‘ছোটদের’ জিয়াউর রহমান

[ছোটদের বলতে ঠিক বাচ্চাদের না আসলে; বরং যারা সার্টেন-ভঙ্গিমার বাইরে, ট্রেডিশনের বাইরে চিন্তা করতে শিখে নাই, অইরকম ‘ছোটদের’ জন্য লেখা। পুরান বামপন্থীদের কিছু বই-টই আছে না – ‘ছোটদের রাজনীতি’ ‘ছোটদের অর্থনীতি’ অইটার রিভার্স-ভার্সন টাইপের। আরেকটু এডিট-টেডিট করা লাগবে হয়তো পরে, কিন্তু এই ছোট বইটা পড়তে পারেন, ইনিশিয়াল আইডিয়া হিসাবে।]

১.
বাংলাদেশে এমন হাজার-হাজার ইন্টেলেকচুয়াল পাইবেন, যারা দাবি করেন যে উনারা আওয়ামী-লীগ/বাকশাল করেন না, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানরে পছন্দ করেন।

কিন্তু এমন একজন ইন্টেলেকচুয়াল পাওয়া মুশকিল, যিনি বিএনপি করেন না, কিন্তু জিয়াউর রহমান’রে পছন্দ করেন।

এইটা খালি রেয়ার-ই না, আমাদের পলিটিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের যেই বেইজ, সেইখানে এইরকম একটা পজিশন মোটামুটি ইম্পসিবল একটা ঘটনা।

২.
– জিয়াউর রহমানের শাসন-আমল (১৯৭৯ – ১৯৮১) হইতেছে বাংলাদেশে ডেমোক্রেটিক শাসনের শুরুয়াত –

বাংলাদেশে ফার্স্ট ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশন হইছিল ১৯৭৯ সালে। অই ইলেকশনে দেশের মানুশের ভোটে বাংলাদেশের ফার্স্ট ইলেক্টেড রাষ্ট্রপ্রধান হইছিলেন জিয়াউর রহমান। [ সেকেন্ড হইতেছেন বেগম খালেদা জিয়া, ১৯৯১ সালে। ]

সো-কল্ড বামপন্থীরা দেখবেন জিয়াউর রহমানরে “সামরিক-শাসক” কইতে কইতে মুখে ফেনা তুইলা ফেলে। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কোন ইলেকশনের ব্যবস্থা করা হয় নাই, দেশের গর্ভমেন্ট ফর্ম করার জন্য দেশের মানুশের ম্যান্ডেট নেয়া হয় নাই। ১৫ মাস পরে, ১৯৭৩-এর মার্চ মাসের ইলেকশনে বাংলাদেশের মানুশরে ভোট দিতে দেয়া হয় নাই। ১৯৭৫-এ সব বিরোধীদল নাই কইরা দেয়া হইছিল। বাংলাদেশের মানুশের ভোট দেয়ার, রাজনীতি করার কোন অধিকার ছিল না।

এই নন-ডেমোক্রেটিক শাসন নিয়া কোন কথা শুনবেন না এই বাটপারদের মুখে। কারণ সো-কল্ড কমিউনিস্টরা ছিল অই জুলুমের শাসনের ইন্ট্রিগ্রাল পার্ট। এরা বিপ্লবী না, এরা নন-ডেমোক্রেটিক, এন্টি-পিপল ফোর্স, বাংলাদেশের রাজনীতিতে।

জিয়াউর রহমানের ইকনোমিক ইনিশিয়েটিভগুলা উনার পলিটিক্যাল আইডিওলজিরই কন্সিকোয়েন্স। উনি ডেমোক্রেটিক ছিলেন। এইটারে ‘পাকিস্তানি করণ’ বইলা প্রমাণ করতে চায় নন-ডেমোক্রেটিক বাম-বাকশালিরা।

এই কারণে, বাংলাদেশে যখনই ডেমোক্রেটিক শাসনের কথা বলা হবে, জিয়াউর রহমানের কথা দিয়াই আমাদেরকে শুরু করতে হবে সবসময়। এই কারণেই বাম-বাকশালিরা জিয়াউর রহমানরে ভিলেন বানাইতে চায়। কিন্তু এর ভিতর দিয়া অদের নন-ডেমোক্রেটিক পজিশনই আরো স্পষ্ট হইতে থাকে সবসময়।

৩.
– ডেমোক্রেসি’রে সেন্টার পয়েন্ট ধরলে, বাংলাদেশের কনটেক্সটে জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের চাইতে ইম্পর্টেন্ট পলিটিক্যাল লিডার –

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে যেইসব এজেন্সিগুলা পিপলরে ডমিনেন্ট করে, সেইসব এজেন্সিগুলারে খুব ভালোভাবে মবিলাইজ করতে পারছিলেন। যার ফলে, এইরকমের পলিটিক্সের জায়গা থিকা বাংলাদেশের সমাজে এক ধরণের রিসোর্স মবিলাইজেশন শুরু হইছিল, যেইটা স্বাধীনতার পরে হইতে পারে নাই।

অইটা ছিল জিয়াউর রহমানের রাজনীতির মেইন সিগনিফিকেন্স, যেইটা এখনো কম-বেশি কন্টিনিউ আছে (বা ছিল কয়দিন আগে পর্যন্ত)। কিন্তু নয়া বাকশালি রিজিমে আইসা আবার হুমকির মুখে পড়ছে।

মানে, আমি বলতেছি, সেন্টার হিসাবে এই জায়গাটারে ভাবেন যে, বাংলাদেশে পিপলস পলিটিক্স কে করছেন, কেমন করছেন?

শেখ মুজিবুর রহমান যতটুক পিপলস লিডার ছিলেন পাবলিক এনগেইজমেন্টের জায়গা থিকাই ছিলেন, কোন এজেন্সির থ্রু’তে উনার কানেক্ট করতে হয় নাই পিপলের লগে। নিজের দলের নেতা-কর্মীরা তো ছিলই; কিন্তু যখনই উনি এই “নেতা-কর্মীদের” হাতে জিম্মি হয়া গেছেন, পিপলের কাছ থিকা দূরে সরতে থাকছেন, কানেক্ট করতে পারেন নাই আর।

খালি এইটাই না, উনার মেজর পলিটিক্যাল ব্যর্থতা ছিল দুইটা – এক, উনি কোন পলিটিক্যাল সিস্টেম তৈরি করতে পারেন নাই পারসোনাল কারিশমার বাইরে।সেকেন্ড, উনি খালি “দলীয় নেতা-কর্মী” না, বরং সরকারি আমলা-কর্মচারীদের কাছে সারেন্ডার করছিলেন। (উনার বাকশাল গঠনের ভাষণে এর ইন্ডিকেশন পাইবেন।) কন্সপিরেসি থিওরি’র বাইরেও যেইখান থিকা মিলিটারি ক্যু’গুলা অর্গানাইজড হওয়ার পলিটিক্যাল সিচুয়েশন তৈরি হইছিল।

আর আনটিল জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশে কোন রাজনীতি শুরুই হইতে পারে নাই। এইটারে পিপলস পলিটিক্স বলা না গেলেও, এইটা জনগণের রাজনীতির শুরুয়াৎ বইলাই আমাদেরকে মানতে পারতে হবে।

জিয়াউর রহমানরে নিয়া সবচে বড় যেই ভুল ধারণাটা চালু আছে, সেইটা হইতেছে, উনি ক্যান্টনমেন্ট থিকা পলিটিক্স করা শুরু করছিলেন। বরং উনিই একমাত্র লোক যিনি রাজনীতিরে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়া আসছিলেন।

উনার এই পলিটিক্যাল সিগনিফিকেন্স বিএনপির লোকজন বলা তো দূরের কথা, বিশ্বাসই করে কম। যখন “দলীয় নেতা-কর্মী” ও সরকারি আমলা-কর্মচারী-এলিটগোষ্ঠীদের দখলে চইলা গেছিল বাংলাদেশের রাজনীতি, তখন মিলিটারি ক্যু’র মাধ্যমে পলিটিক্স ক্যান্টমেন্টে ঢুকে গেছিল।
জিয়াউর রহমান সেইটারে সরায়া নিয়া আসছিলেন। আইনা “দলীয় নেতা-কর্মী” নামে যেই পিপলস এজেন্সিগুলা তৈরি হয়, তাদের হাতে তুইলা দেন নাই; তাদেরকে মবিলাইজ করছিলেন।

এই যে, মিলিটারি’র হাত থিকা রাজনৈতিক ক্ষমতার জায়গাটা ধীরে ধীরে সইরা যাওয়াটা, এইটা মিলিটারির লোকজনই পছন্দ করার কথা না। যার ফলে এরশাদের ক্ষমতা দখলের ভিতর দিয়া মিলিটারি এবং সরকারি আমলা-কর্মচারী-এলিটগোষ্ঠীদের একটা আঁতাত তৈরি হয় আবার।
একটা জিনিস মনে রাখবেন, একজন পলিটিক্যাল লিডারের পক্ষে পুরান সিস্টেম উলট-পালট কইরা ফেলা, নতুন একটা পলিটিক্যাল কালচার তৈরি করা কখনোই সম্ভব না, যদি না এইটা তাঁর চারপাশের লোকজনও এইটারে অউন না করে। এইটা খালি একজন পলিটিক্যাল লিডারের কাজ বইলা আমি মনে করি না, এইটা বরং জনগণের পলিটিক্যাল কনশাসরে তৈরি করার ঘটনা।

বাংলাদেশে যেইটা সবসময় মিসিং ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যর্থতা হইতেছে, পিপলস এজেন্সি তৈরি না করতে পারার ব্যর্থতা।

জিয়াউর রহমানের এই পলিটিক্যাল সিগনিফিকেন্স নিয়া আলাপ কম বা নাই বইলা উনার এই কন্ট্রিবিউশন বাতিল হয়া যায় নাই, বরং যত দিন যাবে জিয়াউর রহমানের এই জায়গাটা আরো স্পষ্ট হইতে থাকবে।

ইতিহাস কোনদিন জোর কইরা লেখা যায় না। কিছুদিন লুকায়া রাখা যাবে, চুপ করায়া রাখা যাবে, কিন্তু মুইছা ফেলা যাবে না আসলে।

৪.
বাংলাদেশে নয়া-বাকশালি শাসন শেষ করতে হইলে বাম-বাটপারদের (লিনিয়ার হিস্ট্রি-রিডিংয়ের) বিপক্ষে থাকতে হবে, সবসময়। জিয়াউর রহমানের এই রাজনৈতিক শিক্ষা আমরা এখনো শিখতে পারি নাই।

আওয়ামীলীগের ফেভারে কথা কইলে আওয়ামীলীগ হইতে হয় না আপনারে, কিন্তু বিএনপি’র ফেভারে কথা কইলে বিএনপি হয়া যাইতে হয়!
পিপল-এজেন্সিগুলারে নাই কইরা দিয়া এই পলিটিক্যাল-বাটপারগুলা পিপলের অথরিটি হয়া বইসা আছে। এই অথরিটি’রে, ক্ষমতার মাউথ-পিসগুলারে আইডেন্টিফাই করতে হবে।

বাংলাদেশের বামেরা যদি আপনারে নিতে পারে, তাইলে বুঝতে পারবেন আপনার পলিটিক্স এখনো হইতেছে না আসলে।
জিয়াউর রহমান অই অথরিটি’র জায়গাটারে কোনঠাসা কইরা ফেলছিলেন। বাংলাদেশের সো-কল্ড বামেরা সুইসাইড করবে, কিন্তু জিয়াউর রহমানরে এই হিস্ট্রিক্যাল কারণেই নিতে পারবে না কোনদিন।

৫.
আপনার যখন ক্ষমতা থাকবে তখন ‘ভালো’ কিছু করার চাইতে ‘ঠিক’ কাজ করতে পারা’টা বেশি জরুরি।

পলিটিক্যাল পাওয়ারের কয়েকটা উদাহারণ দিয়াই বলি। ধরেন, শেখ মুজিবুর রহমান যখন ক্ষমতায় ছিলেন, উনি দেশের জন্য, দশের জন্য ‘ভালো’ কিছু করতে চাইয়াই তো বাকশাল বানাইছিলেন; কিন্তু আর যা-ই হোক, এইটা পলিটিক্যালি ঠিক কাজ ছিল না; উনার ফলোয়ার’রাও পরে বুৃঝতে পারছেন সেইটা। এর সাথে যদি কম্পেয়ার করেন জিয়াউর রহমান মেবি খুব বেশি ‘ভালো’ কাজ করতে পারেন নাই, কিন্তু কিছু ‘ঠিক’ কাজ করতে পারছেন। যেমন, রাজনৈতিক দল বানানোর রাস্তা খুইলা দিছেন; সরকারি পত্রিকা বাদেও অন্য পত্রিকা করার লাইসেন্স দিছেন… – এই জিনিসগুলা যতোটা না ‘ভালো’ তার চাইতে ‘ঠিক’ কাজ। এই কারণে দেখেন, উনার এই কাজগুলা আছে। পরে যারা ক্ষমতায় আসছেন, কেউ বাতিল করার কথা ভাবেনও নাই।

এমনকি দেখেন, এরশাদ যেই ঠিক কাজ’টা করছিলেন, উপজেলা বানায়া; এরশাদ’রে বাদ দিলেও তার এই (‘ভালো’ না, বরং) ‘ঠিক’ কাজটারে বাদ দেন নাই কেউ।

ভালো কাজ আর ঠিক কাজের একটা বেসিক ডিফরেন্স হইতেছে, বিচার করার জায়গাটা। আপনি ‘ভালো’ করতে গিয়া আপনার ভালো’র ধারণা বা কনশাসনেসটারে অন্যের উপ্রে চাপায়া দেন আসলে, বরং যার ‘ভালো’ করতে চাইতেছেন, তার ভালো-মন্দ তারে বিচার করতে দেন, এইটা তার জন্য ভালো না-ও হইতে পারে, কিন্তু এইটা আপনার দিক থিকা তার জন্য ঠিক একটা কাজ। মানে, ঠিক কাজ হইলো, বিচার করার ফ্রিডম’টা দেয়া, কাউরে খুশি করার চাইতে একটা কমন গ্রাউন্ড থিকা ভালো-মন্দ যাচাই করতে চাওয়া; ক্ষমতা আছে বইলা, সেইটা ডিসাইড কইরা দেয়া না।

এইটা খালি পলিটিক্যাল ব্যাপারেই সত্যি না; প্রফেশনাল, পারসোনাল লাইফের ব্যাপারেও ট্রু। ভালো/খারাপ তো আছেই; কিন্তু তার উপরে, ঠিক/বেঠিকের জায়গাটারে প্রায়োরিটি দিতে পারলে ব্যাপারটা আখেরে (মানে, লং টার্মে) সবার জন্যই ‘ভালো’ হওয়ার কথা।

৬.
– পিপলস পলিটিক্স এবং খালেদা জিয়া ও জিয়াউর রহমানের রাজনীতি –

জিয়াউর রহমান’রে যদি পিপলস লিডার বলা হয়, তাইলে ভুল হবে না, বরং একটু বাড়ায়া বলা হবে আসলে। বাংলাদেশে যেইসব এজেন্সিগুলা পিপলরে ডমিনেন্ট করে, সেইসব এজেন্সিগুলারে উনি খুব ভালোভাবে মবিলাইজ করতে পারছিলেন। যার ফলে, এইরকমের পলিটিক্সের জায়গা থিকা বাংলাদেশের সমাজে এক ধরণের রিসোর্স মবিলাইজেশন শুরু হইছিল, যেইটা স্বাধীনতার পরে হইতে পারে নাই। অইটা ছিল জিয়াউর রহমানের রাজনীতির মেইন সিগনিফিকেন্স, যেইটা এখনো কম-বেশি কন্টিনিউ আছে (বা ছিল কয়দিন আগে পর্যন্ত)। কিন্তু নয়া বাকশালি রিজিমে আইসা আবার হুমকির মুখে পড়ছে। এই পলিটিক্যাল মবিলাইজেশন বা লাড়া-চাড়া পিপল এনগেইজমেন্টের জায়গা থিকাই শুরু হইছিল, কিন্তু এজেন্সিগুলার খপ্পর থিকা বাইর হইতে পারে নাই। যেইখানে পরে খালেদা জিয়ারেও এই জায়গাতে সাফার করতে হইছিল। কিন্তু এই জায়গাতে খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের চাইতে গ্রেট রাজনৈতিক নেতা ছিলেন।

মানে, আমি বলতেছি, সেন্টার হিসাবে এই জায়গাটারে ভাবেন যে, বাংলাদেশে পিপলস পলিটিক্স কে করছেন, কেমন করছেন? শেখ মুজিবুর রহমান যতটুক পিপলস লিডার ছিলেন এই পাবলিক এনগেইজমেন্টের জায়গা থিকাই ছিলেন, কোন এজেন্সির থ্রু’তে উনার কানেক্ট করতে হয় নাই পিপলের লগে। নিজের দলের নেতা-কর্মীরা তো ছিলই; কিন্তু যখনই উনি এই “নেতা-কর্মীদের” হাতে জিম্মি হয়া গেছেন, পিপলের কাছ থিকা দূরে সরতে থাকছেন, কানেক্ট করতে পারেন নাই আর। খালি এইটাই না, উনার মেজর পলিটিক্যাল ব্যর্থতা ছিল দুইটা – এক, উনি কোন পলিটিক্যাল সিস্টেম তৈরি করতে পারেন নাই পারসোনাল কারিশমার বাইরে; সেকেন্ড, উনি খালি “দলীয় নেতা-কর্মী” না, বরং সরকারি আমলা-কর্মচারীদের কাছে সারেন্ডার করছিলেন। (উনার বাকশাল গঠনের ভাষণে এর ইন্ডিকেশন পাইবেন।) কন্সপিরেসি থিওরি’র বাইরেও যেইখান থিকা মিলিটারি ক্যু’গুলা অর্গানাইজড হওয়ার পলিটিক্যাল সিচুয়েশন তৈরি হইছিল। আর আনটিল জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশে কোন রাজনীতি শুরুই হইতে পারে নাই। এইটারে পিপলস পলিটিক্স বলা না গেলেও, এইটা জনগণের রাজনীতির শুরুয়াৎ বইলাই আমাদেরকে মানতে পারতে হবে।

জিয়াউর রহমানরে নিয়া সবচে বড় যেই ভুল ধারণাটা চালু আছে, সেইটা হইতেছে, উনি ক্যান্টনমেন্ট থিকা পলিটিক্স করা শুরু করছিলেন। বরং উনিই একমাত্র লোক যিনি রাজনীতিরে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়া আসছিলেন। উনার এই পলিটিক্যাল সিগনিফিকেন্স বিএনপির লোকজন বলা তো দূরের কথা, বিশ্বাসই করে কম। যখন “দলীয় নেতা-কর্মী” ও সরকারি আমলা-কর্মচারী-এলিটগোষ্ঠীদের দখলে চইলা গেছিল বাংলাদেশের রাজনীতি, তখন মিলিটারি ক্যু’র মাধ্যমে পলিটিক্স ক্যান্টমেন্টে ঢুকে গেছিল। জিয়াউর রহমান সেইটারে সরায়া নিয়া আসছিলেন। আইনা “দলীয় নেতা-কর্মী” নামে যেই পিপলস এজেন্সিগুলা তৈরি হয়, তাদের হাতে তুইলা দেন নাই; তাদেরকে মবিলাইজ করছিলেন। এই যে, মিলিটারি’র হাত থিকা রাজনৈতিক ক্ষমতার জায়গাটা ধীরে ধীরে সইরা যাওয়াটা, এইটা মিলিটারির লোকজনই পছন্দ করার কথা না। যার ফলে এরশাদের ক্ষমতা দখলের ভিতর দিয়া মিলিটারি এবং সরকারি আমলা-কর্মচারী-এলিটগোষ্ঠীদের একটা আঁতাত তৈরি হয় আবার।

খালেদা জিয়া অই “দলীয় নেতা-কর্মী”, মিলিটারি এবং আমলাদের দল তৈরি করেন নাই, উনি ইনহেরিয়েট করছিলেন জিয়াউর রহমানের কাছ থিকা। কিন্তু যারা এই “পিপলস এজেন্সি” বইলা দাবি করে নিজেদেরকে, উনাদেরকে উনি বিশ্বাস করেন নাই, আর অই এজেন্সিগুলা উনারে গাইড করছে ঠিকই, কিন্তু উনারে কখনোই পুরাপুরি কন্ট্রোল করতে পারে নাই। খালেদা জিয়া যে সারেন্ডার করেন নাই, এর অনেক রাজনৈতিক প্রমাণ আছে। ১৯৮৬ সালের ইলেকশন এর একটা বড় উদাহারণ। এইটা উনার পারসোনাল গোয়ার্তুমি না, বরং পলিটিক্যাল ডিসিশান। এই জায়গা থিকা রিড করতে বলবো আমি।

একটা জিনিস মনে রাখবেন, একজন পলিটিক্যাল লিডারের পক্ষে পুরান সিস্টেম উলট-পালট কইরা ফেলা, নতুন একটা পলিটিক্যাল কালচার তৈরি করা কখনোই সম্ভব না, যদি না এইটা তাঁর চারপাশের লোকজনও এইটারে অউন না করে। এইটা খালি একজন পলিটিক্যাল লিডারের কাজ বইলা আমি মনে করি না, এইটা বরং জনগণের পলিটিক্যাল কনশাসরে তৈরি করার ঘটনা। বাংলাদেশে যেইটা সবসময় মিসিং ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যর্থতা হইতেছে, পিপলস এজেন্সি তৈরি না করতে পারার ব্যর্থতা। এইটারে শেখ মুজিবুর রহমান বা খালেদা জিয়া’র রাজনৈতিক ব্যর্থতা হিসাবে দেখলে ভুল হবে আসলে।

তো, আগের জায়গাতে যদি ফিরা আসি, এই যে পিপলস এজেন্সিগুলারে মবিলাইজ করা, জিয়াউর রহমানের এই পলিটিক্যাল সিগনিফেকেন্স নিয়া আলাপ কম বা নাই বইলা, উনার এই কন্ট্রিবিউশন বাতিল হয়া যায় নাই, বরং যত দিন যাবে জিয়াউর রহমানের এই জায়গাটা আরো স্পষ্ট হইতে থাকবে। ইতিহাস কোনদিন জোর কইরা লেখা যায় না। কিছুদিন লুকায়া রাখা যাবে, চুপ করায়া রাখা যাবে, কিন্তু মুইছা ফেলা যাবে না আসলে।

খালেদা জিয়াও এই হেইট্রেট শিকার হইছেন। ‘এইট পাশ মহিলা’ বইলা গালি-গালাজ উনার নিজের দলের লোকজনই উনারে গোপনে দিছেন, বা দেন। এরা হইতেছে অই ‘শিক্ষিত বাটপার’, অই বান্দর, যারা লেখা-পড়া দিয়া মানুশের বিদ্যা-বুদ্ধিরে মাপতে চায়। ইন্টেলেকচুয়ালিটি আর পলিটিক্যাল লিডারশিপ যে একই ঘটনা না, এই বাইনচোতদেরকে এইটা কে বুঝাবে! যা-ই হোক… তো, জিয়াউর রহমান যেমন এই পিপলস এজেন্সিগুলারে বিশ্বাস করেন নাই, খালেদা জিয়াও করেন নাই, এমনকি উনি অই জায়গাতে বেটার যে, অদের এগেনেস্টে গিয়াও পিপলের ফর-এ উনি ডিসিশান নিছেন। এইখানে উনি জিয়াউর রহমানের চাইতেও এক কদম আগানো বইলা আমি মনে করি।

এখনকার সময়ে, এই জায়গাগুলারে খেয়াল করতে পারাটা জরুরি। কারণ বাংলাদেশে আমরা এখন বাঁইচা আছি যে কোন ধরণের “পলিটিক্যাল আলাপ নিষেধ”-এর একটা টাইমে। আপনি সবকিছু করতে পারেন, সবকিছু নিয়া কথা বলতে পারেন, একসেপ্ট পলিটিক্স। আর এই কারণেই পিপলস পলিটিক্স নিয়া কথা বলাটা যে কোন সময়ের চাইতে দরকারি একটা জিনিস।

যদি বলতে না পারি, এটলিস্ট সরাসরি ভাবার যেন ট্রাই করি। তা নাইলে, আতারে-ফাতারে বাইড়াইয়া, মানে “বিটিং অ্যারাউন্ড দ্য বুশ” কইরা বড়জোর একটা কিংস পার্টিই বানাইবেন আপনেরা। এর বেশি কিছু হবে না, ওস্তাদ!

৭.
ভাষণ-বক্তিমা দেয়ার নাম পলিটিক্স করা না। পলিটিক্স হইতেছে এক্ট করার ঘটনা। যেই কারণে আমাদের যে কোন পাবলিক কাজকামই পলিটিক্যাল এক্ট একেকটা।

এই এক্ট করার জায়গা থিকাই জিয়াউর রহমান বেটার একজন পলিটিশিয়ান। উনি এক্ট করছেন, কাজ করছেন। সমাজের নানান ফোর্সগুলার লগে একটা পলিটিক্যাল রিলেশনে গেছেন। কিন্তু এরপরে, বিএনপি’র পলিটিক্যাল দল হিসাবে এফেক্টিভ না হইতে পারার বড় একটা কারণ হইতেছে এক্ট না করতে পারা। এখন মিছিল-মিটিং করতে পারাটাই পলিটিক্যাল এক্ট না, বরং সমাজে নানান ধরণের ফোর্স আছে, তাদেরকে পলিটিক্যাল জায়গা থিকা মবিলাইজ করতে পারাটা হইতেছে ঘটনা। এই কানেক্টিভিটির জায়গাটাতে বিএনপি অনেকদিন ধইরাই সাফার করতেছে। শাহবাগ, হেফাজত, ধর্ম, সেক্যুরালিজমসহ অনেক ইস্যুতেই একটা সাফসাফ পজিশন নিতে পারার ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখাইছে। এখনো সেই জায়গাটা উতরাইতে পারতেছে না।…

একটা কালচারাল ও আইডিওলজিক্যাল আইডেন্টিটি তৈরি করা না, বরং একটা পলিটিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা এবং সেইখানে সমাজের নানান ফোর্সরে ইন্ট্রিগ্রেট করার ঘটনাটা নাই না, অনেকবেশি আলগা হয়া আছে বইলা মনে হইছে আমার কাছে। মানে, সমাজের এক্টিভ ফোর্সগুলারে একটা পলিটিক্যাল এক্টের জায়গাটাতে নিয়া আসতে পারার ঘটনা’টা কম। (অবভিয়াসলি এইটাই একমাত্র ঘটনা না, জাস্ট বাইরে থিকা দেইখা আমার অবজারভেশনই এইটা।)

৮.
– মুক্তিযুদ্ধের শুরু –

মুক্তিযুদ্ধের সময় কতোজন পাকিস্তানি সৈন্য মারা গেছিল? এর কোন লিস্ট কি কোথাও আছে? একটা জায়গায় পাইলাম, জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের পরে বলছেন যে, ১৫-২০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য মারছে মুক্তিবাহিনি। কিন্তু পাকিস্তানের দিক থিকা কোন লিস্ট পাইলাম না। ৫ জনরে মিলিটারি এওয়ার্ড দেয়া হইছে পাকিস্তানে, এর বাইরে কোন লিস্ট নাই। বাংলাদেশের দিক থিকাও কিছু থাকার কথা না! যে, কয়জন কর্ণেল, মেজর, ক্যাপ্টেন মারা হইলো, থাকার কথা না কোথাও?

মানে, মার্চ মাস শেষ হওয়ার আগেই এই জায়গাটা মনেহয় মার্ক কইরা রাখাটা দরকার যে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা কেমন হইছিল।
যেই আলাপগুলা আছে, সেইখানে খুব স্পষ্টভাবেই দেখা যায়, জিয়াউর রহমান খালি “স্বাধীনতার ঘোষণা”-ই করেন নাই, বরং “যুদ্ধ” বইলা যেই জিনিস সেইটা শুরু হইছিল তার রিভোল্টের ভিতর দিয়া, চিটাগাংয়ে। উনি যুদ্ধ কইরা ক্যান্টমেন্ট থিকা বাইর হয়া গেছিলেন। তার আগে পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসারদেরকে বন্দি করতেছেন। যুদ্ধ শুরু কইরা দিয়া তারপরে যুদ্ধের ঘোষণা দিছেন। মানে, “স্বাধীনতার ঘোষণা” দিছেন, এইটুক আংশিক একটা ঘটনা। এর আগে যুদ্ধ যে শুরু কইরা দিলেন – এই সিগনিফিকেন্সের কথাটা হাইলাইট করা হয় না কোথাও।

হিস্ট্রির বনর্ণায় দেখবেন, ঢাকা ভার্সিটিতে কুচকাওয়াজ হইতেছে, মিছিল-মিটিং হইতেছে। এর পরে পাকিস্তানি মিলিটারি এটাক করতেছে। কিন্তু “যুদ্ধ”টা কই? সেইটা গিয়া শুরু হইতেছে চিটাগাংয়ে। তারও ১৫-২০ দিন পরে গিয়া পলিটিকাল লোকজন গর্ভমেন্ট ফর্ম করতেছে ইন্ডিয়া থিকা আইসা। মুক্তিবাহিনি অফিসিয়ালি ফর্মড হয় জুলাই মাসে।

মানে, অফিসিয়ালি পাকিস্তানি মিলিটারি তো “পূর্ব পাকিস্তানে ল এন্ড অর্ডার রক্ষা করার কাজ” করতেছিল! কিন্তু এইটারে খালি যুদ্ধ হিসাবে ডিক্লেয়ারই করেন নাই জিয়াউর রহমান, বরং অফিসিয়ালি যুদ্ধটা শুরুও করছিলেন উনি একটা মিলিটারি রিভোল্টের ভিতর দিয়া। যেইটা থিকা পলিটিকাল লিডারদের সইরা আসার কোন উপায় আর ছিল না।

দেশে অবশ্যই একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করতেছিল, কিন্তু সেইটা পলিটিকাল নেগোশিয়েশনের মধ্যেই ছিল। নেগোশিয়েশনটা যখন আর কাজ করে নাই, তখন মিলিটারি অপারেশন শুরু হইছে। কিন্তু সেইটা “যুদ্ধ”-তে কনভার্ট হইছে তখনই যখন মিলিটারির একজন অফিসার হিসাবে জিয়াউর রহমান রিভোল্ট করছেন।

এখন এই ঘটনাগুলারে অবশ্যই ফ্যাক্ট ধইরা টাইমলাইন আকারে সাজাইতে হবে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থিকা শুরু কইরা ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত। তাইলে দেখা যাবে অফিসিয়ালি “যুদ্ধ” কই কই হইতেছে, কিভাবে হইতেছে। অই রিভোল্টগুলার লিস্টিং করা গেলে মুক্তিযুদ্ধের শুরু হওয়ার ডাইনামিক্স অনেক দূর পর্যন্ত ক্লিয়ার হইতে পারবে বইলা আমার মনেহয়। যেইখানে দেখা যাবে, জিয়াউর রহমানের অফিসিয়াল ডিক্লারেশন এবং তার আগে তার মিলিটারি রিভোল্ট মোস্ট সিগনিফিকেন্ট ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর।

Leave a Reply