বিলাই ও কুত্তার হৃদয়

এইটা ত ঊনিশো চুয়াত্তর সাল না; তারপরও কুত্তাটা দুর্ভিক্ষের কান্দা কানতেছে, সকাল হইতে না হইতেই। একটানা। কিসের লাইগা কান্দে সে; শিরিন-আরা ভাবার চেষ্টা করেন। দারোয়ানগুলা ঠিকমতো খাইতে দেয়া না ওরে? খিদা লাগছে? নাকি দেশের লাইগা ওর পেট পুড়ে? বসুন্ধরা রেসিডেনশিয়াল এলাকায় বেশিরভাগই কুকুর; কুত্তা কমই দেখা যায়। কুকুরগুলা এক একটা বাঘের লাহান, গলায় বেইল্ট লাগানো, চেইন লাগানো; দেখা যায়, যখন এরা হাঁটতে বাইর হয়, বিকালবেলায়। ছোটখাট বিলাইয়ের মতো কুকুরও আছে কিছু, কিন্তু ওইগুলা রাস্তায় বাইর হয় না, এইজন্য কম কম দেখা যায়। বাইরে বাইর হইলে এদের গায়ে ময়লা লাগে। এরা গাড়িতে কোলের উপ্রে সাইজা-গুইজা বইসা থাকে। এইরকম একটা কুকুর-সমাজে বাসার দেশি-কুত্তাটা একটা রেয়ার পিস। ওর ত একলা লাগার কথা, বিদেশ-বিদেশ লাগার কথা; কান্দে কি এর লাইগাই, তাইলে! শিরিন-আরা ভাবেন উনার লাইগা কে কানবে আর! যদি নাতি-নাতনি থাকতো তাইলেও না হয়, মরা’র পরে বিলাই পালতো তার নামে। এই দুঃখে তার বিলাই হৃদয়ও কানতে চায়, এইরকম স্ট্যাবল জিডিপি গ্রোথের টাইমে। রিসার্চ কইরা যাঁরা গল্প লিখতে বসেন তাঁরা আরো স্পেসিফিক ডাটা নিতে পারতেন এই জায়গাটাতে। আমরা এভয়েডই করি বরং!

বাইরে, সবকিছু পরিষ্কার তখন, আকাশে লালরং ছড়াইয়া আরো অনেকক্ষণ ধইরা ক্যাটক্যাট করবো সূর্যটা। ভাইরে উঠেন, উঠেন না, অফিসে যাইবেন না! বইনরে ওঠেন, বাচ্চা-কাচ্চা স্কুলে যাইবো না; ওদেরকে তুলেন! এইরকম ডাকতে থাকে সে পর্দার ফাঁক দিয়া। ভাই বইনেরা একটু কমই শোনেন উনার এই অর্গানিক ডাক। উঠলেও বইনেরা ঝাল ঝাড়েন বুয়া’র উপ্রে, তোমারে না কইছি, আরো আগে উঠতে! বাচ্চাদের বকা দেন না, কারণ এতে ওদের মানসিক গ্রোথে সমস্যা হইতে পারে! আর ভাইয়ারা, অফিসে গিয়াই বলেন, অনেক বইনেরাও, রাস্তায় কি যে জ্যাম! ঢাকা শহরটা দেখছেন এখন থাকার অযোগ্য! দৈনিক পত্রিকাগুলাও সমর্থন দেয় এইটাতে, আওয়ামীলীগরে দেয়া জাতীয়পার্টির সমর্থনের মতো; যে, ঠিক ‘থাকার’ না, ‘বসবাসের’ অযোগ্য; দেখেন না একটা রির্সাচেও আসছে; আমরা আমাদের গল্প-লেখকদের দিয়া ঢাকা শহরের জ্যামের উপ্রে একটা স্পেশাল গল্প-সংখ্যা বাইর করবো এরপরে। এইরকম সর্বদলীয় স্থিতিশীল অবস্থায় ভাই-বইনেরা তাই খুশিমনে সূর্যের ডাক ইগনোর করতে পারেন আরো। মফস্বলী-সাহিত্যের লিডার আহমেদ ছফা যদিও লিখিয়াছিলেন, সূর্য তুমি সাথী! সেইটা রাশিয়াতে কমরেডদের শাসন ইনভ্যালিড হওয়ার আগেই বাতিল হয়া গেছিল বাংলা-সাহিত্যে! পর্দার ফাঁকে এখনো সে দুলে, মনের হরষে; মকারি-সাহিত্যেরই আড়ালে! রিভাইভ করতে পারবে না সে, অন্য কোন ফর্মে! সূর্যও ভাবে, তাঁর ডাক কেউ না শুনলেও সে একলাই রবি হয়া ওইঠা যাবে, আরো উপ্রে!

সূর্যের এই রাগ দেখার আগেই অনেকে, যাঁদের বয়স বেশি, সিনিয়র সিটিজেন, তাঁরা এই ডাক কবুল করেন। তাঁদের কেউ কেউ তবলিগ জামাত করেন। কেউ কেউ শরীরের মূল্য বুঝেন। তাই ভিন্ন ভিন্ন ফর্মে তাঁরা একই সূর্যরে পাত্তা দেন।

এইরকম এক সকালে শিরীন-আরা তার শূণ্যতার বাইরে আইসা একটা কারেক্টার হইলেন, গল্পের; হাঁটতে বাইর হওয়ার কারণেই মেইনলি। তো আসেন, চরিত্র-বর্ণনা করি। ছয়তলা বিল্ডিংয়ের তিনতলায় থাকেন উনি। বড়পোলার সাথে। জামাই মারা গেছেন। দুইটাই পোলা উনার। ছোটটার বউ একটা বদশাইশ। মুখের উপ্রে চটাং চটাং কইরা কথা কয়। শিক্ষা-দীক্ষা নাই, ও-লেভেল ফেইল; লাজ-শরমও কম। বড়টার বউও যে খুব ভালো, তা না; তবে ভদ্র পরিবারের মে বইলা লজ্জা-শরম আছে কিছু; সরাসরি কয় না, ইশারা-ইঙ্গিত রাইখা কথা কয়; যেইটা চাইলে নেয়া যায় বা চাইলে ইগনোরও করা যায়। ভদ্রতা এইরকমই; নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো, মিছিল-মিটিং করা যায়, কথাও বলা যায়, কিন্তু কোন এফেক্ট নাই, সিচুয়েশন যা আছে, তা-ই; বিচারবিভাগের উপ্রে কব্জা রাখতে পারলেই ক্ষমতায় থাকা যায়। থাকা আর কী! এই সকালবেলার হাঁটাটাই। একটা ঘণ্টা নিজের সাথে থাকা যায়। কুত্তাটা কান্দে তখনো। কুত্তাটারে দেখতে দেখতে শিরিন-আরা’র হৃদয় বিলাইয়ের মতো নরোম-সরোম হয়া যায়। বেজার মন নিয়া তিনি বাইর হয়া আসেন, বাইরে; কোনরকম কাঁই-কুঁই না কইরাই।

বাইরে আইসা ভাল্লাগে। সকালবেলা আকাশ এতো পরিষ্কার। মনেহয় ফেরেশতারা এখনো ফেরত যায় নাই আকাশে, দুনিয়া থিকা। ভাঙা রাস্তাগুলাও সুন্দর, যখন বেহুদা প্রাইভেট কারগুলা না চলে। মানুষ হাঁটার জন্য ঠিকই আছে। কুত্তা বিলাইয়েরও। কী মিহি রঙের বাতাস! জোরে জোরে হাঁটতেই আর ইচ্ছা করে না। মনেহয় নিজের ওঠানে দাঁড়াইয়া থাকি। পুবের বাতাসে গাছের পাতাগুলা কাঁপে। গতরাতের বৃষ্টিতে কাঁচা পেঁপে পইড়া গেছে কয়েকটা। তুলতে যাবে শিরিন-আরা আর এমন সময়ে দেখে শে পেঁপেগুলা রাখা আছে আসলে একটা ঝুড়িতে আর একটা ছোট কুত্তা বইসা আছে তার সামনে। শিরিন-আরা ভাবেন, কুত্তা কেন সব্জি বেচে, কেমনে? উনি হয়তো খেয়াল করেন নাই যে, উনি বিলাইয়ের মতোই হাঁটতেছিলেন আসলে। এই সচেতনার পরে মানুষ হয়া দেখতে পাইলেন ওইটাও ছোট্ট কিউট কোন কুত্তা না আসলে; ছোট্ট একটা পোলা, সাত বছর বয়স হবে। পেঁপে বেচতেছে। কিন্তু ছোট্ট একটা পোলা একলা কেমনে বেচে? এই বয়সে ত তার স্কুলে যাওয়ার কথা, নাইলে মানুষের বাসায় কাজ করার কথা। এই বয়সেরই ছিল তাঁর বড়ছেলেটা  ঊনিশো চুয়াত্তরে। পেঁপে বেচতে গেছিল বাজারে। কি যে কান্দন, মাস্টারের ব্যাটার। এই পোলাটা ত কান্দে না। কান্দে না কেন? শিরিন-আরা ফিল্ড স্টাডি শুরু কইরা দেন তখন:

‘কি রে পেঁপে বেচবি নাকি?’

বাচ্চা-কুত্তায় কোন কথা কয় না।

‘কথা কছ না কেন? দাম কত?’

‘উউউউ…’ গোঙায় সে।

‘কিরে পেঁপে বেচবি না? ত, বাসায় কাম করবি?’

বাচ্চা-কুত্তাটা আরো গাঁট মাইরা বইসা থাকে।

‘ল, তরে বাসায় লইয়া যাই!’

বাচ্চা-কুত্তাটা মাথাটাই নোয়াইয়া ফেলে।

‘বুঝছি, পেঁপে হইলো তর কইলজা। পেঁপে লইয়া যাই তাইলে!’

 

ইন্টারভিউ শেষ কইরা তিনি পেঁপে হাতে নেন। যাওয়া ভঙ্গি করেন। এবং যখন বুঝতে পারা যায় যে, তিনি চইলাই যাবেন সেই সীমানার একটু দূরে যাওয়ার পরেও অবস্থার উন্নতি হয় না। মানে, তথাপি কুত্তাটি নড়ে না।

শিরিন-আরা আরো এগ্রেসিভ হন। বাচ্চা-কুত্তারে কোলে নিতে উদ্যত হন। ‘ল, তরে বাসায় লইয়া যাই।’

এই শারীরিক কসরতের জায়গাটাতে আইসা তখন কুত্তার বাচ্চাটা ফট কইরা মানুষের বাচ্চা হয়া যায়, এবং লাস্ট মোমেন্টে একজন প্রকৃত প্রলেতারিয়তের মতো চিৎকার দিয়া ওঠে, ‘আ-ব্বা!’

শিরিন-আরা দাঁড়ান; এইদিক ওইদিক তাকান, আব্বা কই? ইন দ্য মিন টাইম উনি দৌড় মারতে পারতেন; কিন্তু উনি বুঝতে পারেন এইটা ঊনিশো চুয়াত্তর সাল না। তাই তিনি ডরান না। হিস্ট্রি রিপিট ইটসেলফ অনলি ইন আওয়ার অউন অ্যাসপেক্ট! লেটস ফেইস ইট! উহার মুখখানা দেখি। এইরকম একটা ব্যাপার। দেয়ালের সাইডের একটামাত্র ছাপড়া ঘর থিকা আব্বা বাইর হন। ঘুমাইতেছিলেন মনেহয়। লুঙ্গিতে গিঁট দিতে দিতে আসতে থাকেন, ঘটনার দিকে। পোলা’রে জিগান (যেহেতু আব্বা ডাকাতে হাজির হইছেন, এই কারণে সম্পর্ক হিসাবে এইরকমই ভাবতে হইলো), ‘চিল্লাস কেন!’ আর তখনই তিনি বয়স্ক বিলাইটারে দেখতে পান, উনার হাতে পেঁপে-ধরা। জিগান তারে,

‘পেঁপে লইয়া আপনি কই যান?’

‘আমি ত পেঁপে কিনতে চাই।’

‘কিনতে চান ত দাম কইবেন, হাতে নিছেন কেন?’

‘হাতে নিয়া দেখবো না!’

আব্বা বুঝতে পারেন, খুব একটা সুবিধা হইতেছে না। তখন পোলার দিকে টার্ন করেন, বয়স্ক-বিলাইরে আরো কেমনে টাইট কইরা ধরা যায়, সেই পয়েণ্ট বাইর করার লাইগা।

‘কি রে কি অইছে? তুই ক!’

পোলা হইলো বাপের বেটা। বুঝতে পারে বিষয়টা, মানুষ ত; বাচ্চা-কুত্তা ত সে আর না!

কয়, ‘আমারে বাসায় নিয়া যাইবার লাইগা টানাটানি শুরু করছে এই মহিলা!’

আব্বা তখন পিতৃত্ব নিয়া ফুঁইসা ওঠেন। আমরা কি মানুষ না! কুত্তা-বিলাই আপনাদের কাছে! আপনারেই ত একটা বিলাইয়ের মতো লাগে! ইত্যাদি ইত্যাদি। এইরকম।

মানুষজন জাগতেছে তখন। বিপ্লবের আওয়াজ শুইনা টিভি’র বাইর হইতে শুরু করছে। শিরিন-আরা বুঝতে পারেন এই লড়াই তিনি জিততে পারবেন না কারণ এইখানে মানুষজন ফিউচারিস্টিক, বাচ্চাদের বেশি পছন্দ করে এখন, বয়স্কদের চাইতে। আর এদের সাথে কথা বইলাই কি হবে! নিজেরাই নিজেদেরকে কুত্তা-বিলাই বলে! কনস্ট্রাকশনের কাম করতে আসছে, কয়দিন পরে চইলা যাবে। শহরের মানুষরে যে একদিন সকালবেলায় অপমান করতে পারলো, এইটাই ওদের অ্যাচিভমেন্ট। এই ভাইবা উনি সরে আসতে থাকেন। হালকা রোদের ভিতর ভাসতে ভাসতে।

রোদ ওঠলে সব মানুষ তার ঘুম থিকা, স্বপ্ন থিকা জাইগা ওঠে; জীবনের ভিতর জন্তু হইতে থাকে। একটু টাইম লাগে অবশ্য, স্টার্ট নিতে। মাঝে-মধ্যে প্যাঁচও লাগে একটু। সকালবেলায়; হৃদয়, হুদাই জাইগা উঠে, শরীরের সাথে।

 

 

অগাস্ট, ২০১৪।

Leave a Reply