প্রথম প্রস্থ: গ্রন্থ-আলোচনা
আসলে একটা প্রকল্প হাতে নিছি। বইমেলায় যে বইগুলি কিনছি, তা পড়ে শেষ করবো আর সেইগুলি নিয়ে লিখবো ‘পাঠকের প্রতিক্রিয়া’; যেহেতু পাঠক, তুমিই গুরু। শেষ নিষ্ঠা, লেখকের! [pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]
খুব আগ্রহ নিয়াই কিনছি, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘রঙিন চশমা’; কারণ স্মৃতিকথা আমার প্রিয়। প্রিয় আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। অবসর সময়ের রিডিং। সাবজেক্ট নিজে তার সর্ম্পকে বলছে! কী রকম একটা গূঢ় অভিব্যক্তি। মানুষ কখন বলে এইসব কথা, কেন মনে করে যে বলাটা জরুরি? এই জীবন-যাপন, কোনকিছু স্বীকার হঠকারিতা? আমি অনুভব করতে চাই সেইটা। সবগুলি একইরকম হয় না। অনেকগুলি ফাঁকি থাকে। অনেক বিস্মরণ থাকে, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত; থাকে বাছাই করা, অগূঢ় সেইসব জিনিস; একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়। তারপরও আমার আগ্রহ কমে না। মানুষ আসলে কী স্বীকার করতে চায়? কোন কথাটা সে বলতে চায়, নিজের সর্ম্পকে? কোন কোন ঘটনা? কোন কোন সত্যিগুলি, সে মনে করে যে তার নিজস্ব? যা-ই হোক, তা মানুষের বিবেচনা, যিনি লেখেন, লেখক, তার। আমি পাঠক, উছিলামত্র। সেইটা পড়তে বসি।
কিন্তু আমার আগ্রহ থেমে আসে, মাঝ পথে গিয়া। আমি ক্লান্ত হয়া পড়ি একসময়। মনে হয় আগেও হয়তো পড়েছিলাম, হয়তো কোথাও ছাপা হয়েছিল কয়েকটা, মানে বেশিরভাগই। কিন্তু একটানে পড়া হয়ে যায়। একটা আবেগী হিন্দি ছবি দেখার মতো এই বই পড়া, একটাই অনুভূতি খালি মনে লেগে থাকে। একটা শ্লেষ, অনেকটা আক্ষেপের মতো একটা কথা যে, তিনি যদি সত্যিকারের সাহিত্যিক হতেন তাহলে তিনি তার বাবাকে নিয়ে একটা বই লিখতেন, তিনি সাহিত্যিক না বলেই বানিয়ে বানিয়ে মহাজাগতিক আগন্তুকের গল্প লিখেন। এইরকম একটা স্বীকারোক্তি। কথাটা সত্য বা মিথ্যা এইরকম না, কিন্তু কথাটার ভিতর কেমন একটা প্রাণের অস্তিত্ব টের পাই। মনে আছে, মার্ক শাগালের আত্মজীবনীর ভিতর একটা জায়গায়; সে বলতেছিলো যে, এর পরের লেখাগুলি আমার নিজের জন্যে লেখা; তারপর, মা’র কথা বলে কাঁদতেছিলো, লোকটা। আমার মনে হয়েছিল যে, ওই কথাগুলা বই থেকে বের হয়ে পাঠকের পাশে বসে আছে। কান্নার শব্দগুলি শোনা যাচ্ছিলো, তখন। এই এত দূরে বসেও। এইরকম মোহময়তা!
আসলে একটা বই। তার ভালো বা খারাপ। উন্নত বা অনুন্নত। কী-ই বা বিচার হয়! পাঠক হিসাবে আমি কোন কাঠগড়া দাঁড় করাইতে পারি নাই। মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনেক লেখা চোখে পড়লে, দেখি। অনেক সময় পড়ি। অনেক সময় পড়ি না। কী যায় আসে তাতে! সাহিত্যিক হওয়া তাঁর লক্ষ্য না, এই কথা উপলদ্ধি করি আমি।
দ্বিতীয় ইস্যু: ব্যক্তিসত্তা, লেখক ও রাজনীতি
কথা হচ্ছিল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সঙ্গে। প্রসঙ্গক্রমে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি ছাত্র এবং তার বিবেচনার বিষয়, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনীতি ও তাঁর শিক্ষাজীবন। কিন্তু তাঁর বিবেচনায় উপস্থিত সবাই কিছুটা বিমূঢ়, অস্থির। কারণ তাঁর ক্লেইম কিছুটা ভিন্ন। তিনি মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে দোষী বলে সাব্যস্ত করেন। তিনি বলেন যে, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষক রাজনীতি চালু রাখেন, তার নীতি, আর্দশ ও ন্যায়বোধের জন্য ছাত্রদের শিক্ষাজীবনকে দীর্ঘায়িত করেছেন, ইত্যাকার।
সে আরো বলে যে, তাঁর আশ্চর্য লাগে, লেখক হিসাবে তিনি বইমেলায় কতোটা বিখ্যাত তা দেখে, রাশি রাশি অটোগ্রাফশিকারি সেই লেখকের পাশে, যিনি শিক্ষক, অথচ ছাত্রদের স্বার্থ দেখেন না, দেখেন খালি তার নিজস্ব রাজনীতি, ন্যায়বোধ ও বিবেচনা। মানে, হয়তো সে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের রাজনীতির অনুগ্রাহী না, এইটা সে হইতে পারে। কিন্তু লেখক হিসাবে জনপ্রিয় দেখতে পারাটারেও সে অন্যায় মনে করতেছে।
তাঁর এই শেষ কথায় আমি আরেকবার উপলদ্ধি করি যে, যিনি লেখক, তিনি একজন ব্যক্তিসত্তা। তাঁর যে রাজনীতিবোধ, সেইটা অগ্রাহ্য না, লেখার পাঠে ও বিবেচনায়। একজন লেখক হচ্ছেন সমগ্র; ভঙ্গুর ব্যক্তিত্ব এবং অপর্যাপ্ত রাজনীতির সমীকরণ, কখনো কখনো।
রঙিন চশমা।। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল।। ফেব্রুয়ারি, ২০০৭; প্রতীক।।
রাজশাহী,
২২/০৩/০৭.
Leave a Reply