আজম খান নামের ঘটনারে আমার সালাম

১.
বাংলাদেশ মানে যে ঢাকা শহর – এই কালচারাল পরিচয় বানানোটাই আজম খান-এর আসল ক্রেডিট। আজম খানের আগে (তার সময় এবং এখনো প্রায়) আসলে বাংলা-সংস্কৃতি ছিল (বা আছে) কলকাতা-কেন্দ্রিক হয়া। বাংলাভাষার পপুলার গানগুলা উৎপাদিত হইছে অইখানেই: শচীন, হেমন্ত, মান্নাদে ইত্যাদি। এর বাইরে যদি কাজী নজরুল ইসলাম বা আব্বাসউদ্দীনের কথাও বলেন, উনাদের স্বীকৃতিটা ওই কলকাতা থিকাই আসছে। রবীন্দ্রনাথের কথা আর কইলাম না, যেহেতু উনি নিজেই কলকাতা! আজম খানের গানই প্রথম ব্যতিক্রম, যা কলকাতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায় নাই, বা অই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিটারে গুরুত্বপূর্ণ কইরা তোলে নাই। তাই উনারে আমার সালাম জানাই।

২.
তো, এইটার প্রতিক্রিয়া বা এফেক্টটাই বা কেমন হইলো? আমার ধারণা অনেকেরই তথ্য আকারে জানা আছে যে, উনার গানরে একসেপ্ট করা হয় নাই, শুরুতে। কিন্তু সময় যত পার হইছে, ‘বাংলাদেশ’ ধারণাটা যতটা প্রতিষ্ঠিত হইছে, আজম খানের গানও তার স্পেস কইরা নিতে পারছে।

তখন (এবং এখনো) তার গানের বিরোধিতাটা ছিল দুইটা জায়গা থিকা: কলকাতা-কেন্দ্রিকতা এবং গ্রাম-বাংলার অনুসারীরা – এই দুইটা ধারণার লোকজনই তার গানরে নিতে পারে নাই। আসলে গ্রাম-বাংলা বইলা তো কিছু নাই! যা আছে সেইটা পুরানা একটা মিথ, যেইখানে ধারণা করা হইতো যে আছে সহজ-সরল-স্বাভাবিকতা। আজম খান ‘নগর’ নিয়াই চিন্তিত হইছেন, ঢাকা শহরের গানই তিনি গাইছেন মেইনলি। এইভাবে গ্রাম-বাংলার বাংলাদেশরে তিনি ঢাকা শহর দিয়া রিপ্লেইস কইরা ফেলছেন। এইটা একটা ঘটনা, যেইটাতে গ্রাম-বাংলার অনুসারীরা ক্ষিপ্ত হইছেন, মানে চেতছেন। কিন্তু তাদের চেতাচেতির কোন মেরিট আসলে কিছু নাই। কারণ গ্রাম-বাংলা’র কোন কালচার তারা নিজেরাও তৈরি করতে পারেন নাই। আসলে গ্রাম-বাংলা’র নাম দিয়া তারা কলকাতার সফিশটিকেশনরেই সার্পোট করছেন এবং করতেছেন। এর বাইরে এক ধরণের বোকা বোকা গ্রামও উৎপাদিত হইতেছে এখন, টিভি নাটকে।

Continue reading

দাস্তাম্বু: ‘কবি’ কিভাবে আরো অপ্রয়োজনীয় হয়া উঠলেন সমাজ-ব্যবস্থার ভিতর – তার অসম্পূর্ণ কাহিনি

মির্জা গালিব আমার প্রিয় কবি। উনার লেখার বাংলা অনুবাদ পড়ছিলাম আগে, গানও শুনছি। আর জাফর আলম সাহেবের অনেক অনুবাদ দেখছি; মনে হইছে উর্দু-সাহিত্য সর্ম্পকে উনার খুব আগ্রহ আছে।

দিনলিপি আমার আগ্রহের জিনিস। প্রাত্যহিকতার যে পেইন এর ত কোন প্রতিকার নাই। তার উপর বইটাও আকারে ছোট; লেখা হিসাবেও মাইনর একটা টেক্সট, বইমেলায় কিনা বইগুলি থিকা তাই এইটাই প্রথম পড়তে শুরু করলাম।

প্রতিদিনকার রক্তাক্ত হওয়ার কাহিনি! [pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

কি রকম অসহায় একটা মানুষ, খালি বাঁইচা থাকার লাইগা তাঁর কাব্য-প্রতিভাও বন্ধক রাখতে চাইতেছে… কি রকম দিশেহারা!

যেই সমাজের ভিতর উনি ছিলেন, সেইখানে কবি’র যে ভূমিকা, সেইটা পাল্টাইয়া যাইতেছে। যেই সমাজে উনি ছিলেন, সেইখানেও ছিলেন উপেক্ষিত আর এই নতুন ব্যবস্থায় ‘কবি’ হিসাবে বাঁচাটা প্রায় অসম্ভব।

দিনলিপি কি, আসলে এইটা ত একটা মিনতি! (পেনশন দিবে ত ইংরেজরা!!)

Continue reading

কায়েস আহমেদ

 

কায়েস আহমেদ যখন মৃত্যুর গল্প লিখতেন, তখন তার মনের অবস্থাটা কী রকম ছিল? মানে কী কারণে তখন তিনি চিন্তা করতেন এইরকম করে বা লিখতেন এইরকম করে। কী রকম করে লিখতেন তিনি, এই কথার উত্তর দিতে গেলে লাগবে তার গল্প থেকে উদ্ধৃতি, আক্ষরিক প্রমাণ। কেননা যেহেতু তিনি আত্মহত্যা করে মারা গেছেন, এর মানে তো এই নয় যে, তিনি কেবলমাত্র মৃত্যু নিয়াই ভাবছেন এবং লিখছেন। সুতরাং জরুরী, তার উদ্ধৃতি। আর এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে তার কোন গল্পের বই আমার কাছে নাই। হয়তো আর্কাভাইল টাইপের না আমি। নিশ্চয় অন্য কেউ কেউ সংগ্রহ করেছে বা পড়ছে তার গুমোট, দম-বন্ধ করা বনর্ণাগুলি, স্যাঁতস্যাঁতে প্রেক্ষাপটে কাহিনীর মোচড়া-মুচড়ি; আরে বাবা কী আর বলতে চাইছো তুমি; জীবন হঠকারী আর মৃত্যুটা সৎ! এইরকম ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট করে বলো না একটা কিছু! নাকি বলেছিলে?[pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

আমি চিরায়ত সাহিত্যের ভিতর গুমটি মেরে বসে থাকা উইপোকা; বই খেতে খেতে অন্ধ; কী যেন বলেছিলে তুমি এইরকম ভাব করে মনে করার চেষ্টা করি। আসলে তো ভুলে আছি সমস্তই। দেখছো, কনফেস করতে শুরু করছি। মানে, দৃশ্যের যে বনর্ণারূপ তার ভিতরই আটকে পড়ে থাকা তোমার ব্যক্তি অনুভূতি। আর যে কাহিনীর আড়াল তাতে লুকানো তোমার সত্তা। কত যে চেষ্টা তবু পারছে না লুকাতে, পারছে না প্রকাশিত হতে।

আমিও পছন্দ করি মৃত্যু, বিশেষ করে যখন সে ঘাপটি মেরে বসে আছে, তোমার ঘাড়ের উপর ফেলছে তার গরম নিঃশ্বাস, কেবলই আরো একটা সম্ভাবনা; বিন্যাস, ছড়ানো পথের উপর, এইরকম একটা পরিস্থিতি। আর এই সম্ভাবনা ঘনীভুত হয়ে উঠেছিলো কেন তার অপশনগুলির মধ্যে; কী করে সে হয়ে উঠলো একক? একমাত্র অল্টারনেটিভ?

Continue reading

রঙিন চশমা

প্রথম প্রস্থ: গ্রন্থ-আলোচনা

আসলে একটা প্রকল্প হাতে নিছি। বইমেলায় যে বইগুলি কিনছি, তা পড়ে শেষ করবো আর সেইগুলি নিয়ে লিখবো ‘পাঠকের প্রতিক্রিয়া’; যেহেতু পাঠক, তুমিই গুরু। শেষ নিষ্ঠা, লেখকের! [pullquote][AWD_comments width=”294″][/pullquote]

খুব আগ্রহ নিয়াই কিনছি, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘রঙিন চশমা’;  কারণ স্মৃতিকথা আমার প্রিয়। প্রিয় আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। অবসর সময়ের রিডিং। সাবজেক্ট নিজে তার সর্ম্পকে বলছে! কী রকম একটা গূঢ় অভিব্যক্তি। মানুষ কখন বলে এইসব কথা, কেন মনে করে যে বলাটা জরুরি? এই জীবন-যাপন, কোনকিছু স্বীকার হঠকারিতা? আমি অনুভব করতে চাই সেইটা। সবগুলি একইরকম হয় না। অনেকগুলি ফাঁকি থাকে। অনেক বিস্মরণ থাকে, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত; থাকে বাছাই করা, অগূঢ় সেইসব জিনিস; একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়। তারপরও আমার আগ্রহ কমে না। মানুষ আসলে কী স্বীকার করতে চায়? কোন কথাটা সে বলতে চায়, নিজের সর্ম্পকে? কোন কোন ঘটনা? কোন কোন সত্যিগুলি, সে মনে করে যে তার নিজস্ব? যা-ই হোক, তা মানুষের বিবেচনা, যিনি লেখেন, লেখক, তার। আমি পাঠক, উছিলামত্র। সেইটা পড়তে বসি।

 

মুহাম্মদ জাফর ইকবাল

মুহাম্মদ জাফর ইকবাল

 

প্রচ্ছদ: রঙিন চশমা

প্রচ্ছদ: রঙিন চশমা

 

কিন্তু আমার আগ্রহ থেমে আসে, মাঝ পথে গিয়া। আমি ক্লান্ত হয়া পড়ি একসময়। মনে হয় আগেও হয়তো পড়েছিলাম, হয়তো কোথাও ছাপা হয়েছিল কয়েকটা, মানে বেশিরভাগই। কিন্তু একটানে পড়া হয়ে যায়। একটা আবেগী হিন্দি ছবি দেখার মতো এই বই পড়া, একটাই অনুভূতি খালি মনে লেগে থাকে। একটা শ্লেষ, অনেকটা আক্ষেপের মতো একটা কথা যে, তিনি যদি সত্যিকারের সাহিত্যিক হতেন তাহলে তিনি তার বাবাকে নিয়ে একটা বই লিখতেন, তিনি সাহিত্যিক না বলেই বানিয়ে বানিয়ে মহাজাগতিক আগন্তুকের গল্প লিখেন। এইরকম একটা স্বীকারোক্তি। কথাটা সত্য বা মিথ্যা এইরকম না, কিন্তু কথাটার ভিতর কেমন একটা প্রাণের অস্তিত্ব টের পাই। মনে আছে, মার্ক শাগালের আত্মজীবনীর ভিতর একটা জায়গায়; সে বলতেছিলো যে, এর পরের লেখাগুলি আমার নিজের জন্যে লেখা; তারপর, মা’র কথা বলে কাঁদতেছিলো, লোকটা। আমার মনে হয়েছিল যে, ওই কথাগুলা বই থেকে বের হয়ে পাঠকের পাশে বসে আছে। কান্নার শব্দগুলি শোনা যাচ্ছিলো, তখন। এই এত দূরে বসেও। এইরকম মোহময়তা!

Continue reading