এতোদিনে মনেহয় ট্রেন্ড’টা একটু ঠান্ডা হইছে, তারপরেও ডরে ডরে বলি, পান্তা-ভাত আমার পছন্দের জিনিস ছিল না কখনোই। 🙁 (ঢাকা শহরে ‘ফ্যাশন’ হয়া উঠার পরেও।) গরম ভাতই আমার পছন্দের জিনিস। ভাত ঠান্ডা হইলেই খাইতে ভাল্লাগে না। ভাত হবে গরম-গরম, ভাপ উঠা, ধোঁয়া বাইর হইতেছে, এইরকম। আলু-ভর্তা খাইতে ভাল্লাগে ডাল বা লগে একটা কিছুর ঝোল দিয়া। পেঁয়াজ-মরিচের ভর্তাও আমার পছন্দের জিনিস। ভাজা-মাছও। তবে মাছের ঝোল বেশি পছন্দ। মানে, খাওয়ার তো শেষ নাই দুনিয়ায়। কম-বেশি সব খাবারই ভালো।
আগের দিনের রাতের ভাতরে ‘পান্তা’ না বানায়া বরং হলুদ-পেঁয়াজ-কাচামরিচ দিয়া একটু তেলে ভাইজা বানানো “ডিম-ভাত” নাশতা হিসাবে বেশি পছন্দ আমার। ভাতেরও তো কয়েকটা পদ হয় আসলে। পান্তা-ভাতের চাইতে জাউ-ভাত বেশি খাইছি। আম দিয়া, দুধ দিয়া। একটা রেস্টুরেন্টে (Thai Emerald-এ মনেহয়) আমের সাথে জাউ-ভাত দিয়া মজার একটা ডেজার্ট খাইছিলাম। খুদের চাল (চাল ঝাড়ার পরে যেইটা থাকে, সেইটার কথা বলতেছি আসলে) দিয়া মাটির চুলাতে পোড়া-পিঠা বানায়া মাঠা দিয়া, দই দিয়া খাইছি। চিটাগাংয়ে ভাতের হোটেলে গেলে, বসার লগে লগেই জিগাইতো, সিদ্ধ না আতপ? সিলেটের আখনি যে খিচুরি না এই ডিফরেন্সও তো জানছি খাইতে খাইতেই। খিচুরিও লেটকা’টাই (ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট ছাড়া আর কেউ বানায়া না মনেহয়) বেটার শুকনাটার চাইতে। পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি যে আলাদা আলাদা জিনিস, এইটা বুঝানোটাও তো টাফই আসলে।
তো, ভাত যে একটা জাতীয়তাবাদী ঘটনা – এইটা সবচে বেশি মিসিং মনেহয় বাংলাদেশের “আর্ট-ফিল্মগুলাতে”। 🙂 (আমার ভুল হইলে কেউ বইলেন, কোন সিগনিফিকেন্ট সিনের কথা।) [কারণ, যা কিছু ফরেন, তা-ই ‘আর্ট’ আমাদের কাছে! ভাত খাওয়া যেহেতু লোকাল জিনিস, এতোটা আর্ট হইতে পারে না। এখন হইতে পারবে হয়তো কিছুটা, অস্ট্রেলিয়া থিকা সার্টিফিকেট পাওয়ার পরে।] আমজাদ হোসেনের একটা সিনেমা আছে “ভাত দে”, রিমার্কেবল; জাফর ইকবাল আর ববিতার একটা সিনেমা আছে, জাফর ইকবাল হোটেলে ভাত চুরি করতে গিয়া “গণপিটুনি” খায়; “আম্মাজান” সিনেমাতেও মনেহয় ভাত খাওয়ার একটা ঘটনা আছে; মানে, এফডিসির সিনেমাগুলাতে দেখবেন, লোকজন ভাত খাইতেছে। কয়দিন আগে দুইটা বাংলা-সিনেমা দেখছি – ‘ডুব’ আর ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’; ডুবে মনেহয় টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত পাঠায় বউ আর প্রেমিকা, লাইভ ফ্রম ঢাকা’তে পরোটা ভাজে নাশতার, ভাত খাওয়ার কোন ঘটনা নাই (মানে, মনে নাই আর কি আমার)। এইখানে আমার পছন্দের উদাহারণ হইতেছে ওং কার ওয়াই, ইন দ্য মুড ফর লাভে অরা খালি নুডুলস আনতে যায় নুডুলসের দোকানে; হ্যাপি টুগেদারেও রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া আছে অনেক।…
যা কিছু আমরা করি, তারে ‘মহান’ বা ‘স্পেশাল’ বানানোর দরকার নাই; কিন্তু ভাত যে খাই আমরা, সেইটা যখন অন-ক্যামেরা বা পাবলিকলি বলতে শরম পাই, তখন সেইটা কম-বেশি হইলেও একটা ট্যাবু’র ঘটনা; তো, অইটা ঢাকতে গিয়া প্রাউড ফিল করাটা জরুরি না (পাদের গন্ধ ঢাকতে গিয়া বিলাই’রে দৌড়ানি দেয়ার মতো)। ভাত খাওয়া যে ভাত খাওয়ারই একটা ঘটনা – এইটুক বলতে পারলেই হয় আসলে।
এখন বলা’টা অনেক সহজ ব্যাপার মনে হইতে পারে। কিন্তু ট্রাই কইরা দেখেন, গল্পে-কবিতায়-সিনেমায় একটা সহজ-সাধারণ-স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে বলতে, পারবেন না এতোটা; অনেক ফুলায়া-ফাঁপায়া, রোমান্টিকতা দিয়া, গরিবি দিয়া না মাখায়া বলতে পারবেন না। ভাত-খাওয়ার ব্যাপারটারে আমাদের আর্ট-কালচারের ভিতরে ‘নরমাল’ ঘটনা বানাইতে পারি নাই আমরা। কারণ তাইলে সেইটা ‘আর্ট’ হইতে পারে না! যা-ই হোক, বাংলাদেশের নায়ক-নায়িকারা ভাত খাইতে গিয়া আগে যেমন ‘আন-স্মার্ট’ হয়া যাইতেন, এখন ‘প্রাউড’ ফিল করতে থাকলেও আরেক কেলেংকারিই হবে সেইটা। 🙁
তারচে বড় কথা, বাংলাদেশের মানুশজন ‘জাতীয়তাবাদী চেতনা’ ছাড়াও এতোদিন যে ভাত খায়া আসতে পারছে, সেইটা যেন খাইতে পারে, তিনবেলা। ভাতের কষ্ট যেন কাউরে না দেয় আল্লা।
Leave a Reply