আমার কবিতার/বইয়ের রিভিউ

ব্যাপার’টা খালি এইরকম না যে, ‘ভালো’ কবিতা-গল্প-নভেল খুব কম লেখা হয়; আমার ধারণা ‘ভালো’ রিভিউও খুব কম-ই লেখা হইছে বাংলা-ভাষায়। একটা ‘প্রশংসা’ করার জায়গার বিপরীতে ‘কাইট্টা-ছিইল্লা লবণ’ লাগায়া দেয়াটারেই মেবি ‘রিভিউ’ হিসাবে ভাবতে পারি আমরা এখনো। কিন্তু রিভিউ বলতে একটা কিছু’রে সমর্থন করা বা বাতিল করার চাইতে (এইগুলা করা যাবে না – তা না), কিছু ‘রিভিল’ করতে পারা বা কোন একটা জায়গা থিকা দেখতে পারাটারে ‘ভালো’ বইলা মনে করতে চাই আমি। তো, এই জিনিসটাও মাথায় রাখা ভালো যে, রিভিউ’টা বা দেখার জায়গাটাই বই’টা বা লেখাটা না।…

তো, রিভিউ নিয়া ভাবতে গিয়া মনে হইতেছিল, যেহেতু অনেক দিন ধইরাই লিখি, অনেকেই ফর্মালি, ইনফর্মালি, সামনাসামনি বা গোপনে, ভালো-মন্দ বলছেন, আমার কবিতা নিয়া। তার মধ্যে থিকা এই ৩টা রিভিউ’র কথা আমার মনে আছে। (এইখানে অবশ্য উনাদের বলা ‘ভালো, ভালো…’ কথাগুলাই রাখতেছি। )

রিফাত ভাই তো অনেক প্রশংসা করছিলেন; উনি কিছুদিন সমকালের সাপ্তাহিক সাহিত্য-পাতা কালের খেয়া’তে বুক রিভিউ লিখছিলেন। এর আগেও ‘ছাঁট কাগজের মলাট’ বা কোথাও রিভিউ লিখলে উনি জুঁইফুল চৌধুরী নামেই লিখছেন, দেখছি। তো, উনারে কারো কবিতা নিয়া কখনোই খারাপ কথা লিখতে দেখি নাই যে, এইটা হয় নাই, অইটা হয় নাই, এইরকম… এইটারে ‘ভদ্রলোকী’ বইলা আমরা হাসি-ঠাট্টা করতে পারি এখন; কিন্তু উনার এই ‘ভদ্রলোকী’র কিছুটা ভক্ত আমি। আমি যে রিভিউ করতে গিয়া বাজে কথা বলি নাই – তা না, কিন্তু কম-ই বলতে চাই; বরং কোন রিভিউ লেখার কারণ লেখাটা বা বইটারে ইর্ম্পটেন্ট মনে করি বইলাই। এইরকম।…

জাহেদ আহমদ খুবই দী র র র ঘ একটা লেখা লেখছিলেন, লাল জীপের ডায়েরী’তে। আমি মোটামুটি শরমই পাইছিলাম, এতো কথা যে লেখা যাইতে পারে আমার কবিতা নিয়া। আমার মনে হইছিল, কবিতা ও চিন্তা – এই জায়গাটাতে উনি খুবই কাছাকাছি থিকা আমার কবিতারে দেখতে পারছিলেন। আমার ধারণা, এইটা একজন রাইটারের লাইফে খুব কমই ঘটে; কোন রাইটার হয়তো খুব পপুলার হইতে পারেন, বা খুবই রিজেক্টেড হন; কিন্তু উনার লেখালেখিরে উনি যেই জায়গা থিকা লিখতেছেন তার কাছাকাছি জায়গা থিকা দেখতেছে, এইটা খুব রেয়ার ঘটনাই।… আর গত দুই-তিন বছরে যা হইছে, আমার কবিতা নিয়া কথা বলতে গেলে ‘ভাষা’ জিনিসটা খুব ডিস্টার্ব করে; এমনটাই যে, কি লিখছি – সেইটা আর এতোটা আলাপের ব্যাপার হইতেই পারে না! আমার ধারণা, এইটা নিয়া কিছু একটা হইতেছে আর কি! তারপরেও দেখেন, ‘ফেসবুকের ভাষা’তেই তো লিখি, ‘টিকটক’ পর্যন্ত তো যাইতেই পারি নাই। তো, এইগুলা কিছুদূর মোকাবিলা কইরা রাদ আহমেদ আমার লাস্ট কবিতার বই ‘লাস্ট ক্যাকটাস’ নিয়া লিখছিলেন। খুবই ডিটেইল একটা জিনিস ছিলো। রাদের গদ্যও সুন্দর।…

তো, যারা আমার কবিতা পড়ছেন, তারা এই রিভিউগুলাও দেখতে পারেন। উনারা আমার লেখার দোস্ত। দুশমনও।

…………………………………………..

/ জুঁইফুল চৌধুরী, ২০০৬ (“কালিকাপ্রসাদে গেলে আমি যা যা দেখতে পাবো”, ২০০৫ বই নিয়া লেখা বুক রিভিউ। কালের খেয়া, দৈনিক সমকাল।) /

ইমরুল হাসান বহুদিন কবিতা লিখছেন, নরম নিজস্ব কণ্ঠ আছে, কিন্তু চাপা গলায় কথা বলেন। …একটি কবি-মনের পরিচিতি ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়/সবার অলক্ষে ইমরুলের একটা নিজস্ব জগৎ গড়ে উঠেছে, যেখানে সে কবি। পাতার পর পাতা ভরিয়ে গেছে সে নিজের দুঃখের কাহিনীতে। বটগাছের শেকড় যেমন মাটিকে, ইমরুল তেমনি করে কবিতাকে শুষে নিংড়ে নিয়েছেন।

গদ্য কবিতা লেখা যায় বলে বহুজন কবিতা লিখছেন। কিন্তু গদ্য বা পদ্য যাই হোক না কেন, কবিতা এক রকম নিয়মানুবর্তিতা। চক্ষুদানের পরও থাকে প্রাণপ্রতিষ্ঠা। অন্ধদের দেখাতে চক্ষুস্মাণের দেখায় তুলে আনতে হলে, কল্পনা আর অনুভবের গভীরতায় তার উদ্বোধন ঘটাতে হয়। কবিতা রচনায় কল্পনা এবং অনুভব শক্তির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। ইমরুল হাসান গদ্যে সুন্দর কবিতা লিখেছেন। ছোটগল্পের মতো করে লেখা। ছোটগল্পের সঙ্গে কবিতার সর্ম্পক খুব ঘনিষ্ঠ বলে আমি মনে করি।…

গোটা নব্বইর দশক ধরে সে যা লিখলেন মননশীল পাঠকের মনে রেখাপাত করতে পেরেছে। তার জীবনের অভিজ্ঞতা এবং লেখার ক্ষমতা খুবই উঁচু। সমসাময়িককালে আমাদের জীবনে যে বিপন্ন বিষন্নতা ঘিরে আছে, ঘিরে আছে অসাধুনতার পাপবোধ, নিজের ভেতরে তার দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়ে বিষয়বস্তুর সঙ্গে ভাষার, সাযুজ্য বজায় রেখে শিল্পেীাতীর্ণ কবিতা লিখেছেন ইমরুল হাসান। আমরা সবাই কম-বেশি কাজ করি, কিন্তু কাজের চেয়ে বড় হতে পারি না। যারা তা পারেন, তাদের সংখ্যা কোটিতে গুটিকয়। তারা শুধু কাজ করেন না, কাজকে আলোকিত করেন। ইমরুল হাসান তাই করেছেন। যখন তিনি যে ধনুক ধারণ করেছেন অনায়াসে তাতে একটি অতিরিক্ত তীর রোপণ করতে পেরেছেন। প্রায়ই তিনি লিখেন, এবং যা লিখেন তাতেই একটি অতিরিক্ত মাত্রা যুক্ত হয়। একটি দুর্লভ স্বাদ এবং গল্প তার কয়েক লাইনের কবিতায়ও ছড়িয়ে থাকে। পাঠক হিসেবে আমরা পুলকিত রোমাঞ্চিত হই।…

…ইমরুলের তীব্র দুঃখপীড়িত কবিতাগুচ্ছ। তীব্র বেদনা আমাকে স্পর্শ করে। আমাকে কবিতাগুলো তীব্রভাবে আলোড়িত করে তোলে। এক ঝকঝকে লেখা। সার্টিনের মতো মসৃণ, সিল্কের মতো নরম শ্বন্ধ। যেন ছাপার অক্ষরের তলেও পরিষ্কার দেখা যায় রূপ-রস-বর্ণ-গল্পের পৃথিবী।
এ কবিতা গ্রন্থটির নাম দিতে চাই ‘রোলিগানস’। হুলিগানস কথাটির ঠিক উল্টো। ডেনিস ভাষায়, রোলিগ কথার অর্থ শান্ত এবং শৃংখলাপরায়ণ। ইংরেজি শব্দ হুলিগানস-এর হাঙ্গামাকারী বা দাঙ্গাবাজ] ঠিক উল্টো। …আধুনিক কবিতা এখন সঠিক পাঠককে সেভাবে টানতে পারছে না। কি যে বলি, আসলে কবিদের ক্রিয়েটিভিটি বোধহয় তেমন আর নেই। পাঠকের চাহিদাও তার জন্য দায়ী।

আজকে ইমরুল হাসানকে এড়িয়ে যাওয়া খুব মুশকিল। …

পুরা লেখাটা পড়তে পারবেন এইখানে:
https://www.facebook.com/notes/imrul-hassan/কালিকাপ্রসাদ-নিয়া-রিফাত-চৌধুরী/439662845751/

…………………………………………..

/ জাহেদ আহমদ, ২০১৪। /

ইন-জেনারেল কবিতায় আমরা নানান উপায় ও অনুষঙ্গের উপর ভর দিয়া চিন্তাকে হাজির হতে দেখি, চিত্রকল্প-উপমা বা নানাবিধ অন্যান্য অলঙ্কারাদির আয়োজনে সেই চিন্তা সামনে এসে খাড়ায় পাঠকের কিংবা পাঠক নিজেই হয়তো কবিতা পড়তে পড়তে একটা আগডুমবাগডুম চিন্তা বা ভাবনা খাড়া করে নেয়। কিন্তু ইমরুল হাসানে যেন প্রোসেসটা রিভার্স্যাল, আই মিন, তিনি চিন্তার ওপর ভর দিয়াই চিত্রকল্প প্রভৃতি যা যা আবশ্যক কবিতার জন্য তা তা খাড়া করান। অন্য একটা ব্যাপারও মনে হয় আমার, ইমরুল হাসান প্রকল্পিত কন্সট্র্যাকশনগুলো যথাসাধ্য ঘন ও নিবিড় নয়নে দেখতে দেখতে, একটা কবিতায় সচরাচর আমরা বস্তুর বা ভাবের বা ভবের বা অনুভবের রূপ-রঙ-দৃশ্য-গন্ধ-শব্দ-সোয়াদ-ধ্বনিচিত্র উপহার পাই, ইমরুলের কবিতায় আমরা রূপ-রঙ-দৃশ্য-গন্ধ-শব্দ-সোয়াদ-ধ্বনিচিত্র পাই চিন্তার। ব্যাপার স্যাপার শুনে কারো মনে হতে পারে, ইমরুল বুঝিবা আইডিয়ানির্ভর কবিতা লেখেন—না, ব্যাপার মোটেও তা না। আইডিয়া নির্ভরতার বাইরে রেখে একটা কবিতায় কেমন করে চিন্তার রৌদ্রকুচি ইনজেক্ট করে দেয়া যায়, সেই হেকিমি ইমরুলকবিতার উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন। ইমরুল হাসান সেই আলকেমিস্ট, আবহমান বাংলাস্টাইলের কবিতাকিমিয়ায় যিনি ডিস্টিংক্ট একটা পার্ফিয়্যুম পরিশোধনরত। গোয়িং অন, অবশ্যই, ইমরুল হাসানের পাঁচটা কাব্যপুস্তক অনওয়ার্ডস কবিতারাজি ভিন্নতর শূন্যোদ্যানের পানে অগ্রসরমান।

পুরাটা লেখাটা পড়তে পারবেন এইখানে: https://laljiperdiary.wordpress.com/2014/05/01/দ্য-পোস্টম্যান-জাহেদ-আহম/

………………………………..

/ লাস্ট ক্যাকটাস নিয়ে আলোচনা, রাদ আহমেদ, ২০১৯ /

…ভাষা নিয়ে আমার আগেকার কিছু কথার জের টেনে এনে একটা কথা বেশ জোর দিয়ে বলা যায়। এই যে এত এত এক্সপেরিমেন্ট আমাদের, নতুন ভাষা নিয়ে, এতসব চিন্তা , কর্মকাণ্ড, এই এতসব কিন্তু সফল হবে না যতক্ষণ না আমরা আমাদের উদ্দিষ্ট কাজটি করতে পারি। অর্থাৎ, আমি যদি বিকল্প ভাষায় একটা প্রবন্ধ লিখি, তাইলে আমার ওই বিকল্প ভাষার ব্যবহার তখনই সফল হবে যখন প্রবন্ধ হিসাবে আমার লেখাটি সফল হবে। তার পরে আসে ভাষার ব্যাপারটি।

একইভাবে, কবিতার ক্ষেত্রেও বিষয়টা খাটে। এই যে উনি অন্যরকমে ভাষায় একটা কবিতার বই লিখলেন, এই অন্যরকম ভাষার ব্যবহারটি সফল হবার পূর্বশর্তই হবে – কবিতাগুলি সফল হয়েছে কি না তার উপর।

সেই হিসাবে হিসাব করতে গেলে, বলতেই হবে এই বইয়ের কবিতাগুলি সফলতার দিকে বেশ প্রবল ভাবে এগিয়েছে বা সফল হয়েছে। লেখাগুলি একটা ‘অধরা’ অনুভূতির সন্ধান দেয় আমাদের, খুব সহজ ভাষায় লেখা কিছু ঘটনা পরম্পরা – অথচ পড়া শেষে দেখা যাবে – বেশ একরকমের চিন্তা নিয়ে, দ্বন্দ্ব নিয়ে আমরা বসে আছি। একটা অনুভূতি লাভ করি। একটা চিন্তা। চির পরিচিত জগতকে অন্যভাবে দেখতে পাই। নতুন ভাবে কথা বলার ইঙ্গিত লাভ করি।

এদিকে, আধুনিক/তত পরবর্তী-কালীন এবসার্ডিটি ঘুরেফিরে চলে আসে। এখানে প্রেমগুলাও নিষ্কণ্টক রোম্যান্টিক প্রেম নয়, এখানে প্রেমগুলাও আরও নানা রকম হতাশা, এবসার্ড-সেন্স, তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা (মনোগ্যামি, পলিগ্যামি) , রসিকতা ইত্যাদি নিয়ে হাজির হয়। সুতরাং কবিতা হিসাবে এগুলা অবশ্যই সফল বলতে হয়। বইটা থেকে হঠাৎ করে পাওয়া দুটা চমৎকার অন্যরকম পঙক্তির উদাহরণ দেই। এরকম নানা নানা অজস্র অরিজিনাল পঙক্তি এ বইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

” …রাস্তায় অনেকগুলি গাড়ির হর্ন একসাথে বাইজা উঠার মতোন/বইলা উঠলা তুমি তখন”

” … কোন এক যুবতী বউয়ের গোসল বাঁশঝাড়ের চিপায় দাঁড়ায়া দেখার মতোন একটা দুপুর …”

বইটি সুখপাঠ্য। অন্তত আমার মনে হয়েছে – কোনো রকমের এক্সট্রা চাপ ব্যতিরেকে অনেকগুলি কবিতা পর পর পড়ে যাওয়া সম্ভব। যদিও প্রায়শই দেখা যাবে একটা কবিতার পরে পাঠককে ব্রেক নিতে হচ্ছে – তবে তা ক্লান্ত হয়ে নয়, বরং কবিতার বিষয়বস্তুটি – জন্ম নেয়া মধুর কনফিউশনটি সমাধা করার জন্য। বইটি নিঃসন্দেহে পড়ার মতো – দীর্ঘদিন ধরে বার বার করে পড়ার মতো একটি বই বলে মনে হয়েছে।…

পুরা লেখাটা পড়তে পারবেন এইখানে:
https://www.facebook.com/imrul.hassan/posts/10156471604437093

Leave a Reply