জীবনানন্দ’র ‘সমারূঢ়’ নিয়া

 

জীবনানন্দ’র এই কবিতা নিয়া কথা বলতে হইতেছে ফেইসবুকের একটা  আলাপের কারণে; কোনএকটা জায়গায় আমি কইছিলাম যে, বাংলা-কবিতার সমালোচনা নিয়া যে নেগেটিভ একটা ধারণা এগজিস্ট করে, সেইটাতে এই কবিতার কন্ট্রিবিউশন আছে। তখন অনেকে (যদ্দূর মনে পড়ে রায়হান রাইন, মুজিব মেহদী এবং আরো কয়েকজন) আমার কথার প্রতিবাদ করছিলেন, উনারা করতেই পারেন, সেই রাইট উনাদের আছে; কিন্তু আমার মনে হইছে যে, ডিটেইলসে আমার পয়েন্টটাও বইলা রাখা দরকার।

আসেন, আগে কবিতাটা পড়ি।

 

সমারূঢ়

‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা –‘
বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয় – সে যে আরূঢ় ভণিতা:
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ‘পর
ব’সে আছে সিংহাসনে – কবি নয় – অজর, অক্ষর
অধ্যাপক, দাঁত নেই – চোখে তার অক্ষম পিচুঁটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে – আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো – হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।

(পৃষ্টা: ২০৬, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র – জীবনানন্দ দাশ, আবদুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত)

জীবনানন্দ দাশ-এর সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের ৩নম্বর কবিতা এইটা। কাব্যগ্রন্থটা প্রকাশিত হয় অগ্রহায়ণ ১৩৫৫ (ইংরেজী ১৯৪৮সনে)। রচনাকাল: বাংলা ১৩৩৫-১৩৫০ (ইংরেজী ১৯২৮-১৯৫০)।

 

‘সমারূঢ়’ শব্দটার ডিকশনারি মিনিং হইলো ‘সম্যক উপরে উপবিষ্ট; বিশেষভাবে অধিষ্ঠিত’। তার মানে উপরের পজিশন। ‘সমারূঢ়’ মানে তিনি, যিনি কিছুটা উপরে আছেন। উপরে কে আছেন? ধারণা করি, যারে বিভিন্ন সময় ‘ছায়াপিন্ড’ ‘আরূঢ় ভণিতা’ ‘অধ্যাপক’ হিসাবে উল্লেখ করছেন, তিনি বা তারা-ই; তারা যে ‘কবি নয়’ এই উল্লেখও আছে ২বার। ধরে নিতেছি, তারা ‘সমালোচক’, ‘ব’সে আছে সিংহাসনে’। এইগুলা ত আসলে এক ধরণের ক্রোধ  কবি’র দিক থিকা; উনি সেই মানুষটার বর্ণনা দিতেছেন যে কিনা নিজেরে উপরে আছে বইলা ভাবতেছে, কিন্তু আসলে উপরে নাই। সে কবিতা লিখতে চাইতো, এখন পারে না, কবিতার সমালোচনা লিখতেছে খালি। কবিতা লিখতে পারলে সে আর কবিতার সমালোচনা লিখতো নাকি! তার মানে সে যদিও নিচে আছে, কিন্তু যেহেতু কবিতা নিয়া বলতে পারে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারে, টাকা কামাইতে পারে, ভাবে যে সে উপরে আছে; কিন্তু সে ত কবিতা লিখতে পারে না, কবি-ই না সে, কবিতার সমালোচনা কেমনে করে! এই মিহি শ্লেষের টোনটা কবিতাতে আছে।

জীবনানন্দ কবিতা লিইখা প্রমাণ করতে পারছেন যে, যে কবিতা লিখতে জানে না, সে যদি সমালোচনা করে, সে ইনফিরিয়র একরকমের, কারণ সে যা করে তার সোশ্যাল ভ্যালু আছে, যার ফলে আর্টিস্টিক ভ্যালু নাই কোন। এইখানে উপরে-নিচে একটা ব্যাপার অ্যাজিউম করা আছে; কেউ নিচে না থাকলে খালি খালি তো কেউ উপ্রে থাকতে পারে না। কিন্তু কবি বা সমালোচক কেউ  ইনফিরিয়র বা সুপিরিয়র হইতে পারে না, কারণ যদিও দুইজনের মাধ্যম একটাই, ভাষা; উদ্দেশ্যটা কোনভাবে একই না; এইটা উপর-নিচ হওয়ার কোন ব্যাপার না, দুইটা জাস্ট ডিফরেন্ট প্লাটফর্ম। মনে হইতে পারে যে, কবি এত কম কথা কইয়া এতকিছু বইলা ফেলতে পারেন আর সমালোচক এত বেশি কথা কয়াও তেমন কিছুই বলতে পারেন না, কবি তো ডেফিনেটলি বেটার; মানে উপর-নিচ এর কল্পনা নানানভাবেই পসিবল একটা অপশন! এখন এই উপর-নিচ এর অপশনরেই আমি নিতে রাজি না, কারণ ‘বলতে পারা’টা কোন দাড়িপাল্লা না, যেইটাতে কবিতা আর সমালোচনা’রে মাপতে পারি আমরা। এখন সমালোচকের কাজ কি সেইটা নিয়া ত আরো কথা হইতেই পারে।

দুইজনের কাজ দুইটা, তাদের অবজেক্টিভ একই না; এইটা এই কবিতাতে এক্সপ্লিসিটলি বলা নাই, যার ফলে এই কবিতার সমালোচক’রে নিয়া, সমালোচনা নিয়া আরো হাসি-ঠাট্টা করা যায়।

এখন এই হাসি-ঠাট্টা আসতে পারে যখন আপনি আইডেন্টিটিটারে একটা  ফিক্সড জিনিস বইলা ভাবতে পারবেন; যিনি সমালোচক তিনি আর কবিতা লিখেন না এবং যিনি কবি তিনি কবিতার সমালোচনা লিখতে পারবেন না; সিঙ্গুলারিটি’র এই বেড়াটা ইমাজিন না করতে পারলে আপনার পক্ষে ঠাট্টা’টা করা পসিবলই না। একটা হাসি কেমনে আসে যদি সে কোন বেড়া-ই না ডিঙাইতে পারে! আপনারে ধইরা নিতে হবে  যে বউ, সে মা হইতে পারে না, মা হইলে সে আর কখনোই প্রেমিকা হইতে পারবে না – এই অ্যাজাম্পশনটা ইনভ্যালিড হয়া গেলে কবিতাটা একটু ভালগারই লাগার কথা।

জীবানানন্দ কি বলছেন সেইটার চাইতে ইর্ম্পটেন্ট হইলো উনার টেক্সটের রিডিংটা কিভাবে প্রমিনেন্ট হয়া ওঠে বা উঠতে পারে। আমরা যা দেখি সেইটা রিয়ালিটি না, বরং কিভাবে আমরা দেখি, সেইটাই হইলো রিয়ালিটি।

আবার, জীবনানন্দ’র সময় হয়তো সমালোচকরা সোশ্যালি অনেক পাওয়ারফুল ছিলেন, তারা নানান যন্ত্রণা দিছেন তার কবিতার উল্টা-পাল্টা ব্যাখ্যা কইরা। তাই তিনি তাদের বর্তমান (ওই সময়ের) অবস্থা বিবেচনা কইরা তুলাধুনা করছেন; এই ‘ক্রোধ’ তিনি প্রকাশ করতেই পারেন, সেই ‘নৈতিক অধিকার’ উনার থাকতেই পারে; কিন্তু এর ভিতর দিয়া কবিতাটারে ত একটা ভুল-ব্যাখ্যার ভিতর দাঁড় করানো যায় না;  যে উনি সমালোচকদের সুপিরিয়র-ইনফিরিয়র বইলা ভাবেন নাই।

সমালোচনা বিষয়ে জীবনানন্দ’র আরো অনেক কথা থাকতে পারে, কিন্তু স্পেসিফিক্যালি এই কবিতাতে তিনি কি বলছেন, সেইটা নিয়াই আমি বলতে চাইছি। এমনিতেও এইটা জীবনানন্দের সবচে দুর্বল কবিতাগুলার একটা। এই কবিতা দিয়া জীবনানন্দের কবিতারে বিচার করতে গেলে খুবই ভুল কাজ হবে।

‘সমারূঢ়’ কবিতার একটা আদি ভার্সনও আছে দেখলাম।

 

Leave a Reply