গল্প-লেখকের স্বপ্ন

 

একটা উপন্যাসের দুইটা চ্যাপ্টার লিইখা বইসা আছি। স্কেলিটন’টা দাঁড়া করানো গেছে মোটামুটি। আরেকটু হয়তো কাজ করা লাগবে। এমনিতে থিমটা মোটামুটি দাঁড়াইছে। কিন্তু যেইটা সবচে ভালো হইছে, সেইটা হইলো নাম’টা। দুর্দান্ত রকমের পছন্দ হইছে। যে কারোরই পছন্দ হবে। যে কারো বলতে অবশ্যই লেখক-ইন্টেলেকচুয়াল সমাজের লোকজন। সবাই মোটামুটি টাস্কি খায়া যাবে। মানে, নামেই উপন্যাসের অর্ধেক কাজ শেষ।

মুশকিল হইলো, আর লেখা হইতেছে না। একটু একটু লেখি। আগাইতেছে না। এইজন্য ভাবলাম, কয়দিন লেখালেখি বাদ দিই। একটু ঘুরাফিরা করি। এখন স্বপ্ন যেহেতু, যে কোন জায়গাতেই ত যাইতে পারি। এইরকম একটা ফ্রিডম, ফুরফুরা ভাবে রাস্তায় হাঁটতেছিলাম। তখনই সমস্যাটা টের পাইলাম। যেহেতু জিনিসটা স্বপ্ন; এইটাতে আমার খুব একটা কন্ট্রোলও নাই। ঘটনা সবসময় সামনেই চলে না, ব্যাকওয়ার্ডেও যাইতে থাকে। এই অস্বস্তি থিকাই হাসান আজিজুল হক আসলেন বাসায়। আসলেন মানে তিনি ছিলেনই।

স্বপ্নে তিনি ভিজিবল হইলেন আর কি। শাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা। চোখে চশমা, মুখে রাঢ়বঙ্গের মফিজ হাসি। বুকের লোমগুলাও শাদা। পায়রা না হইলেও শান্তির প্রতীকই ভাবা যায়। কিন্তু শান্তি’র অপজিটে ত যুদ্ধ থাকে; মানে, যুদ্ধ না থাকলে ত কারো শান্তি’র কথা মনে করার কথা না। এইরকম বাজে ভাবনা হইলো যে, যেহেতু শান্তি আছে; যুদ্ধও আছে কোথাও না কোথাও আশেপাশে। এইটা না থাকলে আলাদা কইরা শান্তি থাকার কোন কারণই নাই।

হাসান আজিজুল হক এখন রিটায়ার্ড লাইফ পার করতেছেন বইলা সমাজের জীবন-যাপনের সাথে উনার যোগাযোগ কইমা গেছে। এর ওর বাড়িত থাইকা, সোশ্যাল লাইফ ফিল করার চেষ্টা করেন এবং সামাজিক গল্প লিখেন। আমাদের ফ্যামিলিতে কোনভাবে রিলেটেড, বেড়ানোর লাইগা আসছেন। কিন্তু উনারে নিয়া অস্বস্তিটার সাথে উপন্যাসের নামের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। আমি ঠিক শিওর না।

হাঁটতে হাঁটতে ভাবতেছিলাম, কোনদিকে যাই। বিকালবেলাতেই বাইর হইছিলাম মনে হয়। কিন্তু এখন একটু সকাল সকাল মনে হইতেছে। সবাই মর্নিং-ওয়াকে বাইর হইছে। এর পরেই মনে পড়লো হঠাৎ চাকা (গায়ত্রী চক্রবর্তী) আসছেন আমাদের বাড়ি। গোলগাল চেহারা উনার, কিন্তু নাদুস-নুদুস না। আমার ফ্রেন্ড। যেইরকম মানস চৌধুরী গেছিলেন সুম্মিতা চক্রবর্তীদের বাড়িতে পূজা দেখতে, কিশোরগঞ্জে; সেইরকম ঈদ দেখতে আসছেন চাকা, আমাদের বাড়িতে। ঈদে ত দেখার কিছু নাই, তারপরও কেন যে আসছেন তিনি!

তিনিও বাইর হইতে পারেন, এইরকম ভাবতেছিলাম। একটু আগাইতেই উনার সাথে দেখা। পরনে তাঁতের শাড়ি, কপালে টিপ এবং মোস্ট অ্যামাজিংলি সিঁদূর নাই, চুলের সিঁথিতে। মানে, আমি বিয়া নিয়া কিছু ভাবি নাই; কিন্তু এইটা যে একটা এক্সপোজড বিষয় না, ব্যাংকের মর্টগেজকৃত সম্পত্তি’র সাইনবোর্ডের মতোন; এইটা একটা রিলিফ। কি কারণে জানি না ঠিক, তবে পুরুষ-সমর্থিত নারীবাদের একটা প্যার্টানও হইতে পারে, যেইটা সিমন দ্য বেভোয়ার বলতেছিলেন যে, আরো মারাত্মক; যে, তুমি ত এখন ফ্রি, তাইলে ত যে কারো সাথেই সেক্স করতে পারো!

ওই ট্রাপে পড়ার আগে আমি অন্যকিছু দেখতে থাকি।

রাস্তায় আরো লোকজন। আশ্চর্য ব্যাপার হইলো, প্রায় সবাই জোড়ায় জোড়ায়, মানে কাপল। মহিলাদের কারো চুলের সিঁথিতেই সিঁদূর নাই এবং পুরুষদের সবারই একটু না একটু ভূড়ি আছে। কিন্তু বুঝতে পারলাম যে, এঁরা বিবাহিত। আমিও যেহেতু চাকা’র পাশে হাঁটতেছি, তাইলে আমিও নিশ্চয় বিবাহিত, কিন্তু চাকার সাথে না। ওরা এইটা ভাইবা নিলো বইলা আমি ভাবলাম। একটা জিনিস মিলাইতে পারেতছিলাম না, আমি যখন উপন্যাসটার কথা ভাবতেছিলাম, তখন আমি ত কিশোর, পনের-ষোল বছর বয়স হবে।এখন যেহেতু এই কাপলদের সাথে আছি আমার বয়সও নিশ্চয় চল্লিশের ঘরে। এইটা একটা কনফিউশনই, কোন ডিসিশানে আসতে পারি নাই আর।

এই কনফিউশনটারে এক্সপ্লেইন করার লাইগাই মনে হয় ব্যাপারটা একটু ঘটনার মতো দাঁড়াইলো।

হঠাৎ কইরা এই তিন-চাইরটা কাপল রাস্তার একপাশে সইরা গেলো; যেইখানে দুইপাশে ঝাউগাছের আড়াল। এঁরা এইটার জন্যই অপেক্ষা করতেছিল আসলে। সেইখানে গিয়াই ওরা নিজেদেরকে কিস করা শুরু করলো। আমি আর চাকা দাঁড়াইয়া গেলাম ওদের পাশাপাশি। সবারই গায়ে গা লাগার মতো অবস্থার। ও, গ্রুপ অর্গি শুরু হইছে তাইলে! আমাদেরও ত শুরু করা দরকার। আমি আর চাকা কিস করলাম। আর চাকা’র মাইয়ে রাখতেই ওর মুখটা শুকাইয়া গেলো।

কারণ আমি ভাবলাম যে, ও আমারে মনোয়ার ভাবছে। মনোয়ার চল্লিশ বছর বয়সে চাইর-পাঁচবার রিহ্যাব ঘুইরা, ড্রাগ ছাড়ার শেষ ভরসা হিসাবে বিয়া করতে গেছে। বউ ত সুন্দরী। খুশিমনে বিয়া করছে। কিন্তু বাসর রাইতের পরে সিরিয়াস মন-খারাপ। কি ঘটনা? আরে মামা, বলিস না; মাগী ত বিরাট ধরা খাওয়াইছে। বিয়ার আগে ত মাই ধরতে পারি নাই, উপর থিকা দেইখা ত বড়-ই মনে হইছে; বাসর রাতে ব্লাউজ খোলার পরে দেখি কি, এত্তটুক! শালা, আগে দেখলে ত বিয়া-ই করতাম না! আমরা, তার অ্যাডিক্টেড বন্ধুরা, বেশ খেইপা গেলাম, নারী-শরীরের এই অপমান দেইখা; কইলাম, শালা তুই যে ড্রাগ-অ্যাডিক্টেড এইটা জানলে, মেয়েটা তোরে বিয়া করতো নাকি! এইটা ভাইবা দেখ। আর প্রতারণা ছাড়া কোন সম্পর্ক হয় নাকি এই দুনিয়ায়! শালা, ফেটিশ করার লাইগা তোর মাই-ই কেন লাগবো; এইরকম। কিন্তু মনোয়ারের দুঃখ ওয়াজ রিয়েল; রিহ্যাবে, দিনে তিনবেলা হেরোইন না নিতে পারার মতোই। কোন সাত্বনা নাই এর।

আমার ব্যাপারটা মে বি একইরকম না। পার্টিকুলার কোন ফিমেইল অর্গানে ত আমার অ্যাজ সাচ ফেটিশ নাই। থাকলেও, নিজেরে নিয়া ভাবতে চাই না আমি। আর তখনই বুঝতে পারলাম, ঘটনাটা আসলে অন্যখানে। চাকা আমার বউয়ের কথা ভাবতেছে। তার সুন্দর মাই জোড়ার কথা। আমাদের সেক্সের সময় আমি সেইটা এনজয় করতে পারি। এখন সেই সম্ভাবনাটা নাই। বা অভ্যাসটা রেপ্লিকেট করা সম্ভব না। কিন্তু এইটা আমার কাছে জরুরি না। চাকার মাইয়ে হাত রাখার পরে হাতটা যে একটু থাইমা ছিলো, সেইটা থিকাই এই বিষাদ। আমি জানি আই ক্যান কাভার ইট আপ। আমি ওর শরীর পছন্দ করি। শরীরের বাঁকগুলি। হাঁটাপথ, বাদামি রংয়ের। কি নির্জন! যেন অনেক আগে কেউ একজন হেঁটে গেছিলো, তারপর একলা পইড়া আছে। গরমের দিন, কিন্তু বাতাস বহিতেছে, খ্রীষ্টীয় আঠারোশ শতকের বাংলায়, বঙ্গভঙ্গ হয় নাই তখনো। এইরকম। মানে, এইরকম কাব্যিক না হইতে পারলে শরীর যে শরীর সেইটাও কি আর ফিল করা পসিবল!

কিন্তু তখনই আবার সবাই তটস্থ হয়া ওঠলো। ফিরা আসলাম একুশ শতকে। না, না এইটা ত ঠিক হইতেছে না। পরকীয়া ত করা যাবে না! একটু পরেই এই ঝোপের সামনে দিয়া একটা পাজরো জিপ যাবে; আর সেইটা কালো ধোঁয়া ছাড়বে আমাদের দিকে, তখন আমরা সবাই তখন ভ্যানিশ হয়া যাবো। এই পাপের কারণে। কিছু করলে যার যার বাসায় গিয়া করেন। গ্রুপ অর্গি করা যাবে না। কেউ মনেহয় বলতেছিলো বা আমি-ই নিজে নিজে ভাবতেছিলাম।

শিট, এইটা ত ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়া গেলো! মার্কেজ কেন পত্রিকার পাতা থিকা এইখানে হিজরত করলো! প্যাঁচ লাইগা গেছে। এখন কাহিনি তো আগাইতে পারবো না। তাইলে উপন্যাসের নামটা এখন কই?

চাকা বাসায় আসার পরে হাসান আজিজুল হক তারে পাইলো। কইলো, আমি ত একটা উপন্যাস লিখতেছি, নাম হইলো; এই। চাকা কয়, ভালোই ত হইছে নামটা। আমি তখন রাগে ভিতরে ভিতরে গজরাইতেছি। শালা, আমার উপন্যাসের নামটা মাইরা দিলো! আমি হক সাব’রে জিগাইলাম, কি লিখছেন আপনি কন? আপনে ত কিছু লিখেন নাই; লিখছি ত আমি, এই নাম দিয়া। ল্যাপটপ’টা খুইলা চাকার হাতে দিলাম। সে দেখলোই না। এইসব নিয়া ওর কোন ফিলিংস নাই। মানে যে-ই লিখুক, একজন লিখলেই হইলো, আর কি লিখলো এইটা নিয়া তার কী, এইরকম একটা ব্যাপার।

চাকা তখন বিছনায় হেলান দিয়া ইশিগুরু’র নেভার লেট মি গো পড়তেছিলো।

অনেকক্ষণ পরে। এর মধ্যে, আমরা চা-নাস্তা খাইতেছিলাম। টিভি দেখলাম। আরো অনেকে আছিলো। চাকা ইশিগুরু’র বইটা রাইখা ল্যাপটপে না দেইখাই কয়, না, এইখানে ত তোমার কিছু পাইলাম না!

আমি আর ল্যাপটপ’টা খোলার সাহস-ই পাইলাম না। যদি উপন্যাসের ড্রাফট’টা না থাকে। আর চাকা-ই যদি না দেখে, বালের এই উপন্যাস লিইখা কি লাভ! মেজাজটা খুবই খারাপ হয়া গেলো। হক সাব’রে নিয়া বাইর হয়া গেলাম।

মোড়ের চা’এর দোকানে গিয়া দেখি আরো গল্প-লেখকরা বইসা আছে। কায়েস আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর মাহমুদুল হক। চা খাইতেছে। স্বপ্নে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দেখি অন্যরকম; খুবই হাসি-খুশি, মাই ডিয়ার; এমনিতেও উনি তাই, ঢাকা কলেজে পড়ার সময় দেখছি উনারে; করিডোর দিয়া হাঁইটা যাইতেছিলেন আর আমারে দেইখা হাসছিলেনও একদিন; যেহেতু ছাত্র ইউনিয়ন করি, দেয়াল পত্রিকা করি; কিন্তু এইখানে অন্যরকম, ছেমড়া টাইপের। হাসান আজিজুল হক-এর পিঠে চাপড় দিয়া কয়, কি রে, কি খবর? আরেকটা উপন্যাসের নাম মাইরা দিছোস? বইলাই, হো হো কইরা একটা হাসি দেন। সবাই হাইসা দেয়। আমিও একটু রিলিফ পাই। হাসান আজিজুল হক ধরা-পড়া চোরে’র মতো হাসেন, যে জানে যে তার কোন শাস্তি হইবো না। জাস্ট ফান, এইটা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কয়, আরে কইও না; শালা, চৌদ্দটা উপন্যাসের প্লট লিইখা বইসা আছে, কিন্তু নাম দিতে পারে না। এইজন্য পুরাপুরি লিখতেও পারতেছে না। কারো কাছে কোন নাম শুনলেই মাইরা দেয়। আমিও ভাবি যে, মেধাস্বত্ত্ব আইনে আমার নামটা কি টিকবো শেষ পর্যন্ত? কারণ তিনটা শব্দ পর্যন্ত মনে হয় এলাউড, অন্যের লেখার তিনটা শব্দ ইউজ করলে আর বলা লাগে না, কিন্তু আমার উপন্যাসের নামটা চাইর শব্দের। কিন্তু হক সাব যদি দুইটা দুইটা জোড়া দিয়া চাইরটারে দুইটা বানাইয়া ফেলে, তাইলে কি হবে?

আরে, লেখকদেরকে নিয়া আমি কেন স্বপ্ন দেখতেছি? এইগুলা ত গল্প-লেখকদের দেখার কথা।

আল্লা বাঁচাইছে, এইটা ত তাইলে গল্প-লেখকদের স্বপ্ন। আমার না।

 

 

Leave a Reply