কানার হাটবাজার ।। লেখক: সুমন রহমান ।। প্রকাশক: দুয়েন্দে ।। বইমেলা, ২০১১ ।। পৃষ্টা: ৯১। দাম: ৫০০টাকা ।।
১.
আমার কোন প্রস্তুতিই ছিল না, ‘কানার হাটবাজার’ বইটা নিয়া লিখবার; কারণ যে বিষয় নিয়া বইটা লেখা, সেইটা আমার খুববেশি আগ্রহের সাবজেক্ট না, তার চাইতে বড় বিষয় যেইভাবে বইয়ের ফর্মটারে সাজানো হইছে, সেইখানে আমার কিছু সংশয় আছে; তারপর, বইটা যাদের উদ্দেশ্যে লেখা হইছে, আমি সেই পাঠকদলের লোক না বইলাই মনে হইছে।
এই যে জনপ্রিয় সংস্কৃতি অধ্যয়ন বা সাংস্কৃতিক-অধ্যয়ন – এইটা সুমন রহমান চালু করতে চাইতেছেন; এর আগে মানস চৌধুরী এবং ফাহমিদুল হক-এর মিডিয়া এবং সংস্কৃতি বিষয়ে কয়েকটা লেখা পড়ছি (আরো অনেকেই লিখছেন হয়তো), কিন্তু একটা বইয়ে বিষয় হিসাবে এই জিনিসটার টোটালিটিটারে ধরবার কোন চেষ্টা এইটাই পয়লা মনেহয়।
বইটা নিয়া বলার আগে, বরং অনুমান করতে চাই আমি, যারা বইটার চিন্তা থিকা নিতে পারছেন বা নিতেছেন, তারা বইটা নিয়া কেন বলেন নাই:
১. আসলে বলার সময় হয়তো পার হয়া যায় নাই; প্রথম আলো-ই ত এখনো লিস্ট ছাপে নাই… বাংলাদেশে যারা চিন্তার চর্চা করেন, তারা হয়তো সময়ই পাইতেছেন না, নিজেদের চিন্তাগুলি শেষ কইরা তারপর না হয় কথা বলবেন।
২. আরেকটা ব্যাপার হইতে পারে যে, প্রচলিত সমালোচনার ধারা মতে, একজন উঠতি লেখকেরই একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের বইয়ের সমালোচনা করার কথা অথবা প্রতিষ্ঠিত কোন লেখকের নতুন লেখকের বইয়ের সমালোচনা করা; যেহেতু এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত কোন ‘ইন্টেলেকচুয়াল/চিন্তাচর্চাকারী’ বাংলাদেশে নাই, তাই নিজের শরীরে কেউ ‘উঠতি’ হিসাবে সিল লাগাইতে চান নাই!
৩. সবচে’ বাজে যে অনুমানটার কথা মনে আসতেছে, সেইটা হইলো, এই পর্যন্ত আমাদের চিন্তার যে উত্তরাধিকার, সেইটারই এক্সটেনশন। ২/১টা ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের চিন্তার মূলধারা হইলো, ‘চৌথামারা’, অন্যের চিন্তারে নিজের বয়ানে হাজির করা, ঘটনার উপর অন্যের চিন্তার রিফ্লেক্ট দিয়া বিশ্লেষণ করা এবং এইভাবে মৌলিক চিন্তারে গাপ কইরা দেয়া… ত, সুমন রহমান যদি কোন নতুন চিন্তা কইরা থাকেন, তাইলে পূর্বসূত্র অনুযায়ী তারে প্রথমেই ‘নিরবতা’র ভিতর ঠেইলা দেয়াটা জরুরি, তা নাইলে তারে ভাইঙ্গা খাওয়াটা একটু মুশকিল হয়া যাইতে পারে!
আরো আরো অনুমান সম্ভব, সেইপথে আর না-হাঁটি বরং, বাংলাদেশের চিন্তা নিয়া আরো বলার ইচ্ছা রাখি, পরে।
২.
বইটা নিয়া লিখবার সংশয়ের জায়গাটা নিয়া বলি। সংশয় যতোটা না চিন্তাগুলি নিয়া, তার চাইতে বরং অনেকবেশি বইটার ফরম্যাটটা নিয়া… মোটাদাগে আমার মনে হইছে, চিন্তাগুলারে অনেকবেশি ‘অ্যাকাডেমিক’ কইরা তোলার একটা ব্যাপার আছে, এই অর্থে যে, চিন্তারে অনেকবেশি প্রমাণিত, রেফারেন্স-নির্ভর এবং সীমাবদ্ধ করার একটা চেষ্টা আছে; আর এই চেষ্টাটারে চিন্তার জন্য আমি একটা আটকাইয়া যাওয়ার মতো ব্যাপার বইলা মনে করি। এর বিপরীতে আমার ধারণা, চিন্তার কাজই হইলো এক্সপান্ড করা, ছড়াইয়া যাওয়া এবং যতবেশি সম্ভব ওপেন থাকা; ত এই বিষয়গুলা যে সুমন রহমান-এর লেখাগুলাতে নাই – তা না, উনার চেষ্টাটা সবসময়ই ওপেন-এনডেড, কিন্ত ফোকাসড হইতে গিয়া উনি সীমাবদ্ধ করছেন উনার আলোচনারে – এইটাই সংশয়ের জায়গাটা। চিন্তার কাজ যতোটা না ‘সত্য প্রমাণ করা’, তার চাইতে বরং সত্য-এর সম্ভাবনাগুলারে বোধগম্যতার ভিতর নিয়া আসা।
ভূমিকা থিকাই বলি, সুমন রহমান তার লিখিত বিষয়গুলারে মোটাদাগে ৩টা বিষয়ের ভিতর আটকাইছেন – নগর, জনসংস্কৃতি ও গণমাধ্যম; কিন্তু বিষয়গুলা শুধু এই ৩টা জিনিস নিয়াই বলে না, এর সাথে সাম্প্রতিক জ্ঞান-কাঠামো এবং ঘটনা-প্রবাহগুলা যেমন জড়িত, একইভাবে বিভিন্ন পাটাতনে দাঁড়াইয়া বিষয়গুলারে দেখার সম্ভাবনারেও ধারণ করে; কিন্তু একটা জ্ঞান-তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিতর লেখাগুলিরে দাঁড় করানোর সাপেক্ষে লেখার ভিতর থাকা সেই সম্ভাবনাগুলারে তিনি সীমাবদ্ধ করতে চাইছেন, লেখাগুলারে একটা বেড়ার (closure) এর ভিতর নিয়া আসতে চাইছেন (এইটা আমার রিডিং, ভুলও হইতে পারে)। এইটা হয়তো বই-এর চিন্তার জন্য হয়তো জরুরি, কিন্তু আমি বরং লেখাগুলার এক্সপান্ড হইতে চাওয়ার যে আকাংখাটা আছে, সেইটাতে ফোকাস করতে বেশি আগ্রহী।
আর ভূমিকাটাতে রেফারেন্স-এর প্রাচুর্য (সাধক মনমোহন, হেগেল, হিউম, নীটশে, ফ্রয়েড, মার্ক্স, লেভী-স্ট্রাউস, হেবিজ, আলথুসার, ফুকো, রঁলা বার্থ, জুডিথ বাটলার, জিগম্যান্ট বম্যান, স্টুয়ার্ট হর ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, অ্যাডোর্নো, নোম চমস্কি, জাঁ বদ্রিয়াঁ, সাইমন ড্যুরিং, সস্যুর, পিয়ার্স, উমবার্তো একো) আমার মতো পাঠকরে আরো ভীত করছে, এই বই পড়ার যোগ্যতা আমার আছে ত! যে কোন ধরণের দায়-স্বীকার-এর বিপরীতে এইটা যেন আরেকটা এক্সট্রিম-অবস্থা!
তবে লেখাগুলা শুধুমাত্র সাধারণ পাঠক (!) এর জন্যই না, বরং প্রথাগত প্রবন্ধ-নিবন্ধ’র চাইতে ভিন্নমাত্রার এবং অনেকবেশি আনন্দদায়ক তার গদ্য। বিষয়গুলাতে যদি আগ্রহ নাও থাকে, সুমন রহমান-এর গদ্য-ভঙ্গিমার স্বাদ নেয়ার জন্য হইলেও ত এই বই পড়া দরকার!
৩.
উনার বই-এর মূল পাঠকদলে (যারা এই বিষয়গুলা নিয়া চিন্তা করেন এবং করতে চান) আমি পড়ি না, তারপরও তার এই লেখাগুলা আমি পড়ছি কারণ আমি সবসময় নতুন চিন্তার গ্রাহক হইতে চাই, জানতে এবং বুঝতে চাই; সুমন রহমান-এর এই বইয়ের অ্যাকাডেমিক গুরুত্বের বাইরেও এক ধরণের ক্রিয়েটিভ গুরুত্বও আছে বইলা আমি মনে করি।
কিন্তু এই মুর্হূতে সেইটারে মুখ্য কইরা তুললে, তার চিন্তারেই পাশ কাটানো হইবো।
৪.
এতো কথা বললাম, বইটার সাথে আমার চিন্তার যোগাযোগ-এর জায়গাটাতে; কিন্তু বইটার লেখাগুলি নিয়াই কিছু বলা হইলো না।
বইটার নাম কানার হাটবাজার, ক্যাটাগরি ‘সাংস্কৃতিক-অধ্যয়ন’; সাবটাইটেল ‘নগর, জনসংস্কৃতি ও গণমাধ্যম পঠন’; ভূমিকা (কানার হাটবাজার) বাদে ৬টা চ্যাপ্টারে ২৩টা লেখা আছে: ভয়ের স্বরলিপি (৪টা), তারুণ্যের টানাপোড়ন (৩টা), মৃত্যুর টেক্সচুয়ারিটি (৩টা), টেলি-রিয়াল খোয়াবনামা (৩টা), সেলুলয়েড-জাতীয়তাবাদ (৪টা), আর্টের নিন্মবর্গীয়পনা (৬টা)।
২/১টা লেখা বাদে সবগুলাই আমি পড়ছি দৈনিক পত্রিকায় কিংবা ওয়েব স্পেসে, কমেন্টও করছি মাঝে-মধ্যে। এখন বলতে গেলে প্রতিটা লেখা নিয়াই আসলে আলাদা আলাদা কইরা বলার মতো আছে। আবার একইসাথে অ্যাকাডেমিক চিন্তার ফরম্যাট-এর সাথে নিজের চিন্তার বৈসাদৃশ্যটাও ভালোভাবেই টের পাই, তাই এক্সপেক্ট করি, যারা এইসব বিষয় (নগর, জনসংস্কৃতি ও গণমাধ্যম) নিয়া পাঠ্য (অ্যাকাডেমিক) আলোচনা করেন, তারা বললে, হয়তো তাদের চিন্তার লেজ হিসাবে আমার অ-পাঠ্য (নন-অ্যাকাডেমিক)কথা-বার্তা হয়তো যোগ হইতে পারে।
জনপ্রিয়তা বিষয়ে এই বই খুববেশি জনপ্রিয় হবে – এই আশা আমার কম, কিন্তু জনপ্রিয়তা বিষয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের এই বইয়ের চিন্তারে মোকাবিলা করার দরকার আছে; গুরুত্বপূর্ণ চিন্তারে পাশ-কাটাইয়া যাওয়ার উত্তরাধিকার বর্জনের সময় হয়তো এইটাই।
৫.
শিরোনাম বিষয়ে: এই নামে আমি একটা কবিতা লিখছিলাম, ১৯৯৫সালে… মনে হইলো, সুমন রহমান-এর বই-এর প্রসঙ্গে এইটা যাইতে পারে; যেই বিষয়ে উনি বলছেন, সেইটা এক ধরণের অন্ধের দর্শন (এই অন্ধত্ব উনার নিজস্ব না, ব্যাপারটাই এইরকম বলে তিনি অআইডেন্টিফাই করছেন), কিন্তু যেইভাবে উনি বলছেন, সেই ভঙ্গিটা খুব সুরেলা, তাই খুব বাস্তবিক না হইলেও এই বইটারে হয়তো এইভাবে চিত্রিত করা যায় যে, একজন অন্ধ বালক গান গাইছে।
Leave a Reply