কমলা দাসের কবিতার বাংলা অনুবাদ নিয়া।

কেবল আত্মাই জানে কিভাবে গান গাইতে হয়। নির্বাচিত কবিতা, কমলা দাস। অনুবাদ, উৎপলকুমার বসু। সাহিত্য অকাদেমি, নতুন দিল্লী। ২০১২। পৃষ্টা: ১৯২। মূল্য: ১২০ রূপি।  প্রচ্ছদ: অপরূপ উকিল।

 

কমলা দাস ত কবি। এইকথা বুঝতে পারলাম উৎপলকুমার বসু’র করা তার নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ পইড়া। যিনি অন্তঃত দশটা কবিতা লিখতে পারছেন, তারে কবি বইলা মাইনা নেয়া যায়। উনার নির্বাচিত কবিতার বাংলা অনুবাদের নাম – কেবল আত্মাই জানে কিভাবে গান গাইতে হয়; ওইখানের একশ তিপান্নটা কবিতা থিকা বিশটার মতো কবিতা পাওয়া গেলো। বইটা বাইর করছে ইন্ডিয়ার সাহিত্য অকাদেমি, ২০১২-তে। আমি দুইবছর পরে পড়তেছি।

আমার ধারণা, এইটা কোন প্রজেক্ট-বেইজড কাজ, এক ভাষার কবিতা আরেক ভাষাতে ট্রান্সফার করার লাইগা; এইরকম আরো কবিতার বই অনুবাদ হইছে মনেহয় ইন্ডিয়ার অনেক ভাষায়। প্রজেক্ট হিসাবে এইটা ভালো, বাংলাদেশে চলতে-থাকা মীনা প্রজেক্ট যেইরকম (যদিও এইটার স্কোপ এবং ইমপ্যাক্ট অনেকবেশি)। হইতে পারে, এই প্রজেক্টের লক্ষ্য ইন্ডিয়ান স্টেইটগুলার মধ্যে রিজিওনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং বাড়ানো বা এইরকম একটাকিছু; কিন্তু এইখানে, ইন্ডিয়ারে বুঝতে হইলে খালি বঙ্গ দিয়া যে বোঝা যাইবো না এই মেসেজটা বাংলাদেশের লাইগা ইর্ম্পটেন্ট। আর উৎপলকুমার বসু যে আইয়াপ্পা পানিকর-এর কবিতাও অনুবাদ করছেন, এইটা দেইখাও ভাল্লাগলো। বঙ্গের হিন্দু ও মুসলমানরা যে সিটিজেন হিসাবে ইন্ডিয়ান, এই পরিচয়টা তারা মাইনা নিতে পারতেছেন ত তাইলে! আগেও নিতেন হয়তো, এবং এখনো নেন, কিন্তু বাংলাদেশের কথা মনেহইলে উনাদের চোখের জল পানি হইতে হইতে যে আবার জল হয়া যায়, এইরকম একটা ব্যাপারই বেশিবেশি দেখান। যা-ই হোক, বঙ্গ যদি এইরকম সরকারিভাবে হইলেও তার ইন্ডিয়াননেস বাড়াইতে পারে, এতে বাংলা-সাহিত্যের ভ্যারিয়েশনই বাড়ার কথা। Continue reading

রিডিং বিটুইন দ্য লাইনস: মাহমুদুল হকের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার

হিরণ্ময় কথকতা; মাহমুদুল হকের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার। সম্পাদনা আহমাদ মোস্তফা কামাল। পৃষ্টা ৯৩। মূল্য ১৮০ টাকা।  

 আমরা যে কটি সাক্ষাৎকারের সন্ধান পেয়েছি, সবগুলোকেই গ্রন্থভুক্ত করেছি।

এই বাক্যটা লিখছেন আহমাদ মোস্তফা কামাল ‘মাহমুদুল হকের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার’ বইয়ের ইন্ট্রোডাকশনে। মানে যা পাইছেন, তার সবই নিছেন, কিন্তু নাম দিছেন ‘নির্বাচিত’; যদি সবই নেয়া হয়, তাইলে ব্যাপারটা ‘নির্বাচিত’ কেমনে হয়?

এইরকম অস্বস্তি নিয়াই বইটার পড়া শুরু।


ভাষা নিয়া 

১৬ নম্বর পৃষ্টাতে মাহমুদুল হক বলতেছেন যে,

এক কথায় আঞ্চলিক ভাষা বলে সবকিছুকে চালানো যায় না। বুড়িগঙ্গার ওপারেই আঞ্চলিক ভাষা প্রায় চার ধরণের। কুট্টিদের ভাষা, পুবাদের ভাষা, চৌরাদের ভাষা, কিংবা কাছাইরাদের ভাষার তফাত অনেক।

এবং এর পরের পৃষ্টায় বলছেন বলে লেখা আছে

আমার ধারণা, আমাদের আমির বাংলাভাষা এখনও সম্পূর্ণ তার নিজস্ব রূপ ধারণ করেনি, করতে চলেছে।

এবং ২১ নাম্বার পৃষ্টাতে বলছেন যে,

আমার বিশ্বাস বাংলা ভাষা নিজেই গুরুচণ্ডাল দোষে দুষ্ট। ভাষার এই গুরুচণ্ডালিটাকে কাজে লাগাবার চেষ্টা ছিল দোষটাকে গুণে পরিবর্তন করার।

অথচ আহমদ মোস্তফা কামাল উনার সমালোচনা করছেন ২ নম্বর পৃষ্টাতেই যে,

আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে যথেষ্ঠ পারঙ্গমতা থাকা সত্বেও… তিনি কখনো কখনো নিম্নবর্গের ঢাকাইয়া চরিত্রের মুখে কলকাতার বুলি বসিয়ে দিয়েছেন।

এখন আপনি যদি মাহমুদুল হকের আঞ্চলিকতা’র বিভিন্নতার এবং গুরুচন্ডালির সম্ভাবনারে আমলে নেন, তাইলে ঢাকাইয়া কোন নিম্নবর্গের চরিত্রের ‘কলকাতার বুলি’ বলাটা কেমনে অসম্ভব হয়? তারপর সর্বশেষ ৮০ নম্বর পৃষ্টায় লেখা

এত একিউরিসি ধারণ করা যায় না তো।

মানে, ঢাকাইয়া চরিত্র ঠিক আছে, কিন্তু সে যে কলকাতার ভাষায় কথা বলতে পারে না – এই রিজিডিটি মাহমুদুল হক নিজেও ত রাখেন নাই এবং বেশকিছু জায়গাতে এইটা নিয়া বলছেন, বইয়ের ভিতরেই। মানে মাহমুদুল হকের ভাষা নিয়া যখন কথা বলা হইতেছে, তখন ভাষা বিষয়ে মাহমুদুল হকের কথা-বার্তার কোন রিলিভেন্সই নাই! Continue reading

মুসলমান আলাউদ্দিন খাঁ’র বাঙালিজনিত সমস্যা

আমার কথা। অনুলেখক শুভময় ঘোষ। মূল্য ৮০রুপি। পৃষ্টা ৭৮। 

১৯৫২ সালে আলাউদ্দিন খাঁ দুইমাস আছিলেন বিশ্বভারতীতে, তখন উনি যে কথা বলছিলেন, সেইটার উপর ভিত্তি কইরা শুভময় ঘোষ (সাগরময় ঘোষের ছোটভাই) এই বই লিখছিলেন। ১৯৫২ সালে শুভময় ঘোষের বয়স ২৩ বছর ছিল।

সেই বইটার দুইটা প্যারাগ্রাফ নিয়া একটা কথা বলতে চাইতেছি। আগে টেক্সটটা পড়ি, আসেন –

‘আমি বাঁহাতে সরোদ বাজাই। রামপুরে ৪ বছর ডান হাতেই শিখেছি। রামপুর দরবারে অনেকে খুব ঠাট্টা করত আমাকে। “বাঙালী ধুতিখোর, মচ্ছিকে পানি পীনেওয়ালা -” রোজ এই চলত। মাস দু এক গেল, চুপচাপ শুনলুম। বেহালা ভাল বাজাই – ওরা জ্বলে। আর ঠাট্টা করে – “মচ্ছিকে পানি পীনেওয়ালা। ওসব খেলে গান বাজনা হয় না।” ব্যান্ড মাস্টার বলতেন “না না, অমন বল না। বাঙালীর জোড়া মাথা আর নেই। আল্লাউদ্দীন কেমন নোটেশন জানে। তুমি গাও এক মিনিটে শুনিয়ে দেবে।” ওরা শুনে বলে, “কেয়া, নোটেশন মে গান হোতা হায়?” আমার তখন আর সহ্য হয় না, বল্লাম, “আপকো বাপকো পিয়া হ্যায়।” ওরা তবুও ছাড়ে না – “মাছ খাও?” “মাছ ত পাই না। ছোলা খেয়ে থাকি। পয়সা কোথায়?” “নোকরী কর। এসব খেয়ে কি সরোদ বাজান যায়, গান গাওয়া যায়?” “তবে কী খাব? হাতীঘোড়া?”

“গোস্ত খাও। পোলাও, বিরিয়ানী।” “গোস্ত গোমাংস আমি খাই না।” “ও কি হিন্দু নাকি?” এই রকম ঝগড়া রোজই প্রায় হয়। একদিন জামিরুদ্দীন আর আরও কয়েকজন – ফাজিল সব জুটেছে। আমায় নিয়ে খুব ঠাট্টা চলছে। জামিরুদ্দীন বলছে, “গোস্ত খাও, বাজাও। মচ্ছিকে পানি মে কুছ্ নেহি হোগা।” শুনেই মেজাজ চড়ে গেল আমার, “শূয়রের বাচ্চা – কী শুনতে চাও। বাজনা নেহি হোগা? পায়ে ধরে সরোদ বাজাব। শুনবি? মা স্বরস্বতীর জিনিস, তাই পায়ে ধরব না। বাঁ হাতে বাজিয়ে শোনাব।” জামিরুদ্দীন বলে, “হিন্দুর মত কথা বল কেন?” “আমরা ত হিন্দুই ছিলুম।” “কাফের।” কাহাঁতক সহ্য করা যায়। হ্যাঁ শূয়োরের বাচ্চাই বলেছিলাম। সেই থেকে বাঁ হাতে তারের যন্ত্র, ডান হাতে চামড়ার যন্ত্র বাজাই। থাপ্পড়ও বাঁ হাতে মারি। বাঙালীর মেজাজ। রাজাকেও মেরেছিলাম। আঙুল মচকে গিয়েছিল রাজার থাপ্পড় খেয়ে। বাঙালীকে শান্ত দেখেন – রেগে গেলে বোমা মারে। (পৃষ্টা ৫৮ – ৫৯)

এই টেক্সটরে সত্যি ধইরা বলা যায় যে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’রে মুসলমানের মর্যাদা দিতে চাইতেন না, উনার কলিগরা; বাঙালি হওয়ার কারণে। বাঙালি হিসাবে উনার খাদ্য-অভ্যাস এবং বাঙালি হইয়াও প্রতিভাবান হওয়া –  দুইটা কারণই ছিল।

খাঁ সাহেবের হিন্দু হইতে কোন সমস্যা নাই, আদিতে তিনি হিন্দুই ছিলেন (আরবের মুসলমানরাও অন্য ধর্মের এবং স্পেনের মুসলমানরা খ্রীষ্টান ও অন্য ধর্মের আছিলো), সুতরাং এখন মুসলমান হইলেও হিন্দু-অভ্যাস তাঁর মধ্যে থাকতেই পারে। মুসলমান বা হিন্দু হওয়ার চাইতে সঙ্গীতকার হওয়াটাই তাঁর কাছে মুখ্য ব্যাপার; কিন্তু মনে হইতে পারে যেন, বাঙালি হওয়াটারেই উনি মুখ্য ধইরা নিতেছেন। হিন্দু বইলা একটা ধর্ম-অভ্যাস এবং মুসলমান বইলা আরেকটা ধর্ম-অভ্যাসের ব্যাপারে তিনি অসচেতন হইতে চান নাই বা নাই কইরা দেন নাই; বলছেন হিন্দুই ছিলাম (ছিলুম)। কিন্তু এই টেক্সটের পাঠক এই ব্যাপারে অসচেতন থাকতে পারেন, ইজিলি। Continue reading

ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা: সেলিব্রেটিং অ্যা ‘ট্রু’ পোয়েটস লাইফ

 

তুমি আমার ঘুম, ভাস্কর চক্রবর্তী, প্রতিভাস, ১৯৯৮। পৃষ্টা: ৬৪।

ভাস্কর চক্রবর্তী’র এই কবিতার বইটা আমি তখন পড়ি নাই; শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণাটা যখন পড়ছিলাম। অবশ্য তখনই পড়া যাইতো, কিন্তু উনার একটা বই পইড়াই সন্তুষ্ট ছিলাম যে, উনার কবিতা পড়া হইছে।

আমাদের সময়ে কবিতা লিখেন বইলা যাঁদের সাথে পরিচয় আছে, উনারা সবাই দেখি ভাস্কর চক্রবর্তীরে চিনেন। শীতকাল আসার আগে আগে উনার কবিতার বইটার নাম নেন, আমিও কইছিলাম একবার হেমন্তের বাতাসে শীতের গন্ধ পাইয়া যে, শীতকাল চইলা আসলো,সূপর্ণা! কিন্তু অ্যাজ সাচ উনার কবিতা নিয়া তেমন কিছু শুনি নাই, বাংলাদেশে।

বা হয়তো বলছেন লোকে; বলাবলি’র ভিতরই যে সবসময় সবকিছু থাকবো, তাও ত না। কতকছিুই ত পইড়া আছে। আমিও বলি না। কিন্তু এই বইটা পড়ার পরে ভাবলাম যে, কিছু বলা যায়; যা কিছু আমরা পড়ি, তা নিয়া কিছু ত বলার থাকে। হয়তো মাঝে-মধ্যে বলি; মাঝে-মধ্যে বলি না। এইক্ষেত্রে, বলা আর না-বলা খুব কাছাকাছি কিছু জিনিসই শেষ পর্যন্ত – এইরকম একটা স্বস্তিও থাকে আর কি!

এমনিতে, উনার সর্ম্পকে ট্যাগ লাইন ছিল আমার ‘মধ্যবিত্তের কবি’ ( শক্তি চট্টোপধ্যায় একটা এস্কেপ পয়েণ্ট পাইয়া গেলেন)। উনি মধ্যবিত্ত লাইফটারে খুব এনজয় করছেন উনার কবিতায় – এইরকম ভাসা ভাসা কিছু ব্যাপার ছিল মনে হয়। যা-ই হোক, সেইটারে খুব একটা আর মনে রাখি নাই। উনার কবিতা পড়তে ত ভালোই লাগে এবং আসলে শব্দের কিছু সূত্র ধরতে পারলে আমার ধারণা অন্য অনেকের কবিতাই পড়তে খারাপ লাগার কথা না। কিন্তু একটা সময় পরে, কবিতার শ্রুতিমধুরতাও ক্লান্তিকর হয়া উঠতে পারে, ১০ বার, ২০ বার বা ৫০ বার পড়ার পরে। রিপিটেটলি, এইটা যদি তার মিনিংরে রিডিফাইন না করতে পারে। এইটা ভাবতে গিয়াই সম্ভবত মনে হইলো যে, উনার কবিতা আসলে একটা কোর জায়গারে ডিফাইন করে, বারাবার। অন্য প্রায় সবার কবিতাই তো! Continue reading

দুইটা কবিতা পড়া।

কবি রণজিৎ দাশের দুইটা কবিতা পড়তে গেছিলাম। সেইটা নিয়া কিছু কথা।

ধানখেতে বৃষ্টির কবিতা।। রণজিৎ দাশ।।রচনাকাল: ২০১০ – ২০১২; প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০১৩; সর্প্তষি প্রকাশন।। কলকাতা, ইন্ডিয়া।। [pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

 

‘বধূ’ নিয়া ভাবনা

 

মূল কবিতা

মূল কবিতা

 

তুমি কি গো দেখতেছো আমি’রে?

যে আমি তুমি’রে দেখাই, তৈয়ার করি?

 

মানে, পুরান দিনের সুন্দরী ‘বধূ’রা (কি যে যৌনতা-কাতর এই শব্দ, পুরানা দিনের কথা বাদ দিলেও) কি পরকীয়া প্রেম করতো না? যেহেতু তারা ‘বধূ’, তাদের এই আইডেন্টিটির বাইরে তাদের আর কোন অস্তিত্বই ত আর নাই। যদি থাকে, সেইটা কি রকম ভয়াবহ যে, তারা আর ‘বধূ’ই থাকতে পারেন না। পজ।

Continue reading