১.
ডাক্তার সুমনরে রিপোর্টগুলা দেখাইয়া শুভ্র’র লাইগা ওয়েট করতেছিলাম। দুইবার মোড়ের সামনে দিয়া হাঁটাহাঁটি করলাম। বিকালবেলায় কিছু খাই নাই, খিদাও লাগতেছিল। মোড়ে একটা চটপটি ফুচকা’র দোকানের সামনে দিয়া একবার ঘুইরা গেলাম। একটা কাপল বইসা খাইতেছিল। প্রথমে ভাবলাম যে, খাবো না। পরে ঘুইরা আইসা ভাবলাম, খাই। ত্রিশ টাকা প্লেট। দশটার মতো ওঠে পার প্লেটে।[pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]
একজন নারী তার মে’রে নিয়া যাইতেছিল পাশের রাস্তা দিয়া, শে ফুচকাওয়ালারে কইলো আমাদের জন্য একটা চটপটি বানান, কম ঝাল দিয়া। শি ওয়াজ স্পন্টিনিউয়াস। এইদিকেই মনেহয় তার বাসা। এইখানে হয়তো শে ফুচকা-চটপটি খাইতে আসে। এই অর্ডার দেয়া ভাল্লাগলো আমার। আমার ফুচকা রেডি হওয়ার পরে দাঁড়াইয়া খাইতেছিলাম। একটু পরে শে আইসা বসলো। মনেহয় পাশের দোকানে গ্রোসারি কিনতে গেছিল। কইলো, এখনো বানান নাই! ফুচকাওলা বানাইতে শুরু করলো তখন চটপটি। মা-মে প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে বইসা গল্প করতেছিল। আমি সিচুয়েশনটা ভাবার চেষ্টা করলাম। হোমওয়ার্ক করতে বসার আগে মে’রে হয়তো শে বলছিলো, তাড়াতাড়ি হোমওয়ার্ক শেষ করতে পারলে তারে চটপটি খাওয়াইতে নিয়া যাবে; মানে তার নিজেরই হয়তো একটু ইচ্ছা করতেছিল। হয়তো জামাই বাসায় আসতে আসতে দশটা। এই সময়টা, সন্ধ্যাটা মে’রে নিয়া নিজের সাথে ঘুরলো একটু শে। এই অবসরটা ভাবতে পাইরা ভাল্লাগলো আমার।
খিদা যেহেতু লাগছিল, তাড়াতাড়িই খাইতে পারলাম আমি দশটা ফুচকা। খারাপ না জিনিসটা। প্লেট দেয়ার পরে ফুচকাওলার কাছে হাত-মোছার টিস্যু চাইলাম। ফুচকাওয়ালা ইয়াং একটা ছেলে। টিস্যু আলাদা করতে গিয়া একটু ঝামেলায় পড়তেছিল সে, আলাদা করতে পারতেছিল না ডাবল লেয়ারটারে। বেশ একটু সময়ই লাগলো। এইটা দেইখা শে কইলো, দোকান থেকে টেবিল টিস্যু কিনে ওইটা ছুরি দিয়া দুইটা স্লাইস করে নিবেন; তাইলে সমস্যা হবে না খুলতে, সেভও হবে আপনার। তার এই বুদ্ধিতে আমি খুবই ইমপ্রেসড হইলাম, ফ্যামিলির খরচের কতো টাকা না জানি বাঁচায় শে; আমার বউও এইরকম করে, আর এই সেভিংসগুলার কারণে আমি একটু উল্টা-পাল্টা খরচ করতে পারি, যেমন এখন ফুচকা খাইতে পারলাম। আমি যে খুব ইমপ্রেসড হইলাম এইটা শো করলাম না আমি। কিন্তু ব্যাপারগুলা এতোটাই ইনটিমেট যে, বোঝা যায়। আমরা বুঝতে পারতেছিলাম, কিন্তু আমরা বুঝতে দিতে চাইতেছিলাম না নিজেদেরকে। আমি তারে আমার অনুমানের ভিতর নিতে পারতেছিলাম তার হাসি, তার মে’র সাথে কথা, বইসা থাকা, এই সন্ধ্যাবেলা এইসবকিছু দিয়া।
শুভ্র’রে ফোন করলাম আবার। ও আসলো। আমরা কথা বললাম। মা-মে চটপটি খাইতেছিল একটা বাটি থিকা। ওরা আরেকবার নিলো। মে’টার চোখে ভারী চশমা। মা’র চুল ছোট। কালোচুলে নীল ব্যান্ড বাঁধা। আমি আর তাকাইলাম না। ওদের অস্বস্তি লাগতে পারে ত! হাসিহাসি মুখ মুইছা গেলে আমারও ত ভাল্লাগবো না। রিকশা নিয়া চইলা গেলো ওরা আমরা যাওয়ার আগেই।
আমি ভাবলাম, এইরকম সন্ধ্যায়, মা-মে মিইলা মোড়ের দোকানে চটপটি খাইতে যাওয়া কতো আনন্দের একটা ঘটনা! বাপ যেই ব্যাটা, সেই শালা জানতেও পারবো না।
২.
রাত সাড়ে নয়টা বাইজা গেলো বাসায় ফিরতে ফিরতে; তারপরও ভাবলাম যে না, হাঁটতে যাওয়া দরকার। রাতে অনেকক্ষণ টাইপ করার কাজ করা লাগবো, একটু হাঁইটা আসলে এর্নাজি পাওয়া যাবে। আর বুটের ডাল কেনা দরকার; গরুর মাংস দিয়া কাবাব বানানোর লাইগা লাগবে, যেইটা বার্গারবানের ভিতরে দিয়া বার্গার বানানো হইলে মে স্কুলে টিফিন নিয়া যাবে। হাঁইটা আসার পথে মেহেদী মার্ট থিকা নিয়া আসা যাবে।
হাঁটলাম। বুটের ডাল কিনলাম। ভাবলাম যে, আর না হাঁইটা রিকশা নিয়া নেই। রিকশাওলা জিগাইলো গেইটে যাবো নাকি। কইলাম যে, না সি-ব্লকে যাবো। সে রাজি হইলো। বাবাসার দিকে যাইতে থাকলাম।
বাসার কাছকাছি আসার পরে, রিকশাওলার মোবাইল ফোনটা বাইজা উঠলো। রিং-টোন’টা বেশ আনকমন। একটা বাচ্চা মে’র গলার আওয়াজ; বলতেছে, বাবা ফোনটা ধরো না, ও বাবা, ফোনটা একটু ধরো না; বাবা ফোনটা ধরো… মনে হইলো টিভি নাটক থিকা এই আওয়াজ আসতেছে। বাবা যেহেতু রিকশা চালাইতেছিল, উনার লুঙির ভাঁজ থিকা মোবাইলটা বাইর কইরা রিসিভ বাটনটা চাপ দেয়াটা কঠিন হইতেছিল। উনার যে কল আসছে, এইজন্য উনি রিকশা থামাইতেও রাজি ছিলেন না। ভালো সমস্যাই হইতেছিল। তো, যেহেতু উনি গরিব, সৎও মনেহয়; আর এই সততা ধইরা রাখার লাইগা কাজে এইটুক গাফিলতিও করতে চান না।
সময় লাগলেও কলটা রিসিভ করতে পারলেন উনি। মনেহয় মে’রে দিয়া বউ-ই কল দেয়াইছিল। বাবা বলতেছিলেন এইদিকে যে, আসতেছি, লাস্ট ট্রিপ নিছি; নামাইয়া দিয়াই আসতেছি বাসায়। বেশ লজ্জাও পাইতেছিলেন মনেহয় রিকশা চালানোর সময় এই পারিবারিক কথা-বার্তায়; কারণ এইগুলা ত ড্রয়িংরুমে বইসা বলা যায় বা অফিসে বইসা; রিকশা চালাইতে চালাইতে বলাটা কেমন না! যে বলবো, যে দেখবো (এবং যে পড়বো এই লেখাটা, তার লাইগাও ত) সে ত এইটার কোন রিলিভেন্ট ইমেজই খুঁইজা পাইবো না, কেমনে ইমাজিন করবো সে যে, একজন রিকশাওলা, লুঙি-পরা, তার বউ আর মে তারে বলতেছে সাড়ে দশটা বাজে, বাসায় চইলা আসো!
যেহেতু রাত, আশেপাশে তেমন কোন শব্দ নাই, মোবাইল ফোনে ওইপাশের কথাও শোনা যাইতেছিল একটু একটু। বাবা বলতেছিলেন; না, না, বাসার কাছে না; সি-ব্লকে… আচ্ছা, ঠিক আছে… আসতেছি… রাখি…। কিন্তু ওইপাশ থিকা ফোনটা রাখতেছিল না। এই দূর এবং দূর থিকা কথা-বলা এনজয় করতেছিলেন উনারা।
আমার বাসা চইলা আসাতে, রিকশাওলারে থামতে বললাম আমি। উনার কলটাও কেটে দিছিলেন উনি। আমি ভাবলাম, মে’টা মনেহয় স্কুলে পড়ে। পড়াশোনা শেষ করছে শে। খাওয়া-দাওয়াও। ঘুমানোর আগে বাপ’রে দেইখা তারপরে ঘুমাবে। যদিও ঘুম আসছে তার। বাপ’রে না দেইখা শে কেমনে ঘুমাবে!
৩.
রাতে একটা জোনাক-পোকা ঢুকছিল আমাদের ঘরে। যখন লাইট জ্বালানো ছিল ব্যাপারটা বোঝা যায় নাই। লাইট অফ করার পরে দেখা গেলো। পয়লা মনে হইতেছিল কোন লাইটের সুইচ হয়তো অফ করা হয় নাই। কিন্তু জোনাক-পোকাটা ঘুরতেছিল। খুবই ধীরে ধীরে। একটু একটু কইরা সরতে সরতে দরজার ফাঁক দিয়া আরো অন্ধকারের দিকে চইলা গেলো।
৪.
সকালে অফিসে যাওয়ার পথে কয়েকটা স্কুল পড়ে, পাড়ার ভিতরেই। বি-ব্লকে আর সি-ব্লকে। স্কুলগুলা আসলে ফ্ল্যাটবাড়িই। প্রি-স্কুল টাইপ। প্লে-গ্রুপ থিকা ক্লাস ফাইভ। গ্যারেজে প্লে গ্রাউন্ড আর বাসার ভিতরের ঘরগুলাতে ক্লাসরুম। প্যারেন্টদের বসার জায়গা নাই। একটা স্কুলের সামনে সিমেন্টের উচাঁ জায়গা করে দেয়া, গেইটের পাশে। ওইখানে তিনজন নারী বইসা আছেন। দুইজনে কথা বলতেছেন। তেসরা যিনি, সরে বসা, একটু পিছনে। একটা পা ভাঁজ করা। চোখের দিকে তাকাইয়া ঝলসাইয়া গেলাম আমি। কী যে একটা খারাপ-লাগা! কী যে একটা না-পারা! শে জানি নাই, এই বইসা থাকায়। থাকতে চায় না শে আর এই সকালবেলায়। এমন না যে শে উইড়া যাইতে চায়। শে জাস্ট ফিল করে এই যে সকালবেলা, এইটা আর এগজিস্ট করে না কোনভাবেই। আমার মনেহয়, তার যে চোখ, তার ভিতর শে আর নাই, আমিই বইসা আছি। বলতেছি, হায় হায়, এইরকম ভাবনা আমরা কেমনে ভাবি, কেন ভাবতে চাই?
অক্টোবর ১৫, ২০১৪।
Leave a Reply