২০১৬ সালে এই গল্পের বইটা ছাপাইছিলাম। বারোটা গল্প ছিলো। কিন্তু এখন একটু চেইঞ্জ করার কথা মনে হইলো। পুরান দুইটা গল্প বাদ দিয়া নতুন দুইটা গল্প ইনক্লুড করলাম। আর টেক্সটগুলি অনেক এডিট করা লাগবো আসলে। প্রথম দুইটা গল্পের কিছু এডিট করলাম। পুরাটা এডিট করা হইলে আরেকবার ছাপাবো হয়তো।
………………………….
পুরি’র গল্প
…………………………..
পুরি’র গল্প
অমর প্রেম অথবা আমার প্রেম
ছোট শহরের গল্প
গল্প-লেখকের স্বপ্ন
দঈত আননাহাল
কিছু মায়া রহিয়া গেলো
দুর্গতিনাশিনী
মিডলাইফ ক্রাইসিস
যুদ্ধ ও শান্তি
টাইগার
আমার ফ্রেন্ডের বউ
শাহেরজাদী
…………………………………………………..
পুরি‘র গল্প
গল্পটা আসলে পুরি’র। চা-পুরি-সিঙ্গারা’র পুরি; সিলঅটি পুরি, উৎপলকুমার বসুর পুরি-সিরিজের পুরি কিংবা অন্য আর কিছুই না। খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা এইটা। চূড়ান্ত অসাফল্যের একটা ইতিহাস, না-পারার একটা করুণ অধ্যায়।
তখন আমার বয়স দশ। ‘শৈশব’ মার্কা জিনিসটা শেষ হইতেছে। একটু একটু টিনএইজ। পাড়ার মাঠ ছাইড়া রেলের মাঠে যাই মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে বাজারে যাই আব্বার লগে। বাজার শেষে রিকশা কইরা দিলে একলা একলা বাসায় ফিরতে পারি। বাজারের টাকা মারতে পারি না। এইরকম সব ঘটনা। মানে আমি বুঝাইতে চাইতেছি যে, আমি তখন আসলে আর শৈশবের ভিতর নাই। কিন্তু আমার সম্পর্কে তখনও পোলা-মাইয়া ভেদ পুরাপুরি ঘটে নাই। নানুবাড়ি গেলে নানা-নানির সাথে এক বিছানাতেই থাকি। একটা বিহ্বল অবস্থার সূত্রপাতও হয় নাই। তখনও আমি টিনএইজ হওয়ার যোগ্যতাগুলির ভিতর দিয়া যাওয়া শুরু করি নাই।
তখন আমি পড়ি ক্লাস ফাইভে। পৌরসভার মডেল প্রাইমারী স্কুলে। আমি বলতেছি আশির দশকের মাঝামাঝি একটা সময়ের কথা। ইংলিশ মিডিয়াম তো দূরের কথা, কিন্ডারগার্ডেন স্কুলও তখন চালু হয় নাই সেইখানে। পৌরসভার মধ্যে নামি প্রাইমারী স্কুল। পৌরসভার বা পুরা উপজেলার ট্যালেন্টপুল বৃত্তিতে এই স্কুলের ছাত্রদের অনেকের নাম থাকে। আমাদের আগের ব্যাচে উপজেলার সাতটা ট্যালেন্টপুল বৃত্তির পাঁচটাই এই স্কুলের ছিল। গল্পের এবং স্কুলের সাফল্যের সীমানা এই পর্যন্তই। এরপর থিকা আমার অধ্যায়, ব্যর্থতা আর অসাফল্যের গাঁথা। সেই ইতিহাসের বলি এইবার।
আমি যখন ক্লাস ওয়ান থিকা ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার কম্পিটিশনের ভিতরে ঢুকি, সম্ভবত তখন থিকাই ফার্স্ট হওয়ার প্রতি আমার এক ধরনের ডরই বলা লাগবে এখন, সেইটা ছিল। কারণ আমি কখনোই ফার্স্ট হইতে পারতাম না, স্পেশালি ফাইনাল পরীক্ষায়। যখন ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টু তে উঠি, ভুল করার সম্ভাবনা আমার খুবই কম আছিলো, আম্মা-আব্বা, বিশেষ কইরা বড় ভাইয়ের কারণে। এরপরেও আমি ফার্স্ট হইতে পারি নাই। কারণ আমার হাতের লেখা যথেষ্ঠ পরিমাণ খারাপ হওয়ায়, একই নম্বর পাওয়ার পরও আমাকে সেকেন্ড ঘোষণা করা হয়। তবে রোল নম্বর আমার ১ থাকে, বি সেকশনে। ক্লাস টু থিকাআমি ফোর্থ হইয়া ক্লাস থ্রিতে উঠি, পরিবারের নানা কটুবাক্য সহ্য কইরা এবং নিজের দিক থিকা কোনোরকম গ্লানি ও জটিলতা ছাড়াই। থ্রি থিকা ফোর-এ ওঠার সময় আবারও সেকেন্ড হই, নিজের দিক থিকা কোনোরকম গ্লানি ও জটিলতা ছাড়াই। কিন্তু পরিবারে কিছুটা শান্তি আসে এবং পাশাপাশি এই জিনিসটা এস্টাবলিশ হয় যে, এই ছেলে কখনোই ফার্স্ট হইতে পারবো না। কেননা, ফার্স্টের সাথে আমার ব্যবধান ছিল বিশাল। আর ফার্স্টওলাও আমার উপর খুব খুশি এইরকম সেকেন্ড পাইয়া। আর আমিও জেলাস হইতে পারি নাই। এইরকম খুশি খুশি ফার্স্ট-সেকেন্ড আমার ধারণা খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু ট্রাডেজিটা ঘটে তার পরেই। এই কম্পিটিশন না থাকাটা ফার্স্টের বাপ-মা মানতে পারে না, একই ঘটনা ক্লাস ফ্লোরে ওঠার সময় ঘটলে উনারা তারে কাছের হাইস্কুলের প্রাইমারী সেকশনে দাখিল করেন, আরো কম্পিটিশন মোকাবিলা কইরা হাইস্কুলের ভবিষ্যত প্রতিযোগিতার জন্য যোগ্য করার লাইগা। কিন্তু বিপদ হয় স্কুলের এবং আমার। আমি ফার্স্ট হতে পারি না আর ভালো স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করার মতো মেরিট ছাত্র আর খুঁইজা পাওয়া যায় না। তার উপরে ভয়, যদি আমাকে কাট দেওয়ার প্ল্যান করেন, আমার বাপ-মা। কিন্তু আমার ফ্যামিলিতে তখন স্বস্তির হাওয়া, এইবার তো অন্তঃত ফার্স্ট হতে পারবে! কারণ ক্লাসে থার্ড বা ফোর্থ বইলা কাউরে খুঁইজা পাওয়া ছিল আরো মুশকিল। কিন্তু যথারীতি আমি ফার্স্ট হইতে ব্যর্থ হই, প্রথম সাময়িকী পরীক্ষায়। কারণ তখন উত্থান ঘটে নারীবাদের। দুই দুইজন নারী আমার সাথে ফার্স্ট হওয়ার লড়াইয়ে চইলা আসেন। একজন ফার্স্ট এবং একজন থার্ড হন। তারা কম্পিটিশন জাগায়ে তোলেন। যেহেতু তারা মেয়ে, আমি খুব একটা মাইন্ড করি না, কিন্তু একটু একটু খারাপ লাগে যখন লোকজন বলে যে, শেষ পর্যন্ত মেয়েদের তলে পড়লি! সম্ভবত তখন থিকাই আমার মধ্যে নারীবাদের প্রতি সহানুভূতি জাগতে শুরু করে, পাল্টা যুক্তি দিতে গিয়া যে, মেয়েরা কী ছাত্র না! ওরা ফার্স্ট হইতে পারবে না কেন? কিন্তু এই যুক্তি আমাকে শান্তি বা স্বস্তি কোনোটাই দিতে পারে না। এর পরিত্রাণ হিসাবে পড়াশোনার চিন্তা খানিকটা বাদ দিয়া আমি খেলাধুলায় মন দিতে শুরু করি। মোটা দাগে, পরিস্থিতিটা এইরকম। আর তখনই খবর আসে যে, ইন্টারস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে, উপজেলায়। এই প্রতিযোগিতাকে সামনে রাইখা আমি দুইটা খেলায় পারদর্শিতা অর্জনের চেষ্টা করি। একটা হইতেছে একশ মিটার লম্বা দৌড় আর সেকেন্ডটা হইতেছে অংক দৌড়। প্রথমটা ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। কিন্তু দ্বিতীয়টার নিয়মগুলি সর্ম্পকে একটু বলি। প্রত্যেক প্রতিযোগীর হাতে একটা খাতা এবং কলম থাকবে। মাঠের মাঝখানটাতে ব্ল্যাক বোর্ডে একটা অংক দেয়া থাকবে। বাঁশি ফু দেয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক প্রতিযোগীকে দৌড় শুরু করতে হবে। ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গিয়ে অংকটা দেখে, তার সমাধান করার পরে বাকি মাঠ দৌড় দিয়া শেষ করতে হবে। যে অংকটা ঠিকভাবে কইরা সবচেয়ে আগে দৌড়ে শেষ মাথায় পৌঁছতে পারবে, সে ফার্স্ট হবে। মানে, কেউ আগে দৌড় শেষ করতে পারে, কিন্তু অংক ভুল হইলে কোনো লাভ নাই। প্রতিযোগিতায় ভালো করার মূল শর্ত দুইটা, ভালো দৌড়াইতে পারতে হবে আর দ্রুত অংক করতে জানতে হবে। আমি যেহেতু একটু দৌড়াতেও পারি এবং সেকেন্ড হওয়ার অভ্যাস আছে, আমার জন্য এই খেলায় ভালো করার সব সম্ভাবনাই ছিল। আর সত্যি সত্যি সেটা হইছিলোও। স্কুলের মধ্যে প্রাকটিস করার সময় দৌড়ে ফার্স্ট বা সেকেন্ড হতে শুরু করি; আর অংক দৌড়ে স্কুলে ফার্স্ট তো আমি হই-ই, কিন্তু সেকেন্ড আর খুঁইজাই পাওয়া যায় না। দেখা যায়, আমি অংক-দৌড় শেষ কইরা, কল থিকা পানি খাইয়া ফিরা আসার পরেও যারা দৌড় শেষ কইরা আসছে, তাদের অংক পরীক্ষা কইরা সেকেন্ড বাইর করার প্রক্রিয়া চলতেছে। প্রতিটি খেলায় প্রতি স্কুল থেকে দুইজন করে অংশ নিতে পারবে। আমি একশ মিটার লম্বা দৌড় এবং অংক দৌড়-এর প্লেয়ার। কিন্তু আমাদের স্কুল থেকে অংক দৌড়-এর জন্য সেকেন্ড আর কাউকে পাওয়াই গেলো না। তাই আমিই একমাত্র। আমি খুবই খুশি হয়ে উঠি আমার নিজের কিছু করার মতো এই জায়গাটা পাইয়া। ভবিষ্যত সাফল্যের স্বপ্ন দিনে এবং রাতে সবসময় দেখতে শুরু করি। পরিকল্পনা করতে থাকি কী কইরা আমি আরো দ্রুত দৌড়াইতে পারি, দৌড়টা কীভাবে শুরু করবো, অংক করার সময় কোন ভঙ্গিতে বসতে হবে, ইত্যাদি। আর অংক তো আমি পারিই। ফার্স্ট হই বা সেকেন্ড হই অংক পরীক্ষায় হায়েস্ট মার্কস আমার থাকেই। মেয়েরা এতটা ভালো অংক করা তখনও শেখে নাই। দেখতে দেখতে একসময় প্রতিযোগিতার দিন চলে আসলো। প্রথমে পৌরসভা এবং ইউনিয়ন ভিত্তিক প্রতিযোগিতা হবে, তারপর উপজেলা পর্যায়ের খেলা। আমরা জানতাম যে, পৌরসভার প্রতিযোগিতাটা আমাদের স্কুলেই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর ঘটলো না। কারণ আমাদের স্কুলের মাঠটা আবার ঈদগারও মাঠ। খেলাধুলার প্রতিযোগিতা করে সেই মাঠ নষ্ট করা যাবে না। তাই অন্য আরেকটা স্কুল ঠিক করা হইলো। যদিও সেই মাঠটা ছোট। আমরা সকাল নয়টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেলাম। সব মিলিয়ে আট দশটা খেলা হবে হয়তো। কিন্তু আমার অন্য কোনো বিষয়েই মনোযোগ নাই। শুধুমাত্র আমার নিজের দুইটা খেলা ছাড়া। Continue reading →