শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান-এর আরেকটা ইন্টারভিউ পড়ার সুযোগ আমার হইছে। উনার ‘রাজনৈতিক’ অবস্থানের কারণেই উনার কথাগুলা গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ‘রাজনৈতিক অবস্থান’ অনেকেই সাবস্ক্রাইব করেন বইলা আমার ধারণা। এইজন্য তাঁর ভাষার এই রাজনীতি বিষয়ে আমার বোঝাপড়াটা হাজির রাখতে চাই।
[তবে উনার কথা নিয়া বলার একটা সমস্যা আছে। ব্যক্তি হিসাবে উনি আমাদের সমাজে শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ। এই কারণে একটা প্রি-অ্যাজামশন কাজ করে যে, শ্রদ্ধেয় মানুষদের কথা নিয়া তর্কে যাওয়া যায় না; ব্যক্তিত্ব বা জীবন-যাপন একটা অবস্টেকল হিসাবে কাজ করে। মনে হইতে পারে যে, উনার কথার বিরোধিতা করা মানে উনার ব্যক্তিত্বের বিরোধিতা করা। আবার মনে হইতে পারে যে উনার ব্যক্তিত্ব যেহেতু শ্রদ্ধার ব্যাপার, উনার ব্যক্তিত্বরে ‘খাটো’ করার জন্য হয়তো উনার বক্তব্যের বিরোধিতা করা; ব্যাপারটা যে তা না, সেইটা বইলা রাখাটা মনে হয় ভালো।]
আগের একটা ইন্টারভিউ পড়ছিলাম উনার, ওইখানে যা বলছিলেন, সেইখান থিকা খুব বেশি কিছু চেইঞ্জ না হইলেও, উনার বলার জায়গাটা সম্ভবত প্রশ্নগুলার কারণেই আরেকটু স্পষ্ট হইছে। খুববেশি কিছু চেইঞ্জ হয় নাই, কারণ ভাষা বিষয়ে চিন্তার ক্ষেত্রে ‘আঞ্চলিক’ এবং ‘প্রমিত’র যে ভাবনা, সেইটা উনি একবছর আগে যেইভাবে হোল্ড করতেন, এখনো করেন। উনি বলছেন,
অসুবিধা হলো, যখন আমরা জোর করে বলতে চাই যে আমরা এক শ বছর আগের ভাগীরথীর তীরবর্তী বাংলাকে কেন প্রমিত বাংলা হিসেবে মানব। এর মধ্যে একটা রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে।
এই ‘জোর’ শব্দটা নিয়া একটু দ্বিধায় আছি; এতে কইরা মনে হয় যে, কথার মধ্যে ‘যুক্তি’ নাই, অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলা। কিন্তু ব্যাপারটা ত তা না। আমি অনুমান করছি যে, এই ‘জোর’ মানে হইলো ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’; কারণ, এইটার কথা উনি পরের বাক্যেই বলছেন। মানে, আমি যখন বলি যে, ‘প্রমিত বাংলা’ আমি মানব, তখন কি কোন রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে না? সেইটা কি খুবই ‘অ-রাজনৈতিক’ একটা ব্যাপার? খুব অপ্রসাঙ্গিকভাবে (মানে, ‘জোর’ কইরা) আনিসুজ্জামান সম্ভবত তা-ই ভাবছেন। বা ‘রাজনীতি’ বইলা ঠিক রাজনীতি না, বরং ঘৃণার একটা জায়গাতে নিয়া যাইতে চাইতেছেন যেইখানে আর্গুমেন্টের কোন স্পেইসই আর নাই।
আমরা যদি বলি বুড়িগঙ্গার তীরের মানুষের ভাষাকেই প্রমিত বাংলা করতে হবে, তার যৌক্তিক পরিণতি কী হবে? তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলামের লেখাকে আমাদের বাংলা বলে স্বীকার করব না? আমরা যদি ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিবেচনার ওপর জোর দিই তাহলে একসময় দুটো ভাষা হয়ে যাবে।আমরা বাংলাদেশের জন্যও তো একটি প্রমিত বাংলা তৈরি করতে পারিনি।
যুক্তি’টা (মানে এইটারে যদি যুক্তি বইলা মানতে রাজি হই আমরা) খুবই বাজে; মানে, যেই তিনজন রাইটারের নাম উনি কইলেন উনাদেরকে ‘স্বীকার’ করার লাইগা ভাষারে ধইরা রাখতে হইবো? উনি ধইরাই নিতেছেন, ভাষা জিনিসটারে স্ট্যাটিক একটা ঘটনা, আর এইটা নেসেসারিলি প্রেস্কাইবড একটা জিনিস হইতে হবে, ফোর্ট উইলিয়াম জায়গা’টা নিতে হবে বাংলা একাডেমি’রে। হইতে যে পারে নাই বা পারতেছে না ঠিকমতো, এই আক্ষেপ’টা আছে উনার। মানে, বাংলা ঠিক রাজ-ভাষা টাইপ হইয়া উঠতে পারতেছে না।
ষাটের দশকে যে কথা আবুল মনসুর আহমদ, ইব্রাহিম খাঁ, আবুল হাশিমরা বলতেন;
আধুনিকদের কাছ থেকেও সেই দাবি উঠেছে।
এই ‘আধুনিক’ কারা? কি তাদের দাবি? বা আবুল মনসুর আহমদ, ইব্রাহিম খাঁ, আবুল হাশিমরা যা বলছিলেন সেইটার সাথে ‘আধুনিক’দের মিলের জায়গাটা ইলাবরেট করলে আরো ভালো হইতো। আমি যদ্দূর পড়ছি সেইটা থিকা ধারণা করি, উনাদের আর্গুমেন্ট ডিফরেন্ট হইলেও চিন্তার গ্রাউন্ডটা একইরকম ছিল। সেন্ট্রাল ভার্সেস আঞ্চলিক-এ উনারা আঞ্চলিক-টাইপ আছিলেন।
আমি মনে করি, সাহিত্যের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চলতে পারে কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা কোনো দেশেই প্রমিত ভাষার জায়গাটা নিতে পারে না।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে নেওয়া ঠিক নয়।
এই বাক্যগুলা প্রাণভোমরা। কিন্তু এইখানে ‘প্রমিত’ এবং ‘আঞ্চলিক’ এর প্রিমাইজটারেই তো স্বীকার করাটা সম্ভব না; কারণ ‘প্রমিত’ মানে ‘অঞ্চল’হীন একটা ব্যাপার ত না! প্রমিত বরং একটা ভোকাবুলারি’রে প্রমোট করতে চায় যেইটা কলকাতার শিক্ষিত মানুষজন ইংরেজ আমলে ইউজ করতো; একটা সার্টেন টাইমের সার্টেন অঞ্চলেরই ব্যাপার।
প্রথমআলো:যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের মান বা প্রমিত বাংলাই ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু ভাষা পরিকল্পনায় বাংলায় অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ আমদানির ওপর জোর দিলে বাড়তি কোনো চাপ সৃষ্টি করবে কি না?
আনিসুজ্জামান:যদি স্বাভাবিকভাবে কোনো শব্দ আসে আপত্তি নেই। কিন্তু জোর করে শব্দ আনা, কিংবা আইয়ুব খানের মতো কিছু উর্দু,
কিছু বাংলা মিলিয়ে একটি সংকর ভাষা তৈরি করা ঠিক হবে না।
এই ‘স্বাভাবিকতা’ আর ‘জোর’-এর জায়গাটা বেশ ঝামেলার। কোনটারে বলবো ‘জোর করে আনা’ আর কোনটারে বলবো ‘স্বাভাবিকতা’?… ভাষার ভিতর ‘অ-প্রচলিত’ শব্দগুলারে ইম্পোজ করার চেষ্টাটারেই ‘জোর’ করা বলা যাইতে পারে; যেমন ধরেন, যেই ভাষায় আমি রিকশাওলার সাথে ঝগড়া করি, অফিসের কলিগদের সাথে কথা বলি, সেই ভাষা ত ‘জোর’ কইরা আনা হইতে পারে না, বরং সেইটা ব্যবহার না করতে পারাটাই ‘জোর’ কইরা চাপাইয়া দেয়া।
বাংলা ভাষা বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা এ উৎস (হিন্দি) থেকেই সবচেয়ে বেশি। আঞ্চলিক ভাষা থেকে বিকৃতির সম্ভাবনা ততটা নয়।
ভাষা’রে খাঁচা দিয়া আটকাইয়া বড় করা সম্ভব না। ভাষা কখনোই অ্যাজ ইট ইজ থাকতে পারে না; বিকৃতির চাইতে বিবর্তিত হওয়ার রাস্তাগুলারে যতবেশি সম্ভব ওপেন রাখা সম্ভব ততই ভালো।
ভাষা’র রাজনৈতিক, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিবেচনা বাদ দিয়া নিতান্তই একটা ‘সাংস্কৃতিক’ বা ‘সামাজিক’ ব্যাপার হিসাবে ব্যাখ্যা করার যে চেষ্টা সেইটা সর্ম্পকে বাংলাভাষায় যারা সাহিত্যচর্চা করেন, তাদের সবারই সাবধান থাকাটা দরকার। শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান ‘প্রমিত ভাষা’র পক্ষ নিতে গিয়া এই জিনিসটাই ইগনোর করতে চাইছেন। এইভাবে বাংলা-ভাষায় চিন্তার জায়গাটারেও লিমিট করতে চাইছেন আসলে।
লিংক:
http://epaper.prothom-alo.com/view/dhaka/2012-02-19/12
Leave a Reply