের লাইগা লজ্জা পায় শে? যেহেতু আমরা চিন্তা করতে পারি, আমাদের ত অ্যাক্ট না করলেও চলে!
পোর্টেট
এই আলো দুপুরবেলার। দুপুরবেলা ত অনেক লম্বা সময়; সকাল এগোরাটার হলুদ-রোদ থিকা শুরু কইরা বিকাল চারটার কমলা-রোদ পর্যন্তই প্রায়। এর মাঝামাঝি কোনএকটা সময়, এগারোটার দিকে হবে বোধয়। একটা কাঁচের দেয়াল সেইখানে। একটা বিল্ডিংয়ের উপরেরে দিকে, দক্ষিণ-পূবে; মিনিমাম আট-দশতলার উপরে হবে। বিল্ডিংটা আঁকার দরকার নাই। যেহেতু অনেক দূরে কিছু গাছ দেখা যায়, এইজন্য অনুমান করা যায়। কাছাকাছি ধূসর রঙ-ই ছড়ানো। কাঁচের দেয়ালটাই মেইন ব্যাকগ্রাউন্ড। তার পাশে গ্রে-কালারের একটা সোফা, দুইজন বসার মতো। মাঝখানে শি বইসা আছে। একটা পা ভাঁজ করা; আরেকটা পায়ে স্যান্ডেল ঝুলে আছে, ফ্লোরের কাছে। দুনিয়ায় যে মধ্যাকর্ষণ আছে এর প্রমাণ নিয়া। মুখটা কাঁচের দিকে ঘোরানো। কোন ছায়া নাই কাঁচে। একটা হাতে মোবাইল ধরা কানে, আরেকটা হাত সোফার উপরে। চুলগুলা পিঠের উপর। শরীরে খয়েরি রঙের জামা। খুব গাঢ়ভাবে কারো সাথে কথা বলতেছে শে। কথাগুলি আমি আর আকঁতেই পারতেছি না। ইচ্ছা হয়, ওর কানের কাছে গিয়া বসি; জিগাই, কী কথা; ওগো চুল, কী কথা!
দাঁত দিয়া নখ কাটা
হাই উঠে। ফলে দাঁত দেখা যায়।দাঁতের ফাঁকে বাদামি ব্রেড আর লাল একটু জেলি। বেচারারা, যাইতে পারে নাই মুখের ভিতর। দাঁতেই আটকাইয়া গেছে। হাঁচি দিবা না ত তুমি আবার! আমি ডরাই। হাই-তোলা পর্যন্ত ঠিক আছে। এরপরে, ওই ধ্বনি-বিহ্বলতারে হয়তো সামলাইতে পারবো না। শি হাসে। কয়, দেইখা দেইখা কবিতা লেখা খুবই কষ্টের কাজ, তাই না?
ঠিকাছে, আমি তাইলে পায়ের দিকে তাকাই। স্যান্ডেলের সামনের দিকটাতে একটা ফুল, বুড়া-আঙুল আর তার পাশের আঙুলের চিপাতে। একটা পা সামনে আগাইয়া আছে। সেই পা’টা, আরেকটা পায়ের উপর ভাঁজ করা। কী আশ্চর্য! যেই ভাবলাম পায়ের কথা, পাগুলাও গুটাইয়া গেলো, সরে আসলো তোমার দিকেই আরো। এইভাবে, কবিতার সাবজেক্ট হয়া যাওয়াটাতে কি খুব অস্বস্তি লাগলো, পা-গুলার? সবসময় ব্যাপারটা একইরকম না। মনে হইলো কে যেন আমার পায়ে হাত রাখছে। বিশ্রী ধরণের একটা ব্যাপার, বুঝলা। শি বলে, ভ্রূ কুঁচকাইয়া।
আমি হাতের আঙুল দেখি। নখগুলা। দেখা কি যায়, নখের ভিতর লুকাইছি যে আমরা, আমাদের শরীরের সনাতন ধর্মগুলা নিয়া? দাঁত দিয়া নখ কাটতেছে শি। আর আমি ভাবতেছি, মারা-যাওয়া ত এমনই সহজ একটা কাজ, তাই না!
Leave a Reply