চিটাগাং গেছিলাম ঘুরতে, ফয়েস লেকের রিসোর্টে থাকছিলাম দুইদিন। সেকেন্ড দিনে জিইসি মোড়ে আইসা ব্যাংকের পুরান অ্যাকাউন্ট ক্লোজ কইরা জামালখানে বইয়ের দোকানে গিয়া বই কিনছিলাম কয়েকটা। রুমির কবিতা এর মধ্যে একটা। ‘RUMI Selected Poems’, Coleman Banks এর অনুবাদ করা [লগে John Moyne, A.J.Arberry আর Reynold Nicholson আছিলেন]। পেঙ্গুইন বুকস বইটা ছাপাইছিলো ১৯৯৯-এ, এর আগে হার্পার কলিন্স ছাপাইছিলো ১৯৯৫-এ। আমি পাইছি ২০০৪ এর রিপ্রিণ্ট ভার্সনটা। কক্সবাজার যাওয়ার পথে পড়লাম, ঢাকায় ফিরার পথে আর ঢাকায় ফিরার পরে। পড়তে পড়তে মনে হইলো, কাহিনিগুলি বাংলায় লিখি।
ইংলিশ অনুবাদে কাহিনিগুলি কবিতার ফরম্যাটে লেখা। কবিতা বলতে যেইরকম একটা অস্পষ্টতারে মিন করে সেই প্রি-অ্যাজিউমড ব্যাপারটারে মনেহয় এভয়েড করতে চাইছি আমি এইখানে। অনেকগুলি লিখলাম। অনেকগুলি পরে লিখবো বইলা দাগাইয়া রাইখা দিলাম। এইরকম করতে করতে মার্চ থিকা নভেম্বর, ২০১৬’র মধ্যে তেতাল্লিশ’টা কাহিনি বাংলায় লিখলাম। আরো কাহিনি আছে উনার লেখায়, কবিতায়।
এই কাহিনিগুলি খুব নতুন কিছু না। অন্য কোথাও হয়তো শুনছি বা পড়ছি। তবে কাহিনির ফ্যাক্টগুলি উইকিপিডিয়ার মতো অথেনটিক না। নিজের মতো কইরাই বলছেন। একটাকিছু বলতে চাইছেন উনি কাহিনি দিয়া, ঠিক এখনকার চালু ‘যুক্তি’ দিয়া না। যে, দেখেন এইরকম কিন্তু ঘটে আর এইটার মানে কিন্তু এইটা। আমাদের এখনকার সিচুয়েশনটারে যখন যুক্তি দিয়া ব্যাখ্যা করতে পারতেছি না আমরা তখন এইভাবে কেউ যখন একটা কাহিনি দিয়া ডিফাইনড কইরা দিতেছেন, সেইটা তো ভালো লাগে। মনেহয় দুনিয়াটা খালি ইউরোপিয়ান এনলাইটমেন্টের কলোনি না, আরো আরো টেরিটরি আছে। যারা যারা এইরকম ভাবেন না উনারাও এইরকম কেউ কেউ ভাবে বইলা আনন্দ পান মে বি।
‘অন্ধকারের হাতি’ নামে একটা কাহিনি লিখছেন রুমি (মানে, কাহিনিটা আরো অন্যান্য সোর্স থিকাও আমরা জানি), এইরকম: কয়েকজন হিন্দু লোক একটা হাতি দেখানোর লাইগা নিয়া আসলো একটা জায়গায় যেইখানে কেউ কোনদিন হাতি দেখে নাই। অন্ধকার একটা ঘরে যখন হাতিটারে দেখতে গেলো এক একজন, শুঁড় ধইরা কয়, এইটা তো পানির পাইপের মতোন; ঠ্যাং ধইরা কয়, এইটা তো মন্দিরের থামের মতোন, দাঁত ধইরা কয়, এইটা তো পোরসালিন দিয়া বানানো তলোয়ার (সে আবার খুশি হয়, এইরকম সুন্দর কথা কইতে পাইরা)… মানে, আমরা যট্টুক দেখি সেইটা দিয়াই পুরাটারে বুঝার কোশিশ করতেছি। কিন্তু যদি সবার হাতে একটা কইরা মোমবাতি থাকতো, যদি সবাই একসাথে অন্ধকার ঘরটাতে ঢুকতো, তাইলে আসল হাতিটারে দেখতে পাইতো।
তো, রুমি হইতেছেন একটা মোমবাতি। আশা করি উনার হাতিটারে দেখতে পারবো আমরা আবার, একদিন।
২.
এমনিতে কয়েকটা নিউজে দেখছি গত কয়েকবছর ধইরা রুমির কবিতা আম্রিকাতে বেস্টসেলার। অনেক মানুষ কিনেন, পড়েন। বাংলাদেশেও লালন, সুফীজম জিনিসগুলি পপুলার হওয়ার কারণে রুমির টেক্সটগুলি রিলিভেন্ট হয়া উঠার কথা। কিন্তু যেই জায়গা থিকা রুমি’রে সাবস্ক্রাইব করার প্রাকটিসটা আছে সেই জায়গাটাতে আমার কিছু অবজারভেশন আছে।
পয়লা জিনিস হইলো, ফিলোসফিক্যাল বেইজটা। রুমির কবিতার ফিলোসফি’টা তো ঠিক বস্তুর বিচার না; বরং বস্তুগুলি, ঘটনাগুলি ইশারা খালি, বিচার হইতেছে ভাব-এর। তো, বস্তুর এই দুনিয়ায় ভাব-এর কথা শুনতে তো ভালোই লাগে। মানে, বস্তুর যে মনোটনি সেইটা থিকা টেম্পোরারি ওয়ে-আউটই একটা। ফিলোসফিক্যাল আলাপ ঠিকাছে, কিন্তু সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নাই। এইরকম।
দুসরা হইলো, বলার ফর্মটা – কাহিনি দিয়া বলাটা। কাহিনিগুলির অথেনসিটি নিয়া কোন পেরেশানি নাই। অনেক সময় লজিক্যালও না। ঘটছে কি ঘটে নাই – সেইটা নিয়া কোন কথা নাই। কাহিনিগুলি ইটসেলফই হইতেছে প্রমাণ। এমনিতে যে কোন জিনিস কাহিনি দিয়া কইলে তো মোর কমিউনিকেটিভ হয়। যা কিছু ঘটে বা ঘটছে বইলা ভাবতে পারি আমরা সেইটা তো ট্রুথ একটা, এমনিতেই। অ্যাপিয়েরন্সরেই দেখতে হবে আমরার। কাহিনিটারে মেবি ন্যারেটিভ কইতে পারি আমরা এখন। তো, কাহিনিগুলিরে বলতে পারাটা দরকারি একটা ব্যাপার, ইন্টারপ্রিটেশন যা-ই হোক। কাহিনিটা হইতেছে গ্রাউন্ড, এই সেন্সে যে, একটাকিছু ঘটছিলো। ঘটনাগুলি যে ঘটতে পারতেছে – এইটারে ধারণার ভিতরে নিতে পারতে হবে. সাজেশনটা এইরকম। কোন ‘কারণ’-এর কারণে ঘটনা ঘটছে – এইরকম না, কিন্তু কোন ‘ঘটনা’ কোন না কোন ‘কারণ’রে স্পষ্ট করতে পারতেছে। এখন যেমন, একটা উদাহারণ হিসাবে একটা ‘ঘটনা’রে কওয়ার প্রাকটিস আছে, রুমি’র কাহিনিতে ব্যাপারটা একটু আলাদা; পয়লা কাহিনিটা আসে, আর তারপর এর যে থট – সেইটা; অনেকসময় আবছা রকমেরই। মানে, আমার রিডিংটা এইরকম। আর অনুবাদ বেশিরভাগ সময়ই আরেকটা রিডিং-ই।
তেসরা, এই অনুবাদ ব্যাপারটা নিয়া কথা বলা দরকার। এইটা বেশ মুশকিলের ঘটনা। ল্যাঙ্গুয়েজ ইটসলেফই তো একটা অনুবাদের ঘটনা। ঘটনাগুলিরে আমরা ট্রান্সলেট করে নিতেছি ভাষায়। তারপরে একটা ভাষা থিকা যে আরেকটা ভাষাতে নিতেছি, একটা কনটেক্সট থিকা আরেকটা কনটেক্সটে, একটা ফর্ম থিকা আরেকটা ফর্মে, এইভাবে ট্রান্সলেশনের ব্যাপারটা চলতেছেই থাকতেছে।
তো, এই টেক্সট নিয়া কয়েকটা জিনিস বইলা রাখাটা মনেহয় জরুরি:
১. এই লেখাগুলি ইংরেজি থিকা বাংলাতে করা। কিন্তু জালালউদ্দিন রুমি তো আর ইংরেজি’তে লেখেন নাই। লিখছেন পার্শিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেই। ওই কনটেক্সট’টা ট্রাভেল করছে ইংরেজিতে, ইউরোপিয়ান দুনিয়ায়; থটগুলি, টেক্সটগুলির এইরকম ট্রাভেলিং চলতেছে। রুমি হিমসেলফ অন্য অনেক কালচার থিকাই নিছেন কাহিনিগুলি উনার ল্যাঙ্গুয়েজে।
২. এই হিস্ট্রি’টা ভিতরে ভিতরে থাকেই, তো এর বাইরে অনুবাদ দুইটা ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যাপার। এইখানে দুইটা ভাষা জড়িত – ইংরেজি আর বাংলা; ইংরেজি পইড়া বুঝতে পারা আর সেইটারে বাংলায় বলতে পারাটা। কিন্তু বাংলা নিয়াই কিছু ‘ঝামেলা’ আছে। ল্যাঙ্গুয়েজরে একটা এক্সপ্রেশনের টুলের বাইরে এর পলিটিক্যাল জায়গাটা নিয়া কনশাস না হয়া থাকাটা তো আসলে সম্ভব না। যেইটারে ‘বাংলাভাষা’ বইলা জানি আমরা, সেইটাতে আমার ঈমান নাই। যার ফলে, কারো এক্সপেক্টশন যদি থাকে ‘ব্যাকরণ-মানা’ ‘সঠিক’ বাক্য দেখার, তাইলে হতাশ হইবেন। কারণ ‘ব্যাকরণ’ বা ‘ভুল-ঠিক’র জায়গাগুলি নিয়াই আমি বরং অনেকবেশি ডাউটফুল।
৩. অনুবাদে খালি ভাষাটাই না, টেক্সটের সাথে একজন রিডারের যোগাযোগ করতে পারা আর সেই পারসপেক্টিভ থিকা অন্য আরেকটা টেক্সটে হাজির করতে পারা এবং না-পারার ব্যাপারটাও আছে। মানে, কিভাবে কমিউনিকেট করতেছি বা করতে চাইতেছি, সেইটা ক্রুশিয়াল, এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা। এইটার উপরে বেইজ কইরাই একটা অনুবাদ অনেক সময় ওপেন করে টেক্সটারে, আবার লিমিটও কইরা ফেলতে পারে।
৪. রুমি বা কোলম্যান তো বাংলায় আইসা কথা বলেন নাই, আবার আমিও তাদের কথাগুলিরে টপকাইয়া গিয়া আমার নিজের কথা ঢুকাই নাই। কিন্তু আমি যেইভাবে এবং যতটুকু বুঝতে পারি তার নজির সবসময় এইখানে হাজির থাকে। এডওয়ার্ড সাঈদ তার বইয়ের অনুবাদের কথা বলতে গিয়া বোর্হেসের কথা মনে করছিলেন এইভাবে যে, এক একটা ভাষায় এক একটা অরিয়েন্টালিজমের জন্ম হইতেছে। তো, এই ফাঁদটারে অস্বীকার করার কোন মানে নাই।
৫. আর এই কারণে একটা অনুবাদ সবসময় সম্ভাবনা রাখে আরো ’ভালো’ হওয়ার, আরো রিলেট হওয়ার সমসাময়িক কনটেক্সটের সাথে। আরো ৫০ বা ১০০ বছর পরে এই বাংলা কেউ পড়তে পারবে – এইরকম আমার মনেহয় না। নতুন অনুবাদরেই দরকার পড়বে হয়তো তখন, যদি রুমির চিন্তার রিলেভেন্স থাকে।
৬. এমনিতে শব্দগুলি তো মিনিংয়ের ভিতরে আরো বেশি পিছলা; আরো বেশি কইরা কইলে, তারা তাদের হিস্ট্রিক্যাল মিনিংয়ের ভিতর আটকা, আরো কুঁকড়াইয়া থাকা, স্পেসিফিক হইতে চায়। আর অন্যদিকে, বলার মতো কথাগুলি নতুন মিনিংয়ের দিকেই যাইতে চায়, তখন কন্ট্রাডিকশনটা টের পাওয়ার কথা। পাঠকরে সর্তক করা আমার কর্তব্য মনে করছি, তাই এই কথাগুলি বলা।
সবশেষে, আমার না-পারাগুলি নিয়া খুববেশি টেনশন আমার নাই, কারণ আমি জানি, এর কোন লিমিট নাই। কিন্তু যেই একটা নির্দিষ্ট লেভল পর্যন্ত টেক্সট’টা ‘পারা’র মাত্রাটারে ফলো করতে পারে, সেই বিষয়ে আমি আরো কনশাস হয়া উঠতে চাই; যার ফলে এই অনুবাদটার আরো এডিট হওয়া পসিবল। যদ্দূর পর্যন্ত পারা গেলো, সেইটা একটা রিডিংয়েরই এক্সটেনশন, যার সাথে পরে হয়তো আরো জানা-বুঝা অ্যাড হবে, আরো সাবলীল হয়ে উঠতে পারবে টেক্সট’টা। আমার ধারণা, বাংলায় একটা টেক্সট হওয়ার পথে আরো কয়েকটা পর্যায় পার হইতে হবে, যার পুরোটা হয়তো এখনো আমার অ্যাবিলিটির মধ্যে নাই। আপাতত, আগ্রহ ও চেষ্টাগুলির প্রতিফলনটাই থাকলো। এই না-পারাগুলি হয়তো অন্য কাউরে ইন্সপায়ার করতে পারে আরো বেটার কিছু করার জন্য, সেই এক্সপেক্টশনটা তো থাকলোই। J
৩.
এমনিতে অনুবাদের সোশিও-পলিটিক্যাল কারণ তো থাকেই, এখন যেমন রিজনের দুনিয়াতে ফাটল ধরছে, আমরা বুঝতে পারতেছি; এক ধরণের সুডো আধ্যাত্মিকতাও ইমার্জ করতেছে, রুমির টেক্সট সেইখানে একটা ফুয়েল হিসাবে কাজ করতেছে। তো, অনুবাদের ভিতর দিয়া তাঁর চিন্তাটারে বাংলাভাষার ভিতরে ইনসার্ট করার একটা কোশিশ ছিলোই। এই টেক্সটের বেসিসে উনার চিন্তার আরো ডিটেইল ইন্টারপ্রিটেশন হয়তো পসিবল হইতে পারে। কিন্তু এর বাইরে রুমির কথাগুলিরে বাংলায় বলতে চাওয়ার ইচ্ছাটাই মেইন। অনেক সময় মনেহয় না যে, নিজের মতো কইরা বলি! তোমার কথাটাই আমি নিজের মুখ দিয়া বইলা দেই! মানে, কথা তোমার, আমি যে বলতে পারতেছি, এইটুক বলার ভিতর দিয়া যে থাইকা যাওয়ার মলিন একটা ইচ্ছা, এইটা মনেহয়, থাকেই। এইটুকই।
Leave a Reply