অ্যা জার্নি বাই বাস

নারীর প্রতি নন-ভায়োলেন্স এবং একটা অ-পরিচয়ের ঘটনা

গত রোজার ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময়ের ঘটনা। ৭০ কিমি’র রাস্তা। ঈদের দুইদিন আগে দুপুরের পরে মহাখালী থিকা বিআরটিসি’র এসি-বাস সার্ভিসের ঢাকা-কিশোরগঞ্জের একটা বাসে উঠছি, যাবো ভৈরবে। রাস্তা-ঘাট মোটামুটি ফাঁকা, কিন্তু বাসে মানুষ থইথই।

যেহেতু আমি একা, আমার খালি দেখা।

দেখলাম, স্কিনি একটা মেয়ে, জিনস-পড়া, ফতুয়া; কাঁধে ব্যাগ, কানে হেডফোন। আমার একটা রো পরে, বামপাশে বসলেন এবং আরেকটা সিট-দখল করলেন। কিছুক্ষণ পরে তার মোটা প্রেমিক আইসা বসলো। তেমন কোন কথা নাই। তবে বোঝা গেলো প্রেমিক ঢাকায় থাকেন বা থাকবেন, প্রেমিকারে নরসিংদীতে নামাইয়া দিতে আসছেন। অথবা এই ভ্রমণের নৈকট্য তারা চাইতেছেন। মেয়েটা ‘ভোকাল’ এবং বাস ছাড়তে যখন দেরি হইতেছে তখন তিনি কাউন্টারের লোকদেরকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ ডাকার এবং ‘থাপ্পর দেয়ার’ প্রস্তাব রাখতে পারছেন। উনার প্রেমিক, এতে সম্মতি দিছেন এবং এই ফিলটা দিছেন যে উনি এই ‘পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী। এই প্রেম, ভায়োলেন্স আমার ভালো লাগলো, কারণ আমি বাড়ি যাইতে চাই দ্রুত। কিন্তু আমি তখনো বুঝতে পারি নাই যে এইটাই একমাত্র ভায়োলেন্ট ঘটনা, নারী’র দিক থিকা। বাকি সব-ই পুরুষের নন-ভায়োলেন্স; এবং নিশ্চিতভাবেই ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ বন্ধের যে প্রচার তার কিছু মিনিমাম অ্যাচিভমেন্ট।

টিকিট কাটা সহজ ছিল মোটামুটি।বাসও চইলা আসছিল আধঘণ্টার মধ্যেই। সিটও পাওয়া যাচ্ছিলো বসার জন্য। কিন্তু সিটগুলা খুবই ছোট। ছোট ছোট দুইটা মেয়ে নিয়া বোরকা পড়া একজন মহিলা এবং একজন কিশোরী উঠলেন। তিনজন পাশাপাশি বসতে পারলেন, আমার দুইটা রো আগে। কিন্তু আরেকজনের ত জায়গা হয় না; মাঝখানের রো’তে তিনটা কিশোর ছেলে বসা। ওরাও উঠবো না। তাই ছোট’র মধ্যে যে বড় মেয়েটা, শে বসলো আমার পাশে।[pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

মা, মেয়ে বসার পরে আরেকজন ছোটমেয়ে দাঁড়াইয়াছিলেন, তখন একজন বসতে চাইলেন তাদের পাশে; তিনিও মেয়ে, কিশোরীর চাইতে একটু বড়। কিশোরী মেয়েটা একটু কনফিউজড ছিলেন মনেহয়, ঢাকা শহরেই থাকেন; হয়তো ভাবলেন যে, শহরে ভদ্রতা প্রদর্শন ত বাধ্যতামূলক অথবা তাঁর বয়সজনিত দুর্বলতা থাইকাও থাকতে পারে। যা-ই হোক, এর সুযোগ নিয়া অন্য নারী বইসা পড়লেন। আর কিশোরী মেয়েটার ছোটবোন দাঁড়ানো তখন।

তখন একজন মোটাসোটা লোক তেড়ে-ফুঁড়ে এই সিটের দিকে আসতে থাকলেন এবং কিশোরী মেয়েটার সামনে আইসা তারে এমনভাবে ধমকাইলেন যে,  আমার বড় মেয়ে’র কথা মনে পড়লো, কারণ তার সাথে আমিও এমনভাবে কথা বলি প্রায়ই এবং এইকারণেই বুঝতে পারলাম যে, তিনি পিতা। যা কইলেন, তার সামারী করলে দাঁড়ায়, সবচে’ ছোট মেয়েটার জন্যও তিনি টিকেট কাটছেন, সুতরাং তারে সিটে বসতে না দিয়া কিশোরী মেয়েটা অন্যরে কেন বসতে দিলো; তারে দিয়া কিচ্ছু হবে না, বেকুব, অকর্মা, কিছুই করতে পারে না, ইত্যাদি, প্রায় মিনিট দুয়েক, একটানা… কিশোরী মেয়েটার চোখ দুইটাতে পানি টলমল; শে আর কিছুই বলতে পারে না! আমি মনে মনে আমার বড় মেয়ে’র কাছে মাফ চাইয়া নিলাম। পাবলিকলি বাপগিরি দেখানোটা আমিও সম্বরণ করতে পারি না। অন্য মেয়েটা তখন উইঠা দাঁড়াইলো।

কিন্তু তার পেরেশানি’র তখনো অনেক বাকি।বাস ছাড়তে দেরি হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়া জানা গেলো, বাসে যতজন মানুষ, টিকিট পাওয়া গেছে তার চাইতে একটা কম। শেষে জানা গেলো, এইজনই সেই মেয়েটা। শে বললো যে, তাঁর জামাই এয়ারপোর্ট থিকা উঠবো, সে-ই টিকিট কাটবে দুইটা এবং বাসের লোকজনের সাথে এমনটাই কথা বলা আছে। পরে মোবাইলে সেই রেফারেন্সে ফোন দিয়া সেইটা কনফার্ম করা গেলো এবং বাসটা ছাড়তে পারলো। কিন্তু ততক্ষণে সেই মেয়েটা, গণশত্রু। আমি ভাবতেছিলাম, কেন জামাই টিকিট কাটার টাকা বা দায়িত্বটা বউ’রে দিলো না?হইতে পারে যে, তার কাউন্টারে পরিচিত আছে, টিকিট কাটা লাগবো না; কিন্তু বউয়ের এই অস্বত্বি সে কি ভাবতে পারে নাই? নাকি চিন্তাই করে নাই?

কিন্তু এইটাই শেষ না, টেরিবল ঘটনাটা সবসময় ঘটে সবার শেষেই।আমি এবং সম্ভবত আরো অনেকেই অবাক হইতেছিল যে, আমার সামনের সিটের তিনটা কিশোর ছেলে কেন আমার পাশে বসা বাচ্চা মেয়েটারে তার মা-বোনের কাছাকাছি বসতে দিতেছে না, একজন পিছনে আইসা। আমি জিজ্ঞাসা করার পর একজন কইলো যে, ওরা সিট-দখলকারী মাত্র। আসলে তার বন্ধুর বোন এবং হাজব্যান্ড উঠবে নিকুঞ্জের স্টপেজ থিকা; তার বন্ধুর বোনের কয়েকদিন আগেই বাচ্চা হইছে, টেইক কেয়ার করার জন্য একসাথে বসা দরকার।একটা সিট ছাড়া সম্ভব না।

তো, উনারা উঠলেন – জামাই এবং তার বউয়ের কোলে তোয়ালে জড়ানো বাচ্চা, বউয়ের মা এবং তাঁর ভাই। তিনজন সামনের সিটে এবং বউয়ের বাচ্চা ভাই (৬/৭ বছর হবে) আমাদের রো’তে। জামাই খুবই জলি মানুষ। আশেপাশের অনেকের সাথেই কথা বলতেছেন, হাসি-ঠাট্টা করতেছেন, আমার সাথেও কথা হইলো। একটু বসেন, আবার উঠে দাঁড়ান; শাশুড়ি এবং বউ’রে কমর্ফোট দেয়ার জন্য। এই প্রথমবারই মনে হয় কিশোরগঞ্জ যাইতেছেন, কারণ একটু পরে পরেই জিগাইতেছিলেন, এইটা কোন জায়গা – এইরকম। খুবই সোবার একজন মানুষ।

কিন্তু একটা জায়গাতেই খটকা লাগতেছিল, কারণ বউ’টা খুবই চুপচাপ। জামাই চুটকি বলেন, কিন্ত বউ হাসেন না। কইলেন, এইদিকে তাকাও; শে তাকায় না। বাচ্চা কানলে বউ’রে ধমক দেন যে এইভাবে না ওইভাবে কোলে নেও, বউটা তারপরেও কথা বলেন না। একস্ট্রিম ব্যাপার হইলো, ইফতার যখন আইনা দিলেন, তখন শে শোনাই যায় না প্রায় এমন ভাবে কইলো যে, শে খাবে না। এই দুর্বিনীত-ভাব জামাই আর মানতে পারলেন না; বউয়ের গাল ধইরা চিপা দিয়া ঠোঁট ওপেন কইরা খাওয়াইতে চাইলেন এবং না-পাইরা শাশুড়ির কাছে বিচার দিলেন; ‘দেখেন, আপনার মেয়ে’র অবস্থা!’

আমি ভাবতেছিলাম, শাশুড়ি’র কী অবস্থা! মিনতিই করলেন একরকম যে, বাদ দেও বাবা! জামাই রাখলেন শাশুড়ির কথা উইথ অ্যা স্টেটম্যান্ট যে, শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছাইয়া উনি এর একটা বিহিত করবেন, এই অপমানের!

পুরুষের অপমানবোধ খুবই ভয়ঙ্কর একটা জিনিস ।

ভেলানগর থিকা দেখলাম, তাপস উঠলো বাসে। হাইস্কুলে একসাথে পড়তাম আমরা। আমাদের স্কুলটিচার জোৎস্না আপার ছেলে তাপস। আমারে চিনলো না। জগন্নাথপুরে নাইমা গেলো।

আমি ভাবতে পারলাম যে, অ-পরিচয় খুব একটা দূরের কোন জিনিস না।

 

ভাদ্র ২০, ১৪২০

Leave a Reply